পরিবেশকর্মী হত্যা : একটি আলেখ্য। পর্ব ১৫। লিখছেন অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য

0

(গত পর্বের পর)

পরিবেশরক্ষক বনাম পরিবেশঘাতক – ব্রাজিলীয় পরিবেশ-আন্দোলনের চিরন্তন লড়াইয়ের সেকাল, একাল

নিহত পরিবেশকর্মী ব্রুনো পেরেইরা ও ডম ফিলিপসের স্মরণে সাও পাওলোয় গুয়ারানি আদিবাসীদের জমায়েত (ছবিসূত্র – ইয়েল এনভায়রনমেন্ট থ্রি সিক্সটি)

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়রনি। ৫ জুন। ২০২২। বছর একচল্লিশের ব্রুনো পেরেরা এবং সাতান্ন ছোঁয়া ডম ফিলিপস। ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম আদিবাসী অঞ্চল ৬,০০০ আদিবাসী অধ্যুষিত ভেল ডি জাভারির ইটাকুয়াই নদী বরাবর এই দুই পরিবেশকর্মীর একটা সোজোর্ন। লাস্ট সোজোর্ন। কারণ সাও রাফায়েল অঞ্চলের এক স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে দুজনে ইটাকুয়াই বরাবর ফিরে আসছিলেন আতালিও ডো নোর্তের দিকে। সেখানেই একটি ইল্লিগাল ফিশিং বোট নজরে এসেছিল ব্রুনোর। ব্রুনো ফিলিপসকে বললেন, ছবি তোলো। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডম ফিলিপস এই সুযোগ খুঁজছিলেন। গল্প খুঁজছিলেন। ইংলন্ড থেকে ২০০৭ সালে ব্রাজিলে এসে সালভাদোর অঞ্চলের পাকাপাকি বাসিন্দা ডম দ্য গার্জিয়ান, ফিনান্সিয়াল টাইমস, নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডে একের পর এক পরিবেশ-সংক্রান্ত রিপোর্ট লিখলেন। বৃহত্তম লক্ষ্য ছিল আমাজন অরণ্যের পরিবেশ সংকটের ওপর তাঁর বই ‘How to Save the Amazon: Ask the People Who Know’-এর জন্য তথ্য সংগ্রহ করা। আদিবাসী ব্রাজিলকে জানা। এবং তাই স্থানীয় পরিবেশকর্মী ব্রুনোর সঙ্গে ঘোরা। ২০১৮ সালের প্রথম দেখা। সেবছর আগস্টে ৯৫০ কিলোমিটার বোটিং এবং ৪০ মাইল হাইক করে আদিবাসী আমাজনের ভেতর দিয়ে ব্রাজিল সরকারের ‘ফুনাই’ দপ্তরের আদিবাসী বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করা ব্রুনোর সঙ্গে এক্সপেডিশনে ছিলেন ডম নিজেই। সেই ব্রুনো যিনি একসময়ে সরকারি পদে থেকে ইল্লিগাল ফিশিং এবং মাইনিং সাইটগুলো খুঁজে খুঁজে অতিরিক্ত আগ্রহের মাশুল দিয়েছিলেন বোলসেনারো সরকারের অধীনে আদিবাসী বিশেষজ্ঞের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বরখাস্তের নোটিশ পেয়ে। অপরাধ? ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে ইয়ানোমামি রিজার্ভে একটি অবৈধ সোনার খনির বিষয়ে রিপোর্ট করে মাইন অপারেটরের লাইসেন্স প্রায় বাজেয়াপ্ত করা। তার এক মাসের মধ্যেই বরখাস্ত। সো হোয়াট? নিজেই একা একা ঘুরে ব্রাজিলের আদিবাসী অঞ্চলের ম্যাপ তৈরি করে আদিবাসীদের সংগঠিত করলেন। ব্রাজিল সরকারের সুস্পষ্ট চিহ্নিত করা আদিবাসী অঞ্চল জাভেরি ভ্যালি থেকে বহিরাগত কারও শুধুমাত্র মাছ না, একটিমাত্র পাথর নিয়ে যাওয়াও সাংবিধানিক অপরাধ। অথচ, স্থানীয় লোভনীয় ‘পিকারুকু’ মাছের জন্য ইল্লিগাল ফিশিং ক্রমশ বাড়ছিল। ব্রুনো জাভেরি ভ্যালির পরিবেশরক্ষক ‘ইউনিভেজা’ সংস্থার হয়ে রাতের পর রাত পাহারা দিয়ে ইল্লিগাল ফিশিং রোখার প্রশিক্ষণ দিলেন আদিবাসীদের। আর এভাবেই ঢুকে গেছিলেন হিটলিস্টে। সেই ব্রুনো ফিশিং-বোটের ছবি তুলতে বললেন ফিলিপসকে। ফিলিপস তুললেন। দুই অন্যতম বিপজ্জনক ইল্লিগাল ফিশারদের থেকে মাল্টিপল গানশট। এক সপ্তাহ পরে ব্রাজিল-পেরু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গভীর জলা অরণ্যের ভেতর সেই হিটম্যান ফিশার ‘পেলাডো’ ব্রুনো, ফিলিপসের সাত দিনের পুরোনো মৃতদেহ খুঁজে দেয়। দশ দিনের অক্লান্ত পুলিশি সার্চে প্রত্যাশিত কিন্তু বিষণ্ণ টুইস্ট। আতালিও ডো নোর্তের থেকে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের নদী পেরিয়ে তারপর ৩.১ কিলোমিটার দূরে লাগো দ্য প্রেগুইকা অঞ্চলের গভীর অরণ্যের ভেতর ব্রুনো-ডমকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় শরীরী অংশ। গ্রেপ্তার খুনে তিন ইল্লিগাল ফিশার আপাতত জেলবন্দী হলেও ট্রায়ালের দিন ক্রমশ পিছোচ্ছে। লুলা ডি সিলভার শাসনাধীন ব্রাজিলেও এমন পরিণতি! আতালিও অঞ্চলের অস্থায়ী ফেডারেল পুলিশের টিম ‘নোভা এরা’ কাজ শুরু করেও আশ্চর্যজনকভাবে উঠে গেছে কিছুদিন আগেই। ব্রুনোর তিন সন্তানের অন্যতম পেদ্রো দুরারোগ্য নিউরোব্লাস্টোমায় আক্রান্ত। দেশের বাইরে থেকে আনা ড্রাগ ‘কারজিবা’-র প্রতিটি ডোজের মূল্য ৮৮,০০০ রেইজ (১৮,০০০ মার্কিন ডলার)। ‘সেভ পেদ্রো ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেন’-এ পাঁচ বছরের উড বি ব্রুনোকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। লক্ষ্য অন্তত এক মিলিয়ন রেইজ। ‘দ্য গার্জিয়ান’-এ জোনাথন ওয়াটস, টম ফিলিপসের মতো সহযোদ্ধারা ডমের রেখে যাওয়া ‘হাউ টু সেভ দ্য আমাজন’ শেষ করে ২০২৫-এ প্রকাশ করতে চলেছেন তাঁর স্বপ্নগ্রন্থ। শুধু দেখার জন্য ব্রুনো নেই। নেই ডম ফিলিপস।

ব্রুনো পেরেরা (ছবিসূত্র – দ্য গার্জিয়ান)

ব্রুনো-ডম নিরুদ্দেশ হওয়ার পর খুঁজে পাওয়া ডম ফিলিপসের প্রেস কার্ড (ছবিসূত্র – ফরবিডেন স্টোরিজ)

ব্রুনোর উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনে তোলা এক অবৈধ মাছচাষির সঙ্গে কথোপকথনরত ডম ফিলিপসের (ডানদিকে) অন্যতম শেষ ছবি (ছবিসূত্র – ফরবিডেন স্টোরিজ)

জাভেরি ভ্যালি এবং ফুনাই প্রসঙ্গেই কাছাকাছি এসে যায় ব্রাজিলের সরকারি ‘ফুনাই’ দপ্তরের কর্মী ম্যাক্সিয়েল পেরেরা ডস স্যান্টোসের হত্যা। ফুনাই-এর হয়ে ১২ বছর কাজ করা ম্যাক্সিয়েল পাঁচ বছর পরিবেশ সংক্রান্ত কাজের প্রধান পদে ছিলেন। জাভেরি ভ্যালির অবৈধ গাছকাটা, গোল্ড মাইন নিয়ে গলা ফাটিয়ে ২০১৯-এর ৬ নভেম্বর দেশের পেরু-কলম্বিয়া সীমান্ত লাগোয়া টাবাটিঙ্গা অঞ্চলের বড়রাস্তায় মোটরবাইকে যাওয়া অবস্থায় মাথায় দু দুটো বুলেট পান পরিবেশকর্মী, অফিসার। প্রাসঙ্গিক থেকে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় ব্রাজিল সরকারের ‘ন্যাশনাল ইন্ডিজেনাস পিপল ফাউন্ডেশন’ বা ‘ফুনাই’-এর বিবর্তন, ইতিহাস, মটো। ১৯১০-এ ‘ব্রাজিলের গান্ধী’ নামে খ্যাত প্রাক্তন সামরিক অফিসার ক্যান্ডিডো র‍্যামন প্রতিষ্ঠিত এস.পি.আই সংস্থা ১৯৬৭-তে ‘ফুনাই’-এর রূপ নেয়, যার মটো – ‘ডাই ইফ নেসেসারি, বাট নেভার কিল’।

জাভেরি ভ্যালি এবং অরণ্য (ছবিসূত্র – ফরবিডেন স্টোরিজ)

ব্রুনো পেরেরার ফিউনারেলে শোকস্তব্ধ জুকুরু আদিবাসীরা (ছবিসূত্র – ইয়েল এনভায়রনমেন্ট থ্রি সিক্সটি)

‘ডাই ইফ নেসেসারি’। ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক  ভিসেন্তে কানাস ও ডরোথি স্ট্যাং-এর স্মৃতি। স্পেনীয় মিশনারি ভিসেন্তের নেতৃত্বে মাতো গ্রোসো রাজ্যের আনকন্ট্যাক্টেড আদিবাসী এনাওয়েনে নাওয়ে-দের সঙ্গে প্রথম শান্তিপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন হয়। তাঁদের সঙ্গে থেকে গিয়ে ভিসেন্তের নেতৃত্বে উন্নয়নমূলক কাজে আদিবাসী জনসংখ্যা ৯৭ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩০-এ। অবশ্য পাশাপাশি ভিসেন্তেসহ এনাওয়েনেদের ওপর চলছিল ক্যাটল র‍্যাঞ্চার ও সয়া মনোকালচারিস্টদের নিরন্তর থ্রেট। আদিবাসী অধ্যুষিত রিও-প্রেটো অঞ্চল সংলগ্ন জেরুয়েনা নদীতে জেনারেটরে অসংখ্য নেটিভ মাছের মৃত্যু, ট্রাডিশনাল ইয়াকোয়া উৎসবের ক্রমশ বিলুপ্তি – পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসের প্লট তৈরি করছিল বহুজাতিক। চিকো মেন্ডিসের হত্যার আগের বছর ১৯৮৭-র ৬ এপ্রিল আটচল্লিশ পেরোনো নিরস্ত্র ভিসেন্তেকে ফেটাল ছুরিকাঘাত একাধিক র‍্যাঞ্চারের। শরীর খুঁজে পাওয়া যায় ৪০ দিন পর। আশ্চর্যরকম হাস্যকর ট্রায়াল শুরু হয় হত্যার উনিশ বছর পর ২০১৬-য়, যখন হত্যাকারীর বেশ কিছুজন প্রয়াত। সে ট্রায়ালের পরিণতি আদৌ প্রাসঙ্গিক? স্মৃতিতে এসে যায় মার্কিন মিশনারি ডরোথি স্ট্যাংয়ের জীবন, লড়াই, সমাপ্তি। ১৯৬৬ সালে ব্রাজিলে এসে ১৯৮২ থেকে ক্যাথলিক প্যাস্টরাল ল্যান্ড কমিশনের হয়ে পরিবেশ আন্দোলন, আমাজন সংরক্ষণ ও ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে কাজ করতেন ডরোথি। পাশাপাশি ২৬টির মতো স্কুল তৈরি, ফ্রুট কোঅপারেটিভ গঠন করে এলাকার মেয়েদের কর্মসংস্থান এবং বড় বড় দুটি সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট চালানো, পারা সরকারের থেকে পাওয়া ‘ওম্যান অফ দ্য ইয়ার’ – এইসমস্তর ওপরে চরমতম সংযোজন ব্রাসিলিয়ার কংগ্রেশনাল কমিটিতে গিয়ে বৃক্ষচ্ছেদনবিরধী কথা বলে অবৈধ লগারদের নাম পর্যন্ত বলে আসা। স্থানীয় ‘গ্রিলেইরো’ জমিমাফিয়াতন্ত্র ও লগারদের হিটলিস্টে চলে আসেন নিরস্ত্র বৃদ্ধা। দিন কমে আসছিল ক্রমশ। ২০০৫-এর ১২ ফেব্রুয়ারি শনিবার পারা রাজ্যের আনাপু পৌরসভার বোয়া এস্পের‍্যাঙ্কা সেটলমেন্টে প্রায় জনা চারশ সবহারাদের নিয়ে নিজের তৈরি সাস্টেনেবল প্রোজেক্ট অঞ্চলের বৃষ্টিভেজা কাদা মাটিতে মিটিং করতে যাওয়ার সময় দুজন গানম্যান রাস্তা আটকায়। ‘কী অস্ত্র আছে আপনার কাছে?’ বৃদ্ধার উত্তর ছিল – ‘বাইবেল। রাস্তাতেই পড়তে শুরু করেন – ‘ব্লেসড আর দ্য পুওর ইন স্পিরিট …’। বেশিক্ষণ পড়তে পারেননি তিয়াত্তর পেরনো ডরোথি। ছ’ ছটি বুলেট – পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ। দুজন গানম্যান, দুজন র‍্যাঞ্চারের বিরুদ্ধে চলা দীর্ঘদিনের ট্রায়াল, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং শাস্তির মেয়াদ কমে আসার চেনা রাস্তার ভেতর খুব প্রাসঙ্গিক ২০২০-র প্যাস্টরাল ল্যান্ড কমিশিনের একটি রিপোর্ট। ডরোথি হত্যার পর থেকে সংগঠিত আরও ৫৫০টি খুনের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বাকি ৯৫ শতাংশ থেমে গেছে রাতের আমাজনের নিস্তব্ধতায়। থেকে গেছে বৃদ্ধার চেনা টিশার্টে পর্তুগিজে লেখা সেইসমস্ত কথাগুলো – ‘দ্য ডেথ অফ দ্য ফরেস্ট ইজ দ্য এন্ড অফ আওয়ার লাইভস’। ‘এন্ড অফ আওয়ার লাইভস’ – প্রতীকী। ডরোথি-হত্যার পরেও তাঁর অন্যতম উত্তরসূরি ফাদার আমারো লোপেজকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পুলিশি হেনস্থা ও গ্রেপ্তারি, আনাপু-র একাধিক কর্মী-হত্যা লেগেই ছিল। বৃদ্ধার রক্ত স্রেফ আনাপু-র মাটিকেই সামান্য বেশি রক্তাক্ত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি হয়তো। ডরোথি-হত্যা তখনও সপ্তাহ দুয়েকও পেরোয়নি। প্রেক্ষিত রিও থেকে ১৯ মাইল দূরে রিও অঞ্চলের বৃহত্তম রিজার্ভ ২৬,০০০ হেক্টরের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট টিঙ্গুয়া ফেডেরাল রিজার্ভের আটলান্টিক রেইনফরেস্ট। টিঙ্গুয়ায় ১৫ বছর ধরে কাজ করা, ইল্লিগাল লগিংয়ের বিরুদ্ধে গলা তোলা উনষাট পেরনো পরিবেশকর্মী ডায়ানিসিও জুলিও রিবেইরো ফিলহো, ওরফে ‘সেউ জুলিও’ সেবছর ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে মাথায় ফেটাল গানশট পান। নিজের মায়ের সঙ্গে থেকে পরিবেশ-আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া একাকী পরিবেশকর্মী প্রাক্তন ম্যারাথন-রানার জুলিও সম্প্রতি মা’কে হারান। দশ বছর ধরে ডেথ-থ্রেট পেয়ে শেষপর্যন্ত ২২ ফেব্রুয়ারি। আশ্চর্যের শেষ নেই। গ্রেপ্তার গানম্যান হত্যার কথা স্বীকার করেও পরে ছাড় পেয়ে যায়, বলা হয় বলপূর্বক ফাঁসানো হয়েছে তাকে। প্রসঙ্গত, আমাজন রেইনফরেস্টের এক-তৃতীয়াংশ এই আটলান্টিক রেইনফরেস্ট খুল্লামখুল্লা বৃক্ষচ্ছেদনে শেষ হয়ে গেছে ৯৭ শতাংশই। আই রিপিট, ৯৭ শতাংশ।

পরিবেশকর্মী মিশনারি ভিসেন্তে কানাস (ছবিসূত্র – উইকিমিডিয়া কমন্স)

সিস্টার ডরোথি স্ট্যাং (ছবিসূত্র – রয়টার্স)

ডরোথি স্ট্যাং-এর সমাধি এবং পাশে ডরোথির পর নিহত আরও ১৬ জনের নামসহ একটি রেড ক্রস, সংখ্যা আরও বাড়ছে বলে সম্ভবত দ্বিতীয় একটি রেড ক্রস বসছে পাশে (ছবিসূত্র – ন্যাশনাল ক্যাথলিক রিপোর্টার)

ব্রাজিল প্রসঙ্গে গ্লোবাল উইটনেসের হিসেব। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ – দেশে নিহত পরিবেশকর্মীর সংখ্যা এই তিন বছরে যথাক্রমে অন্তত ২৪, ২০ ও ২৬। ২০২২-এর হিসেবে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোর পর পৃথিবীর তৃতীয় ভয়ঙ্করতম দেশ ব্রাজিল ২০১২ থেকে ২০২১-এর মোট হত্যা (৩৪২)-র নিরিখে বিশ্বের ভয়ঙ্করতম দেশ। এই ৩৪২-এর এক-তৃতীয়াংশই আদিবাসী, আফ্রো-ব্রাজিলীয়, ৩৪২-এর ৪৪টি হত্যা সরাসরি অ্যাগ্রো-বিজনেসের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেখা গেছে হত্যাগুলি হয়েছে সেইসব রাজ্যে যেখানে কৃষিজ পণ্য যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন হয়, যেমন মাতো গ্রোসো, মাতো গ্রোসো দো সুলের মতো রাজ্য কিংবা সেরাডো-আমাজনের ট্রানজিশন এলাকা মাতাপিবা অঞ্চল। জমি মালিকানার বণ্টনে অসাম্যতা, আর্থিক বৈষম্য ইত্যাদির নিরিখে জিনি ইনডেক্সে ব্রাজিলের পয়েন্ট ২০১০ থেকে বাড়তে বাড়তে ক্রমশ ২০২২-এ ছোঁয় মহাদেশের সর্বোচ্চ ৫২.৯-এ, যা চূড়ান্ত বৈষম্যের দ্যোতক। প্যাস্টোরাল ল্যান্ড কমিশনের হিসেবে ২০২১-এ গ্রামীণ হিংসা জনিত ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মোট ৩৫, যা ২০২০-র চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি এবং এই ৩৫-এর কোনও ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত হত্যাকারী চিহ্নিত হয়নি। আদিবাসী পরিবেশকর্মী হত্যা প্রসঙ্গে গুয়াজাজারা-দের কথায় আসি। মারানহাও রাজ্যের হিউম্যান রাইটস সোসাইটির হিসেবে ২০১৯-এর নভেম্বর থেকে ২০২০-র মার্চ পর্যন্ত রাজ্যের আরাবোইয়া রিজার্ভ এলাকায় হত্যা হয়েছে পাঁচটি। সেই আরাবোইয়া রিজার্ভে থাকা ৫,৩০০ গুয়াজাজারা আদিবাসী দেশের অন্যতম বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী, গোটা দেশে যাদের সংখ্যা ২৭,০০০-এর কাছাকাছি। এবং এদের প্রতিনিধি অন্যতম এক প্রতিবাদী পরিবেশকর্মী জেজিকো রডরিগেজ গুয়াজাজারা ইল্লিগাল লগিং নিয়ে তীব্র আন্দোলনে সময় গুণছিলেন ক্রমশ। প্রাণসংশয়ে এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন বন্ধুরা। নাকচ করে জেজিকো বলেছিলেন, তাঁর নিজের থেকেও বাকিরা অনেক বেশি সংশয়ে আছে। যদিও বিপদ বুঝেই বাড়ির বাইরে সবসময় একা বেরোতেন, যাতে ক্ষতি হলে যাতে তাঁর একারই হয়। জেজিকো ব্রাজিলীয় কবি মারিও ডি আন্দ্রাদে পড়েছেন? ‘মাই সোল ইজ ইন আ হারি …’। আত্মার সময় নেই! এভাবেই ২০২০-র ৩১ মার্চ ‘লিডার অফ কোঅর্ডিনেটর অফ চিফস অ্যান্ড লিডার্স অফ দ্য আরাবোইয়া ইন্ডিজেনাস ল্যান্ড’ পদে আসীন হওয়ার দিনেই ১০০০ আদিবাসী অধ্যুষিত জুতিওয়া গ্রামে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ গানশট পান জেজিকো, শরীর খুঁজে পাওয়া যায় রাস্তায়। ঠিক আগের বছরের শিকার অন্যতম আরেকটি মুখ বছর ছাব্বিশের পাওলো পাউলিনো গুয়াজাজারার মাথায় ফেটাল গানশট আসে ২০১৯-এর ১ নভেম্বর। আরাবোইয়া রিজার্ভের ‘গার্জিয়ান অফ দ্য ফরেস্ট’ পরিবেশরক্ষক পেট্রলিং টিমের অন্যতম আলোচিত মুখ পাওলো চলে গেলেও পাওলোর সঙ্গী আরেক পরিবেশকর্মী লেয়ারসিও গুয়াজাজারা আশঙ্কাজনক থেকেও কোনওরকমে বেঁচে যান। ফিরে এসে লেয়ারসিওর প্রথম কথা ছিল – ‘আমি শেষ পর্যন্ত দেখব। লড়াই ছাড়ব না … ’। ২০১৯-এর ৭ ডিসেম্বর দুটি গানশটে দুই তরুণ রাইমুন্ডো ও ফারমিনো এবং ১৩ ডিসেম্বরে বছর পনেরোর এরিসভান গুয়াজাজারা স্থানীয় আমারান্তে অঞ্চলের ফুটবল মাঠে একাধিক ছুরির আঘাতে চলে যায়। শেষতম সংযোজন ২০২২-এর ৩ সেপ্টেম্বর একটি আদিবাসী উৎসব থেকে ফেরার পথে গানশটে চলে যাওয়া অন্যতম তরুণ পেট্রলিং টিম লিডার জানিল্ডো গুয়াজাজারা।

পেট্রলিংকালীন একটি ইল্লিগাল লগার ক্যাম্পে খুঁজে পাওয়া বুলেট নিয়ে পরিবেশকর্মী পাওলো গুয়াজাজারা (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

 ২০১৯-এর ডিসেম্বরে ব্রাসিলিয়ায় একটি প্রতিবাদ আন্দোলনে পাওলোর ছবি হাতে এক প্রতিবাদী (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

অথবা সংকটাপন্ন পশ্চিম ব্রাজিলের রোন্ডোনিয়ার ১.৮ মিলিয়ন হেক্টরের ‘উরু এউ ওয়াউ-ওয়াউ’ আদিবাসী অঞ্চল। ১৯৮১ পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীর কাছে যোগাযোগবিহীন ছিল এই রিজার্ভ এবং আদিবাসীরা। ১৯৯১ সাল থেকেই পাকাস নোভাস ন্যাশনাল পার্ক ঘেঁষা সুস্পষ্ট চিহ্নিত এই এলাকায় আদিবাসী বহির্ভূত বাইরের কারও বৃক্ষচ্ছেদন, ফিশিং ইত্যাদিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। অথচ, এখানেই ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬-য় ২৪৮ শতাংশ বেশি বৃক্ষচ্ছেদন হওয়ার আপাত অবিশ্বাস্য ডেটা। ব্রাজিলের ন্যাশনাল স্পেস এজেন্সির হিসেবে ২০১৫-র ৫৪৭ হেক্টর বৃক্ষচ্ছেদন বাড়তে বাড়তে ২০১৯-এর বীভৎস বছরে শীর্ষে ওঠে ১,০৭০ হেক্টরে, যা ২০২০-তে অনেকটাই কমে ৩৩৩ হেক্টরে এসে আবার বাড়তে থাকে ২০২১-এ। শুধু রোন্ডোনিয়াতেই ২০২১-এ ২০২০-র তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি বৃক্ষচ্ছেদন হয়েছে। লুলা সরকারের সময়ে আশ্চর্য দক্ষতায় ফুনাই আউটপোস্টগুলি পুনর্গঠন, ফেডারেল পুলিশের নেতৃত্বে একাধিক অপারেশন এবং এউ ওয়াউ-ওয়াউয়ের পেট্রলিংয়ের টিমগেমে কিছুটা আশার আলো এসেছিল। এবং এই আদিবাসী অঞ্চলেরই অন্যতম প্রধান মুখ, পরিবেশকর্মী ছিলেন আরি এউ ওয়াউ-ওয়াউ। পাশাপাশি ছিলেন প্রায় ১৫০ জন কমিউনিটি সদস্য নিয়ে গড়ে তোলা একটি গোষ্ঠীর শিক্ষক, পরিবেশ-রক্ষক পেট্রলিং টিমের নেতা এবং দৃপ্ত কণ্ঠের অধিকারী। ১৯ এপ্রিল দেশের আদিবাসী দিবস। ২০২০ সালে সেই উনিশের দুদিন আগেই ১৭ এপ্রিল রোন্ডোনিয়ায় নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোটরবাইকে করে রোজকার মতো গভীর আমাজনে ঢুকেছিলেন আরি। বছর তেত্রিশের পরিবেশকর্মীর শরীর পরের দিন জারু পৌরসভার টারিল্যান্ডিয়া অঞ্চলে পাওয়া যায়, মাথায় একাধিক জোরালো আঘাত, গলায় ধারালো অস্ত্রের দাগ। আরি-হত্যা মামলা রাজ্য থেকে ফেডারেল পুলিশের দরজায় গেলেও খুনী এখনও পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়নি। ২০২২ সালে ব্রাজিল-ড্যানিশ-মার্কিন যৌথ প্রযোজনায় অ্যালেক্স প্রিজ নির্মিত এমি পুরস্কার জয়ী তথ্যচিত্র ‘দ্য টেরিটোরি (ও টেরিটোরিয়া)’-য় দেখা গেছিল আরির ফুটেজ। এলাকার অন্যতম তরুণ মুখ জাই সুরুই ২০২১-এর নভেম্বরে গ্লাসগোর কপ টোয়েন্টি সিক্স সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে বক্তব্য রেখে আরি’র কথা তুলে ধরেন। এবং এই জাই সুরুইয়ের পরিবার, তাঁর মা নেইদিনহা, বাবা আলমিরের ওপর ডেথ-থ্রেট চলে এসেছে বহু বছর ধরে। নিজেরা এউ ওয়াউ-ওয়াউ আদিবাসী না হলেও নেইদিনহার বাবা চিকো মেন্ডিস-খ্যাত অ্যাকার রাজ্যের প্রাক্তন রবার ট্যাপার। সেখান থেকে এউ ওয়াউ-ওয়াউ রিজার্ভে এসে ডব্লুডব্লুএফের সঙ্গে যৌথভাবে বৃক্ষচ্ছেদন আটকানোর জন্য একাধিক অনলাইন সারভেইল্যান্স এবং ফিল্মিংয়ে অংশ নেন তাঁরা। হত্যা-শাসানির একাধিক ঘটনায় ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত নেইদিনহা-আলমির পুলিশি নিরাপত্তায় ছিলেন। পাঁচ সন্তানের অন্যতম তরুণী সেই জাই সুরুই দেশের অন্যতম সক্রিয় পরিবেশ-কর্মী।

পরিবেশকর্মী আরি উরু এউ ওয়াউ-ওয়াউ (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

উরু এউ টেরিটোরির পেট্রলিং টিম, সবার ডানদিকে অন্যতম তরুণ নেতা বাইটেট (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

চিকো মেন্ডিসের একজিকিউশন ঘরানার প্রায় একইরকমভাবে হত্যা করা হয় পারা-র বেলামের শহরতলি অঞ্চলের বারসারেনার কাইনকুইয়ামা গোষ্ঠীর পরিবেশকর্মী বছর সাতচল্লিশের পাওলো সার্জিও নাসিমেন্টোকে। ২০১৮-র ১২ মার্চ ভোর সাড়ে তিনটের সময় ঘরের বাইরে উঠোন-লাগোয়া বাথরুমে স্নান করতে যাওয়ার সময় মারণ-বুলেট পান পাওলো। তাঁর অপরাধ ছিল নরওয়ের মাইনিং ফার্ম হাইড্রো অ্যালুনোর্তের কারখানা থেকে স্থানীয় নদীতে টক্সিক ওয়েস্ট দূষণ নিয়ে সোচ্চার হওয়া। স্থানীয় বোম ফুটুরা কমিউনিটির কাছে একটি নদীর জলে অ্যালুমিনিয়ামের মাত্রা দেখা গেছিল লিটার প্রতি ২২ মিলিগ্রাম, যা স্বাভাবিক পরিমাণ লিটার প্রতি ০.১ মিলিগ্রামের চেয়ে বহুগুণ বেশি। স্থানীয় একটি প্রায়-পরিত্যক্ত ওয়েস্ট পাইপের কাছে এই মাত্রা বীভৎস লিটার প্রতি ৬০০০ মিলিগ্রামে পৌঁছেছিল, অস্বাভাবিক বেড়েছে ক্লোরাইড, সালফেট, নাইট্রেট, লেডের মতো টক্সিকের পরিমাণ। বিষাক্ত লাল জল, স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবেশকর্মী-হত্যা – স্থানীয়রা পারা সরকার, হাইড্রো অ্যালুনোর্তে ও অংশীদার অ্যালব্রাস অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ১৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের লসুট দাবি করেছে। ট্রায়াল এখনও ঝুলে। অ্যালুমিনিয়ামের পাশাপাশি গোল্ড মাইনিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্মল স্কেল গোল্ড মাইনিং গোটা পৃথিবী জুড়ে দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস। আমাজন রেইনফরস্টের বৃক্ষচ্ছেদনের দশ শতাংশ হচ্ছে এই প্রত্যক্ষ গোল্ড মাইনিংয়ের জন্যেই। এবং উত্তর ব্রাজিলের ২৭,০০০ আদিবাসীর ইয়ানোমামি রিজার্ভের অবৈধ সোনা খনন সাম্প্রতিক পৃথিবীর অন্যতম বড় পরিবেশ-সমস্যা। ১৯৯২ সালে ইয়ানোমামি রিজার্ভ তৈরির অন্যতম মুখ্য নেতৃত্ব এথনোলজিস্ট এবং তৎকালীন ফুনাই-অধিকর্তা সিডনি পোসুয়েলোর নেতৃত্বে দেশের কঠোর অবস্থানের ফলে প্রায় ৪০,০০০ মাইনার ইয়ানোমামি ছেড়ে বেরোতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও আসা যাওয়ার গ্রাফ বদলেছে। শাসন ব্যবস্থার একাধিক বদল এবং লুলা ডিসিলভার দ্বিতীয়বার নেতৃত্ব পাওয়ার পর ব্রাজিল সরকার এবং পরিবেশ-নিয়ন্ত্রক ইবামা দপ্তর এই ইয়ানোমামি সমস্যা মেটাতে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। ২০২২-এ ২০,০০০ অবৈধ লগার ও গোল্ড মাইনারদের চিহ্নিত করে অন্তত আশি শতাংশ এলাকামুক্ত করা হয়েছিল। অনেকটা পিছনের পায়ে চলে গিয়েও আশ্চর্যজনকভাবে দেশের সেনা, নৌ এবং এয়ার ফোর্স থেকে ক্রমশ গুটিয়ে নেওয়া মানসিকতায় ফের নখ দাঁত বের করছে চোরা গোল্ড মাইনার বা গ্যারিমপেইরোসরা। ইবামা’র হেলিকপ্টারকে জ্বালানি দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে মিলিটারি ফোর্স, নদীপথে অবৈধ মাইনারদের চিহ্নিত করে ব্লকেড করার পন্থা থেকে ক্রমশ সরে আসছে নৌ-দপ্তর, এবং রাষ্ট্রপতির আদেশ সত্ত্বেও রিজার্ভের নো-ফ্লাই জোনে বিমান নামানো কমিয়ে দিয়েছে এয়ার ফোর্স। এই আশ্চর্যের ব্যাখ্যা নেই। প্রসঙ্গত, গোল্ড মাইনারদের থেকেই ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য ক্রান্তীয় রোগের প্রাদুর্ভাবে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে ইয়ানোমামিরা। ২০২০-র এপ্রিলে কোভিড অতিমারিতে প্রথম মৃত্যু দেখা ইয়ানোমামি রিজার্ভে ক্রমশ একের পর এক সংক্রমণের সরাসরি দায়ভার এসেছে মাইনারদের ওপর। সেবছর ডিসেম্বরে ৪,৩৯,০০০ সইসহ ‘মাইনার্স আউট, কোভিড আউট’ শীর্ষক একটি পিটিশন জমা পড়ে ব্রাজিল কংগ্রেসে। সরকারি হিসেব বলছে, ২০২৩-এ ২৫,০০০টি ম্যালেরিয়ার কেস এসেছে, যা ঠিক আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-এর ৩,২০৩টি ফ্লুয়ের সংক্রমণ ২০২৩-এ অবিশ্বাস্য ৬৪০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০,৫২৪-এ। ২০২৩-এর জানুয়ারি থেকে নভেম্বরে ৩০৮ জন আদিবাসীর মৃত্যু হয়েছে, যার ভেতর অধিকাংশই শিশু, বয়স পাঁচ ছোঁয়নি। এবং এর সঙ্গে গোল্ড মাইনিংয়ের খুব স্বাভাবিক ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ তীব্র মার্কারি দূষণে মাছেদের থেকে আসা বায়োম্যাগনিফিকেশনে ক্রমশ দ্বিতীয় মিনামাতার দিকে এগোচ্ছে ইয়ানোমামিরা। প্রসঙ্গত, ২০১৭-র ৩ জুলাই রোরাইমা রাজ্যে ভেঙে পড়ে ইয়ানোমামির দিকে যাওয়া একটি ছোট বিমান। বিমানে ছিলেন ইয়ানোমামি রিজার্ভ ও ইল্লিগাল মাইনিং নিয়ে কাজ করা ইবামা’র তিন অফিসার – অ্যানালিস্ট ওলাভো পেরিম গ্যালভাও ও আলেকজান্দ্রে রকিন্সকি ডিকো, সঙ্গে টেকনিশিয়ান সেবাস্টিয়ান লিমা ফেরেরা জুনিয়র। তদন্তে সেভাবে কিছুই না বেরোলেও একটা বড় অংশের সন্দেহ, সেটি আদৌ দুর্ঘটনা ছিল না।

ইয়ানোমামির ভেতর একটি ইল্লিগাল গোল্ড মাইন (ছবিসূত্র – রয়টার্স)

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ বলছে দেশে ২০০২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বৃক্ষচ্ছেদনে মোট ৩০.৭ মিলিয়ন হেক্টর হিউমিড প্রাইমারি ফরেস্ট শেষ হয়েছে, যা ওই সময়ের মোট ট্রি কভার ধ্বংসের (৬৮.৯ মিলিয়ন হেক্টর) ৪৬ শতাংশ। দেশের প্রথম তিনটি বীভৎস বৃক্ষচ্ছেদিত রাজ্য আমাজনাস, পারা ও মাতো গ্রোসোতে ২০০১ থেকে ২০২৩-এ ট্রি কভার শেষ হয়েছে যথাক্রমে ১৭, ১৩.৫ ও ৬.২৯ মিলিয়ন হেক্টর। এই বেআইনি গাছাকাটার প্রসঙ্গে কিছু পরিবেশ-শহিদের কথা। পারা-র পরিবেশ দপ্তরের নির্ভীক অফিসার লুইজ আলবার্তো আরাউজো। ২০১৪ সালে ব্রাজিল নাট অপারেশনের সময় পারা-র নোভো প্রোগ্রেসো অঞ্চলের এক বিরাট অংশের অবৈধ গাছ-লোপাট চক্র ধরিয়ে দিয়েছিল লুইজের টিম। বিখ্যাত ফ্লাইং রিভার অপারেশনের সময় লুইজের নেতৃত্বে পেট্রলিং টিম ফেডারেল পুলিশকে তথ্য দেয়, ধরা পড়ে আলতামিরায় ২৯৪ বর্গকিলোমিটার অরণ্য লোপাট করা কুখ্যাত চোরাকারবার, ইল্লিগাল লগার ‘এজেজে’ – পরিণতিতে মোট ২৪ জনের গ্রেপ্তারি এবং দেশের পরিবেশ-অপরাধের নিরিখে বৃহত্তম আর্থিক জরিমানা, ‘এজেজে’কে দিতে হয় ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথবা বেলো মন্তে ড্যামের মৃত মাছের বীভৎসতা। সত্যি খোঁজার নেপথ্যে সেই লুইজ। গ্রহের চতুর্থ বৃহত্তম বাঁধ বেলো মন্টের অপারেটর নোর্তে এনার্জিয়ার নেতৃত্বে ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁধের অনৈতিক কার্যপ্রণালীর জন্য মৃত ১৬.২ টন মাছকে বাঁধসংলগ্ন আলতামিরায় গোপনে মাটি চাপা দেওয়া হয়, লুইজের টিমের তদন্তে তথ্য উঠে এলে দায়িত্ব নেয় ফেডারেল পুলিশ – পরিণতি নোর্তে এনার্জিয়ার ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা। এইসমস্ত জমছিল। লুইজ জানতেন সময় কমছে। ২০১৬-র ১৩ অক্টোবর বাড়ির সামনেই গাড়ি থেকে নামতে গেছিলেন। স্ত্রী, দুই সন্তানের সামনে হঠাৎ দুজন গানম্যান এবং সাতটা বুলেট। তখনও ড্রাইভার সিটে বসে লুইজ। আলতামিরা পৌরসভার পরিবেশ দপ্তরের প্রধান বছর চুয়ান্নর লুইজ আলবার্তো আরাউজো আর কোনও সিক্রেট পরিবেশ-অপারেশনে যেতে পারেননি। অথবা মারানহাও রাজ্যের পরিবেশকর্মী রাইমুন্ডো ডস স্যান্টোস রডরিগেজ। কিংবদন্তি চিকো মেন্ডিসের স্মৃতিতে চিকো মেন্ডিস ইন্সটিটিউট ফর বায়োলজিকাল কনজারভেশনের অন্যতম পরামর্শদাতা এবং মারানহাওয়ের গুরুপি রিজার্ভের অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য রাইমুন্ডো স্থানীয় পিন্ডারে উপত্যকার বৃক্ষচ্ছেদন নিয়ে সোচ্চার হয়ে ডেথ-থ্রেট পাচ্ছিলেন। ২০১৪-র নভেম্বর ন্যাশনাল অ্যাগ্রারিয়ান ওমবুডসম্যানে রিপোর্ট করেও কেউ পাশে আসেনি। ২০১৫-র ২৫ আগস্ট মারানহো-র বোম জারডিমে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন। মোটরবাইকে পেছনে স্ত্রী মারিয়া। নিজের প্রিয় গুরুপি রিজার্ভ থেকেই বেরিয়ে এসেছিল মৃত্যু। বারোটি গানশট, ধারালো অস্ত্র। আশঙ্কাজনক থেকেও বেঁচে ফেরা মারিয়ার শরীরে, মনে নিয়ার-ফেটাল আঘাতের চিহ্ন, পরিবেশ-শহিদ স্বামীর স্মৃতিভার। রোন্ডোনিয়া রাজ্যের পোর্তো ভেলোর গাছকাটা নিয়ে গলা তুলে লগারদের হিটলিস্টে চলে আসেন অ্যাডেলিনো ‘ডিনহো’ র‍্যামোস। পেশায় সবজি বিক্রেতা ডিনহো ২০১১-র ২৭ মে সবজি বেচার মাঝেই পেলেন ছ’ ছটি ফেটাল বুলেট। এবং এর ঠিক তিনদিন আগেই দেশের পরিবেশ-কর্মী হত্যার নিরিখে অন্যতম আলোচিত হত্যা – পঞ্চাশ পেরনো দম্পতি হোসে ক্লদিও রিবেইরো ডা সিলভা (ওরফে ‘জে ক্লদিও’) এবং মারিয়া ডো এসপিরিটো স্যান্টো। পারা রাজ্যের মারাবা অঞ্চলের নোভা ইপিক্সুনার ২০ হেক্টরের জায়গা জুড়ে থাকা ৫০০ পরিবার ঘেরা প্রায়া আল্টা-পিরানহেইরো অ্যাগ্রো-এক্সট্র্যাক্টিভ প্রোজেক্টের নেতা এবং চিকো মেন্ডিস-খ্যাত সিএনএস সংস্থার অন্যতম সক্রিয় সদস্য হোসে এবং মারিয়া বৃক্ষচ্ছেদন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সরব ছিলেন। ২০০৮ সালে দেশের ইল্লিগাল লগারদের হিটলিস্টের শীর্ষে চলে আসেন দম্পতি। ডেথ-থ্রেট পেয়ে এসেছেন অবশ্য বিগত চোদ্দ বছর ধরেই। পুলিশি নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্টিল উৎপাদনের জন্য পিগ আয়রনের অন্যতম কাঁচামাল চারকোলের জন্য লগারদের লোভনীয় নজর ছিল ক্লদিওদের অ্যাগ্রো-এক্সট্র্যাক্টিভ প্রোজেক্টের গাছেদের ওপর। স্থানীয় এক প্রভাবশালী জমিমাফিয়া-লগারের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে তীব্রতায় পৌঁছেছিলেন দম্পতি। ২০১১-র ২৪ মে নোভা ইপিক্সুনা-র মাকারান্ডুবা-টু সেটলমেন্টে ০.৩৮ ক্যালিবার রাইফেল থেকে মারণ-গুলি পেলেন দুজন, ২৪ বছর ধরে দুজনের কর্মক্ষেত্র প্রায়া আল্টা রিজার্ভের ভেতরেই তাঁদের শরীর খুঁজে পাওয়া গেল পরের দিন। রেখে গেলেন দত্তক নেওয়া ষোলো বছরের ছেলে, হোসের প্রথমপক্ষের দুই সন্তান এবং অগণিত পরিবেশ-উত্তরসূরির লেগ্যাসি। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ফর জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের একটি রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ পারায় যেখানে দম্পতিকে চলে যেতে হয়েছিল, ১৯৭১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সেই অঞ্চলেই খুন হয়েছেন মোট ৫৩৪ জন গ্রামোন্নয়ন কর্মী, যাঁদের ভেতর আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র দুটি হত্যা এখনও পর্যন্ত ট্রায়ালে উঠেছে – এই দুজন হোসে ও মারিয়া। ২০১৩-র ৪ এপ্রিল রায়ে দুই গানম্যানের ৪২ ও ৪৫ বছরের দৃষ্টান্তমূলক জেল হলেও হত্যার মাস্টারমাইন্ড সেই জমিমাফিয়া মুক্তি পেয়ে যায় ‘যথেষ্ট প্রমাণের অভাব’-এ। থেকে যায় আগের বছরেই (নভেম্বর, ২০১০) বিখ্যাত ‘টেড টক’-এ হোসে রিবেইরো-র উচ্চারিত সেই কথাগুলো – ‘আমি যেকোনও মূল্যে অরণ্য বাঁচাবো। এবং এই কারণেই যেকোনও মুহূর্তেই আমার মাথায় একটা বুলেট এসে লাগতে পারে।’

পরিবেশ দপ্তরের অফিসার ও পরিবেশকর্মী লুইজ আলবার্তো আরাউজো (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

পরিবেশকর্মী-দম্পতি জে ক্লদিও ও মারিয়া (ছবিসূত্র – ভাইস)

এবং এই বৃক্ষচ্ছেদন ও কর্মীহত্যা প্রসঙ্গে আমাজন ও সেরাডোর কথা। ভক্স নিউজ সাইটের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-এর ১ আগস্ট থেকে ২০২১-এর ৩১ জুলাই আমাজনের মোট ৩৪,০০০ বর্গকিলোমিটার অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, নেপথ্যে থাকা রাষ্ট্রপতি বোলসেনারো-র প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় মদত। বৃক্ষচ্ছেদনের পাশাপাশি ইবামা’র হয়ে একাধিক সফল অপারেশনে নামা একাধিক পরিবেশ-অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার আত্মঘাতী লেগ্যাসিতে জড়িয়ে যায় সরকারের নাম। উল্লেখযোগ্য, দক্ষিণ পারা-র জিঙ্গু নদী উপত্যকা সংলগ্ন ইটুনা ইটাটা রিজার্ভে ২০১৯-এর ৭,৪৬৭ হেক্টরের বীভৎস বৃক্ষচ্ছেদন ২০২০-তে সম্পূর্ণ শূন্যে নামিয়ে আনার অন্যতম কাণ্ডারি দুই রেঞ্জার রেনে লুইজ ডি অলিভিয়েরা ও হুগো ফেরেরা লসের চাকরি ছাঁটাই। সেই সময়ের বীভৎস গ্রাফ অনেকটাই আয়ত্তে আসে একসময়ের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, পরিবেশকর্মী রাষ্ট্রপতি লুলা ডিসিলভা এবং চিকো মেন্ডিসের সহকর্মী পরিবেশমন্ত্রী ম্যারিনা সিলভার দৃঢ়তায়। দেশের ন্যাশনাল স্পেস এজেন্সির হিসেবে ২০২২-এর ১০,২৭৮ বর্গ কিলোমিটার বৃক্ষচ্ছেদনের হিসেব পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়ে ২০২৩-এ এসে দাঁড়ায় আশাতীত ভাবে ৫,১৫৩-য়। অবশ্য আমাজনের বৃক্ষচ্ছেদন নিয়ন্ত্রণে এলেও আশ্চর্য পরিবেশ আইনের লুপহোলে গ্রহের মোট ফ্লোরা-ফনার পাঁচ শতাংশের মালিক প্রায় ছ’হাজার প্রজাতির গাছে ভর্তি সেরাডো তৃণভূমিতে ২০০২-এর তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি গাছ লোপাট হয়েছে ২০২৩-এ। প্রসঙ্গত এই সেরাডোর বৃক্ষেই অসম্ভব কার্যকর ও দৃঢ় শেকড় ব্যবস্থার জন্য এই অরণ্য ‘আপসাইড ডাউন ফরেস্ট’ নামে খ্যাত, যা মাটির উপরিতলের থেকে পাঁচগুণ বেশি কার্বন জমা করে রাখতে পারে। ২০১৭-র হিসেবে মোট কার্বন সিঙ্ক ১৩.৭ বিলিয়ন টন। ২০২৩-এর ২৯ জুন কার্যকর হওয়া ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডিফরেস্টেশন রেগুলেশন’ আইন আমাজনে কাজ করলেও সেখানে সেরাডোর উল্লেখ নেই। এবং এই সুযোগে সয় কাল্টিভেশন এবং গ্লোবাল উইটনেসের একটি রিপোর্টে জেবিএস-মারফ্রিগ-মিনার্ভা ফুড প্রোসেসিং কোম্পানি-ত্রয়ীর কামড়ে ক্যাটল র‍্যাঞ্চিং ও মিট এক্সপোর্টে ক্রমশ শেষ হচ্ছে সেরাডো। মাতো গ্রোসো – অর্থাৎ দেশের প্রধান মাংস রপ্তানিকারক রাজ্য থেকে মাংস যাচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেনে। এই মাতো গ্রোসোতেই বাসিন্দা-প্রতি ৯টি এবং রাজ্যের মোট হিসেবে ৩২.৮ মিলিয়ন গবাদি পশু। আমাজন ও সেরাডো দুইয়েরই সহাবস্থান এই রাজ্যে। হিসেব বলছে সেরাডোর ক্যাটল র‍্যাঞ্চিংয়ের ৪৩ শতাংশই চলছে অবৈধ গাছ কাটা অংশে, অন্যদিকে রাজ্যের আমাজনীয় অঞ্চলে এই হিসেব মাত্র ১০ শতাংশ। দেশের আশ্চর্য ফরেস্ট কোডে আমাজনে জমিমালিকরা নিজেদের জমির ৮০ শতাংশে সবুজ রাখতে বাধ্য হলেও বিপরীতে সেরাডোতে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ সবুজ রাখার ছাড় – বাকি ৮০ শতাংশে দেদার বাণিজ্যিক কাজের অধিকার। আমাজনের বৃক্ষচ্ছেদনের প্রায় পাঁচগুণ গাছ শেষ হচ্ছে সেরাডোতেই। শেষ হচ্ছে নদীমাতৃক রিবেরিনহো ও ক্রীতদাশ ব্যবস্থার রক্ত বহন করা স্থানীয় কুইলোমবোলা আদিবাসীরা।

চাপাডা ডস গুইমারেসের সেরাডো সাভানায় আগুন (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

মাতো গ্রোসো-র একটি প্রহিবিটেট এলাকায় বেআইনি ক্যাটল র‍্যাঞ্চিং (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

কুইলোমবোলা প্রসঙ্গেই নাজিল্ডো ডস স্যান্টোস ব্রিটো-র কথা। কুইলোমবোলা অর্থাৎ রানঅ্যাওয়ে স্লেভ। ক্রীতদাস ও আফ্রো-ব্রাজিলীয় মিশ্র রক্ত। এই লেগ্যাসির সঙ্গে নাজিল্ডোর ছিল তীব্র পরিবেশবোধ এবং কুইলোমবোলাস এলাকার সবুজ লোপাট করা পাম-অয়েল মনোকালচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। লক্ষ্যে পারায় মাইনিং জায়ান্ট ভেল কোম্পানির সাবসিডিয়ারি পাম অয়েল কোম্পানি বাইপালমা ডা আমাজনিয়া। ২০১৮-র ১৫ এপ্রিল বছর তেত্রিশের এই প্রতিবাদী কর্মীর খুঁজে পাওয়া নিঃস্পন্দ শরীর, মাথায়, পেটে একাধিক মারণ-গুলির চিহ্ন। প্রসঙ্গত পাস্টোরাল ল্যান্ড কমিশনের হিসেবে আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-য় দেশে নিহত মোট  রুরাল ওয়ার্কারের সংখ্যা ৭০, শুধুমাত্র পারা-তেই এই সংখ্যাটি ২১। এই পারা-তেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, উচ্ছেদ ও একটি আলোচিত হত্যা। পরিবেশকর্মী দিলমা ফেরেরা সিলভা। ১৯৭৪ থেকেই পারার টোকানটিনস নদীর ওপর ট্রপিকাল রেইনফরেস্ট অঞ্চলের বৃহত্তম এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইলেক্ট্রোনোর্তে কোম্পানির ৮,৩৭০ মেগাওয়াটের টুকুরাই মেগাড্যাম কাজ শুরু করে, যার দ্বিতীয় পর্বের এক্সপ্যানশন এবং বাসিন্দা-উচ্ছেদের মোট ৩২,০০০টি শিকারের অন্যতম দিলমা এলাকা থেকে উঠে গিয়ে পাঁচ বছর থাকেন সালভাদোর অ্যালেন্দে সেটলমেন্টের নারকীয় পরিবেশে। বিদ্যুৎ, জল, স্যানিটেশন, নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিবহণ – প্রায় কোনওকিছুই না থাকা দেশের পুনর্বাসনের নির্লজ্জ চেহারা অবশ্য নতুন কিছু নয়। খোদ মিনিস্ট্রি অফ মাইনস অ্যান্ড এনার্জির রিপোর্ট বলছে দেশের মোট ৫ লক্ষ পরিবার বিদ্যুৎহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, যার ৭০ শতাংশই আমাজন অঞ্চলের বাসিন্দা। তা বলে মুখোশ খোলা হবে না! ২০১১ সালে ‘ন্যাশনাল মিটিং অফ উইমেন অ্যাফেক্টেড বাই ড্যামস’ জনসমাবেশের অংশ হয়ে ব্রাসিলিয়ার ৫০০ জনের সম্মেলনে যান দিলমা। রাষ্ট্রপতি দিলমা রাউসেফের সঙ্গে দেখা করে ন্যাশনাল রাইটস পলিসির ড্রাফট রিপোর্ট জমা দেন। যদিও কার্যকরী হয়নি কিছুই। তার আগের বছরেই ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের রিপোর্টে অন্যতম মুখ হিসেবে উঠে আসেন দিলমা। দীর্ঘদিনের পরিবেশ-আন্দোলনের পর্দা পড়ে ২০১৯-এর ২২ মার্চ। মার্চের সেই রাতে ‘মুভমেন্ট অফ পিপল অ্যাফেক্টেড বাই ড্যামস’ বা এমএবি-র কোঅর্ডিনেটর সাতচল্লিশ পেরনো দিলমা তাঁর স্বামী ক্লদিয়ানোর কোস্টা ডা সিলভা এবং এক বন্ধু হিল্টন লোপেজের সঙ্গে সন্ধে থেকেই নিজের বাড়িতে আলোচনারত ছিলেন। দিলমাদের বাড়ি থেকে অসম্ভব তীব্র মিউজিক শুনতে পাওয়া যায় সেই রাত থেকেই, যা সেই পরিবারের সঙ্গে কোনওভাবেই মানাচ্ছিল না। ভোরেও শব্দ এতটুকু না কমায় ভয়ঙ্কর কিছু সন্দেহে বাড়ি ঢুকে তিনজনের নিঃস্পন্দ শরীর খুঁজে পান পড়শিরা। ঐতিহাসিক এই হত্যার পাশাপাশি আলোচিত এই হত্যার রায়। দেশের স্বাভাবিক ইমপিউনিটির বিপরীত স্রোতে গিয়ে বছরখানেকের মধ্যেই গ্রেপ্তার হন এক প্রভাবশালী কৃষক-জমিমালিক। প্রায় তুলনীয় আরেকটি হত্যার শিকার রোন্ডোনিয়ার পোর্তো ভেলহোর নিলসে ডিসুজা মাগালহেজ। সাতের দশকে শুরু হওয়া মুভমেন্ট অফ পিপল অ্যাফেক্টেড বাই ড্যামস’ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য ছিলেন নিলসে। মাদেইরা নদীর মৎস্যচাষিদের যথেষ্ট বিকল্প কর্মসংস্থানের দিশা না দেখিয়েই উচ্ছেদ করা জিরাউ ইউসিনা হাইড্রেইলেক্ট্রিকা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন স্থানীয় তরুণী মৎস্যচাষি নিলসা। ২০১৬-র ৭ জানুয়ারি নিরুদ্দিষ্ট হওয়া নিলসের হাত পা বাঁধা অবস্থায় গলিত শরীর ছ মাস পরে ২১ জুন পাওয়া যায় ইউসিনা বাঁধের কাছে জলের মধ্যে। হত্যাকারী চিহ্নিত হলেও মোটিফ সুস্পষ্ট করে চিহ্নিতকরণের প্রকৃত ভারডিক্ট এখনও অন্ধকারে।

২০১১-য় ব্রাসিলিয়ায় ‘ন্যাশনাল মিটিং অফ উইমেন অ্যাফেক্টেড বাই ড্যামস’-এ অন্যান্যদের সঙ্গেএ একবারে সামনে ছবির ডানদিকে দিলমা ফেরেরা সিলভা (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

এইসমস্তর ভেতর ব্রাজিলের পরিবেশ-কর্মী হত্যার সাতকাহন। চিকো-উইলসন-দিলমা-ডরোথি-আরি-গুয়াজাজারা’দের লেগ্যাসির ভেতর কাজ করা এখনও টিকে থাকা বেশ কিছু মুখ। যেমন ২০১২ সালে ১০২ জন গুয়াজাজারা আদিবাসী নিয়ে তৈরি পরিবেশরক্ষক ‘গার্জিয়ান অফ দ্য ফরেস্ট’-এর নেতা, প্রতিষ্ঠাতা কর্মী উনপঞ্চাশ ছোঁয়া অলিম্পিও ইউইরামু গুয়াজাজারা। ৪,১৩,০০০ হেক্টর আরাবোইয়া রিজার্ভ প্রতিদিন টহল দিয়ে ইল্লিগাল লগারদের ক্যাম্প দেখলেই পুড়িয়ে দিচ্ছে অলিম্পিওর নেতৃত্বে গার্জিয়ানরা। তাঁদের চোখে জেদ, ইভিল স্পিরিট থেকে রক্ষা পাওয়ার বিশ্বাস থেকে গোটা মুখে মেখে নেওয়া স্থানীয় উরুকুম বীজের রক্তবর্ণ। জেজিকো, পাওলো, জানিল্ডোদের উত্তরসূরিরা ডেথ-থ্রেট পেয়েও অরণ্য সংরক্ষণে থামেননি। আলতামিরার ২৮ বছরের মেডিকেল ছাত্রী পরিবেশকর্মী জুমা জিপায়ার লড়াইয়ে উঠে আসে লুইজ আলবার্তো আরাউজোর স্মৃতি। বেলো মন্তে মেগাড্যাম এবং নোর্তে এনার্জিয়ার একাধিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হত্যা-চেষ্টা থেকে কোনওরকমে বেঁচে ফিরেও লড়াই ছাড়েননি তরুণী। বুঝেছেন, প্রাণের বিনিময়ে আসলে কিছুই হবে না এদেশে, টিকে থাকতে হবে। বুদ্ধি করে, কৌশলে, আইনের পথে এগোতে হবে। বলছেন, ‘আমি দ্বিতীয় ডরোথি স্ট্যাং হতে চাই না।’

বুলেটের দাগে ক্ষতবিক্ষত আরাবোইয়াদের একটি প্লেকের সামনে পরিবেশকর্মী অলিম্পিও গুয়াজাজারা (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

পরিবেশকর্মী জুমা জিপায়া (ছবিসূত্র – মোঙ্গাবে)

রবার ট্যাপার পরিবারের রক্ত ও উরু-এউ ইন্ডিজেনাস টেরিটরির লেগ্যাসি নিয়ে বড় হওয়া এবং পরে কপ টোয়েন্টি সিক্সের মঞ্চে চলে আসা বছর চব্বিশের জাই সুরুই স্পেনীয় এল পাইস সংবাদপত্রের রিপোর্টে এই মুহূর্তে ব্রাজিলের সবচেয়ে আলোচিত পরিবেশ-কর্মী। তরুণী বলছেন, ‘আদিবাসীরা না থাকলে পৃথিবীতে আর কোনও অরণ্য থাকত না’। ১৯৯২-এর ইয়ানোমামি টেরিটোরির ঐতিহাসিক চিহ্নিতকরণের অন্যতম কাণ্ডারি ডেভি কোপেনাওয়া পেয়েছেন ২০১৯-এর রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। স্টকহোমের পুরস্কার মঞ্চে তীব্র ব্যারিটোনে পঁয়ষট্টি পেরনো আদিবাসী পরিবেশরক্ষক বলছেন – ‘আমরা মানুষ, আমরা ইয়ানোমামি …’। প্রথমবার দেশের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র কোনও মন্ত্রক তৈরি হচ্ছে। আশা-অন্ধকারের দোলায় মনে পড়ছে কবি এলিজাবেথ বিশপের বিখ্যাত ‘সান্তারেম’ কবিতার সেইসমস্ত কথা – ‘মোর দ্যান এনিথিং এলস আই ওয়ান্টেড টু স্টে অ’হোয়াইল/ ইন দ্যাট কনফ্লাক্স অফ টু গ্রেট রিভার্স, টাপাজোস, আমাজন,/ গ্র্যান্ডলি, সাইলেন্টলি ফ্লোয়িং, ফ্লোয়িং ইস্ট …’

পরিবেশকর্মী জাই সুরুই (ছবিসূত্র – গ্লোবাল উইটনেস)

ইয়ানোমামি পরিবেশকর্মী নেতা ডেভি কোপেনাওয়া (ছবিসূত্র – আমাজনিয়া রিয়েল)

 

ঋণস্বীকার

১. Andrzejewski, Cecile (Trans. by Stuber, Sophie). Dom Phillips wanter to ‘Save the Amazon’ – he was killed for investigating illegal fishing. June 1, 2023. Forbidden Stories.

২. Bevins, Vincent. Inquiry launched after mystery air crash kills Brazilian environmentalists. July 28, 2017. The Guardian.

৩. Branford, Sue. Environmental official murdered in Brazilian Amazon. October 17, 2016. Mongabay.

৪. Brazil: crisis in Yanomami territorry, one year after operation to remove goldminers. January 17, 2024. Survival International.

৫. Brown, Sarah. Grassroots efforts and an Emmy-winning film help Indigenous fight in Brazil. January 29, 2024. Mongabay.

৬. Brown, Sarah. In Brazil, an Indigenous land defender’s unsolved killing is the deadly norm. June 27, 2022. Mongabay.

৭. Brown, Sarah. Violence persists in Amazon region where Pereira and Phillips were killed. August 2, 2022. Mongabay.

৮. Calder, Evie. What is the Cerrado – and why is it important for our planet? February 21, 2024. Global Witness.

৯. Cowie, Sam. Calls for justice after latest murder of indigenous Guajajara leader in Brazil. April 3, 2020. Mongabay.

১০. Cowie, Sam. On anniversary of nun’s murder Amazon land rights activists at high risk. February 27, 2020. Mongabay.

১১. Day, Mark. Sr. Dorothy Stang, martyred American nun, remembered at Amazon synod. December 18, 2019. National Catholic Reporter.

১২. Denicoff, Josh & Nielsen, Mia. How Cattle Ranching in Brazil Could Lead to the End of the Amazon. February 7, 2024. IISD.

১৩. Dias, Adriano. Memory: Dionisio Julio Ribeiro Filho. February 22, 2024. C3 Portal.

১৪. Downie, Andrew. Dom Phillips and Bruno Pereira: Brazil police find two bodies in search for missing men. June 16, 2022. The Guardian.

১৫. Downie, Andrew & Briso, Caio Barretto. Bruno Pereira: the dedicated defender of Indigenous rights missing in BraziI. June 8, 2022. The Guardian.

১৬. Espinoza, Venessa Romo & Alvitres, Gloria (Trns. by Salazar, Maria Angeles). Crime and no punishment: Impunity shrouds killings of Indigenous Amazonian defenders. August 17, 2022. Mongabay.

১৭. Gonzales, Jenny. Brazil sacks officials who curbed deforestaion on Amaon indigenous lands. May 5, 2020. Mongabay.

১৮. Gonzales, Jenny. Leading Amazon dam rights activist, spouse and friend murdered in Brazil. March 27, 2019. Mongabay.

১৯. Gregorio, Jana. Activists who sacrificed their lives to save the Amazon rainforest. July 31, 2020. World Atlas.

২০. Hanbury, Shanna. Murders of indigenous leaders in Brazilian Amazon hits highest level in two decades. December 14, 2019. Mongabay.

২১. Langlois, Jill. After two murders, a Brazilian indigenous leader steps up the fight. September 1, 2022. Yale Environment 360.

২২. Luhn, Alec. Historic EU law against deforestation-linked imports ignores Brazil’s Cerrado. December 8, 2022. Mongabay.

২৩. Marcal, Carol. The life and death of the Guajajara. November 8, 2019. Greenpeace.

২৪. Marcelino, Ueslei & Boadle, Anthony. Gold miners bring fresh wave of suffering to Brazil’s Yanomami. January 18, 2024. Reuters.

২৫. Mendes, Karla. Fears over rising violence in Amazon as ‘forest guardians’ battle logging. May 13, 2019. Thomson Reuters Foundation News.

২৬. Mendes, Karla. ‘Guardian of the Forest’ ambushed and murdered in Brazilian Amazon. November 2, 2019. Mongabay.

২৭. Mendes, Karla. Land activist and descendant of slaves slain in Brazil’s Amazon. April 18, 2018. Reuters.

২৮. Montoya, Angelina. Olimpio Guajajara, ‘guardian’ of the Amazon rainforest: ‘With Lula, dialogue will be possible’. September 29, 2022. Le Monde.

২৯. Oliveira, Elizabeth. How an Indigenous family under siege became a symbol of resistance in the Amazon. October 18, 2022. Mongabay.

৩০. Phillips, Dom. Lost tribes: The 1,000 km rainforest mission to protect an Amazon village. August 20, 2018. The Guardian.

৩১. Phillips, Dom. Pollution, illness, threats and murder: is this Amazon factory the link? March 16, 2018. The Guardian.

৩২. Phillips, Dom & Calton, Gary. ‘Miners out, Covid out’: threats to indigenous reserve in Brazil grow. December 29, 2020. The Guardian.

৩৩. Phillips, Tom. Six months after Dom Phillips and Bruno Pereira were murdered, the Amazon remains unsafe for activists. December 5, 2022. The Guardian.

৩৪. Rocha, Jan. Brazil declared forest havens after nun’s killing. February 19, 2005. The Guardian.

৩৫. Speejjens, Peter. Life as an Amazon activist: ‘I don’t want to be the next Dorothy Stang.’ July 13, 2020. Mongabay.

৩৬. The Cerrado crisis: Brazil’s deforestation frontline. February 21, 2024. Global Witness.

৩৭. Watts, Jonathan. Dom Phillips obituary. June 24, 2022. The Guardian.

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *