কাগজের নৌকো। পর্ব ২৭। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
দিনকয়েক আগে গ্রামদেশে গেছিল অবিনাশ, নিতান্তই পাড়া-গাঁ, এলোঝেলো বাতাস, ধুলাখেলার পথ, পুকুর, দিঘি, বাঁশঝোপের মাথায় ম্লানমুখ রৌদ্র, কাঁচা ঘরবাড়ি, যেমনটি ভেবেছিল, ঠিক তেমনই চারপাশ! এসব দেখে আজকাল অবিনাশের মনে ভারি আমোদ হয়। কার্তিকের আশমানি-দুপুরে বড়ো রাস্তার ধারে একটি ভাতের হোটেলে বসে রয়েছে, কাঠের বেঞ্চি আর টলোমলো টেবিলে দোকানি শালপাতায় খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেলেন, আগুনে ভাত, কপির ডাটা-মুলো-বেগুন দিয়ে কী একটা পাঁচমেশালি ঘ্যাঁট, পেঁপের তরকারি, মুসুর ডাল–মুখে ক’গরাস তোলার পর খেয়াল করল সামনে এক দম্পতি এসে বসেছেন, যুবতির বয়স বেশি নয়, তেইশ চব্বিশ হবে, ঝকমকে নীল শাড়ি পরনে, সিঁথিজোড়া সিঁদুর, কানে ঝুটো সোনার গয়না, ভ্রু-দুটির নিচে লাল টিপ, বাম চোখটি সামান্য ট্যারা, একে অবিনাশের দেশে বলে লক্ষ্মীট্যারা! স্বামী যুবকটিও বেশ আলাভোলা, সরল মুখে তেমন দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে নাই।বাচ্চাটি কোলের নাহলেও সদ্য হাঁটতে শিখেছে, একটি প্লাস্টিকের ভেঁপু দুহাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখছে, তবে শিশুর খেয়াল তো, মন উঠে গেলে এখনই হয়তো পথে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।আলগোছে কান পেতে শুনি, স্বামী নিচু স্বরে স্ত্রী’কে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কী খাবা?’
গলা নামিয়ে যুবতি কী যেন বললেন, ঠাহর হল না ভালো। দোকানি সামনে এসে দাঁড়ালে যুবক শুধোলেন, ‘সবজি-ভাত কত?’
–চল্লিশ!
–আর মাচ-ভাত?
–ষাট!
দু-এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে যুবক বললেন, ‘একটা সবজি-ভাত আর একটা মাচ-ভাত দ্যান। মাচের পিচ গাদা দ্যাবেন।’
ডাল-ভাতে কাঁচালঙ্কা ডলে মুখে তুলে অবিনাশ শুনল, যুবতি অনুযোগের স্বরে বলছেন, ‘মাচ বললা ক্যানো!এরা দুইটা তরকারি দিচে, ওতেই তো ম্যালা, সুদু সুদু পইসা খরচ!’
–খাও তো! বেড়াতে এসে অত পইসার হিসাব ধরলি চলে! খাও! মাচ খাও!
ঠোঁট চিপে একপলক ধানি বাতাসের মতো হাসলেন যুবতি, ‘তুমিও খাবা! এক পিচে দুজনার ঠিক হয়ি যাবে!’
বেলা পড়ে এসেছে, পিচ রাস্তায় হলহল শব্দে ধুলা উড়িয়ে বাস যাচ্ছে আসছে, ভিড় তেমন নাই, দোকানপাটেও ভাতঘুমের ঝিমুনি, যুবতির মুখে মাছের কথা শুনে অবিনাশেরও সাধ হল মাছ খাবে, তা দোকানিকে অর্ডার দিয়ে আরও একমুঠি ভাত নিল, এসব দেশে ভাতের অভাব নাই, পুকুরে মাছ, মাঠে হেমন্তের ঝুমঝুম অলঙ্কারের মতো ধান, গোয়ালে গরু, নিকানো যত্নের উঠান, এমন শ্রীমণ্ডিত গ্রাম যে মনে হয় স্বয়ং অন্নপূর্ণা এখানে নিজের অনন্ত রূপ বিছিয়ে দিয়েছেন।
ডানদিকের পথটি এই বৈকুণ্ঠলোক ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে অন্য গ্রামে, অবিনাশ শুনেছে, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর কী তারও আগে দেরেগ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ দুর্বিপাকে পড়ে ভিটামাটি-ধানি জমির মায়া ত্যাগ করে নিজের পরিবার, দশ বছরের বালক পুত্র আর চার বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে ওই গ্রামে বন্ধুর বাড়ি এসে উঠেছিলেন, কলহ ও ঈর্ষায় পূর্ণ অনিত্য সংসারে সেদিন তাঁদের কী সম্বল ছিল অবিনাশ জানে না, তবে অনুমান করতে পারে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের কাছে ইষ্টদেবতা মর্যাদা-পুরষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র ছাড়া আর কেউই ছিলেন না! আর ছিল আন্তরিক বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে তিনি চাল বাড়ন্ত হলে স্ত্রীকে একদিন বলেছিলেন, ‘ভয় কী, যদি রঘুবীর উপবাসী থাকেন, তাহলে তাঁর সঙ্গে আমরাও উপবাসী থাকব!’
মুখে অন্ন তুলে এসব সাতপাঁচ কথাই ভাবছে অবিনাশ। মানুষ ভবনদীর পানসি সামান্য টলোমলো হলেই বিচলিত হয়ে পড়ে, আর সেই ব্রাহ্মণ দুর্দিনে কেমন শক্ত হাতে হাল ধরে বসে ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও তেমনই ছিলেন, হেমন্তের রিণিঠিণি রৌদ্রে চোখ রেখে আনমনে ভাবি, তাঁদের দুটিকে নিশ্চয় ভারি মানিয়েছিল! ব্রাহ্মণী কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে একবার এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেছিলেন, তাঁর বড়ো ছেলে সেদিন পূজার জন্য যজমান বাড়ি গেছেন, নিশুত মধ্যরাত্রি, চারপাশ জ্যোৎস্নার শিথিল কবরী-মায়ায় আচ্ছন্ন, তীক্ষ্ণ গলায় প্রহর জানান দিয়ে উঠল শিবাদল, পুত্র ফিরছেন না দেখে আশঙ্কায় জননী দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, দৃষ্টি আর মন দুটিই দূর পথে পড়ে রয়েছে, হঠাৎ দেখলেন কুসুম সুবাসের মতো এক সালঙ্কারা রমণী ছমছম জোসনায় আশ্বিনের দিগন্তপ্রসারী প্রান্তর পার হয়ে গৃহপানে আসছেন, গ্রামদেশে মধ্যরাত্রে এ খুব স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়, তবুও কী এক অজানা কারণে ব্রাহ্মণী সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোতা থেকে আসচ গো মা?’
রমণী কুন্দফুলের মতো মৃদু হেসে বললেন, ‘ভুরসুবো গ্রাম থেকে আসছি গো!’
দু-এক মুহূর্ত না যেতেই উৎকণ্ঠিতা জননী প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলেকে দেখেচ নাকি মা? এত রাত তো করে না, দেকেচ তাকে তুমি?’
সহজ গলায় অপরিচিতা রমণী বললেন, ‘হ্যাঁ, সে আসছে, ভয় পেও না, যে বাড়িতে সে পুজো করতে গেছিল আমিও ওখান থেকেই আসছি। এখনই তোমার ছেলে ফিরবে।’
ছেলে ফেরার কথা শুনে ব্রাহ্মণী এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরে পেলেন, ভালো করে দেখলেন রমণীকে, এ-দেশের মেয়ে তো নয়, অসামান্যা রমণীর পরনে জ্যোৎস্নার মতো বস্ত্র, সর্বাঙ্গ অলঙ্কারে সাজানো, কানে পারিজাত কুসুমের মতো সুগন্ধী কুণ্ডল, ব্রাহ্মণী সামান্য বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘মা, এত রাতে গয়না-গাঁটি পরে কোতায় যাচ্চ গো? কাদের বাড়ি যাবে তুমি?’
রমণী মৃদুহাস্যে রহস্য করে বললেন, ‘আমাকে এখন অনেকদূর যেতে হবে!’
–এত রাত, গাঁ-গেরামে পথে ভয় কম নাই, আজ রাতে আমাদের বাড়ি থেকে কাল সকালে যেও মা! রাতটুকু থেকে যাও!
রমণী যেন বীণাকণ্ঠী, তিনি নির্ভার গলায় বললেন, ‘আজ যেতে হবে মা! পরে একসময় তোমাদের বাড়ি আসব!’
কথাক’টি শেষ করে সালঙ্কারার যুবতি আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করেননি, রাত্রি-জ্যোৎস্নায় ধানের মড়াইয়ের পাশ দিয়ে দ্রুত পায়ে কুয়াশাচ্ছন্ন পথে হারিয়ে গেছিলেন।
ভাতের দাম মিটিয়ে ধুলা বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে অবিনাশ ভাবল, কে ছিলেন ওই রমণী, তা তো জানি না, চোখেও কখনও দেখি নাই, আমি শুধু লোকমুখে গল্প শুনেছি। অবশ্য গল্পই বা কম কী! আখ্যান থেকেই তো বাস্তব ঘটনার জন্ম হয়, চিরকাল এমনই হয়ে চলেছে।
এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে একটি শীর্ণকায়া নদীর কাছে চলে এল অবিনাশ, জল প্রায় নাই, তবে চারপাশ ভারি মধুর, একটি প্রাচীন বেলগাছে কতগুলি শালিখ কিচিরমিচির ঝগড়া করছে, দুপাশে নিভু আলোয় ধানের সুবাস, ধুতরা ফুলে জায়গাটি ঝিলমিল হয়ে রয়েছে, গ্রামের লোক নদীটিকে আমোদর বলে ডাকে, পারে বসে তার মনে পড়ল, এর কয়েকদিন পরেই ওই ব্রাহ্মণীর গর্ভে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, খুব দুষ্টু ছিল শিশুটি, তবে গ্রামের মানুষের আদরের ধন ছিল সে, ওইসব আখ্যানে মন আলোফুলের মতো ফুটে ওঠে। অল্প দূরে সেই ভুরসুবো গ্রামে মানিকচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন, লোকে বলত ‘মানিক রাজা’, তাঁর ছায়াচ্ছন্ন আমবাগানে ওই বালক সঙ্গীসাথী নিয়ে খেলা করত, খুব প্রিয় ছিল আম-বাগানটি, ভিক্ষার সাপি অপরাহ্নের কোলে ঢেলে দেওয়া দ্বিপ্রহরে বসে সেই অপরূপ খেলাধুলার কথাই ভাবছে অবিনাশ। ও আমার ব্রজের কানু, ব্রজের কানু বাজিয়ে বেণু, চরায় ধেনু পথে পথে…ভাবছে, এই আমার ব্রজ, আমোদরের ধুলাই ব্রজধুলা, ওই অপার্থিব খেলা কখনও দেখিনি আমি, জন্মই তো হয়নি, নাকি হয়েছিল, কী জানি, মনে তো পড়ে না! তবে সেই বালকই আমার জন্মান্তরের খেলুড়ে, তার সঙ্গেই যত পীরিত, সে ছাড়া এই মায়াচ্ছন্ন জগতে আপনার জন বলতে আর কেউ নেই।
(ক্রমশ)