ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। চতুর্থ পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।
ষাটের দশকে এই প্রাইভেট ট্যুর গুলি ফিরে আসার সূত্রপাত ঘটেছিলো সম্পূর্ন এক ভিন্ন ঘটনাক্রমে। আর তা হলো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী নীতি। দক্ষিণ আফ্রিকা কোনোকালেই অ-শ্বেতাঙ্গদের সুযোগ দিতো না।
ক্লারি গ্রিমেটের প্রশংসা সত্ত্বেও টালিএপ সালি একটাও টেস্ট খেলার সুযোগ পান নি। মালয়ের ওয়ালি হ্যামন্ড বলে বিখ্যাত ডল ফ্রিম্যান, সেস আব্রহাম, আবেদ ভাইয়েরা, মালয় ক্রিকেট বোর্ডের ধ্বংসাত্মক ফাস্ট বোলার এরিক পিটারসন, বান্টু ক্রিকেট বোর্ডের বেন মালম্বা, এরিক মাজোলা, জর্জ লাঙ্গা কেউ কিছু সুযোগ পাননি। এরিক রোয়ানের সমকক্ষ বোলার ফ্রাঙ্ক রোরো বা প্রথম যে ক্রিকেটার (অবশ্যই অ- শ্বেতাঙ্গ হিসেবে) দুর্দান্ত খেলে নজর কাড়েন সেই ক্রোম হেন্ড্রিক্স কেও নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ চেহারার জন্য একমাত্র কালার্ড ক্রিকেটার তাঁর খেলেছিলেন তিনি হলেন বাক লেওয়েলিন। ১৬ বছরে ১৫টি টেস্ট খেলেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা আশা করেছিলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্টরা জিতবে ও আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ গোটা আফ্রিকায় ছড়ি ঘোরাবে। কিন্তু তাঁদের এই আশা পূর্ণ হয়নি। যদিও অসম্ভব সব আইন তারা প্রণয়ন করতে শুরু করে। মিশ্র বিবাহ বন্ধ করে দেয়, আদম-শুমারির সময় গায়ের রং এর নথিভূক্ত করন, আলাদা আলাদা গোষ্ঠীর জন্য আলাদা এলাকা করে দেওয়া, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করন, সাধারণ ভোটারদের তালিকা থেকে কালার্ডদের অপসারন, বান্টু নির্মাণ কর্মীদের নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখা, যখন তখন কৃষ্ণাঙ্গদের তাদের সম্পত্তি বা জমি বা বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ, বান্টুদের প্রতিনিধিত্বমূলক কাউন্সিল উচ্ছেদ করা হয়, তাদের শিক্ষা, বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, এমনকি চাকরি বা ব্যবসা করাও সীমিত সুযোগে আটকে দেওয়া হয়, শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, আলাদা বাস, রাস্তা, করে দেওয়া হয়। বান্টুদের আটটি আলাদা গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়, সমস্ত উন্নত এলাকা থেকে কালার্ড দের বের করে দেওয়া হয়।
সারা দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল এই নীতির বিরুদ্ধে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মাধ্যমে এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান নেলসন ম্যান্ডেলা। কিন্তু তাঁকেও সাতাশ বছর ধরে আটকে রাখে বর্ণবিদ্বেষী নীতির শাসকেরা।
ইতিমধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একাধিক রাষ্ট্র এর বিরোধিতা করে কমনওয়েলথ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বহিষ্কার দাবী করে। সঙ্গে একাধিক রাষ্ট্র সমর্থন করে। ইংল্যান্ডের পরামর্শক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেই বেরিয়ে যায় কমনওয়েলথ থেকে ১৯৬১ সালে। ফলে আই সি সি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে দক্ষিণ আফ্রিকা আর সরকারীভাবে ততদিন পর্যন্ত খেলতে পারবে না, যতদিন না কমনওয়েলথ এর সদস্য হয়। নিয়মিত ক্রিকেটের ইতিহাসের খবর রাখা ব্যক্তিরা জানেন ভারতকেও একই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল- যখন নতুন সংবিধান গ্রহণের কাজ চলছিল- কারণ তখনও ঠিক হয়নি ভারত কমনওয়েলথ এ থাকবে কিনা। পরে ডি মেলো নেহেরুর সাথে দেখা করে আশ্বাস পান এবং ভারত থেকে যায় যেকারণে এম সি সি ১৯৪৯-৫১ ভারতের সাথে খেলেনি এবং তার বদলে বেসরকারি টেস্ট খেলে কমনওয়েলথ দল।
স্বভাবতই এই নিয়মে দক্ষিণ আফ্রিকার-ও সরকারি টেস্ট খেলার কথা নয়। কিন্তু তাঁরা আই সি সিকে নিয়মটি পাল্টানোর কথা বলে। ইংল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন করে। ভারত,পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বিরোধিতা করে। দক্ষিণ আফ্রিকার ভোটাধিকার তখন নেই। ফল সমান। আই সি সি সিদ্ধান্ত নেয় ওই সময়ের থেকে যতক্ষণ না সিদ্ধান্ত হচ্ছে ম্যাচগুলো বেসরকারি ধরা হবে।
এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই দক্ষিণ আফ্রিকা সাসপেন্ড হয়। দুই দশক পরে ফিরে এসে সরকারি টেস্ট খেলা শুরু করে। কিন্তু ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ এর টেস্ট নিয়ে আই সি সি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় নি। ফলে ঐ সব টেস্ট আসলে আজও বেসরকারি।
শ্বেতাঙ্গ দেশ গুলির ক্রিকেট পত্রিকা (উইসডেন, পেলহ্যাম বুক, দ্য ক্রিকেটার) ও ইতিহাস-পরিসংখ্যানবিদেরা এগুলিকে জোর করে সরকারি টেস্ট ধরতে থাকে। সচেতনতা না থাকায় ভারত,পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে কোনো প্রতিবাদ আসেনি।
ফলে গ্রেম পোলোক, পিটার পোলোক, ব্যারি রিচার্ডস,মাইক প্রোক্টর, জন ট্রাইকস একটাও সরকারি টেস্ট না খেলেও টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে যান। ব্যারি তো টেস্টে ব্র্যাডম্যানের পর সবথেকে বেশি গড় পেয়েছেন।
বাঙালী ক্রিকেট লিখিয়েরা প্রথম থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। মতি নন্দী তাঁর একমাত্র ক্রিকেট পরিসংখ্যান এর বই Cricket Records (১৯৬৬ সালে প্রকাশিত) এর ভূমিকায় এগুলিকে সরকারী টেস্ট ধরবার পক্ষে মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছিলেন – ‘I have included the South African Test record to date, although that country ceased to be a full-fledged member of the Imperial (now International) Cricket Conference in 1961, the year they left the Commonwealth.To overlook the performance, by or against them, I thought , would leave a serious gap in the thrue record. ‘ নিশ্চিতভাবে এই বক্তব্য ছিল তৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাপী চলা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিপন্থী।
অথচ আরেক ক্রিকেট লিখিয়ে, যাঁকে আমরা অনুবাদক হিসেবেই চিনি, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় টেস্ট-ক্রিকেটের কাহিনী’-র তৃতীয় খণ্ডের শুরুতেই (পৃষ্ঠা-২) কিন্তু প্রশ্ন তুলেছিলেন সেই ১৯৭৮ সালেই -‘কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার সদস্য হওয়া না-সত্বেও অস্ট্রেলিয়া, ইংলন্ড এবং নিউ-জিল্যান্ডের খেলোয়াড়দের ‘সরকারি’ খতিয়ানে ঐ সব দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলাকে মানা হয়? কেন তবে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের বা পাকিস্তানের খেলাকে সরকারি টেস্ট খেলা বলে মানা হবে না ? ‘— এবং ঘটনা হলো যে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকা ১৯৬১-১৯৬৯ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিটি টেস্ট কে বেসরকারি বলেই লিখেছিল।
পাঠক, ভেবে দেখুন এই ঘটনা যখন চলছে তখন একদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ধীরে ধীরে ক্রিকেটীয় জগতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছিল। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মার্কসবাদী সাহিত্যিক ও ক্রিকেট লেখক সি এল আর জেমস নিজের দেশের নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার কে করতে হবে এই দাবী তোলেন। নির্বাচনের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে এই ইস্যুটি মর্যাদা লাভ করে, এবং তার ফলস্বরুপ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক নির্বাচিত হন ফ্র্যাঙ্ক ওরেল।
ঠিক তখনই ‘ গোকুলে বেড়ে উঠছেন’ পর্তুগীজ- ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার বেসিল ডি অলিভিয়েরা। তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার কালার্ড ক্রিকেট দলে নিয়মিত খেলতে দেখা যাচ্ছে। বেসিল ডি অলিভিয়েরা ওরফে ডলি ১৯৫১-১৯৬০ এর মধ্যে স্থানীয় ক্লাব ও প্রতিনিধিত্বমূলক ম্যাচে ৮২টি শতরান করেন যার মধ্যে ১৬ বছর বয়সে করা একটি ডবল সেঞ্চুরি ছিল, স্থানীয়দের মতে এর জন্য সময় লেগেছিল মাত্র ৬৫-৭০ মিনিট। অথচ তাঁকে কোনভাবেই দক্ষিণ আফ্রিকা দলে নেওয়া হয় নি, ফলে তিনি জন আর্লটের সাহায্যে ইংল্যান্ডে চলে যান, ডার্বিশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলা শুরু করেন, ৩৪ বছর বয়সে টেস্টে অভিষেক হয়, ৪০ বছর বয়স অবধি টেস্ট খেলে ৪০.০৬ গড়ে ২৪৮৪ রান করেন (৫/১০০-১৫/৫০)। ৪৮ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির খেলায় ৩৬৭ ম্যাচে ১৯,৪৯০ রান করেন ও অনিয়মিত বোলিং করে ৫৪৮ উইকেট পান।
১৯৬৮-৬৯ সাল নাগাদ শুরু হয় সমস্যা। ইংল্যান্ড দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট খেলতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমেই ডলি কে দল থেকে বাদ দিতে চাপ দেয়। এম সি সি চাপে পড়ে ডলি কে বাদ দিয়ে দেয়। এবার ক্রিকেটীয় জগত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিতর্ক তৈরী হয়, বহু এম পি প্রতিবাদ করেন। এমনকি গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় তে লেখা হয় “Any who would swallow that would believe the moon was a currant bun.” টম গ্রেভনী পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ডলি কে দলে না নিলে তিনিও যাবেন না।
এতক্ষন দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বেশ খুশি ছিল, কিন্তু হঠাৎ ডলির দলভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় তাঁরা চিন্তিত হন। ইতিমধ্যে এম সি সি হুমকি চিঠি পায়, বেসিল ডি অলিভিয়েরা দলে থাকলে প্লেন উড়িয়ে দেওয়া হবে। এদিকে হঠাৎ ই ডার্বিশায়ারের মিডিয়াম পেসার টম কার্টরাইট অসুস্থ হলে ডলি টিমে ডাক পান।
পরের দিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী ভরস্টার সরাসরি জানিয়ে দেন যে এমন কোনও দলকে তাঁরা দেশে ঢুকতে দিতে চান না যারা ক্রিকেট খেলতে নয়, রাজনীতি করতে এসেছে। তিনি এও বলেন যে এম সি সির এই দলটা এম সি সি নয়, এটা বর্ণবাদ বিরোধী দল।
সারা বিশ্ব এই বিবৃতির চরম নিন্দা করে, দেশের গণমাধ্যম সরাসরি বলে দেয় এর ফলে হয়ত একঘরে করে দেওয়া হবে, তাও ভরস্টার শুনতে রাজি ছিলেন না, এক গুয়েমি দেখান, এক সপ্তাহ পর সফর পরিত্যক্ত হয়।
এর এক বছরের মধ্যে ‘স্টপ দ্য সেভেন্টি ট্যুর’ আন্দোলন দুই দশকের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাকে সবরকম খেলার জগৎ থেকে বহিষ্কার করে দিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে আলোচনা করে দেখতে হবে বিষয়টি কে। তবে সেই আলোচনায় মুখবন্ধ হবে আরেকটি বিষয়, যা একই রকমভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিষয়।
‘দ্য স্টপ সেভেন্টি ট্যুর’ আন্দোলন সফল হওয়ার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইংল্যান্ড সফর বাতিল হয় ও দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ক্রিকেট থেকে বহিষ্কৃত হয়। তার বদলে বিশ্ব একাদশ ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে পাঁচটি টেস্ট খেলে, যা প্রথমে টেস্ট বলে মর্যাদা পেলেও পরে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ওই সফরের শেষে এডি বার্লো সোবার্স কে রোডেশিয়ায় (বর্তমান জিম্বাবোয়ে) ডবল উইকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সোবার্স দেশটিতে ‘বর্ণবৈষম্য’ চলছে কিনা জেনে নিয়ে রাজি হয়ে যান (যদিও এটা তিনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে বলেছেন, সেই সময় একেবারেই উচ্চারণ করেননি)।
জিম্বাুবুয়ে – প্রাক্তন দক্ষিণ রোডেশিয়া, নামকরণ হয়েছিল এক ধনলোভী সাম্রাজ্যবাদী লম্পট সিসিল রোডসের নামে। তিনি রোডেশিয়াকে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশ করে রাখেন। পরে উত্তর অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে জাম্বিয়া নাম নিলেও ইংল্যান্ড মানতোই না। উল্টে রোডস কলকাঠি নেড়ে বহু অশ্বেতাঙ্গদের দলভুক্ত হওয়া থেকে আটকায়। আসা যাক ঘটনায়।
৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭০। সোবার্স লন্ডনে জানালেন যে তিনি মাসোনাল্যান্ড ক্রিকেট এসোসিয়েশনের ডাকে খেলতে যাচ্ছেন। ১২ই সেপ্টেম্বর বার্বাডোজ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফ্রাঙ্ক ওয়ালকট, যিনি একজন প্রাক্তন প্রথম শ্রেণির আম্পায়ার, এই খেলতে যাওয়াকে সমালোচনা করে বিবৃতি দিলেন যে হাজার হাজার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানের হৃদয়ের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি সোবার্স এমন কিছু করতে পারেন না যার ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্বের ক্রিকেট খেলা যার মাধ্যমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতি স্বত্বা ফুটে ওঠে তা ক্ষুণ্ন হয়। সোবার্স গুরুত্বই দিলেন না।
আলি বাখারের সঙ্গে জুটি বেঁধে খেলেও কিন্তু জিততে পারেননি সোবার্স, কারণ বিমান থেকে নামার পর বিশ্রাম পেয়েছিলেন মাত্র দু’ঘন্টা। যদিও বিপুল সংবর্ধনা ও ৬০০ পাউন্ড পারিশ্রমিক পান। রোডেসিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়ান স্মিথের তিনি প্রশংসা করেন এবং ইয়ান স্মিথও তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি এও বলেন যে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড় রা বিশ্বমানের। তাঁরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে খেলতে চান। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যদি বিশ্ব একাদশ খেলতে আসে তাহলে ভালোই হবে।
এদিকে, ১৯৭০ সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের একটি খবরের কাগজ এই খবর প্রকাশ করার পর থেকেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে উত্তেজনা বেড়ে যায়। ১২ সেপ্টেমর প্রাক্তন প্রথম শ্রেণির আম্পায়ার ও বার্বাডোজ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফ্র্যাঙ্ক ওয়ালকট যে বিবৃতি দেন তাতে তিনি সোবার্স কে অধিনায়ক পদ সরিয়ে দেওয়ারও দাবি করেন ভার্জিন আইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রে।
জলঘোলা শুরু হলো যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট বোর্ডের সম্পাদক পিটার শর্ট জানিয়ে দেন এটা সোবার্সের নিজস্ব ব্যাপার। বোর্ডের মাথা গলাবে না। সোবার্স যখন দেশে ফিরে আসেন, বিমানবন্দরে গণমাধ্যমের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিল।
মাইকেল ম্যানলি (রাজনৈতিক নেতা ও ক্রিকেট লেখক) বিবৃতি দেন যে ক্ষমা না চাইলে কোথাও যেন সোবার্স কে অভ্যর্থনা না করা হয়। যে কোনো খেলার থেকে ক্যারিবিয়ান জনগণের জন্য ন্যায় অনেক বেশি কাম্য।
অ্যান্টিগা লেবার পার্টির মুখপত্ৰ ‘ওয়ার্কার্স ভয়েস’ সোবার্সকে ‘আ হোয়াইট ইন ব্ল্যাক ম্যান’ তকমা পর্যন্ত দিয়ে বসে। ‘দ্য এজ’ দাবি করে, দুনিয়ার সর্বত্র আফ্রিকান ও বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোকেদের আনুগত্য সোবার্স হারিয়েছেন। তাঁকে কেউ বিশ্বাস করছেন না।
সোবার্স এর কোনও কিছুকেই বিশেষ আমল দেননি। উল্টে বিমান বন্দরে নেমে তিনি দাবি করেন, তিনি এভাবে কিছু ভেবে দেখেননি। ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলেন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে। রাজনীতিবিদ হিসেবে যাননি। রোডেশিয়ার কোথায় কি হচ্ছে তা তিনি জানতে চান না। এমনকি এও বলেন যে তিনি প্রথমেই ভেবেছিলেন যে ব্যাপারটি তাঁর পক্ষে যথেষ্ট ভালো ব্যাপার। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে রোডেশিয়া অনেক ভালো। ইয়ান স্মিথ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ভুয়সী প্রশংসা করেন।
যথারীতি দুনিয়া জোড়া বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মানুষ ও গণমাধ্যম এটাকে ভালো চোখে দেখলো না আর সোবার্স তাঁদের এই আবেগ ও লড়াইকে ‘মিডিয়া হাইপ’ গোছের বিষয় হিসেবে দেখে নিজের আত্মজীবনীতে অভিযোগ করেন যে তাঁর ‘সরল উক্তি’ কে নিন্দা করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। সোবার্স ভেবেছিলেন যে সাংবাদিক সম্মেলন বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটাবে কিন্তু সমস্যাটা আরও বেড়ে গেলো।
Antigua-র ‘দ্য ওয়ার্কার্স ভয়েস’ সংবাদপত্র সোবার্স কে ‘কৃষ্ণাঙ্গ হয়েও একজন শ্বেতাঙ্গ’ বলে বর্ণনা করলেন। আরেক সংবাদপত্র ‘Antigua Star’ সরাসরি বলে বসলো যে সমস্ত রকমের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন চলছে, সোবার্সের কাজ সবথেকে নিষ্ঠুর ভাবে আঘাত হেনেছে।
তবে কেউ কেউ সোবার্সের পক্ষ নিয়েছিলেন যেমন একসপ্তাহ বাদে (১৫-১৬ সেপ্টেম্বর) হেক্টর উইন্টার , জ্যামাইকার স্বরাষ্ট্র, যুব ও কমিউনিটি উন্নয়ন মন্ত্রী বললেন যে সোবার্স নিজের সঙ্গে সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গেও অন্যায় করছেন।
বিষয় জটিল হয়ে গেল যখন ১০ই অক্টোবর , ১৯৭০ – গায়ানার প্রধানমন্ত্রী ফোর্বস ব্রুনহ্যাম বলে বসেন, সোবার্স গায়ানায় ঢুকতে পারবেন না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রতিটি সফরে জর্জটাউনে একটা করে টেস্ট খেলে। ব্রুনহ্যাম সরাসরি বলে বসলেন যে ‘আমাদের রক্তের সম্পর্কের এক ভাই, ইয়ান স্মিথের দূত হিসেবে কাজ করছে’। গায়নার ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কেনি উইশহার্ট সোবার্স কে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন, কিন্তু পিটার শর্ট বলে বসলেন ক্ষমার প্রশ্নই ওঠে না।
এইবার মাঠে নামলেন বার্বাডোজের উপপ্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন টিউডোর্স। তিনি বললেন, ‘ To say, as some say who should know better, that he would not be welcomed in their country is an affront to the people of Barbados’. ডঃ ছেদি জগন নামে এক গায়নার প্রোগ্রেসিভ পার্টির নেতা সোবার্সের পদত্যাগ দাবি করলেন। ব্রুনহ্যাম ক্ষমা চাইতে বললেন সোবার্স কে।
১৪ই অক্টোবর, ঘটনাবহুল দিন। গায়নার সরকারে থাকা দল লেবার পার্টি প্রস্তাব পাশ করালো, সোবার্সকে অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হবে। বিরোধী দল পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নেতা মাইকেল ম্যানলি – ক্ষমা না চাওয়া অবধি সোবার্স কে যাতে কোথাও জনতা গ্রহণ না করে, এমন দাবি করলেন। ম্যানলি কিন্তু ক্রিকেটপ্রেমী ও ক্রিকেটের বিষয়ে একাধিক বই লিখেছিলেন।
১৯শে অক্টোবর পিটার শর্ট জানালেন ব্রুনহ্যাম তাঁর দাবীতে অনড়, কাজেই ক্ষমা না চাইলে সোবার্স ওই দেশে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কদিন বাদেই ত্রিনিদাদের বিরোধী দলনেতা ভাৰ্নন জমাদার বললেন তিনি গ্যারির শান্তভাব কে সম্মান জানাচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের আবর্জনাময় রাজনীতির প্রত্যুত্তর হিসেবে। এছাড়াও বার্বাডোজের বিরোধী দলের এক সাংসদ, লায়নেল ক্রেগ সোবার্স কে সমর্থন করলেন।
ঠিক এইসময় ভারতে ইন্দিরা গান্ধী বিবৃতি দেন, সোবার্সকে বাদ না দিলে ১৯৭১ সালে ভারতের যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর রয়েছে তা বাতিল হবে। এরপরেই নড়েচড়ে বসে ওয়েসলি হল। তিনি ত্রিনিদাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। এরপরেও জামাইকার পক্ষ থেকে সোবার্সের পদত্যাগ চাওয়া হয়। গায়নায় টেস্ট না হলে, বা সোবার্স বাদ পড়লে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঐক্য ক্ষুন্ন হবে এমনটা ভাবা শুরু হয়। অবশেষে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী এরিক উইলিয়াম চিঠি (মুচলেকা)লিখে ওয়েসলি হলের হাত দিয়ে পাঠালে সোবার্স তাতে সই করে দেন ও এই সমস্যা সমাধান হয়।
ব্রুনহ্যাম চিঠিটিকে গ্রহণ করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। বোর্ডও জানিয়ে দেয়, তাঁরা সোবার্সের কাছে কোনো চিঠি চাননি এবং সোবার্স নিজেই চিঠি দিয়েছেন। এরপরে জর্জটাউনে খেলতে কোনও বাধা ছিল না। বাধা ছিল না ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের। উলটে জর্জটাউনে দ্বিতীয় ইনিংসে সোবার্সের ১০৮ রান তাঁকে টেস্টে প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যান হিসেবে ৭০০০ রান তুলতে সাহায্য করে। তখন গোটা মাঠ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করে।
সেই ১৯৭১-এর সফরে যায় এবং সেই সফরেই উত্থান হয় সুনীল গাভাসকারের। সোবার্স সেই সিরিজে গাভাসকারের বেশ কিছু ক্যাচ ফেলেছিলেন। তবে সোবার্সের এই পদক্ষেপ ’৮০ র দশকের দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের রেবেল টুরের পথ খুলে দেয়। এই সমগ্র ঘটনায় ক্রিকেট ছিল নেহাতই ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিষয় হয়ে।
এবারে ১৯৬০ এর দশকে প্রাইভেট সফর গুলির ট্রেন্ড বা ঝোঁক দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে ঠিক কি হচ্ছিল। ১৯৬১ সালের মার্চে ই ডব্লু সোয়ানটন দল নিয়ে গিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। চারটি প্রথম শ্রেণি সহ বেশ কিছু ম্যাচ খেলেন তাঁরা। দলে ভারত, পাকিস্তান ও ইংল্যাণ্ডের ক্রিকেটাররা ছিলেন।
ওই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স। কোনও অ-শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার দলে ছিল না। রোডেসিয়া, ট্রানসভাল, নাটাল, ইস্ট অফ্রিকার বিরুদ্ধে খেলেন তাঁরা। লক্ষনীয় ভাবে পূর্ব আফ্রিকা ছাড়া সব ম্যাচের স্কোর পাওয়া যায়। কারণ পূর্ব আফ্রিকা দলে অ-শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটাররা ছিলেন। একই রকম ভাবে পরের বছর যখন এফ আর ব্রাউনের দল খেলতে গেলো পূর্ব আফ্রিকায় তখনও কোনও ম্যাচের স্কোর পাওয়া যায় না। এই বৈষম্য ছিল প্রাইভেট ট্যুর গুলির বৈশিষ্ট্য।
তবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি শুরু হলো অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধের ফল হিসেবে। যা এই প্রাইভেট ট্যুর বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ তথা ক্রিকেট বোর্ড অনুমতি বিহীন সফর তথা খেলা গুলির সংখ্যা বাড়িয়ে ছিল। ঠিক অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের মতো স্বল্প সময়ের ক্রিকেট আরও যুক্তিগ্রাহ্য নিয়মের বাঁধনে বেঁধে যখন ফিরে এলো, তখন সেই পদ্ধতি আজকের অতি স্বল্প সময়ের ক্রিকেটের সুদূর পূর্বসুরীই ছিল বলে মনে। ব্যাপারটা কেমন ছিল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে ক্রিকেটে ব্যাপক মন্দা এলো। আন্তর্জাতিক ম্যাচ অর্থাৎ টেস্ট ম্যাচ ছাড়া মাঠে লোক হচ্ছিল না। এখন যেমন আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে ঘরোয়া ক্রিকেট এর একটা বড় খরচ ওঠে, তখন ব্যাপার ছিলো উল্টো। ঘরোয়া ক্রিকেটের অর্থের যোগান আন্তর্জাতিক ম্যাচ সংগঠিত করতে সাহায্য করতো। ফলে কাউন্টি ম্যাচ সংগঠিত সমস্যা শুরু হয়।
এই সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী এম সি সি সীমিত ওভারের খেলা শুরু করে। প্রথমে ১৯৬২ সালে লিস্টারশায়ার, নটিংহ্যামশায়ার, নর্দাম্পটনশায়ার ও ডার্বিশায়ার এর মধ্যে শুরু হয় মিডল্যান্ড নক-আউট কম্পিটিশন। ব্যাপক সাড়া ফেলে, টিভি সম্প্রচার হয় এই টুর্নামেন্টের। এম সি সি সিদ্ধান্ত নেয় বড় আকারের টুর্নামেন্ট করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের পয়লা মে শুরু হলো জিলেট কাপ।
সীমিত ওভারের ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্যাপক ভাবে। আস্তে আস্তে সীমিত ওভারের খেলা সর্বত্র শুরু হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও একে কিভাবে প্রয়োগ করা যায় তাই নিয়ে ভাবনা শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে জিলেট কাপ জয়ী ইয়র্কশায়ারকে সুযোগ করে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার, কিন্তু ম্যাচটি বৃষ্টির জন্য হয়নি। আবার ওই বছরেই ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ইংল্যান্ড ট্যুর করে, সবকটি ম্যাচ ছিলো ৪০ ওভারের। এর মধ্যে সাসেক্সের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ তাঁরা খেলেন, সেই ম্যাচে সাসেক্সের হয়ে মনসুর আলী খান পতৌদি খেলেছিলেন, এবং শেষ ম্যাচ টি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে ম্যাচে গ্যারি সোবার্স ৬১ করেন।
পরে নব্বইয়ের দশক থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ গুলির মধ্যে যে গুলি প্রথম শ্রেণির দল খেলে সেগুলিকে লিস্ট এ ম্যাচ বলা হয়। এই ‘লিস্ট এ’ তকমাটির আবিষ্কার করেন এসোসিয়েশন অফ ক্রিকেট স্ট্যাটিস্টিয়ান আ্যন্ড হিস্টোরিয়ান নামে একটি সংস্থা। ২০০৬ সাল থেকে ICC এই তকমা সরকারিভাবে মেনে নেয়। প্রতিটি একদিনের আন্তর্জাতিক কিন্তু লিস্ট এ ম্যাচও বটে। জিলেট কাপ লিস্ট এ ম্যাচ ছিলো কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স দলের কোনো খেলাই এই স্বীকৃতি পায়নি, যদিও এই ম্যাচ গুলি সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়। সম্ভবতঃ পতৌদির শেষ নবাব-ই প্রথম ভারতীয় যিনি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেন।
১৯৬৬ সালে জিলেট কাপ জেতে ওয়ারউইকশায়ার। সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলে। এছাড়া সারের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলে একটি একদিনের ম্যাচ আয়োজন করা হয়। যথারীতি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স সফর করে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলে। এরই মধ্যে রথম্যান্স ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাপ খেলা হয়। বিশ্ব একাদশ ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিলে অঘোষিত ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ম্যাচ প্রকৃত অর্থে প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ হওয়ার যোগ্য কিন্তু এই ম্যাচের এমনকি লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।
৪ঠা মার্চ, ১৯৬৭। জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫০ ওভারের খেলায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩২৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জিতে যায়। মজার ব্যাপার ঐ সফরের টেস্ট ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে ধরা হলেও এই ম্যাচটি odi স্বীকৃতি পায়নি, যদিও লিস্ট এ স্বীকৃতি পায়। আসলে ওই সময় কমনওয়েলথ এর বাইরে চলে যাওয়ায় আইসিসি এই ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা একপ্রকার জোর করে একে টেস্ট ধরে। যেহেতু তখন odi বা লিস্ট এ সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিলো না তাই এই ম্যাচ লিস্ট এ হিসেবে পরে ধরা হলেও odi স্বীকৃতি পায়নি।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রথম্যান্স ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট কাপ জেতে। এখানেও ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান লিস্ট এ বা একদিনের আন্তর্জাতিক ধরা হয়নি। যদিও পাকিস্তান কেন্টের বিরুদ্ধে একটা লিস্ট এ খেলে, পাকিস্তানের সব ক্রিকেটারের লিস্ট এ ক্রিকেটে ডেবিউ হয়। ভারত ও ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স এর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে ৪০ ওভারের।
১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে এই প্রায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলতে পারেনি। আসলে এই সময় প্রায় সব ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার কাউন্টি খেলতে ইংল্যান্ডে থাকতেন। ফলে প্রদর্শনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম নিয়ে এরা খেলতেন বোর্ডের অনুমতি ছাড়া। সম্ভবতঃ এই কারণে এই ম্যাচ গুলির কোনও লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।
১৯৭০ সাল থেকে জিলেট কাপের পাশাপাশি জন প্লেয়ার লীগ চালু হয়। সব সিনিয়র কাউন্টি দল একে ওপরের বিরুদ্ধে খেলে। জিলেট কাপে কিছু মাইনর কাউন্টি দলও খেলে। এরপরেই বছরেই ইতিহাস তৈরী হয়।
১৯৭০/৭১ মরশুমে এম সি সি গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ৭ টি টেস্ট খেলা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মেলবোর্ন এর তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে শেষ দিন দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য ৮ বলের ৪০ ওভারের ম্যাচ খেলা শুরু হয়। জিওফ বয়কট, জন এডরিচ, কিথ ফ্লেচার, বেসিল ডি অলিভিয়েরা, কলিন কাউড্রে, রে ইলিংওয়ার্থ, জন স্নো, এলান নট, প্রভৃতি মূলতঃ টেস্ট খেলে বিখ্যাত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা খেলতে নামেন বিল লরি, ইয়ান চ্যাপেল, ইয়ান রেডপাথ, গ্রেগ চ্যাপেল, রডনি মার্শ, ডগ ওয়াল্টার্স, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, কিথ স্ট্যাকপোলদের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ৪৬,০০৬ জন দর্শকদের উপস্থিতিতে ৩৩,৮৯৪.৬০ মার্কিন ডলার উপার্জন হয়েছিলো। এই ম্যাচই প্রথম একদিনের ম্যাচ।
আসলে কেইন্সিয় মডেলের কারণই অতিরিক্ত ক্রিকেটের সূত্রপাত ঘটায়, ঠিক যতটুকু অতিরিক্ত হলে ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না।
পরের পর্বগুলি তে আমরা আলোচনা করবো ১৯৬২-৭১ এর মধ্যে বিশ্ব জুড়ে বেসরকারি বা প্রাইভেট সফর গুলির বৃদ্ধি পাওয়া কে এবং টেস্ট না খেলা দেশে ক্রিকেটের বৃদ্ধি কে।
(ক্রমশ)