কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ১১। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: কাশীর এক অন্যতম উৎসব ‘লাট ভৈরবের বিবাহ’। মেতে উঠলাম তারই গল্পকথায়। 

ঘাটে ঘাটে

নাদিন গর্ডিমারের উপন্যাস ‘বার্জাস ডটার’-এর উপর একটা প্রেসেন্টেশন ছিল ধৃতি ম্যামের ক্লাসে সেদিন। নম্বর কত পেয়েছিলাম তা মনে নেই, তবে সঙ্গে রয়ে গিয়েছে তার অভিজ্ঞতা। অনেক কিছু শিখেছিলাম, বিশেষ করে মানুষের আত্মপরিচয়ের সন্ধান যে চিরন্তন, সে বিষয়ে। আমরা তো নিজেদের কাজে-কর্মে, ভাবে-ভালবাসায় নিজেদেরই সন্ধান করে ফিরি, লড়াই করি পরিচয়ের জন্য, অস্তিত্বের জন্য। একদিন সেই পরিচয়ের সন্ধানে আমি চলতে চলতে পৌঁছে গিয়েছিলাম কাশীতে। সেই সন্ধান আজও থামেনি। 

সেই প্রেসেন্টেশনের জন্য পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত থাকায় গত ক’দিন ধরে খুবই চাপ গেছে। সেদিন ক্লাস থেকে হোস্টেলে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি বিকেলখানি সোনালী রোদ্দুর বিছিয়ে ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরছে। আমার হোস্টেল রুমের ঠিক পেছনের বটগাছটা দিনভর সেই আলো শুষে নিয়ে এবার ধীরে ধীরে নিজের শয্যা প্রস্তুত করছে। কিন্তু আমার মনে সেদিন কোথাও একটা অজানা অস্বস্তি মিশে ছিল। কোন কিছুই যেন সেই সুন্দর অথচ মন খারাপের বিকেলকে আমার বারান্দায় বসে উপভোগ করতে দিচ্ছিল না। সামনে পরীক্ষা বলে কি? হয়তো। সিলেবাসের নিচে তখনও আমি চাপা পড়ে আলো হাতরে বেড়াচ্ছি সেটা সত্যি; তবে সেদিন সেই আলো খোঁজার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। বরং ঘাট আমাকে ডেকে পাঠাচ্ছিল। ততদিনে আমি মজে গিয়েছি বেনারসের ‘মৌজ-মস্তি’তে। বেনারসের সেই মস্তি উপভোগের আদর্শ এক স্থান হল ঘাট। বুঝে গিয়েছি যে মন ভাল থাকলে তার উদ্‌যাপনে মন চলে যায় ঘাটে ঘাটে। কেবল মনের উৎসবই নয়, যখন অন্তরের গভীরে বিভ্রান্তি ও হতাশা এসে সমস্ত আলো এক ঝটকায় নিভিয়ে দিয়ে চলে যায়, ঘাট বসে তার কোলাহলের মাঝেও গঙ্গার স্রোতের শব্দ শুনতে শুনতে চোখের কোণে ফুটে ওঠে জলে ভাসিয়ে দেওয়া প্রদীপের প্রশান্তি। ঘাটে যাওয়ার তাই সময় অসময় নেই। মনের মাঝে ঘাটের ডাক এলে তাকে সামলানো মুশকিল। 

এ ডাক আমি কেবল একাই শুনেছি তা নয়। কয়েকশ’ বছর আগেও জেমস প্রিন্সেপ বেনারসে এসে ঘাটের প্রেমে পরে যান। তাঁর লেখা ঘাটের অপূর্ব বর্ণনা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছিনা —

‘জানুয়ারি মাসের কোন এক বিকেলের অমলিন আকাশের কোল থেকে ঠিকরে আসা পড়ন্ত রোদ্দুরে নদীর ওপারের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখা যায় তার তুলনা বিরল — এত প্রাণবন্ত, এত উল্লসিত। বহু মানুষের কলগুঞ্জন ছাপিয়ে দূর থেকে গঙ্গার হাওয়ায় ভেসে আসে কতশত মন্দিরের সঙ্গীত আর ঘন্টাধ্বনির মায়াময় সুর, মোহিত করে তোলে শ্রবণেন্দ্রিয়কে। তার যথাযথ সংগত করতে মাঝে মাঝেই বড় বড় ইমারতের ঘুলঘুলির থেকে রংধনুর মত জেগে উঠে নীল আকাশে ছড়িয়ে পরে পায়রার সারি, তারপর উঁচু মিনারের চারিপাশে ঘুরতে ঘুরতে তারা নেমে আসে, তাদের ডানার ঝাপটানির শব্দ মিশে যায় বৈঠার শব্দে, জলের শব্দে, হাওয়ার শব্দে। চোখে পরে নানা বর্ণের, নানা ধরণের মানুষ — নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে হাতে পিতলের ঘটি নিয়ে নাইতে নেমেছে গঙ্গার বুকে। কিংবা কাছেই কোন রাস্তায় ভিড়ের মাঝে এক গর্বিত ষাঁড় যেন নাগরিক অধিকারে বলবান হয়ে দৃপ্ত ভঙ্গীতে ফুলের মালা চিবোতে চিবোতে এগিয়ে চলে, কাউকে তিলমাত্র তোয়াক্কা না করে। 

তারপর কোন এক ফাঁকে চুপিসারে নেমে আসে রাত, বদলে যায় দৃশ্য। জলের ধারে ধারে জেগে ওঠে প্রদীপের আলো, শ্মশানের আগুন, সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী, চাঁদের আলোয় ধোয়া পাথরের ইমারত সব। কত রকম গন্ধ-বর্ণ-রূপ মিলে মিশে ঘাট যেন প্রাণ পেয়ে নেচে ওঠে — এ সবের সঠিক প্রতিচ্ছবি আঁকা কোন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব নয়। তিনি কেবল একটা মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরি করে দিতে পারেন, তাকে চিন্ময়ী করে তোলা সম্ভব কেবল দর্শকের মনের মাধুরী মিশিয়ে। 

মনে রাখা দরকার যে কাশীর ঘাটে ঘাটেই কাটে প্রত্যেকের ব্যস্ততম সময়, হৃষ্টতম সময়। অনেক রূপ সেইসব কাশীবাসীর ঘাটপর্বের — গঙ্গাস্নান করা ও তারপর কাপড় পরা, প্রার্থনা করা, জ্ঞান দেওয়া, শুয়ে বসে আরাম করা, গুল-গল্প ও কূটকচাল করা, বা কেবল ঘুমানো। নোংরা, পূতিগন্ধময় দম বন্ধ করা রাস্তা ছেড়ে এসে ঘাটে বসে গঙ্গার খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়া যেন তাদের রাজকীয় বিলাসীতা। এই ঘাটেই চলতে থাকে অলস মনের নিরন্তর সুখসময় যাপন, ভক্তিমনষ্কদের কর্মযোগ, আর নানাবিধ ব্যবসায়িক আদান-প্রদান — এটিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের কোন দেশের কোন শহরেই কোন একটিমাত্র রাস্তা বা জায়গা জনসাধারণকে বেনারসের মত অন্তরঙ্গ আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানায়না। বেনারসের মানুষেরা সার্থকভাবেই গঙ্গার ধারে ঘাটের অন্তহীন সৌন্দর্য, বিশালত্বকে ঘিরে গর্ব অনুভব করে।’ 

পাশের রুমে সুদীপ থাকে। জিজ্ঞেস করলাম যাবে কী না ঘাটে ঘুরতে। নির্দ্বিধায় না করে দিল। কিছু একটা পড়তে ব্যস্ত ছিল। পড়াশোনার ব্যাপারে ও খুব সিরিয়াস। অগত্যা আমি চললাম, একাই। অসি ঘাট। এই ঘাটকে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের আস্তানাই বলা চলে একরকম। যে কোন সাধারণ দিন থেকে শুরু করে কোন উৎসবের দিন, এই ঘাট কখনোই খালি থাকেনা। বেনারসের দক্ষিণের এই ঘাট ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

হিন্দুরা অনেকেই বেনারসে আসেন ‘পঞ্চতীর্থ যাত্রা’ সম্পন্ন করতে। ‘কাশীখণ্ড’ বলছে, ‘প্রথম তীর্থ অসি-সঙ্গম। ইহাও সর্বতীর্থগণের মধ্যে অতি শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয় সর্বতীর্থসেবিত দশাশ্বমেধ। তৃতীয় আদিকেশবসন্নিধানে পাদোদকতীর্থ। চতুর্থ পঞ্চনদতীর্থ, এই তীর্থে স্নানমাত্রেই যাবতীয় পাপ বিনষ্ট হয়। এই চার তীর্থ হতে সর্বশ্রেষ্ঠ মন ও শরীরের শুদ্ধিপ্রদ পঞ্চমতীর্থ মনিকর্ণিকা।… পঞ্চতীর্থে স্নান করে মানব আর পাঞ্চভৌতিক-দেহ ধারণ করে না’ অর্থাৎ তাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়না। বোঝাই যাচ্ছে যে এই ‘পঞ্চতীর্থ’ হল গঙ্গাসংলগ্ন পাঁচটি জলতীর্থ বিশেষ। এই তালিকায় শুরুতেই রয়েছে অসি ঘাট। 

অসি ঘাটের গুরুত্ব এত বেশি হওয়ার কারণ কাছেই অবস্থিত অসি ও গঙ্গার সঙ্গম। কয়েকশ’ বছর আগে এই সঙ্গমস্থল হয়তো বেশ জাঁকালো ব্যাপার ছিল। বহু মানুষ দূর দূর থেকে আসতেন অসি সঙ্গমে। ‘বারাণসী’ নামের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে অসি নদীর অস্তিত্ব — উত্তরে বরণা বা বরুণা নদী এবং দক্ষিণে অসি নদীর মাঝের এই শহর হল বারাণসী। বেনারসের অস্তিত্বে অসি নদীর যখন এত গুরুত্ব, আপনি হয়তো আশা করছেন এই নদীর চেহারাও হবে দেখার মত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আপনার সেই আশার গুড়ে বালি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমার নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা। তখন সবে সবে বেনারসে এসেছি। মঞ্চনাটকের সূত্রে (এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত যথাসময়ে বলব — সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা আমার জীবনের) সেই সময় আমার ওঠা-বসা বেশিরভাগই ছিল আমার সিনিয়র দাদা-দিদিদের সাথে। তাদের সাথেই আমি সেবার প্রথম অসি ঘাটে যাচ্ছিলাম, তাও পায়ে হেঁটে। লঙ্কা থেকে সোজা উত্তরের দিকে এগিয়ে ধূলোর মেঘ ভেদ করে, ট্রাফিক জ্যামের জঙ্গল পেরিয়ে চলি গল্প করতে করতে। তারপর রবিদাস গেটকে ডান দিকে ছেড়ে, দুই পাশে পেহেলোয়ান লস্যির দোকানগুলোর সামনে মাছির মত মানুষের ভিড় পেরিয়ে এগিয়ে অসি রোডে এসে উঠতেই নাকে ভেসে এল কাঁচা মাছের গন্ধ। আমরা তখন অসির মাছ বাজার পেরোচ্ছি। দু’ একজন অবাঙ্গালি সঙ্গীরা ‘মচ্ছি খবো’ বলে আমাদের ঠাট্টা করার চেষ্টা করল। ‘মচ্ছি’! কেমন মাছি মাছি শুনতে। আমি ছাড়া বাঙালি সঙ্গীদের মধ্যে সেদিন ছিল আমার কিছু সিনিয়র। আমার একটু বিরক্ত লাগলেও দেখলাম তারা হেসেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিল। এই অভিজ্ঞতার আঁশটে গন্ধ হজম করে কিছুদূর এগিয়ে যেতে না যেতেই নাসারন্ধ্র কেঁপে উঠল তীব্র দুর্গন্ধে — ঝাঁঝালো সেই গন্ধে এবার আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। বেনারসের গন্ধে অনভ্যস্ত আমার নাক রুমালে চেপে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম এই বিশেষ গন্ধের উৎস কোথায়। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে পুষ্পেন্দু দা’ এসে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আরে, রুমাল সরা, পবিত্র নদীর গন্ধ এটা।’ আমি তো অবাক — নদী কোথায়? এ তো বড়সড় এক নালা বৈ নয়! তার জল কালিমাময়, দুর্গন্ধ যুক্ত। পুষ্পেন্দু দা’র সাথে কথা বলতে বলতেই জানলাম যে এই হল বারাণসীর অসি নদী। বেনারসেই এর উৎপত্তি হয়ে শহরের দক্ষিণপ্রান্ত ঘুরে ঘুরে শেষে গঙ্গায় গিয়ে মিশেছে অসি ঘাটের কাছে। কয়েক দশক আগেও এই নদীর সঙ্গম ছিল অসি ঘাটেই — আশির দশকে এই নদীমুখ কৃত্রিমভাবে নাকি ঠেলে দেওয়া হয় আরও কয়েকশ’ মিটার দক্ষিণে। শহরের নানা প্রান্ত থেকে বর্জ্য এনে ফেলা হয় এই ‘অসি নালায়’। মানুষের উন্নতির কাছে হার মানা এই রুগ্ন, ক্লিষ্ট, দীর্ণ নদী সেই পূতিগন্ধময় নোংরা বর্জ্য বয়ে নিয়ে এসে ফেলে গঙ্গায়। 

(ক্রমশ)

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply