ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। চতুর্দশ পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ গোটা উপমহাদেশে যা উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল তা কহতব্য নয়। কোনোও দিনও ক্রিকেট খেলায় আগ্রহ না দেখানো মানুষজনও ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। এই লেখকের অভিজ্ঞতা বলে সারা জীবন ক্রিকেটকে ব্যাডমিন্টন বলে চালানো মহিলাও ‘কত রান হলো’ -তা একবার অন্তত জিজ্ঞাসা করেছেন। বাংলাদেশেও একই উন্মাদনা শুরু হয়। বিশ্বকাপের পরেই দামাল সামার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে সনৎ জয়সূর্য বা অর্জুন রণতুঙ্গ প্রভৃতি ক্রিকেটারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এমনকি ইংল্যাণ্ডের ফিল ডেফ্রিটাসকেও ডাকা হয় ঢাকায়।

১৯৯৬ এর জুলাই মাসে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ সফরে যায় বাংলাদেশ দল। সেখানে বেশ কিছু ম্যাচ খেলে তাঁরা হারিয়ে দেন যথাক্রমে ইউএসএ ও কানাডাকে তিনটি খেলায়, একটি খেলা ইউএসএ-র সঙ্গে টাই হয়। এরপরেই আসে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল কাপ। এখানে জিতলে এশিয়া কাপ খেলার সুযোগ আবার আসবে। তবে তার আগে আইসিসি ট্রফিও হবে।

সেপ্টেম্বর মাসে কুয়ালালামপুরে প্রথমে নেপাল, তারপর ফিজি ও ব্রুনেই কে অনায়াসে হারায় বাংলাদেশ। এরপর একদিন বাদে জাপানকে বিরাট ব্যবধানে (২১৪ রানে) হারান তাঁরা। আক্রম খান ৫ রানে ৬ উইকেট নেন। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ১০৪ করেন। পরের দিন হংকং কে হারিয়ে সেমি ফাইনালে মুখোমুখি হন পাপুয়া নিউ গিনির। তাঁদেরও অতি সহজে হারাতেই ফাইনালে বিশ্বকাপ খেলা আরব আমীরশাহী মুখোমুখি হয়। দুর্দান্ত খেলে তাঁদেরও অতি সহজেই হারিয়ে এশিয়া কাপ খেলার যোগ্যতা পায় বাংলাদেশ। এই প্রতিযোগিতায় হারুনুর রশিদ লিটন ২০৩, হাবিবুল বাশার সুমন ২১৯, আমিনুল ইসলাম বুলবুল ২৫৭ ও শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ৩০০ করেন। বল হাতে মহম্মদ রফিক ১১টি, সাইফুল ইসলাম সুহাস ও সালাউদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল ১২টি করে উইকেট নেন। বিপুল উন্মাদনা শুরু হয় দেশে ক্রিকেট নিয়ে।

১৯৯৭ এর মার্চে কুয়ালালামপুরেই বি গ্রুপের প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনা কে হারিয়ে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক জয়যাত্রা শুরু করে। পরের দিন ২৫ শে মার্চ পশ্চিম আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় অতি সহজে। ২৭ তারিখে ডেনমার্ক কে হারাতেও বেশি বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ৯৯ রান করতে ৫ উইকেট চলে যায়। গত বিশ্বকাপে খেলা ইউএই তখন তুচ্ছ। তারাও ১০০ করতে পারেনি। পরের ম্যাচে মালয়েশিয়াকেও পরাস্ত করে তাঁরা। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডের এফ গ্রুপের খেলায় প্রথমে হংকং কে হারালেও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচটা বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়। না হলে অবশ্যই জিতে যেত বাংলাদেশ। পরের ম্যাচে নেদারল্যান্ড কে হারায় ডাকওয়র্থ লুইস পদ্ধতিতে। টার্গেট ছিল ৩৪ ওভারে ১৪১। ৭ উইকেট হারিয়ে ৩১.৪ ওভারে রান তুলে দেয়। ভেজা পিচে অধিনায়ক আক্রম খান ৯২ বলে অনবদ্য ৬৮ করেন। এবার সেমি ফাইনাল। জিতলেই বিশ্বকাপে সুযোগ।পাইলট (৭০) আর বুলবুলের (৫৭) ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে তোলে ২৪৩/৭। স্কটল্যান্ড ১৭১ রানে শেষ। এনামুল হক মনি ৩০ রানে ৩টে ও মহম্মদ রফিক ২৫ রানে ৪ উইকেট নেন। এই জয়ের ফলে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। বিরাট উৎসবের সূচনা হয় দেশে। ক্রীড়া প্রেমীরা একদিনে আনন্দে ফেটে পড়ে। অন্যদিকে ক্রিকেটের নতুন বড় বাজার খুলে যায়।

ফাইনালে মুখোমুখি কেনিয়া। গত বিশ্বকাপে তাঁরা দুবারের বিশ্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে হারিয়েছে। বাকি ম্যাচ হারলেও ভারত (১৯৯/৬) , অস্ট্রেলিয়া (২০২/৮) ও শ্রীলঙ্কার (২৫৪/৭) বিরুদ্ধে অল আউট হয়নি। এরমধ্যে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া প্রাক্তণ বিশ্বজয়ী, অস্ট্রেলিয়া সেবারের রানার্স, শ্রীলঙ্কা সেবারই বিশ্বকাপ জয়ী। কেনিয়া বিশাল শক্তিশালী দল।

১২ই এপ্রিল ফাইনালে টসে জিতে বাংলাদেশ ফিল্ডিং নেয়। মাত্র ৫৮ রানের মধ্যে আসিফ করিম, সন্দীপ গুপ্তা ও কেনেডি ওটিয়েনো কে হারায় কেনিয়া। কিন্তু স্টিভ টিকোলো ও মরিস ওদুম্বে (অধিনায়ক, ৪৩ করেন) দলকে ১৯৬ এ টেনে নিয়ে যান। কেনিয়া করে ২৪১/৭। টিকোলো একাই ১৪৭ করেন। রফিক ৪০ রানে ৩ উইকেট নেন। বৃষ্টির জন্য সেদিন খেলা আর হয়নি।

পরের দিন (ফাইনালের জন্য রাখা রিজার্ভ ডে) ও বৃষ্টি হলে বাংলাদেশের লক্ষ্যদাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ অর্থাৎ গড়ে ৬.৬৪ রান প্রতি ওভার। স্লো ও ভেজা আউট ফিল্ড ও ভেজা পিচে কেনিয়ার বিরুদ্ধে এই রান প্রায় অবাস্তব। তাকেই বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।

প্রথম বলেই দুর্জয় মার্টিন সুজির বলে আউট। পিঞ্চ হিটিং এ নেমে রফিক মাত্র ১৫ বলে ২৬ করে যখন আউট হন তখন বাংলাদেশ ৫০। বুলবুল ও নেমেই চালাতে থাকেন কিন্তু একদিক ধরে রাখা মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ৩৩ বলে ২৬ করে আউট হন তখন বাংলাদেশ ৬৩। বুলবুল ও আক্রম দলকে নিয়ে যান ১১৬ রানে। বুলবুল ৩৭ বলে ৩৭ করে আউট। এরপরেই ১১৮ রানের মাথায় আক্রম (২৭ বলে ২২) ও ১২৩ রানের মাথায় এনামুল হক মনি (৭ বলে ৫) আউট হতে বাংলাদেশ ১২৩/৬। বিপুল চাপের মাথায় নামলেন সাইফুল ইসলাম সুহাস। তিনি ও পাইলট ১৬ রান যোগ করেন, যার ১৪ রানই সুহাসের (১৩ বলে)। বাংলাদেশ ১৩৯/৭। নামলেন সুজন। একটা চার মেরে ৫ বলে ৫ করে আউট হলেন যখন তখন ১৫১/৮ হলো। শেষ ওভারে দরকার বারো রান। বাংলাদেশ ১৫৪/৮ ; ২৪ ওভারে। ব্যাট করছেন পাইলট; অপর প্রান্তে শান্ত। প্রথম বলেই ছয়। পরের বল মিস। তারপরের বলে এক রান। দরকার চার বলে পাঁচ। পরের বলে শান্ত এক রান নেয়। ৩ বলে চার। পরের বলে পাইলট দুই রান নেন। দুই বলে দুই। তারপরের এক রান নিয়ে প্রান্ত বদল। শেষ বল খেলতে গেলেন শান্ত। বোলার বল করার সঙ্গে সঙ্গে চালালেন। ব্যাটে বলে হলো না, প্যাডে লাগলো। শান্ত কোনও দিক না দেখে দৌড় দিলেন। সেই দৌড় শুধু আইসিসি ট্রফি জেতার দৌড় নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের দৌড় ও বটে। আইসিসি ট্রফি জিতে নিলো বাংলাদেশ। রেডিওর ধারাভাষ্যকার রা উল্লাসে ফেটে পড়ছেন কোনও নিরপেক্ষতার ভান না করে। এদিকে ইংরেজী ঘোষক হর্ষ ভোগলে জানালেন তিনি আশাবাদী বাংলাদেশ-ই পরবর্তী টেস্ট খেলিয়ে দল।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল ২১৭, আক্রম খান ১৮৬, আতাহার আলী খান ১৭০, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ১৮৫ ও নৈমুর রহমান দুর্জয় ১৭৩ রান করেন এই প্রতিযোগিতায়। আর রফিক ১৯, মনি ১২ ও শান্ত ১১টি উইকেট পান।

ওই বছর জুলাই মাসে এশিয়া কাপে আবার খেলতে নামে বাংলাদেশ। এবারে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচ। ইনজামাম উল হক (৭৭), সঈদ আনোয়ার (৯০), সেলিম মালিক (৬২) আর রামিজ রাজা (৫২) বড় রান করায় পাকিস্তান তোলে ৩১৯/৫। বাংলাদেশ ২১০ করে অল আউট হয় ৪৯.৩ ওভারে। আতাহার আলী খান অনবদ্য ৮২ করেন। আক্রম খান করেন ৫৯। সাকলাইন মুস্তাক ৩৮ রানে ৫ উইকেট পান। যদিও শান্ত ব্যাট করতে নেমে তাঁর প্রথম বল ডিফেন্স করে দ্বিতীয় বলে সাকলাইন কে ছয় মারেন। এরপর ছয়দিন বাদে শ্রীলঙ্কা ৪ উইকেটে ২৯৬ করে (৪৬ ওভারে) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। জয়সূর্য ১০৪ করেন ৮৩ বল। জবাবে বাংলাদেশ ৪৬ ওভারে ১৯৬/৮ তোলে। দুর্জয় ৪৭ ও আতাহার ৪২ করেন। প্রথম উইকেটে ৭৬ রান ওঠে। তৃতীয় ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ৪৩ ওভারে ১৩০/৮ করে বাংলাদেশ। আতাহার আবার ৩৩ করেন। রবিন সিং ১৩ রানে ৩ উইকেট নেন। ভারতের ফাইনালে ওঠার জন্য ২০ ওভারে রানটা তুলতেই হবে এমন অবস্থায় নেমে ১৫ ওভারে ১ উইকেট ১৩২ রান তুলে ম্যাচ জিতে যায়। সৌরভ গাঙ্গুলী ৫২ বলে অপরাজিত ৭২ করেন। অধিনায়ক শচীন ২১ বলে ২৮ ও মহম্মদ আজহারউদ্দীন ২০ বলে ২৩ করেন।

পরের মাসে বাংলাদেশ দল নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট শেল কনফারেন্স এ খেলতে যায়। প্রথম শ্রেণির এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের আগমন ঘটে পাক্কা ২৮ বছর বাদে পাকিস্তানের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে। যদিও তিনটি ম্যাচেই তাঁরা পরাজিত হন তবুও জাভেদ ওমর বেলিন গোল্লা, আক্রম খানের এবং অবশ্যই আল শাহরীয়ার রোকনের ব্যাটিং (ইনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে প্রথম শ্রেণির খেলায় শতরান করেন) ও হাসিবুল হোসেন শান্ত (ইনি প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ১৪৩ রানে ৬ উইকেট পান) – র বোলিং কিছুটা অন্য রকম হয়।

এরপর থেকেই বাংলাদেশ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এরমধ্যে কেনিয়ায় ত্রিদেশীয় সিরিজে (অক্টোবর মাসে) প্রথম ম্যাচে বিরাট ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ। কেনিয়া রীতিমত বদলা নেয়। ৩৪৭/৩ তোলে কেনিয়া। দীপক চূড়াসামা (১২২) ও কেনেডি ওটিয়েনো (১৪৪) প্রথম উইকেটে ২২৫ রান তোলে। বাংলাদেশ ১৯৭ এর বেশি করতে পারেননি। আতাহার আলী ৬১ ও বুলবুল ৩৭ করেন। আসিফ করিম ৩৩ রানে ৫ উইকেট নেন।

জিম্বাবুয়েও প্রথম ম্যাচে ৩০৫/৪ তোলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার বাংলাদেশ কিছুটা লড়াই করে ২৫৭ করে। এই প্রথম তারা ওডিআই খেলায় ২৫০+ করেন। সুমন ৭০ ও আক্রম ৫৯ করেন। পরের ম্যাচে জিম্বাবুয়ে (২৮৪) বিরাট ব্যবধানে জেতে বাংলাদেশের (৯২) বিরুদ্ধে। সেই সময় কেনিয়াও লড়াইয়ে ছিল। কিন্তু কেনিয়া হারিয়ে গেলো। এমনকি ২০০৩ এর বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে যাওয়া সত্বেও। এই নিয়ে পড়ে আলোচনা হবে।

পরের ম্যাচে বাংলাদেশ (১০০) কেনিয়ার (১০২/১)  বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি।

ডিসেম্বর মাসে নিউজিল্যান্ড একাডেমী একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের বিরূদ্ধে কিন্তু বাংলাদেশ দাঁড়াতেই পারেনি। কেবল ডেবিউ ম্যাচে মেহরাব হোসেন অপি ৮১ করেন। এরপরে একমাস বাদে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছর উপলক্ষে করা ইনডিপেন্ডেনস কাপে বাংলাদেশ আরও দুটি ম্যাচ খেলে। ভারতের বিরুদ্ধে বুলবুলের ৬৯ ও সুজনের ৪৭ তাঁদের ১৯০ এ নিয়ে যায়। জবাবে ভারত ৬ উইকেট হারিয়ে ১৯১ তুলে নেয়। পরের ম্যাচে বাংলাদেশ (১৩৪) দাঁড়াতেই পারেনি পাকিস্তানের (১৩৬/১) বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন বাদে ঢাকায় বড় ক্রিকেট ম্যাচ ব্যাপক উন্মাদনা তৈরী করে। ফাইনালে (৩ ম্যাচের ফাইনাল) ভারত পাকিস্তান কে ২-১ হারিয়ে দেয়। গোটা প্রতিযোগিতায় শচীন, সৌরভ, আজহার, আনোয়ার, সোহেল দের ব্যাটিং উপভোগ করেছিল ঢাকার দর্শক।

মার্চ মাসে বাংলাদেশ পাকিস্তানের উইলস ট্রফি খেলতে যায়। সেখানে হাবিব ব্যাঙ্ক লিমিটেড, উইলস ইলেভেন, করাচী ব্লুর কাছে হারে, কিন্তু ভাওয়ালপুর ও পাকিস্তান কাস্টমস কে হারায়। ভাওয়ালপুরের বিরুদ্ধে নান্নু ও পাইলট সেঞ্চুরী করেন।

১৯৯৮ এর মে মাসে ভারতে কেনিয়া ও বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের আসর বসে। সেই টুর্নামেন্টে প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ১৮৪/৯ তোলে বাংলাদেশ। বুলবুল ৭০ করেন। জবাবে ভারত ৫ উইকেট হারিয়ে ১৮৬ তুলে নেয়। জাদেজা ৭৩ করেন।

দ্বিতীয় ম্যাচে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। কেনিয়া ২৩৬ করেছিলো। রভেন্দু শাহ্ (৫২) ছাড়া তেমন কেউ বলার মতো রান করেনি। রফিক ৫৬ রানে ৩ উইকেট পায়। জবাবে আতাহার আলী খান (৪৭) ও রফিক (৭৭) প্রথম উইকেটেই ১৩৭ রান তুলে নেয়। ফলে ২ ওভার বাকি থাকতেই বাংলাদেশ ২৩৭/৪ তুলে জয়ী হয়। টানা ২২ ম্যাচ হারার পরে প্রথম ওডিআই জয় বাংলাদেশের। পরের ম্যাচে কেনিয়াকে ২২৬ রানে আটকে রেখে ৪০.৩ ওভারে ১৭১/৫ তুলে নিয়ে এমন অবস্থায় আসে যখন জেতার জন্য দরকার ৫৭ রান, বাকি ৫৭ বলে হাতে ৫ উইকেট। কিন্তু ২২ বল বাকি থাকতেই ২৮ রানে হেরে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। শেষ খেলায় ভারতের বিরুদ্ধে ১১৫ রান তোলে। জবাবে ভারত ১১৬/৫ তুলে ম্যাচ জিতে যায়।

সেপ্টেম্বর মাসে কমনওয়েলথ গেমস খেলতে যায় বাংলাদেশ। সেখানে বার্বাডোজ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিরূদ্ধে মোট তিনটি খেলাতেই হারে তারা।

পরের মাসে নেপালে বসে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল ট্রফির খেলা। সেখানে প্রথমে পাপুয়া নিউ গিনির ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। তারপর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপ কে সহজেই হারায় বাংলাদেশ। সেমি ফাইনাল খেলায় আরব আমীর শাহীকে ও ফাইনালে মালয়েশিয়াকে হারাতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি। এরফলে আগামি এশিয়া কাপে পৌঁছে গেলো বাংলাদেশ।

এরপরে ঢাকায় বসে মিনি বিশ্বকাপ বা আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির (প্রথম বার নাম ছিল উইলস ইন্টারন্যশনাল কাপ) আসর। দুটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচের মধ্যে প্রথমটিতে নিউজিল্যান্ডের কাছে বড় ভাবে হারলেও দারুন লড়াই হয় ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে। একসময় ১০০ রানের কমে ৫ উইকেট নিয়ে নেয় ইংল্যাণ্ডের। ইংল্যান্ড ২২৫ এর বেশি পারেনি। জবাবে বাংলাদেশ ১৯৩/৯ তোলে বুলবুলের অপরাজিত ৬৫ এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়।

এই টুর্নামেন্টের আয়োজন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একধাপ এগিয়ে দেয়। যার পূর্ণতা পাওয়ার পর্বটি চলে ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপ থেকে ২০০০ এর টেস্ট খেলার মাধ্যমে।

এরপরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘ এ ‘ ভারত ও বাংলাদেশ সফর করে ইয়ান বিশপের নেতৃত্বে। এই সফর ঘিরে ব্যাপক আকর্ষণ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। ঢাকায় প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘ এ ‘ ২৩২/৮ তোলে । এনামুল হক মনি ২৫ রানে ৪ উইকেট নেন। জবাবে আক্রম খানের ৬২ বলে ৬১, গোল্লার ৩২, বিদ্যুতের ৩৭, রোকনের ২৭, ফারুখ আহমেদের ২৬ রানের সহযোগিতায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ৫ বল বাকি থাকতে ২৩৪/৮ তুলে ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। এ দল হলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এই জয় ছিল বিশাল ব্যাপার। কারণ এই দলটাই ভারতের এ দলের বিরূদ্ধে দুটি প্রথম শ্রেণির ও দুটি লিস্ট এ ম্যাচ জিতেছিল।

এরপরের ম্যাচ ছিল রাজশাহীতে। বাংলাদেশ বাজে রকম ভাবে হারলেও শেষ ম্যাচ (একদিনের) ছিল দিন রাত্রের। বাংলাদেশ প্রথমে ২২৯ করে (বুলবুল ৫২)। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দলের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৫ ওভারে ১৯৪। প্রচণ্ড লড়াই করে এক বল বাকি থাকতেই তাঁদের ১৮৪ রানে অল আউট করে একদিনের সিরিজ জিতে নেয় বাংলাদেশ। এই প্রথম কোনও টেস্ট খেলিয়ে দলের এ টিমের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতে তাঁরা।

এরপরে শুরু হয় তিনদিনের প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। সারওয়ানের ৫৯, রেইফারের ৮৯ এর জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ তোলে ৩৮৬/৯। এনামুল হক মনি (৪/৯১) ও debut করা ফাহিম মুনতাসির সুমিত (৪/১১৬) দারুন বল করেন।

জবাবে কার্ল টাকেটের বিধ্বংসী বোলিং (৬/২৫) বাংলাদেশ কে ১৪৯ রানে ফেলে দেয়। কেবল মনি ব্যাট হাতে ২৭ করেন। ফলো অন করে দ্বিতীয় দিনের শেষে বাংলাদেশের ছিল ৮৯/২। একটা সময় সেখান থেকে ১১৮/২ ছিল। আবার লুইস, টাকেট ও বিশপ মিলে সেখান থেকে ১৭৫/৮ এ নামিয়ে দেয়। তখন ও ইনিংস পরাজয় এড়াতে বাকি ৬২ রান। এমন সময় এনামুল হক মনি জুটি বাঁধেন সফিউদ্দীন বাবুর সঙ্গে। যোগ হয় ৫৯ রান। বাবু প্রথম শ্রেণির খেলায় সর্বোচ্চ ৩২ করেন। নামলেন শেষ ব্যাটার মহম্মদ মুর্শেদ আলী খান সুমন। শেষ উইকেটে উঠলো ৬৭ রান। সুমনও কেরিয়ারের সেরা ২৫। অন্য দিকে অপরাজিত ৭৬ করলেন মনি। জয়ের জন্য দরকার ৬৫ রান দু উইকেট খুইয়ে তুলে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ, কিন্তু খেলা গড়ায় তৃতীয় দিনের শেষ পর্ব অবধি যেটা একসময় অসম্ভব মনে হচ্ছিল। দুটি উইকেটই নিয়েছিলেন বাবু।

এরপরে মেরিল চ্যালেঞ্জ কাপে পাকিস্তানের বিরূদ্ধে, মেরিল ইন্টারন্যাশাাল কাপের একমাত্র খেলায় পাকিস্তানের কাছে হার, মেরিল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হেরে যায় জিমবাবুয়ে ও কেনিয়ার কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ।

প্রকৃত পক্ষে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়া আইসিসির মডেল ছিল তুলনামূলক দূর্বল অর্থনীতির ও ক্রিকেটের দেশে ক্রিকেটের প্রচার। সেই পরীক্ষা নিরীক্ষায় তালিকায় ছিল বাংলাদেশ, নেপাল, আরব আমীর শাহী, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও কেনিয়া। এর মধ্যে শুধু আয়োজনে সফল হয় সিঙ্গাপুর ও আরব দেশ। কেনিয়া, বাংলাদেশ আয়োজন ও খেলা দুটিতেই সফল হলে এঁদের দিকে ঝোঁক বাড়ে। এই ছিল সেই পর্ব যেখানে কেনিয়া কে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ এগোবে টেস্ট স্ট্যাটাস এর দিকে, তাকে সাহায্য করবে পরের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এরপরে সেই আলোচনায় আসছি।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *