ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : বত্রিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

২০০০ সালের পর থেকে ক্রিকেট দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গেছে। বদলে যাওয়া এই চেহারা শুধু ওডিআই বিশ্বকাপ দিয়েই দেখিয়ে দেওয়া যায়। সব থেকে বড় কথা কেন্দ্রীভবন হওয়া। ক্রিকেট ফুটবল উভয় ক্ষেত্রেই এই ঝোঁক স্পষ্ট। ১৯৭০ থেকে শেষ বিশ্বকাপ ফুটবল অবধি বিশ্বজয়ী দলের সংখ্যা ৬, বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও সংখ্যা ৬। সদস্য ২০০ হোক আর ১০০; ফলাফল একই।

পরিসংখ্যান বলছে ১৯৯৬ থেকে ২০২৩ এর ফাইনাল অবধি অবধি ওডিআই খেলায় ভারত ১৩৫ বার ৩০০ এর বেশী রান করেছে। ২০০৭/০৮ অবধি যেখানে ৩৪/৩৫ টি চার ও ৫/৬টি ছয় মেরেই ভারত ৩০০ তুলতো, এখন সেখানে ২৮/৩২ টি চার ও ১৩/১৮ টি ছয় মারছে। ফলে চার কমলেও সেগুলি ছয় হচ্ছে, সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু ছয় হচ্ছে, যা রানের পরিমাণ ও ব্যাটিং এর গুনগত চরিত্রের বদল ঘটিয়েছে। ফলে ৩৩০-৩৯০ হামেশাই উঠছে।

কুড়ি ওভারের ক্রিকেট চরম ভাবে ফেলেছে ব্যাটিং এ। তাই ৯১/৭ হওয়ার পর ও ২৯০+ রান উঠে যাচ্ছে, ফুটওয়ার্ক ছাড়াই ওডিআই খেলায় উঠছে ডবল সেঞ্চুরি।

ব্যাপক পরিমাণে একদিনের ম্যাচের সংখ্যা কমছে। ভারত যেখানে নয়ের দশকে মোট ২৫৭ টি ও ২০০০-০৯ এর মধ্যে ৩০৭ টি ওয়ানডে খেলেছিল, ২০১০-১৯ এর মধ্যে খেলেছে ২৪৯টি, আর এই দশকে প্রথম চার বছরে ৭০ টি ম্যাচ খেলেছে। অর্থাৎ বছরে গড়ে ২৫/৩০ টির বদলে ১৭/১৮-য় নেমে গেছে সংখ্যা।

অভিযোগ উঠেছে যে বড্ড ব্যাটার প্রধান খেলায় রূপান্তরিত হয়েছে ক্রিকেট। এবারের বিশ্বকাপে ওভারে গড়ে রান উঠেছে ৫.৮২, সেঞ্চুরি হয়েছে ৪০ টি, হাফ সেঞ্চুরি ১১৯টি, সর্বমোট রানের সংখ্যা ২৪,৬০০ ছাড়িয়েছে, ৩০০ রানের বেশি উঠেছে ২৫ টি ইনিংসে। ২০১৫, ২০১৯ ও ২০২৩ মিলিয়ে ইনিংসে ৩০০ রান উঠেছে মোট ৮০ বার। যেখানে ১৯৭৫-২০১১; এই দশবার মিলিয়ে মোট ৬১ বার ৩০০ উঠেছিল। অর্থাৎ প্রথম ৩৫২টি ম্যাচে ৬১ বার, পরের ১৪১টি ম্যাচে ৮০ বার। একই রকম ভাবে ১৯৭৫-২০১১ এর মধ্যে ৩৫২ ম্যাচে শতরান হয়েছিল ১২৭টি। যেখানে পরবর্তী ১৪১ ম্যাচে ১০৯ টি শতরান হয়েছে।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? বোলারদের কিছুই কি সাফল্য আসছে না? আসলে ব্যাপারটা তা নয়। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বকাপে ইনিংস প্রতি উইকেটের গড় কিন্তু ১৯৭৫ সালে ছিল ৬.৯৩, এখন সেটা ৭.৫৯। ইনিংসে বোলারদের ৪ উইকেট পাওয়ার প্রবণতা বিশ শতকের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ম্যাচের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে, কিন্তু চার উইকেট পাওয়ার হার বেড়েছে তিন গুন। সবথেকে বড় কথা বোলারদের স্ট্রাইক রেট অনেক উন্নত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ৪৭.৭৮ স্ট্রাইক রেট ছিল, এখন তা ৩৪.৮৪ নেমেছে। ইনিংসে দলগতভাবে বল খেলার হারও কমে গেছে। যা প্রমাণ করে, বোলাররা আগের থেকে সাফল্য বেশি পাচ্ছে।

আসলে ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩ সাল অবধি ওডিআই ছিল টেস্ট ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। ১৯৮৭ থেকেই অনেক বেশি ওডিআই খেলা হচ্ছিল, তার ফলে ওডিআই এর নিজস্ব চরিত্র তৈরী হয়। ২০০৬/০৭ থেকে টি টোয়েন্টি শুরু হয়। ২০১৩ সালের পর থেকে টি টোয়েন্টির সংখ্যা বৃদ্ধি ওডিআই কে টি টোয়েন্টির বড় সংস্করণের চরিত্র প্রদান করে। ফলে আজ ক্রিকেটে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তাই যেমন রান ওঠে, তেমনই উইকেট বেশি পড়ে। যে পিচে দুই দলই ৫০ ওভারে ৩০০-৩৫০ করছে, সেই পিচেই বোলার ৭ উইকেট দখল করছে, এই দৃশ্য আজ আর অবাস্তব নয়।

পাল্টে যাওয়া যুগে অনেক পুরনো দল হারিয়ে যাচ্ছে। উঠে আসছে নতুন দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবারে বিশ্বকাপেই খেলতে পারেনি। আসেনি জিম্বাবুয়ে। কেনিয়া হারিয়ে গেছে। ধ্বস নেমেছে শ্রীলঙ্কায়, পাকিস্তানের অবস্থা টালমাটাল। লড়ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, অবস্থা ভালো নয়। এদিকে স্বপ্নের উত্থান ঘটেছে আফগানিস্তানের। নেদারল্যান্ড চমকে দিয়েছে। আগামী বছর কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপে খেলবে নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর উগান্ডা। সম্ভাবনা জাগিয়েছে পাপুয়া নিউ গিনি, নামিবিয়া। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর আরব আমীরশাহী তো আছেই।

এরই একপ্রকারের যাত্রাপথের একটা রূপরেখা বর্ণনার চেষ্টা করা হয়েছিল গত ৩১ পর্ব যাবৎ।

খেলাধুলা সবসময়েই রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যুক্ত। তাই খেলাধুলার বিষয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে সংযুক্ত করা সবসময় সম্ভব। খেলাধুলা আমাদের সমাজের আয়না। যার মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারি যে বর্তমান সামাজিক কাঠামোটি কীভাবে শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতি এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক অক্ষম করে দিয়ে সুস্থ, জীবন- বর্ধক খেলাধুলার প্রকৃত সম্ভাবনাকে বিকৃত করে। প্রকৃতপক্ষে মিডিয়া এবং দক্ষিণপন্থীরা খেলাধুলাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলেও সবসময় ঘনিষ্ঠ মিথস্ক্রিয়া এই ক্ষেত্রে রয়েছে।

যেহেতু পুঁজিবাদ নিরলসভাবে পণ্য উৎপাদন এবং বাজারকে প্রায় সব ধরনের মানবিক ক্রিয়াকলাপে নিয়ে এসেছে, তাই খেলাধুলা আর শুধু ব্যক্তিগত বা স্থানীয় অপেশাদার কার্যকলাপ নয় বরং অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ।

পুঁজিবাদী মুনাফা শিল্প উৎপাদনের পরিবর্তে অর্থনীতির পরিষেবা/অবসর খাতে ক্রমবর্ধমানভাবে উৎপন্ন হয়। আগের থেকে বেশি কর্মী সরাসরি খেলাধুলা-সম্পর্কিত ব্যবসায় নিযুক্ত। শৈশব থেকে, আমরা এমনসব গল্পে সবসময় আগ্রহ দেখাই যা পরবর্তীকালে আমাদের জীবনের অনুভূতি তৈরি করে। খেলাধুলা এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা/উন্নতির ইতিবাচক ধারণা, দলগত কাজ, অনুকরণের জন্য রোল মডেল, বিজয়ীর আরও নেতিবাচক ধারণার সঙ্গে সম্মানজনক প্রতিযোগিতা সহ-অবস্থান সবই এক্ষেত্রে কাজে লাগে, সঙ্গে থাকে অত্যধিক বীর-উপাসনা এবং যে কোনও মূল্যে জয়। যদিও মনে রাখতেই হবে একটি ভীষন প্রভাবশালী আখ্যান যদি কর্পোরেট ক্ষমতা এবং জাতীয় রাষ্ট্রের স্বার্থের পুনরুৎপাদনও ঘটায়, তাহলেও তার থেকে ইতিবাচক প্রায় উপাদানগুলি কখনই বিলুপ্ত হয় না।

স্পনসরশিপ এবং বিজ্ঞাপন নতুন টিভি কভারেজকে অনুসরণ করে আরও বেশি অর্থ এনেছে। ফলস্বরূপ, শীর্ষ খেলোয়াড়রা সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছেন এবং মিলিয়নেয়ার হয়েছেন। স্থানীয় জনসম্প্রদায় এবং তাদের ক্লাবগুলির মধ্যে সম্পর্ক বদলে গিয়েছে। আগে খেলোয়াড়রা আশেপাশের এলাকা থেকেই আসত কিন্তু এখন বিরাট আকারের জায়গা জুড়ে খেলোয়াড়দের আগমন ঘটে, ফলে বহুক্ষেত্রে স্থানীয় জনসম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকেই না।

বর্তমানে ফ্র্যাঞ্চাইজির যুগে টিকিটের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে, খেলাটি শ্রমিক-শ্রেণির সমর্থকদের নাগালের বাইরে চলে গেছে ও যাচ্ছে। সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠার অবস্থা তৈরী হয়েছে অর্থাৎ দলের সঙ্গে যৌথ পরিচয়ের একটি অবশিষ্ট উপাদান এখনও রয়েছে এবং এই সচেতনতাও গড়ে তুলেছে যে কর্পোরেট লোভ খেলাটিকে নষ্ট করছে (ভারতে আইপিএল ও আইএসএল বিরোধী কিন্তু সাময়িক আন্দোলন; যদিও বহু ক্ষেত্রে স্পন্সর আনা নিয়েই আন্দোলনের শুরু এবং স্পন্সর নিশ্চিত হতেই আন্দোলন গুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এক শ্রেণির সমর্থকরা তবুও এই কর্পোরেট কালচারের বিরোধিতা করেন; যদিও বিকল্প রাস্তা দেখাতে তাঁরা অক্ষম)।

এক শ্রেণির মানুষের গড় কাজের সময় কমেছে এবং অবসর সময় বেড়েছে তাই সময় এবং সবাই জানে ও বোঝে যে সম্পদশালী লোকেরা খেলাধুলা করার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করতে পারে এবং অল্প পরিমাণে খেলতেও পারে।

বহু সংখ্যক ক্রীড়াবিদ একটি উন্নত জিমে যুক্ত থাকেন যার মধ্যে অ্যারোবিকস, যোগব্যায়াম মতো কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যা সামগ্রিক ফিটনেসের বিষয়টিকে তুলে ধরে (নিশ্চিতভাবেই অপেশাদার মানসিকতার অবসান এর ফলে দ্রুত হয়েছে যা ইতিবাচক দিক) যদিও স্থানীয় দলের অংশগ্রহণ ক্রমশই বিলীয়মান।

খেলাধুলা কোনও পৃথক সত্তা নয় বরং আন্তঃ সংযুক্ত অনুশীলন এবং প্রতিষ্ঠানগুলির একটি নিয়ত চলন। পুঁজি ও তার ক্ষতিকারক শক্তি, কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় সরকার বা অন্যান্য প্রভাবের সঙ্গে পুঁজিবাদীবশক্তির  সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে দেখানো যায় খেলা ও পুঁজির আন্তঃসম্পর্ক আসলে বস্তুগত অনুশীলন (শোষণ, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ) এবং আদর্শ; উভয়ের ক্ষেত্রেই এই শক্তিকে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ;  যে বাস্তব জীবনে সত্যিই পুঁজি ও ক্রীড়াক্ষেত্র কে আলাদা করা না গেলেও পুঁজিবাদী পরিকাঠামোর মধ্যে একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন স্লোগানের মাধ্যমে এমন লড়াই সৃষ্টি করতে হবে যা পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের অংশীদার হবে ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করবে।

রাষ্ট্র ও সরকারকে পুঁজিবাদী শক্তির পাশে রাখা যেতেই পারে যদিও পুঁজি থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির আপেক্ষিক স্বায়ত্তশাসন রয়েছে তবুও ফ্র্যাঞ্চাইজির যুগে এই সীমা ক্রমশঃ দূর্বল হচ্ছে। আধুনিক বাষ্ট্র গুলি এমন একটি রাষ্ট্র যা পুঁজিবাদকে বজায় রাখার জন্যই বিদ্যমান। ফলত স্থানীয়, অপেশাদার এবং পেশাদার স্তরে পূর্বের তুলনায় অংশগ্রহণ দ্রুত গতিতে নিম্নমুখী।

ঐতিহাসিকভাবে এবং বর্তমানে যেটুকু গণ বা শ্রমিক-শ্রেণীর ক্রীড়া প্রকল্পগুলি বিদ্যমান সেখানে এই পথটিই বিকল্প রাস্তা হিসেবে বজায় রাখতে হবে।

সার্বিকভাবে বিষয়টি একবার দেখা যাক মার্কসীয় তত্ত্বের আলোকে। Economic and Philosophic Manuscripts of 1844 গ্রন্থে, কার্ল মার্কস এন্টফ্রেমডং তত্ত্ব প্রকাশ করেছেনঅর্থাৎ ‘সেলফ বা আত্ম’ থেকে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব। দার্শনিকভাবে, Entfremdung-এর তত্ত্ব লুডভিগ ফয়েরবাখের ‘দ্য এসেন্স অফ ক্রিশ্চিয়ানটি’-র (১৮৪১) উপর নির্ভর করে, যা বলে যে একটি অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরের ধারণা মানুষকে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

তদুপরি, ম্যাক্স স্টির্নার ‘দ্য ইগো অ্যান্ড ইটস ওন (১৮৪৫)’ গ্রন্থে ফয়েরবাখের বিশ্লেষণকে প্রসারিত করে দেখিয়েছেন  যে এমনকি ‘মানবতা’ ধারণাটিও ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিগত সম্পূর্ণ দার্শনিক নিহিতার্থে বিবেচনা করার পক্ষে একটি বিচ্ছিন্ন ধারণা। মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁদের ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’-তে (১৮৪৫) এই দার্শনিক প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন করেছেন।

পুঁজি ঠিক এইভাবেই জনগণের অবসর বিনোদন থেকে তাকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন করে, যৌথ জীবন ও চর্চা থেকে অর্জিত দক্ষতাকে ব্যক্তিগত অর্জন বলে প্রতিপন্ন করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার মাধ্যমে সৃষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব কে ভিত্তি করে মুনাফা কামায়। এমনকি পুঁজিবাদী (বা আজকের নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ) অর্থনীতির সঙ্গে খাপ না খেলে অতি জনপ্রিয় ক্রীড়াও বিলুপ্তির সামনে পড়ে। মাত্র তিনদশক আগেও বহুল পরিমাণে চর্চিত অজস্র খেলা – হা-ডু-ডু, খো খো, দাড়িয়াবান্ধা, বাঘবন্দী, বোলো খুঁটি, বাঘচাল, লাললাঠি বা ছেলের মা ডাইনি-র মত দেশজ খেলা, তথা পোলো, ওয়াটার পোলো এমনকি এককালের প্রবল জনপ্রিয় হকি, বিভিন্ন অ্যাথলেটিকস অন্তত ভারতে ব্যাপক সমস্যার মধ্যে আছে।

সবশেষে একটা কথা, নয়া-উদারবাদ আগামীদিনে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে। যেহেতু ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট এই নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ট্রান্সক্যাপিটালের চিহ্ন, এদিকে জাতি-রাষ্ট্র বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে জাতি-রাষ্ট্র এবং ট্রান্সক্যাপিটালের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার ফলে আগামীদিনে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি যে আইসিসির মতো দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি বা আলাদা বোর্ড তৈরি করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এগুলিতে যে পরিমাণ বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয়, তাতে করে খেলোয়াড়রা যে সেদিকেই ঝুঁকবেন এবং জাতীয় বোর্ড থেকে নিজের নাম সরিয়ে নেবেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

বর্তমানে যে স্টেডিয়ামগুলিতে খেলা হচ্ছে, তা ছাড়াও তারা নিজেদের অর্থ বিনিয়োগ করে আরও স্টেডিয়াম তৈরি করতে পারে, এবং কোনো সরকার তাতে কোনোরকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দেখে দেখে ক্রীড়াপ্রেমীদের একটি বড় অংশ এই ক্রিকেট ফরম্যাটকে বেশি পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ এর মানও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে অনেক বেশি। আইপিএল বা বিগ ব্যাশ লীগে ব্যাটিং, বোলিং বা ফিল্ডিংয়ের যে উৎকর্ষতা দেখা যায়, তা সারা বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেন পাওয়া যায় না, তা এখন বড় প্রশ্ন।

তার ফলে ক্রীড়াপ্রেমীরা সততই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছেন। নিজের দেশের খেলোয়াড়ের ব্যর্থতায় উল্লসিত হয়ে নিজের পছন্দের খেলোয়াড়ের পক্ষে কথা তুলছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের রাজ্যদলের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে সমর্থন করছেন, তাও আবার যখন সেই দল নিজেরই রাজ্যদলের বিরুদ্ধে, রাজ্যদলেরই ঘরের মাঠে খেলতে আসছে।

ট্রান্সন্যাশনাল ক্যাপিটালিজম জাতীয় রাষ্ট্রকে উৎখাত করতে পারেনি। দ্বন্দ্বকে বজায় রেখে দিয়েছে। আগামীদিনে এই দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-বিশ্বে বড়সড় বিভাজন যে আনবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। উলটে, বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো যে ভারতেরও অবস্থা হবে না, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

 

(শেষ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *