ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। তৃতীয় পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।
প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণেই শুরু হয়েছিল। আবার একই সঙ্গে বলা যায় যে রেলপথ ছাড়া যেমন প্রথম শ্রেণির বিশেষ করে কাউন্টি ক্রিকেট শুরুই হতো না, তেমনই বাষ্প চালিত জাহাজ না এলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরুই হতো না। ঘটনাচক্রে এই সূত্রপাত ঘটে ইউরোপে নয়, উত্তর আমেরিকায়। যেখানে ক্রিকেট আজও দূর্বল। অথচ উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিকেটে বেশ শক্তিশালী ছিল। দাসপ্রথার সমর্থকরা প্রায় সকলে ক্রিকেট সমর্থন ছিলেন। ১৮৫২ সালে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়া এক ক্রিকেটার পিকারিং পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম কানাডার মধ্যে আয়োজিত ম্যাচে খেলেন ১৮৫৩ সালে। ওই বছরেই তিনি সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাবের ওয়ালারের সঙ্গে আলোচনা করেন ১৮৫৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে একটি দল নিয়ে আসবার জন্য। অর্থের জন্য সেই প্রচেষ্টা সফল না হলেও অবশেষে ১৮৫৯ সালে জর্জ পারের দল ইংল্যান্ড থেকে ছয়জন অল ইংল্যান্ড ও ছয়জন ইউনাইটেড অল ইংল্যাণ্ডের খেলোয়াড় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করতে যান। দাবি ছিল গোটা সফরের জন্য ৬০০ পাউন্ড দিতে হবে, দলে জন লিলিহোয়াইট (ইংল্যাণ্ডের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক), জন উইজডেন প্রভৃতি। খরচ দেয় মন্ট্রিয়ল ক্রিকেট ক্লাব, হ্যামিল্টন ক্রিকেট ক্লাব ও সেন্ট করি ক্রিকেটর। সফর থেকে ৯০ পাউন্ড করে একেকজন মাথা পিছু উপার্জন করে। কোনও ম্যাচ প্রথম শ্রেণির তকমা পায়নি। মোট ৮টা ম্যাচ খেলা হয়। প্রবল ঠাণ্ডায় কোট ও গ্লাভস পরেও ক্রিকেট হয়েছিল।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মাত্র কয়েক মাসের আগে এই সফর হয়েছিলো, যুদ্ধের পরেই ক্রিকেটের উৎসাহে ধ্বস নামে। পরে কয়েকবার সফর হলেও ক্রিকেট সেই সফরগুলির মতো উৎসাহ আর ছিল না।
১৮৫৯ সালে চার্লস ডিকেন্সের অস্ট্রেলিয়ায় বক্তৃতা করতে যাওয়া দেখে মেলবোর্নের এক ব্রিটিশ মালিকানার ক্যাটারিং কোম্পানির মালিক দ্বয় ফেলিক্স স্প্যায়ার্স এবং ক্রিস্টোফার পন্ড যাঁরা প্যারিসে কাফে ডে প্যারি নামক রেস্তোরাঁ চালাতেন তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় ক্রম-বর্ধমান ক্রিকেটীয় জনপ্রিয়তা দেখে ইংল্যাণ্ডের বারো জন ক্রিকেটারকে প্রস্তাব দেন সফরের। মাথা পিছু ১৫০ পাউন্ডের প্রস্তাব গ্রহণ করে সফরটি শুরু হয় ১৮৬১-৬২ সালে। এইচ এইচ স্টিফেনসন ও উইলিয়াম ক্যাফিন যাঁরা উত্তর আমেরিকা সফরে যান তাঁরাও দলে ছিলেন। দলের অধিনায়ক হন এইচ এইচ স্টিফেনসন। দলের নামকরণ ও তাঁর নামে হয়।
১২টি ম্যাচের একটিও প্রথম শ্রেণির ছিলনা, কিন্তু এই সফরে সারে ক্রিকেট ক্লাবের ছয়জন ও স্থানীয় পাঁচ জনকে নিয়ে গড়া দল সারে একাদশ নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সারে বাদে অন্য কাউন্টির ছয়জন ও স্থানীয় পাঁচ জন ক্রিকেটারের নিয়ে গড়া বিশ্ব একাদশের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচটি খেলা হয় মার্চ মাসে। এই খেলাটি প্রথম শ্রেণির তকমা পায়। বিশ্ব একাদশ দলের জন কনওয়ে প্রথম ইংল্যান্ড সফররত অস্ট্রেলীয় দলের ম্যানেজার হন। প্রথম ম্যাচে ৪৫,০০০ দর্শক হয় ( স্টিভেনসন একাদশ বনাম ভিক্টোরিয়া) ও প্রথম শ্রেণির খেলায় ৮,০০০ দর্শক হয়। সফর টি চূড়ান্ত সফল ও ভবিষ্যতের রাস্তা তৈরী করে।
এরপরেই ঘটে যায় ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে আকর্ষনীয় ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাবরিজিনাল ক্রিকেটার অর্থাৎ সেই সুদূর অতীত থেকে যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা অস্ট্রেলিয়ার আদি বাসিন্দা অর্থাৎ ভূমিপুত্র, তাঁরাই সেদিন সদলবলে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলতে।
শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ানদের টিম লর্ডসের মাঠে নামার ১০ বছর আগে এবং বহুল প্রচারিত ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া অ্যাশেজ সিরিজ শুরু হওয়ার ১৪ বছর আগে। উল্লেখ করা যায় আজ অস্ট্রেলিয়া টিমে একজনও কৃষ্ণাঙ্গ ভূমিপুত্রের স্থান নেই।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির শহরতলীর ক্রিকেট কোচ চার্লস লরেন্স(১৮২৯ – ১৯১৭) (তাঁর হোটেল ব্যবসাও ছিল) অ্যাবরিজিনালদের নিয়ে একটি ক্রিকেট টিম তৈরি করেইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন এসেছিল। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে টাকা বিনিয়োগে সম্মত হলেন – সিডনির তৎকালীন প্রাক্তন মেয়র জন স্মিথ এবং জি ডব্লিউ গ্রাহাম।লরেন্স লন্ডনের এমসিসি কর্তাদের সাথেও চিঠি লিখে যোগাযোগ করেন। ইংল্যান্ড রওনা হওয়ার আগে ওয়েস্টার্ন ভিক্টোরিয়া থেকে খেলোয়াড় বেছে, তাঁদের দিয়ে স্থানীয় ম্যাচ খেলিয়ে টিম বানান লরেন্স। তিনি হ্যামিল্টন স্পেক্টেটর পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও ছাপান যে ওয়েস্টার্ন ডিস্ট্রিক্টের ষোলো বা আঠেরো জনের যেকোনো টিমের সঙ্গে তাঁর লরেন্স ইলেভেন খেলতে আগ্রহী। অ্যাবরিজিনালদের নামকরণের মধ্য দিয়ে ঠাট্টা করার ইঙ্গিত লক্ষ্যণীয়, আবার তাঁদের উচ্চারণের সুবিধার জন্যও! একটু দেখেনি তাঁদের আসল নাম ও শ্বেতাঙ্গদের দেওয়া নামগুলি ছিল —
জনি মুলাঘ – উনাররিমিন(১৩ই আগস্ট ১৮৪১ – ১৪ই আগস্ট ১৮৯১)
হ্যারি বুলোকি – বুলচানাচ(মৃত্যু ১৮৯০)
সানডাউন – বালরিন
ডিক-এ-ডিক – জুঙ্গুনজিনানুকে(১৮৩৪-১৮৭০)
জনি কুজেন্স – জেল্লানাচ
কিং কোল – ব্রিপুম্যারিমিন
রেড ক্যাপ – ব্রিম্বুন্যা(মৃত্যু ১৮৯১)
টু পেনি – মুররুমগুনারিম্যান(১৮৪৫-১৮৮৩)
চার্লি ডুমাস – প্রিপুমুয়াররামান
জিমি মসকুইটো – গ্রৌগাররঙ
টাইগার – বনিনবারনগিট
জিম ক্রো – জাল্লাচনিউরিমিন(মৃত্যু ১৮৭০)
১৮৬৮ সালের ১৩ই মে ইংল্যান্ডের গ্রেভসেন্ড বন্দরে পৌছায় দলটি। ২৫শে মে ওভালে তাঁদের প্রথম ম্যাচ এবং ওখানেই তাঁদের শেষ ম্যাচের(১৫-১৭ই অক্টোবর) মধ্যেকার ১২৬ দিনের মধ্যে রবিবার বাদে অ্যাবরিজিনালরা ৯৯ দিনই মাঠে নেমেছিলেন খেলতে। ১৫টি কাউন্টিতে, ৪০টি জায়গায় মোট ৪৭টি ম্যাচ খেলতে হয়েছিল তাঁদের। ক্রিকেটের ইতিহাসে এটিই বোধহয় অন্যতম ব্যস্ত সফর। বেশিরভাগ মাঠে লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকত না। খেলোয়াড়রা বিভিন্ন তাঁবু থেকে খাবার কিনে খেতেন বা মাঝে মাঝে দর্শকরা তাঁদের দিতেন। কিন্তু সেইসব খেলায় কোনো টি-ব্রেক ছিল না। শুধু ক্রিকেট খেলা নয়, খেলার শেষে অ্যাবরিজিনালদের বর্শা ছোঁড়া, বুমেরাং ছোঁড়া ও আরও বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতে হত!
এই সফরের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল ক্রিকেটার কিং কোলের মৃত্যু। তাঁর যক্ষা ধরা পড়ে। ২৪শে জুন লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। এছাড়া জিম ক্রো ও সানডাউনকে অসুস্থতার জন্য আগস্ট মাসে অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। মোট ৪৭টা ম্যাচের সবকটাতেই খেলেছিলেন রেড ক্যাপ ও টাইগার। কুজেন্স খেলেছিলেন ৪৬টি ম্যাচে, ডিক-এ-ডিক ও মুলাঘ ৪৫টি ম্যাচে এবং লরেন্স ও বাকিরা ৪০টি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। স্থানীয় সারে অঞ্চলের ডব্লিউ শেফার্ড ছিলেন আম্পায়ার। খেলোয়াড় না থাকায় তাঁকেও ৭টি ম্যাচে নামতে হয়েছিল এবং লরেন্সের অনুপস্থিতিতে টিমের অধিনায়কও হয়েছিলেন। অ্যাবরিজিনালদের টিম ১৪টি ম্যাচ যেতে ও ১৪টি ম্যাচ হারে। বাকি ১৯টি ম্যাচ ড্র হয়। তবে খারাপ আবহাওয়ার জন্য বেশ কিছু ম্যাচ ভণ্ডুল হয়। টিমটি মোট ১১বার প্রথমে ব্যাট করেছিল।
শুরুতে ব্রিটিশ সংবাদপত্র এই টিমের খেলাকে ভালোই প্রচার দিচ্ছিল। শেফিল্ড টেলিগ্রাফে লিখেছিল, নিশ্চিতভাবে শতাব্দীর সেরা ঘটনা। স্থানীয় সংবাদপত্রেই এই খেলার খবর ছাপা হত। বিখ্যাত উইজডেন পত্রিকা ম্যাচগুলির শুধু স্কোর ছাপত, খেলার কোনো বর্ণনা দিত না।
ওভালের প্রথম ম্যাচে ৭০০০ দর্শক হয়েছিল। শেফিল্ড ও হোভে ৫০০০ এবং লর্ডসে ৩০০০ দর্শক সমাগম হয়। লিউইশ্যামে তাঁরা প্রথম ম্যাচ জেতেন ৪০০০ দর্শকের সামনে।
কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাবরিজিনালদের প্রতি দর্শক ও উদ্যোক্তারা উদার মনোভাব দেখান। তবে ইয়র্কে খেলার শেষে তাঁদের লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এর প্রতিবাদে মুলাঘ মাঠে নামতে অস্বীকার করেন। আবার এই টিমকেই ওভালে শেষ ম্যাচের পর ডিনারে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। এমসিসি এই দলটিকে লর্ডসে খেলার ব্যাপারে আপত্তি করলেও জনমতের চাপেই হোক বা অন্য কোনো কারণে আপত্তি টেকেনি। অ্যাবরিজিনালরা খুবই চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট খেলতেন। মাঠে তাঁরা খুব প্রাণবন্ত আচরণ করতেন। দর্শকদের সঙ্গে মিশতেন, তাঁদের দেওয়া কেক, বিস্কুট, মিষ্টি খেতেন। ফ্লাস্ক থেকে ধালা গরম পানীয়ও জুটত মাঝে মাঝে।
খেলার শেষে ১৮৬৮ সালের ১৯শে অক্টোবর যে জাহাজটি ইংল্যান্ডের গ্রেভসেন্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়, তাতে ছিলেন বুলোকি, পিটার, টাইগার ও টু পেনি। এক সপ্তাহ পর অন্য জাহাজে প্লেমাউথ থেকে বাকিরা অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দেশে ফিরেও তাঁরা বেশ কিছু ম্যাচ খেলেন। সর্বশেষ ম্যাচটি হয়েছিল মেলবোর্নে, ১৮৬৯ সালের মার্চ মাসে। সেখান থেকে অ্যাবরিজিনালরা যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অ্যাবরিজিনালদের অনেকেই অল্প বয়সে মারা যান, অনেকের কোনো হদিশই পাওয়া যায় না। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিমের সামনের সারিতে সেখানকার ভূমিপুত্রদের কার্যত দেখা যায়নি। বেসরকারী উদ্যোগে তৈরী প্রথম যুগের দল গুলির মধ্যে এই দলটি ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সময়টা ছিল পুঁজিবাদের একচেটিয়া যুগের সাম্রাজ্যবাদী পর্বে প্রবেশের ঠিক আগের মুহূর্ত। তখনও ফ্রান্সে তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসন। তবে প্যারি ফুঁসছে ক্ষোভে। ভারতে মহাবিদ্রোহ শেষ হলেও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়নি।
এই পর্যায়ে একের পর এক জোট হচ্ছিল বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ গুলির মধ্যে। এই সময়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূত্রপাত। সম্পূর্ন ভাবে বেসরকারী ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
ডব্লিউ.জি. গ্রেস তাঁর দল নিয়ে ১৮৭৩-৭৪ সালে অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। সাউদাম্পটন থেকে দলের বিদায়ের সকালে, তিনি শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন যে তার দলের লক্ষ্য “ইংলিশ ক্রিকেটের সম্মান বজায় রাখা ও ইংলিশ ক্রিকেটারদের উচ্চ চরিত্রকে সমুন্নত রাখার।” কিন্তু তার এবং দলের পারফরম্যান্স উভয়ই এই লক্ষ্যের ধারে কাছে আসেনি। সফরটি সফল হয়নি এবং একমাত্র ইতিবাচক ফলাফল ছিল পূর্ববর্তী সফরের দশ বছর পর, এটি “অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট প্রয়োজনীয় সন্তুষ্টি লাভ করে”।
বেশিরভাগ সমস্যা গ্রেসের নিজের ছিল যা তার প্রতি সমস্ত ব্যক্তিগত শুভেচ্ছাকে দ্রুত নিঃশেষ করে দেয়। দলের মধ্যেও সমস্যা ছিল কারণ গ্রেস, যিনি সাধারণত পেশাদার খেলোয়াড়দের সাথে ভাল ব্যবহার করতেন যা পুরো সফরে শ্রেণী বিভাজন ঘটায়। ফলাফলের দিক থেকে, দলটি একটি খারাপ শুরুর পরে ভাল পারফরম্যান্স করেছিল যেখানে তারা ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলস উভয়ের কাছে পরাজিত হয়েছিল। তারা সব মিলিয়ে ১৫টি ম্যাচ খেলেছিল কিন্তু কোনোটিই প্রথম-শ্রেণীর হিসেবে স্বীকৃত পায়নি। কিন্তু এই সফর অভূতপূর্ব আয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শোনা যায়, এই সফরে এত আয় হয়েছিল যে তা ইংল্যান্ডে সারা বছরে ক্রিকেট জুয়ার বিনিয়োগ কে ছাপিয়ে যায়।
১৮২০/৩০ এর দশকে যেমনট ইংল্যাণ্ডে ছিল, সেরকম উনিশ শতকের শেষের দিকে অস্ট্রেলিয়ার দলগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে যায় বুকিরা। কারণ ক্রিকেটে সাধারণ লোকের চোখে পেশাদার খেলোয়াড় আর শখের খেলোয়াড়ের মধ্যে তফাত ধরা পড়ে না, তাই ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক! অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেটাররা ইংল্যান্ডের অপেশাদারদের মতো সমাজের উঁচুতলায় বাস করে না। এই সমাজের উঁচুতলায় বাস করা লোকদের হাতে প্রচুর সময়। কাজেই, এই নানা ধরণের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা, তার সামাজিক ও নৈতিক মান বজায় রাখার মতো কর্মসূচি গ্রহণ, সবেতেই এরা এগিয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা হয়তো নিজেদের পেশাদার বলে না, কিন্তু ইংল্যান্ডে খেলাতে এলেই তাঁদের অবস্থা ভালো হয়ে যায়। তারা তাদের সমস্ত পুজি জমিয়ে রাখা শুরু করে ইংল্যান্ডে খেলতে আসার জন্য। কারণ তাঁরা খুব ভালো করে জানতেন, ইংল্যান্ডে খেলতে এলে এরা কেউ খালি হাতে ফিরবে না।
অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট খেলাটা ইংল্যাণ্ডের অপেশাদার অ্যাথলেটিক্স আর নৌকো চালানোর মতো। মেলবোর্ন ছেড়ে চলে যাওয়া খেলোয়াড়দের পকেটে থাকা টাকার অঙ্কটা খুবই বেশি ছিল। তাই বিষয়টি অন্যরকম চেহারা নিলো জেমস লিলিহোয়াইট এর হাতে।
দুজন ইংরেজ ১৮৭৬/৭৭ মরশুমের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় আলাদা ট্যুর করার চেষ্টা করেছিলেন: জেমস লিলিহোয়াইট যিনি পেশাদার ক্রিকেটারদের নিয়ে সফর করতে চেষ্টা করেন। অন্যদিকে ফ্রেড গ্রেস (ডব্লিউজি গ্রেসের ভাই) অপেশাদারদের অন্তর্ভুক্ত করেন। গ্রেসের সফরের জন্য অনেক প্রাথমিক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও, লিলিহোয়াইট একাই টিম পাঠায়। তিনি জেমস সাউদার্টন কে অস্ট্রেলিয়ায় আগেই পাঠান ক্রীড়াসূচী ও অন্যন্য বিষয় স্থির করতে। দলটি প্রথমে নিউজিল্যান্ড এবং তারপর অস্ট্রেলিয়া সফর করে। এই সফরের খেলাই প্রথম টেস্টের স্বীকৃতি পায়। তখন উইজডেনের সম্পাদক নাইট গোটা সফর কে নিয়ে লিখলেন বটে– কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা আলাদা অংশে। এবং যাকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম টেস্ট ম্যাচ বলে ধরা হয়, তা প্রায় অনুল্লেখিত থেকে গেল। এমনকি নাইটের মৃত্যু(১৮৭৯) এর পর যখন জর্জ ওয়েস্ট সম্পাদক হলেন তখনও ১৮৮০ সালের খেলা গুলির সাথে কয়েকটা মাত্র লাইন লিখলেন গোটা সফর কে নিয়ে।
এখন প্রশ্ন হল কেন? কেউ কেউ বলেন যে ১৮৭২ সালের পরবর্তীকালে যখন সমুদ্রের তলাদিয়ে টেলেগ্রাফ লাইন পাতা হয় তখন তার খরচা ছিল খুব বেশি, ফলে উইজডেন- তখন জাহাজ গুলিতে পাওয়া যায় এমন কাগজ ব্যাবহার করতেন,– যেমন “লিডার”, “অস্ট্রেলিয়ান”, “স্পোর্টসম্যান” প্রভৃতি।
আসলে তা নাও হতে পারে। সেই সময় উইজডেন দাবি করত যে তারা তাদের পুরোন প্রতিষ্ঠিত প্রতিদ্বন্ধি দের প্রচার সংখ্যার নিরিখে পিছনে ফেলে দিয়েছে , ঠিক তখন জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়র তার দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান এবং সেখানে ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলসএর যৌথ দলের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ খেলেন তাই ১৮৯৫ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচের সন্মান পায়। যেহেতু লিলিওহোয়াইট এর দল– তাই উইজডেন ঐ বিষয়ে কিছুই লেখেনি।
ইতমধ্যে ফ্রেড লিলিহোয়াইটের মৃত্যু হওয়াতে (১৮৬৬) জন লিলিহোয়াইট তৈরি করেছেন “জন লিলহোয়াইট ক্রিকেটারস কম্প্যানিয়ন”। তারা আবার দাবি করত যে তাদের গ্রন্থ খেলাটির সর্ববৃহৎ বার্ষিকী অন্যান্য দের তুলনায়। আবার এও বলত যে বাকিরা নাকি “ফ্যাক্ট” এর প্রতি খুব একটা নজর দেয় না। ফলে তাদের ১৮৭৮ সালের সংস্করণে তারা ১৮৭৭ এর ঐ ম্যাচ গুলির পূর্ণ খবর ছাপে।
১৯০০ সালে তাদের(লিলিহোয়াইটদের) প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের ভুত উইজডেন কে তাড়া করে বেড়াত। কারন ১৯৩০ সালে কেইন যখন সম্পাদক তখন উইসডেন দাবি করেছিল যে ১৮৭৭ সালের লিলিহোয়াইট বা ১৮৭৮-৭৯ সালের লর্ড হ্যারিসের দল কোনটাই ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারন প্রথম দল ছিল আর্থিক উদ্দেশ্যে তৈরি আর দ্বিতীয় দল চরম অপেশাদার। মনে রাখবে স্পফোর্থ এই দলের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করেছিল যা টেস্টে প্রথম বলে ধরা হয়।
মজার ব্যাপার, এর ফলে ১৮৮০ সালের লর্ডস টেস্ট কে তাহলে প্রথম বলে ধরতে হয়। কিন্তু তা তারা কোনোদিন ধরেনি। ধরেছে কিন্তু ১৮৭৭ কেই। কারন? দীর্ঘদিন ধরে উইজডেনের পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন সিডনি সাউদারটন। যার বাবা জেমস সাউদারটন ঐ ১৮৭৭ এর খেলায় ছিলেন (মনে রাখবেন জর্জীয় যুগের যে কজন হাতে গোনা ক্রিকেটার টেস্ট খেলেছেন ইনি তাদের একজন।আজও সবথেকে বেশি বয়সে টেস্ট এ অভিষেকের রেকর্ড এর নামে আছে।)। এমন কি ১৯৭১ সালের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক খেলা কেও উইজডেন গুরুত্ব দেয়নি। সংক্ষিপ্ত স্কোর ছেপে ছিল। যাই হোক ১৮৮২-৮৩ সালের সফরে লিলিহোয়াইটরা ২৩ পাতা ছাপলেও উইজডেন এক পাতাও লেখেনি।
১৮৮৪ তে জন উইডেন অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলেন। তার ম্যানেজার হেনরি লাফ এর দায়িত্ব নিলেন। উইজডেন আস্তে আস্তে পেশাদার হল। অনেক পরে ১৯৭৭ সালে শতবার্ষিকী টেস্ট এর সময় তারা ব্রাকেটে ঐ টেস্টের সঙ্গে ১৮৭৭ সালের ম্যাচের পুরো স্কোর ছাপে।
এইভাবে টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম পর্যন্ত হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। তবে বিশ শতকে এর রমরমা কমে আসে। কিন্তু ১৯৬০ এর দশকে আবার এর দাপট বাড়তে থাকে।
(চলবে)