“শতঞ্জীব রাহার ‘কথাচিত্রকর দীনেন্দ্রকুমার রায়’ যেন এক অবজ্ঞাত সাহিত্য প্রাণ মানুষের বেদনাদীর্ণ হৃদয়ের উন্মোচন। “–লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
গ্রন্থ আলোচনা। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ।
কথাচিত্রকর দীনেন্দ্রকুমার রায়। শতঞ্জীব রাহা। সুপ্রকাশ। মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা।
চরিত্র চিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সংকলক দেবীপ্রসাদ ঘোষ। খড়ি প্রকাশনী। মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা।
বাংলা সাহিত্যের অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে দীনেন্দ্রকুমার রায়(১৮৬৯-১৯৪৩) এক পরিচিত নাম। রবার্ট ব্লেকের স্রষ্টা, অজয় সিংহের কুঠির রচয়িতা, সেকালের স্মৃতির লেখক এবং পল্লীচিত্র বা পল্লীবৈচিত্র্য- এর রূপকার হিসেবে আমরা এতদিন যে দীনেন্দ্রকুমার রায় এর পরিচয় পেয়েছি তা একান্তই খণ্ডিত। দীনেন্দ্রকুমার এর জীবন ও সাহিত্যকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক শতঞ্জীব রাহা তাঁর ‘কথাচিত্রকর দীনেন্দ্রকুমার রায়’ নামক গ্রন্থে। এখানে প্রাবন্ধিক দীনেন্দ্রকুমারের বিপুল পরিমাণ সাহিত্য সৃজন এবং তৎকেন্দ্রিক তথ্যাবলীকে সুনিয়ন্ত্রিত পথে পরিচালনা করেছেন এবং শাসন করেছেন আপন প্রজ্ঞা ও মুন্সিয়ানার মাধ্যমে। এই গ্রন্থে আবিষ্কার করা যাবে কাঙাল হরিনাথের ভাবশিষ্য, শ্রীঅরবিন্দের বাংলা শিক্ষক, জলধর সেনের সঙ্গে অম্ল-মধুর সম্পর্কে আবদ্ধ অন্যান্য এবং অন্য দীনেন্দ্রকুমার রায়কে। তাঁর পল্লী বিষয়ক রচনাগুলি সম্পর্কে গ্রন্থকার লিখেছেন-‘একশ্রেণীর পাঠক তাঁর পল্লী -বিষয়ক রচনার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন বাঙালি জীবনের চিরকালীন সুর। ‘
লেখক ভূমিকায় জানিয়েছেন: “দীনেন্দ্রকুমারের যে দিকটি আমাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, তা হলো মানবিক মূল্যবোধগুলির প্রতি তাঁর আস্থা। …. তাঁর মানবিক মূল্যবোধের আরেকদিকে আছে স্বাভাবিক ন্য়ায়-বিচারের প্রতি তীব্র আগ্রহ।” —ভূমিকাতেই এভাবে বইয়ের মূল সূত্রটি ধরিয়ে দিয়েছেন লেখক।
১৯৯০সালে প্রথম প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। সেই সময় ‘দেশ’ সহ বিভিন্ন সাময়িক পত্রে উচ্চ প্রশংসা লাভ করে। পুরোনো দেশ ঘাঁটতে ঘাঁটতেই বইটির সন্ধান পেয়েছিলাম, বইটির শুরু হয়েছিল খোঁজ আমার নিজের পড়াশোনার প্রয়োজনেই। এক ন্যাশানাল লাইব্রেরি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায়নি বইখানি তখন। সাম্প্রতিকে সুপ্রকাশ পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে আমাদের ধন্যবার্দাহ হয়েছেন।
পরিশিষ্ট এই গ্রন্থের বিশেষ সম্পদ। “লোকসংস্কৃতি ও দীনেন্দ্রকুমার” এই গ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়েছে।পরিশিষ্টে রবার্ট ব্লেকের উৎস-সন্ধানেও অগ্রসর হয়েছেন লেখক। প্রায়-বিলুপ্ত দীনেন্দ্রকুমারের গুরুত্বপূর্ণ অজস্র লেখার খোঁজ দিয়েছেন আলোচক। বাংলা সাহিত্য়ের উনিশ শতক চর্চায় এই গ্রন্থ অপরিহার্য বলেই বিবেচিত হবে।
এই সূত্রে’ খড়ি প্রকাশনী’থেকে প্রকাশিত দীনেন্দ্রকুমার রায়-এর চরিত্র সংকলন ‘চরিত্র চিত্র’ -এর কথা বলা যেতে পারে। এই সংকলনের নয়টি গল্পের মধ্যে পাঁচটি গল্প নেওয়া হয়েছে ১৯২৩সালে প্রকাশিত ‘পল্লী চরিত্র’ গ্রন্থ থেকে। পেয়াদা, সেকালের ডেপুটি, রাতচোরা গরু, দত্ত গিন্নি এই গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য গল্প। ‘দীনেন্দ্রকুমারের গল্পে আছে সাধারণ মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের কথা, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালো-মন্দ এবং সঙ্গতি-অসঙ্গতির কথা'(কথাচিত্রকর দীনেন্দ্রকুমার রায়, শতঞ্জীব রাহা) । -উক্তিটি আলোচ্য গল্পগুলি সম্পর্কে যথার্থ। একথাও বলা যেতে পারে যে গল্প সংকলনটি যেন প্রাচীন পল্লী জীবনের বহু বর্ণিল চিত্রের এক বিচিত্র অ্যালবাম।