কাগজের নৌকো। পর্ব ২৬। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
কড়ি বরগার ওপর উইপোকাদের নক্সা। আলকাতরা মাখানো হয়েছিল সেই বুড়ো কর্তার আমলে, তারপর আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এসেছে কালো রঙ। দুটো তির ছাদ থেকে খসে পড়েছে গত বর্ষায়। পুরনো রাজমিস্ত্রি ফকির মোল্লা দেখে বলেছিল,
—ছোটকত্তা ইবার জলছাতটা করন লাগবি যি! নাইলে ধসি পড়বি ছাত।
সে জলছাদ আজও করা হয়নি। কবেকার জমিদারবাড়ি।ভাঙা খড়খড়ির জানলা খুললে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ পদ্মবিল। শনশন বাতাসে উড়ে বেড়ায় গাঙশালিখের দল। আশ্বিনে বিল আলো করে ফোটে গোলাপি পাপড়ির পদ্ম। দু টাকা তিনটাকা দাম ওঠে তখন একেকটা ফুলের। ছেলেপিলেরা চুবড়ি ভরে তুলে গঞ্জের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। দুটো পয়সা আসে ঘরে। সন্ধিপুজোয় একশো আট সদ্য ফোটা পদ্ম চাই। সেই রামচন্দ্র তো আর নেই যে কম পড়লে নিজের পদ্মআঁখি নিবেদনের সংকল্প করবেন !
বিলের একধারে ছোটকর্তার ঘন তালবন। ভাদ্র মাসে পাকা তালের গন্ধে ম ম করে চারপাশ। যে যেমন পারে কুড়িয়ে নিয়ে যায়, হাটে বিক্রি করে। কিছুই বলে না ছোটকর্তা। যাক! নিয়ে যাক, দুটো তাল বই তো নয়। কে খাবে এবাড়িতে তাল! বাড়ির গিরিধারীর জন্মাষ্টমীর পুজোয় এককালে তালক্ষীর তালের বড়া ভাজা হতো বড় বড় পিতলের কড়ায়। তালমারি ঘষে ঘষে ঘন হলুদ কাথ বের করত দুপুরবেলা বাড়ির বউ ঝিরা। প্রহরে প্রহরে নামসংকীর্তন, সদ্যজাত গোপালের নাড়ি কাটা, নামকরণ কত সব আচার। নমো নমো করে এখন পুজো করে যায় ভটচায্যি মশাই।
তালবন পার হয়ে দত্তদের সুপারিবাগান। শুকনো বাকল রোদ্দুরে ঝনঝন করে বেজে যায় নিজের মনে। তারও পর পঞ্চায়েতের পাকা রাস্তা চলে গেছে সেই ময়ূরাক্ষীর ঘাট অবধি। দুপাশে বাগদি কাহার নিকিরিদের সার সার মেটে ঘর। ভর দুপুরে ধান শুকোতে দেয় রাস্তায় বউদের দল। পাশের মাঠে আখ ফলেছে খুব এবার। আলুর দাম নেই মোটে, তিন চারটাকা কিলো। অল্প সর্ষে বুনেছে কেউ। বেশিরভাগ জমিই ছোটকর্তাদের। কিছু বর্গা হয়েছে কিছু হয়নি। সব বাপ-দাদার আমলের ভাগচাষি। ফসল বিক্রি করে টাকার ভাগ দিয়ে আসে তারা কর্তাকে। যে যেমন পারে দেয়, হিসেবপত্র কিছুই রাখে না ছোটকর্তা।
একেকদিন সন্ধেয় পঞ্চা বাগদি আসে। দুঃখী গলায় বলে
—কত্তা, ই করলি চলবি ক্যামনে! হেসিব ল্যান না, দেকতি যান না, বুড়ো কত্তা বলতিন মুরে জমিন হলি নক্কী।
কিছুই উত্তর করেন না ছোটকর্তা। মৃদু হাসেন মাঝে মাঝে। জোয়ান শরীর, এই তো খাটার বয়স, জমি বাড়ি দলিল শরিকি মামলা সব বুঝে নেওয়ার সময়। কথায় বলে জমি বাপের নয়, জমি হল দাপের। তা সেসব কিছুই করেন না তিনি। ভাসানো দুটো চোখে কীসের যেন ছায়া। সারাদিন বাড়িতেই বসা। মদ না, মেয়েছেলে না, আফিং তাস কিচ্ছু না। আড়ালে গাঁয়ের লোকে বলে, কুঁড়ের হদ্দ! কী বাপ, ঠার্কুরদা ছিল, লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ সব আর তাদের বংশে কী ছেলেই না হল!
কীসব পড়েন সারাদিন। দেরাজ আলমারি হাতড়ে উইধরা তামাদি দলিল দস্তাবেজ লাল চামড়া বাঁধানো কবেকার হিসাবের খাতা উল্টেপাল্টে দ্যাখেন। অস্পষ্ট অক্ষর, ঝাপসা সময়ের গায়ে হাত বুলোন নিজের মনেই।
খুব বেশি বললে পঞ্চাকে হেসে বলেন
—কী হবে বল দিনি! দুটো পয়সা কম দিলেই বা কী! খাওয়া পরা তো জুটে যাচ্ছে
—কী ছ্যালো বুড়োকত্তার আমলি, আর কী হল…
—দ্যাখ পঞ্চা, যা ছিল বুঝলি, সবই আছে।
—কুন কথা কন দিনি কত্তা, কত আলা কত জাঁক পুজো পাব্বন
—আছে রে আছে। বুড়োকত্তাও আছে তোর। একটু চোখ খুললেই দেখতে পাবি। এখনও আলো সানাই বাজে। নহবত বসে। নাচঘরে হীরাবাঈয়ের ঠুমরি ঘঙুর…
গিরিধারীর সাতপদে ভোগ…সব আছে! সব আছে!
—সি বুড়োকত্তা যি ঘুরে বেড়ায়, মুই জানি। দেকিচি তো কত রেতে!
হা হা করে হেসে উঠে ছোটকর্তা বলেন
—সে তো তুই ভূত দেখিস! হাঁড়িয়া টেনে চুর হয়ে থাকিস তো সন্ধে হলেই! আমি বলছি, সব ঘটে চলেছে রে এখনই, এই রাতেই! কিছুই হারায় না!
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে পঞ্চা। মনে মনে ভাবে, নোকে নায্যস বলি, মাতা বিগড়েছে ছোটকত্তার! সব আচে! ক্যারাসিন কিনার ট্যাকা নেই বলি ঘুটঘুটি পারা হয়ি থাকি ঘর দালান, বলে কিনা সব আচে!
গাঢ় হয় রাত। ফুটফুটে ভাদ্রের জোছনায় বান ডেকেছে আজ। থমথম করছে কবেকার ঘর দালান। অস্পষ্ট সব ছায়া শুয়ে আছে এখানে ওখানে। বারবাড়ির উঠোনে মাধবীলতায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। টুপটুপ করে শিউলি ফোটার দিন ঘনিয়ে এলো। এমন সব মধুরাতেই তারা জেগে ওঠে ঘুম ভেঙে। এতবড় বাড়িতে কেউ কোথ্থাও নেই। হুট হুট শব্দে গম্ভীর গলায় ডেকে ওঠে এক অনেকদিনের লক্ষ্মীপ্যাঁচা। এলোঝেলো বাতাস ভেজা ঠোঁট রাখে ছাদের ভাঙা আলসের ওপর। পাশেই একটা পোড়ো ঘর, কোনকালে গলায় দড়ি দিয়েছিল নাকি হৈমবতী।ভর যৌবন শরীরে, ছোটকর্তার মা। কী যেন কলঙ্ক রটেছিল গাঁ দেশে।
ছোটকর্তা একাহারী, রাতে খাওয়ার পাট নেই। লম্ফটা নিভিয়ে শোওয়ার ঘরের জানলাদুটো খুলে দিলেন হাট করে। খালি গা, শুধু পরনে একটা সাদা ধুতি। আকাশে দু এক টুকরো সাদা মেঘের সারি। মিহি বাতাসের দোলায় উড়ে বেড়াচ্ছে। পদ্মবিলের জলে হাজার টুকরো চাঁদ। ঝিমঝিম জ্যোৎস্না। টলমল করছে কচি পদ্মডাঁটি।ওই দূরে অস্পষ্ট দিকচক্রবাল রেখার কাছে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে জলরেখা আর আকাশ। তাল সুপুরি গাছের পাতায় খেলা করে বেড়াচ্ছে বাতাস। নশ্বর জগতের মায়া মুছে যায় মানুষের মন থেকে এমন রাতে। সব আছে। এখানেই আছে সবাই।
তানপুরোটা কোলে তুলে মেঝের ওপর বসেন আচার্য বাড়ির শেষপুরুষ, হেমেন্দ্রনারায়ণ আচার্য, আমাদের ছোটকর্তা। পরম যত্নে সুর বাঁধেন একমনে তারের ওপর। দামাল শিশুর মতো উড়ে বেড়ায় সেই সুর পাখা মেলে। জোছনায় ভেসে যায়। লেগে থাকে দরদালানে। কোন অপরূপ জগতের দুয়ার খুলে যায়। আবছা শোনা যায় এক গন্ধর্বপুরুষের পায়ের শব্দ। দূর উর্দ্ধলোক থেকে তিনি নেমে এসেছেন যেন আজ সুরের মায়ায়।
আজকের এই রাত্রি হেমেন্দ্রনারায়ণ এই ভাঙা আচার্যবাড়ি জমি জিরেত সবই একদিন মুছে যাবে আয়ুর পাতা থেকে। শুধু ওই সুরটুকু লেগে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভকুসুমে। সেখানে মন রাখলেই দেখা যাবে কালস্রোত। তারই হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে অতীত। কিছুই হারায় না।
এক আকাশ সুরের নীচে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়তে থাকে কর্ণফুলি গ্রাম। জেগে থাকেন শুধু এক একাকী পুরুষ।
প্রসন্না কালের দেবীর আশীর্বাদ ঝরে পড়ে শারদ জ্যোৎস্নায়।
ইদানিং হেমেন্দ্রকুমারের সব গেছে, ভেক ধরেছেন নামে, সার্কাসের দল ফেঁদে বসেছেন। নতুন নাম বিশ্বনাথ বড়াল।
গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের তাঁবু পড়েছে চড়কতলার মাঠে। রিক্সা নিয়ে দিনভর ফিনফিনে গোলাপি কাগজ বিলি করে ঘুরছে একটা সিড়িঙ্গেপানা লোক। হাতে চোঙা মাইক ফুঁকে বলে চলেছে, আসুন আসুন সপরিবারে আসুন! আফ্রিকার সিংহ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রুশ দেশের মেয়েদের ট্র্যাপিজের খেলা দেখুন! প্রত্যহ তিনটে শো! আসুন! আসুন! কচি কাঁচার দল রিক্সা ধাওয়া করে কুড়িয়ে নিচ্ছে গোলাপি কাগজ।
আসল কথা হল রাত সাতটার শোয়ে গণপতি জুনিয়রের যাদু! দিনে একবার মাত্র। গাঁ ঘরে শীতকালে সাতটা মানে অনেক রাত। অঘ্রাণের শেষে ন্যাড়া মাঠ। অস্পষ্ট জলের দাগের মতো কুয়াশা জমে থাকে থরথরে। তার মাঝেই বেজে ওঠে সার্কাসের বাজনা। ধান বিক্রির কাঁচা পয়সা লোকের হাতে। মেলাখেলা সার্কাস যাত্রা আমোদ আহ্লাদের মোচ্ছব। হিম হিম বাতাস। কাঠের চেয়ারে সাতটাকা ভাড়া, সামনের সারি। তার পিছনে চটের বস্তা পাতা আসন মাঠের ধুলোর ওপর, দু টাকা তিন টাকা চার টাকা। লাল সবুজ নীল টি কিট।
তিরিশ বছর এই তাঁবু নিয়ে হাটে গঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বনাথ বড়াল। একমাথা টাক। সাদা ধপধপে ধুতি পাঞ্জাবির ওপর উলের মোটা জহর কোট। লালচে হেনা করা গোঁফ। সেই পঁচিশ বছর বয়সে ঢুকেছিলেন সার্কাসে। হিসাব পত্র দেখতেন। ঘর পালানো ছেলে। আখড়া মেলা বাইজি নাচ সাত ঘাটের জল খেয়ে শম্ভু বিশ্বাসের সার্কাসে নাড়া বাঁধেন। বিশ্বেস মশাইয়ের সাতকুলে কেউ ছিল না, ছেলের মতোই ভালবাসতেন। মারা যাওয়ার আগে লেখাপড়া করে বিশ্বনাথকে দিয়ে যান গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। সেও হল আজ বিশ বাইশ বচ্ছর।
বড়াল বাবুর মেয়েছেলের দোষ কোনওদিনই ছিল না। সার্কাসের লোকজনদের বুক দিয়ে আগলে রাখেন। নেশা বলতে সন্ধের বাজনা বেজে উঠলে সার্কাসে নিজের খুপরি তাঁবুতে দিশি বোতল খুলে বসেন। লাল সুতোর বিড়ি টেক্কা মার্কা দেশলাই পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেরোয়। দিনমানে ওই একবারই। সবাই বাবা বলেই ডাকে। চোখ লাল হয় যত রাত বাড়ে। ইদানিং একটা গান শুনতে বড় সাধ হয় তাঁর। সেই কবে কলকেতার প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রি টে শুনেছিলেন লালবাঈয়ের গলায়। রূপ দেখে সই কুল হারালেম বকুলতলায় এসে! নিজের মনেই হাসেন। নিজের কুলও নেই বকুলতলার সখীও নেই!
সাতটার শোয়ের সব শেষে আলো কমে আসে মঞ্চের। থেমে যায় সব বাজনা। আবছা আঁধারে যেন দোলা খায় ভুতুড়ে কুয়াশা। কালো জোব্বা পরে উঠে আসে তখন গণপতি। মাথা মুখ পরিস্কার করে কামানো। এমনকি ভুরু অবধি। ঘোলা মরা দুটো চোখ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নেশা ধরে যায়। কোনও যন্ত্রপাতি কিছুই নেই। একটাই খেলা দেখায় গণপতি। বাবু হয়ে চুপ করে বসে মঞ্চে। তারপর ভাসতে ভাসতে উঠে আসে একটু ওপরে। নীচে কিচ্ছু নেই। যেন হাওয়ায় বসে আছে। ওখানেই উঠে দাঁড়ায়। হাত পা নাড়ে। হেঁটে বেড়ায় শূন্যে। পাঁচ ছ মিনিট। আস্তে আস্তে নিভে আসে সব আলো। জোব্বার পকেট থেকে একটা আড়বাঁশি বের করে নিঁখুত সুরে বাজাতে থাকে।
সে সুর এই নশ্বর পৃথিবীর নয়। একবার শুনলে মানুষের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। হাহাকারে ছেয়ে যায় অন্তর। ভারী হয়ে আসে বাতাস। কে যেন ডেকে চলে ওই মায়া পর্দার আড়াল থেকে। আয়! আয়! আয়! কত কত জন্মের সঞ্চিত কামনা বাসনার দল কুসুম রেণু হয়ে ঝরে পড়ে মর পৃথিবীর বুকে।
নেশার ঘোরেও বিশ্বনাথ বড়ালের কানে বাজতে থাকে গণপতির বাঁশি। মনে পড়ে যায়, ফুরিয়ে আসছে সার্কাসের সংসার। হাতি সিংহ বাঘ আর নাকি রাখা যাবে না সার্কাসে। ট্র্যাপিজের বুড়ি দুটো রাশিয়ান মেয়ে আর পারে না খেলা দেখাতে। জোকারের মুখে বলিরেখার দাগ। অনেকেই চলে যাচ্ছে সার্কাস ছেড়ে। নতুন যুগের ভিডিও সিনেমার রমরমে বাজার এখন। কে থাকবে তবে ? তিনি আর গণপতি ? আর ওই কালান্তক বাঁশির খেলা ?
ঘুম নেমে আসে বড়াল মশাইয়ের চোখে। সার্কাসের রংচটা তাঁবুর ওপর জেগে ওঠে অঘ্রাণের চাঁদ। আবছা জোছনায় ছেয়ে যায় ভুবনডাঙা। বুনো ফুলের গন্ধে জেগে থাকে ধূ ধূ মাঠ।
আলো নিভে আসে গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাসের।
সার্কাসের আলো নিভে এলে চলবে কী করে গণপতির। তাই ইদানিং সে বহুরূপী হয়েছে! নতুন নাম নিয়েছে মহাদেব।
মাথায় বাঁকা চাঁদ। কণ্ঠলগ্না কালনাগিনী। পরনে বাঘছাল, ভস্মমাখা অনাবৃত দেহ। ঘুপচি অন্ধকার চা দোকানের বেঞ্চে বসে বিড়ি খাচ্ছেন মহাদেব। পাশেই রাখা ডম্বরু আর ত্রিশূল। দোকানের গায়ে লাগা বড় কদম গাছে ফুল আসার সময় হয়নি এখনও।
সামনে রাস্তার ধারে চট পেতে আবছা আলোছায়ায় সকালের শুকনো সবজি নিয়ে বসেছে বুড়োমতো একটা লোক। কানা বেগুন ধসে যাওয়া কুমড়ো চিমসে কাঁচালঙ্কা বেছেবুছে দেখছেন মহাকালী। জরিপাড় লাল সারি, হাত গলা ভর্তি গয়না। মিশিকালো গায়ের রঙ। কোঁকড়ানো পিঠ ওপচানো চুল। লম্বা টকটকে জিভ আর খাঁড়া হাতের থলেয় রাখা আছে।
ক্লান্ত মফস্বলে সন্ধে নেমেছে। কিচির মিচির অটো সাইকেল রিক্সার ভিড় রাস্তায়। গোটা কয়েক চেয়ার দুটো মাইক পেতে বেসুরো গলায় ‘আমরা করব জয়’ গান গাইছেন একজন বয়স্কা মহিলা। আধবুড়ো দু চারজন চেয়ারে বসে ঢুলছেন। হাতরুটির দোকানে মানুষের ভিড়। গরম রুটি আলুর তরকারির চনমনে গন্ধ বাতাসে।
মহাদেব চা দোকানিকে বলছেন, একটা লেড়ো দাও দিনি!
মহাকালী মুখ করছেন, ও বাবা, পচা কুমড়া পনেরো টাকা করি লিবা ? তুমি যি ডাকাত গ!
দিনমানে টো টো করে একসঙ্গে ঘুরেছে দুজনে।ট্রেনে দশ বিশ টাকা রোজগার হয়েছে । সেই কোন সকালে বাজিতপুর গাঁ থেকে বেরিয়ে পায়রাডাঙা রাণাঘাট ব্যারাকপুর হয়ে এদিকে এসেছে। রাতে ট্রেন ধরে আবার ফেরা। গাঁ ঘরে তখন নিঝুম রাত। ভাত বসাবেন মহাকালী। মহাদেব দাওয়ায় বসে গান ধরবেন ভাঙা গলায়, ‘দুদিন এলি এই ভবে/ দুদিন পরে যেতে হবি/
খামারবাড়ি খামারজমি/ সময় হলে যাবে ছাড়ি।’
ঝিমঝিম হাওয়া বাতাস বয়, কোনওদিন গুমগুম গর্জে ওঠে মেঘ। পায়রাডাঙার গাজনে ভেক ধরে মহাদেব। তিনদিনের ভিখ মাঙা সন্নিসি। লাল শালু, হবিষ্যি, গাঁজা। মহাকালীকে ছেড়ে তিনরাতের বেম্ভচারী। ক’টা পয়সা হাতে আসে। নীলষষ্ঠীর দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুত্রবতীএয়োতিদের আশীর্বাদ করে। চাল মুলো কলা সিধে পায়। দু চার টাকা পায়। আর চৈতগাবে গান ধরে। আগে চড়ক গাছে বাঁইবাঁই করে ঘুরতো পিঠে লোহার শলা ফুঁড়ে। বছর পাঁচেক আগে পড়ে গিয়ে পা ভাঙে। সেই থেকে খুঁড়িয়ে হাটে।
সেই কবে মহাদেবের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিল মহাকালী। কাঁচা যৈবন। গাঁয়ের মুরুব্বিরা বিধান দিয়েছিল মহাদেবকে গাঁ থেকে বের করে দেওয়ার। দুজনেই পালিয়েছিল। সেসব কতবছর আগের কথা। তা হল বিশ বাইশ বছর। ভাত জোটে না ঠি কমতো খুদকুঁড়ো যা জোটে তাই দিয়ে দুটো পেট চলে। বেদম মার খায় কোনও কোনওদিন, সেও মারে, নড়া ধরে মাটিতে ফেলে বুকে পা দিয়ে দাঁড়ায়! চালে খড় নাই, টপটপ জল ঝরে বর্ষার রাতে, পেটভরা ভাত নাই সখ আহ্লাদ কিছু নাই। তবু বেশ আছে, মহাকালী। সেই যে গেলবার পুজোয় সস্তার একটা লালপেড়ে শাড়ি এনে দিয়েছিল! যখের মতো আগলে রেখেছে তা। মাঝে মাঝে পরে, টকটকে লাল সিঁদুর দেয় কপালে! সেদিন মেঘ করে খুব! ঝিঙে ফুল ফোটে ক্ষেতে। বেশ আছে! ওই যে লেড়ো খাচ্ছে, মহাকালী জানে ফিরতি টেরেনে গেঁজ থেকে তঠি ক একটা লেড়ো বের করে তার হাতে দেবে। বলবে, ফিরতে ম্যালা দেরী, পিত্তি পড়বে, খেয়ে লে!
ফেরার সময় আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে আসবে ট্রেন। ঝমঝম করে সেতু বেয়ে পার হয়ে যাবে কত নদী খাল বিল। রাত বাড়বে। ক্ষেতে মাঠে ছুটে বেড়াবে শেষ চৈত্রের পাগলা বাতাস। লেবু ফুল ফুটবে খুব। দুপাশে সরে সরে যাবে কুপি জ্বলা জনপদ। ধূ ধু আকাশে হিরের কুচির হয়ে আলো দেবে নক্ষত্ররাজি। ভাঙা চাঁদ উঠবে নিজের মনে।
তার নীচেই আলতাব শেখ আর পারুল মণ্ডলের সংসার। মহাদেব আর মহাকালীর ভালবাসা। মুখে রঙ, পরনে সস্তার বাঘছাল, জরিপাড় শাড়ি হাতের থলেয় পরচুলো, বাঁকা চাঁদ, কালনাগিনী, লোলজিহ্বা, খাঁড়া, ডম্বরু আর ত্রিশূল।
মহাকালের বাতাসে দোলা খায় ঈশ্বর ঈশ্বরীর প্রেম।
মহাদেব মহাকালীর বিয়া হবে কাল। মানে শিব আর নীনাবতী। আজ নীলের অধিবাস।ওই অশ্বত্থ গাছের তলে বুড়া শিবের থান। তার পাশেই দিয়াসিনী মায়ের একচালা। মায়ের মাতায় জটা, লালপেড়ে শাড়ি, চোখ দুটা করমচা পারা নাল। বউ বিটিছেলেদের দল কাল সাঁঝ ঘনালে নীলের ঘরে বাতি দিতে আসবেক। দিয়াসিনী মা সিঁদুর পরায় দিবেক। সারা দিনমান সূয্যি উঠা থিকে উপাস উয়াদের। কাঁচা আম দিবেক নীলের পায়ে। হাড়িদের ডাঁটো বউটোর কাঁচা আমে লজর হুই ফাগুন মাস থিকে, বুড়ি শাউড়ি খিতে দেয় লাই! নীলকে আম দিয়া তবে না খাবেক। দিয়াসিনী মা ছড়া কাটবেক, নীলের ঘরে দিয়া বাতি জল খাওগা পুত্তবতী। ছেলেপিলাগুলানকে সারা বছরটো দেকবে নীল ষষ্টির ঠাকরেণ!
রেতে দুলু বাগদীর ভর উঠবেক। চৈত মাসের সন্নিসি। বউ ঘর মাছ ধরার জালটো ছেড়ে বুড়া শিবের থানে ডেরা বাঁধিছে মাস ভর। নাল অঙে ছুপানো কাপড় অঙ্গে। একবেলা ভাত, কাঁচা মেটে হাঁড়ি চড়ায় আখায় সেই সূয্যি ডুবলি। আরও কতক জোয়ান মদ্দের দল দুলুর সঙ্গি বত রাখিছেক। ডোমদের ঘরের জোয়ান ব্যাটা শিউরাম ইবচ্ছরের বাণ সন্নিসি। চড়কের দিন জিভে লোহার তির ফুটায় ঘুরবেক সারাটো বেলা। নিতাই হাড়ির বেত-সন্নেস। কচি বেত পিঠের পানে মোটা চামড়া ভুকিয়ে ঢুকয়ে দিবে। চিল্লালে চলবেক লাই। আরও কতক হবেক। কাঁটা-ঝাঁপ হবেক। বটি-ঝাঁপ হবেক। পা দুটা চড়ক গাছে বেঁইধে ঝুলে থাকবেক, ঝুল-ঝাঁপ বড় কষ্টির গ! কাঁটা ঝোঁপে খোলা বঁটিখানের ওপর ঝাঁপাবেক। অক্ত বেরোবে গলগল করি। তবু নীলের দয়া যি গ! জয় নীল বাবার জয়!
আর আছেক চড়ক গাছে বোঁ বোঁ করি পাক লাগান।অগুলান মেয়ে বিটি লোকের ভিড়ে থিকথিক তখন চড়ক তলা। সাঁঝ লাগার আগেই পিঠে বঁড়শি ভুকিয়ে গাছে পাক লাগান। দয়া না থাকলি বড়শি সন্নিসি হবেক ক্যামনে। ঢোল বাজবেক, ঢ্যাং ঢ্যাং ঢ্যাং। ম্যালা বসিছে চড়ক তলায়, কতোও জিনিস বটেক! বেলান-চাকি দা বঁটি ছুটা ছুটা পুতুল। জিলাপি ভাজা, পাঁপড় ভাজা! জাদুকরের খিলা, সোন্দরী বিটিছেলা গায়েব করার খিলা।
চড়কের ম্যালা দের আছেক। আজ নীলের অধিবাস। রেতে বুড়া শিবের থানে হাজরা ভোগ হবেক। যতেক দেবতাদের নিমতন্ন যি গ! শিবের বিয়া বলে কতা! ভূত পেরেত শাকচুন্নীর দল একটেরে দাঁড়ায় থাকবেক। উয়াদের লেগে খিঁচুড়ি আর শোল মাছ রাঁধবেক দিয়াসিনী মা। সন্নিসিরা সারাটো দিন নীলকে কাঁখালে মাথায় লিয়ে ঘর ঘর ঘুরছেক। বেলকাট কেইটে নীলের মুত্তি, গঙ্গায় চান কইরে তবে শুরু। ঘরে ঘরে উঠানে বিটি বউদের দল আপন্না কাটিছে, তেল সিঁদুর দিয়া নীলকে বরণ করবি যে! বিয়ার বচ্ছর ঘুরতে গেলও বিশ্বেস বাড়ির বিটির, ছেলা হয় লাই! সন্নিসিরা দণ্ডের বারি দিবে মাতায়! নীলের দয়ায় ঠি ক ছেলা হবেক গ!
গান গাইবেক সন্নিসিরা নীলকে মাথায় লিয়ে। ওই যি শিব সাজিছে বাগদীদের পো কাত্তিক। পায়ে ঘুঙুর পরি বিটিছেলের পারা চুল লাগাইছে হোঁটে আলতা দিয়েছেক কাহারদের ব্যাটাছেলা, লক্কন। কেমন বুক উঠায়ছে দ্যাকো! ত্যানা কানি পুরে বেলাউজে! অষ্টক গান বটেক! বাউড়ি পাড়ার নিতাই অধিকারী! বালা হয়েছেক! য্যামনি গানের সুর ত্যামন গলা বটে। গাইছি দ্যাকো ক্যানে
চিড়নে চুড়িয়া চুল
খোঁপায় দিয়া, হা রে, চম্পা ফুল
ফুলের গন্ধে কেড়ে লেয় প্রাণের যুবতির কুল!
শিব বলে, সুন্দরী
তুই তো বড় রূপসী
আমি একটু হইছি বুড়া
তাতে তোর ক্ষেতি কি ?!
চারপাশে তখন ধূ ধূ চৈত্রমাস। ফুটিফাটা মাঠঘাট। দীঘির জল শুকিয়ে কাদা কাদা। পথের ধুলোয় ঘেঁটু ফুলের সৌরভ। হা হা বাতাস বইছে উন্মাদের মতো।
কাল শিব নীলাবতীর বিয়ে। দুলু বাগদীর মতোই জামাই তিনি। মাছ ধরে মাঠে ফুরনের কাজ করে দিন কাটে। রাতে নেশাভাঙ। অত সুন্দরী সোমত্থ মেয়েকে হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিল গো বাপ।
তবুও কী পিরীত! কী পিরীত! ছাড়ান কাটান নাই।
জন্ম জন্ম পার হয়ে যায়। কত আগুনখেকো চৈত্র আসে, আবার মুছে যায় কালের গর্ভে। শিব নীলাবতীর ভালবাসার সংসার হয় বারবার।
তাই হোক! পড়ন্ত বেলায় একটা শুকনো বেলপাতা দু একটা ঘেঁটু ফুল খসে পড়ে, ভেসে বেড়ায় আপনমনে।
দিনান্তের রৌদ্রে রঙ ধরে ভুবনডাঙায়!
(ক্রমশ)