কাফিরনামা । পর্ব ৩। লিখছেন রাণা আলম

0

শুনুন কর্তা,আমি নিজে গাইতে পারিনে, দু-কলম গুছিয়ে লিখতে পারিনে রেডিও ছাড়া অন্য কিছু বাজাতে পারিনে, ছবি আঁকলে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মনে হয়, সুতরাং সেইই আমি যে দুনিয়ার যাবতীয় ‘আর্তিস্ত’, ‘কলাবৎ’ দের বিরুদ্ধে এরদোগানীয় জিহাদ ঘোষণা করবো সেটা তো আর অন্যায় কিছু নয় সার।

আমার পাশের ফ্ল্যাটে একজন গান শিখতেন। ‘শিখতেন’, এটা তার ব্যক্তিগত ধারণা। আশেপাশের জানালার লোক অবশ্যি গণতান্ত্রিকভাবেই ভিন্নমত পোষণ করতেন।কখনও সখনও সাত সকালে তার মৌলিক সুরে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঠেলা সইতে হত আমাদের। এবং তিনি যেমন তেমন ভাবে শিখতেন না, রীতিমত মাইনে দিয়ে মাস্টার রেখে শিখতেন। বাজার-হাটে অনেকবারই তার সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, মনে হয়েছে সাহস করে তাকে বলা দরকার যে বা যারা তাকে পয়সা দিয়ে গান শেখার পরামর্শ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে মানহানি এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন অনায়াসে।

মুশকিল হচ্ছে ভালো পরামর্শ আমি দিতে চাইলেই উনি তা সানন্দে সহাস্যে নেবেন, হারমোনিয়ামটা নিলামে বেচে আমায় ডেকে জমজমের বিরিয়ানি খাওয়াবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়?

আরেকটা কথা, ওই যে বিজ্ঞানীরা বলেন না যে জিন না কি একটা দিয়ে বংশের গুণ দোষ ইত্যাদি প্রবাহিত হয়, তার মানে আপনার বাবা তার যৌবনে অনাদির মোগলাই খেয়ে তারিফ করে থাকলে আপনিও সুলেখার কাছের বাদশার কাউন্টারে কাবাব রোল খেয়ে ঢেঁকুর তুলবেন,  ওসব ভুয়ো বকায় একদম বিশ্বাস করবেন না সার। আমার পিতৃদেব উস্তাদ আবু দাউদ খানের বাড়িতে হারমোনিয়াম হাতে ধরেছিলেন। সেই সুবাদে গোরাবাজারে দোতলার ঘরে যেদিন গলা ছেড়ে গান ধরেছিলাম, সেদিনই পিতৃদেব একতলা থেকে হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে হুড়কো নিয়ে তেড়ে এসেছিলেন। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিওয়াসাল্লামের পর ইসলামে সন্তানকে জনস্বার্থে কুরবানি দেওয়ার চেষ্টাকে খুদাতলা মান্যতা দ্যান নি, তাই সেযাত্রা গোটা কয়েক গাট্টা আর চোখা বাক্যবাণেই রেহাই পাওয়া গিয়েছিল।

যেহেতু, ‘গণপিটুনি’ শব্দটা অভিধান থেকে এখনও যায় নি, তাই ‘রাসভনন্দিত’ স্বরে আর বেসুরো গান গাওয়ার ‘কোশিস’ করার ‘গুস্তাখি’ করিনি।কিন্তু, আমি না গাইলেও বাঙালি থামবে ক্যানো? ‘অমাইক’ বাঙালির ‘মাইক’প্রীতির কথা তো সর্বজনবিদিত। পাড়াতুতো প্রতিভারা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায়, পলিটিক্যাল বাঙালি জনসভায়, বিদ্যা বালানে দগ্ধ বাঙালি আকাদেমিতে মাইক দেখলে মুখ খোলাটা অবশ্য কর্তব্য ভাবে।

অবশ্যি, আকাদেমি নিয়ে আরেকটা কথা না বললেই নয়। সৌপ্তিক নাট্যদলের পরিবেশনায় আকাদেমিতে বাদল সরকারের নাটক ‘শনিবারগুলো’ দেখতে গেছি। আমি সচরাচর পিছনের সারিতে বসা পছন্দ করি। তাতে ভালো ঘুমোনো যায়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডামাস বিল্ডিং এর অডিটোরিয়ামে ছাত্রাবস্থায় একটিও সেমিনার বা আলোচনাসভা বাদ দিতাম না ঠিক এই কারণেই যে এসি হলে পিছনে বসে নিশ্চিন্তে ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।

তা নাটক শুরুর আগে এক ‘মহাভারত’ খ্যাত মহীরূহ বক্তিমে দিচ্ছিলেন। ভদ্রলোকের এমনিতেই মাইক কে পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে নেওয়ার সুনাম ছিল। আমার মত মূর্খদের এইসব ক্ষেত্রে পিছনে থাকাটাই সমীচীন ভেবে লাস্ট রো’তে বসে এট্টু ঘুমিয়ে নেওয়ার কষ্টসাধ্য প্রিপারেশন নিতে যাচ্ছি, আচমকা মৃদু নাসিকা গর্জনের শব্দ। নড়ে-চড়ে উঠে বোঝার চেষ্টা করলাম অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমার সুবিখ্যাত নাসিকাটিই দায়ী কিনা। তারপরে দেখলাম আমি নই, সুদীর্ঘ ‘মহাভারত কথা’র সৌজন্যে আশেপাশের কয়েকজন মৃদুমন্দ নাসিকাগর্জনসমেত আরামসে ঘুম দিচ্ছেন।

গাইতে পারিনে বলেই যে সমানে নিন্দেমন্দ করে যাবো অ্যামন টা নয় সার। শেয়ালদা থেকে বহরমপুর যাওয়ার ডাউন ভাগীরথী এক্সপ্রেসে বাঁশি বাজাতে উঠতেন এক বছর পঞ্চাশের মানুষ। রোগাটে গড়ন। গায়ে ময়লা জামাকাপড়। স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। রেল স্টেশনে থাকতেন। যাদের শোনার সৌভাগ্য হয়েছে তারা জানেন যে অসামান্য বাঁশি বাজাতেন ওই মানুষটি। রাতের অন্ধকারে, ট্রেনের হাল্কা দুলুনির সাথে বাঁশিতে উদাসী সুর তুলতেন তিনি। আমাদের মত বেসুরোদেরও ভিতরটা কেঁপে উঠতো। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি,

‘দাদা, আপনার বাড়ি কোথায়?’

জানালার বাইরে নিকষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে উত্তর দিয়েছেন,

‘যেদিন সেইখানে থাকি, সেটাই আমার বাড়ি’।

স্বল্পবুদ্ধিতে বোঝার চেষ্টা করেছি সেই বাড়ির ঠিকানার গভীরতা। মানুষ যেখানে থাকে সেটাই তার ঠিকানা। বিষয়টা কি এতটাই সহজ?

যখন আমাদের রাষ্ট্র আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পে তুলে আনছে একের পর এক মানুষকে অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে। ঊনিশ লক্ষ ছহাজার ছশোসাতান্ন জন গোটাগোটা মানুষ রাষ্ট্রের তুঘলকি সিদ্ধান্তে মুহুর্তে ঠিকানাহীন হয়েছেন। তাদের বাড়ি-ঘর-শেকড় থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ডিটেনশন ক্যাম্পেই প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই।

আমরা, শিক্ষিতরা তখন মার্টিন ন্যুয়েমলার আওড়েছি, কিন্তু তা বোঝার চেষ্টা করিনি। রাষ্ট্রের চোখ রাঙ্গানির ভয়ে গোপন সিন্দুকে বন্ধক রেখেছি শিক্ষিত বিবেক। রাজামশাই একনায়কতন্ত্রের রোডরোলার চালিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন,

‘সব ঠিক আছে তো?’

আমরা তোতাপাখির মতই উত্তর দিয়েছি,

“চমৎকার। হুজুরের মতে অমত কার?”

ঠিক এইসময়ই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে প্রতিরোধের শক্তি দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের দেশের কৃষকরা। খালিস্তানী, দেশদ্রোহী বলে অনবরত দাগিয়ে দিয়ে, দেশদ্রোহের মামলা দিয়ে, পুলিশ নামিয়েও কাবু করা যায় নি অহিংস কৃষকদের। সাতশোর বেশি কৃষক শহীদ হয়েছেন। প্রবল ঠান্ডায় রাজপথ আঁকড়ে পড়েছিলেন তারা। সরকার বাধ্য হয়েছে মাথা নোয়াতে।

আমাদের কবি সেই কোনকালেই বলে গেছেন, ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’।

মহামহিম রাষ্ট্রশক্তি তার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বর ওঠানো মানুষদের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করেছে।

আর আমরা প্রহর গুণছি নিজের ঘরে আগুন লাগার।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *