ইতিহাসের পথে পথে: একটি ক্রিকেট আলেখ্য। প্রথম পর্ব। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।
সময় বহতা নদীর মতো। প্রতিবছরই ভারতীয় মরশুম শেষ হয় ক্রিকেটে। আগে মরশুম শেষে “সব পাখি ঘরে ফেরে/ সব নদী, ফুরায় জীবনের সব লেনদেন ” এর মতো ক্রিকেটাররা কেউ ব্যবসায় মন দিতেন, কেউ অফিস করতেন। কেউ ছুটি কাটাতেন, কেউ কাউন্টি খেলতে যেতেন। এখন সেসব দিন শেষ।
এখন আলাদাই জাঁকজমক। মরশুম শেষ হলেই কর্মকর্তা থেকে দর্শক, খেলোয়াড় থেকে বড় হোটেলের ম্যানেজারদের ঘুম উড়ে যায়। এরপরেই কদিন বাদেই রং -চং মেখে সং সাজতে এগিয়ে যাবে নর-নারীর দল রেড রোড ধরে নন্দন কাননের দিকে। নন্দনকাননে বাতিস্তম্ভ জ্বলে ওঠে, শুরু হয় ‘মনোরঞ্জন কা বাপ’ আই পিএল। এদিকে ময়দানে ছায়া গভীর হয়। সব ক্রিকেটীয় ক্রিকেটীয় বিতর্ক ঘটনা কে মনে পড়িয়ে দেয়।
জন্মলগ্ন থেকে বিতর্ক ক্রিকেটের সঙ্গী। একবার দেখা যাক বাস্তবিকই খেলাটা ‘জেন্টলম্যান’স গেম’ কিনা -ক্রিকেট খেলাও সামাজিক কাজ। দুইদলের খেলোয়াড়দের ও কর্মকর্তাদের মিলিত প্রয়াস। বস্তুতঃ এর জন্ম সম্ভবত শ্রমজীবি মানুষের সময় কাটানো বিনোদনের জন্য।
কিন্তু যুগ যুগ ধরে তার পৃষ্ঠপোষক হয়ে এসেছে সমাজের উপরতলার মানুষেরা। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ক্রিকেটের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব আছে। এর কারণ সম্ভবতঃ এমন কোনো প্রত্ন-ক্রীড়া বা ক্রীড়াপদ্ধতি যার থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রিকেটের জন্ম হয়েছিল এবং সেই ক্রীড়া পদ্ধতি বা প্রত্ন-ক্রীড়ায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী ধাঁচের উপস্থিতি ছিল। বোলারের বল করা, ব্যাটারদের বল মারা, ফিল্ডারের ক্যাচ লোফা সবই ব্যক্তিগত কর্ম। কিন্তু যাবতীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ যেমন যৌথ জীবনের মাধ্যমে উন্নতি করে, তেমনি শক্তিশালী দলের দ্বারাই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়। এনিয়ে কোনোও সন্দেহ নেই যে ইংল্যান্ডে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম প্রচলিত হওয়ায় এই খেলার প্রভূত উন্নতি ঘটে, কারণ সারা সপ্তাহ কাজ করার পরে ছুটির দিন গুলো গির্জায় যাওয়ার বাধ্যতামূলক নিয়ম থেকে কিছুটা হলেও ছাড় পাওয়া যায়, যে সময়টা ক্রিকেটের জন্যই ব্যয় হওয়া শুরু হয়। মূলতঃ গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজ এই খেলাটি খেলতো।
‘গোলাপের যুদ্ধ’, বলা যায় যে সামন্তবংশ গুলিকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিল; কারণ তাঁরা সকলেই হয় ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ান বা ইয়র্কশায়রিয়ান বংশের হয়ে যুদ্ধ করে। পরে যাঁরা এঁদের শূন্যস্থান পূরণ করে তাঁরা এঁদের বংশধর হলেও মানসিকতায় অনেক আলাদা ছিল। আসলে ক্রমশঃ এঁরা বুর্জোয়া মানসিকতা নিয়ে চলা শুরু করে। এই নব্য জেন্ট্রি সম্প্রদায় গ্রামের ছোট চাষীদের জমি ও জমিদারী কিনে সেগুলিকে আকারে বাড়িয়ে নেয়। এরাই প্রাথমিকভাবে ছিল ক্রিকেটের প্রথম পৃষ্ঠপোষক। ঠিক এর পরেই তথাকথিত ‘গৌরবময় বিপ্লব’ ঘটে। শহুরে রাজতন্ত্রীদের একাংশ গ্রামে পালায়। অবস্থা উন্নতি হলে তারা যখন শহরে ফিরে আসে; সঙ্গে করে নিয়ে আসে গ্রামীণ খেলা ক্রিকেট।
অষ্টাদশ শতকে শহর ও শহরতলী অঞ্চলের পানশালাগুলোর সামনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করতো পানশালার মালিকেরা। সেখানে স্থানীয় পেশাদার ক্রিকেটারদের খেলতে ডাকতো। এরা ছিল শ্রমজীবি। কেউ ইঁটভাটার শ্রমিক, কেউ ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান, কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ রাজমিস্ত্রি। এরা যেহেতু নিজেদের পেশা ছেড়ে খেলতে আসছে, ফলে এদের খরচ ও পারিশ্রমিক দিতে হতো। সেই অর্থ কোনও ‘ধনাঢ্য অভিজাত’ই ব্যয় করতেন।
শিল্প বিপ্লবের প্রথম পর্বের শেষে যখন উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে অথচ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র হাতছাড়া, ইংল্যাণ্ডে তখন চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে, কারণ শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা খুবই সঙ্গীন, ফলে শ্রমিক ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। এর জন্য উপনিবেশিক গুলোয় উৎপাদিত পণ্য আরও বেশি রপ্তানী করতে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা কমিয়ে তাকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার দরকার ছিল। দরকার ছিল উপনিবেশগুলির শাসক শ্রেণির মধ্যে ব্রিটিশ ব্যবস্থা জনপ্রিয় করা। উপনিবেশের শাসকেরাও বুঝেছিল নিজেদের টিকিয়ে রাখতে গেলে ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে।
ফলে ক্রিকেট কে সাম্রাজ্যবাদ/ঔপনিবেশিক নীতির একটি অঙ্গ করা হয় ও উপনিবেশ গুলিতে ছড়ানো হয়। ক্রিকেট হয়ে ওঠে উপনিবেশের দেশীয় শাসক ও ব্রিটিশদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরীর মাধ্যম। এই কারণেই দরকার ছিল ক্রিকেটে ‘ভদ্রতা’র প্রলেপ লাগানোর। এরই ফল হলো ‘ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা’ এই ধারণা প্রচার।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চার্টিস্ট আন্দোলন (১৮৩৮), শিল্প বিপ্লবের প্রথম পর্বের শেষ পর্যায় (১৮৩০-৪০), বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি ও রেল গাড়ির সূত্রপাত (১৮২৫-৩০), জর্জিয় যুগের শেষে ভিক্টোরীয় যুগের শুরু (১৮৩৫-৩৭) এবং জেন্টলম্যান বনাম প্লেয়ার্সের নিয়মিত খেলা শুরু হওয়া একই সময়কালে ঘটেছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিল্প বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতার অবসান, উপনিবেশ গুলোয় প্রথম জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ভারতের মহাবিদ্রোহ বা চীনের বিভিন্ন বিদ্রোহ), আধুনিক পৃথিবীর প্রথম অর্থনৈতিক ধ্বস এবং ঔপনিবেশিক জনগণের ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রায় একই যুগে (১৮৫৯-১৮৬০)।
বেটিং, দুর্নীতি এবং পেশাদারিত্ব এই ছিল জর্জীয় বা হ্যানোভারীয় যুগের ইংলিশ ক্রিকেট। ভিক্টোরীয় যুগ প্রথম দুটিকে বাদ দিয়ে তৃতীয়টিকে নিয়ে পথচলা শুরু করে যদিও পেশাদারিত্বের চেহারা কিন্তু জর্জীয় যুগেরই ছিল। অবশ্য এই পেশাদারিত্ব ছিল তাদের কাছে গলার কাঁটা এবং এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পেশাদাররাই ভিক্টোরীয়দের খেলা শেখায় এবং খেলাটিতে বিপণন যুক্ত করে। পেশাদাররা না থাকলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট জিনিসটার জন্ম সম্ভব হত না।
পেশাদারদের চাকরের চোখে দেখা হত, এবং অধিকাংশ বোলাররা উঠে এসেছিল (বিশেষতঃ ফাস্ট বোলাররা) পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে, ফলে ধারনা হয়ে গিয়েছিল যে প্রভুরা ব্যাট করেন, আর চাকরেরা বল করে। আজও ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের প্রাধান্য এই কারনে। এমনকি নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত যাবতীয় সবকিছু বোলিংকে ঘিরে বা ফিল্ডিংকে ঘিরে। আসলে ক্রিকেটে শ্রমজীবীদের প্রথম প্রতিনিধি এই পেশাদার ক্রিকেটাররা শ্রেণি বৈষম্য এই কারনে সাঙ্ঘাতিক ভাবে চোখে পরে এই জেন্টলম্যান বনাম প্লেয়ার্স খেলা কে ঘিরে।
প্রথম দিকের শিল্প বিপ্লবের সময় এইভাবে সামন্তপ্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেইযুগে শ্রমজীবীদের প্রাধান্য বিস্তার হয়েছিল, কিন্তু এই প্রাধান্য তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেনি। সেই অধিকার শিল্প বিপ্লবের প্রথম যুগে পাওয়াও যায়নি। কৃষিতে পুঁজির প্রবেশ এবং শিল্প বিপ্লবের ফলে যে বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবীর উদ্ভব ঘটে তাঁদের একটা বড় অংশ ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং তা পেশাগতভাবেই যুক্ত হয়েছিল। এঁদের অনেকের পেশাও নির্ধারণ করেছিল ক্রিকেট।
অ্যামেচার শব্দটি ফরাসি শব্দ যা ইংরেজি ভাষায় খেলাধুলা সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৮০৪ সাল থেকে। বহু বছর আগে থেকেই ক্রিকেট সংক্রান্ত ক্লাব গুলোর খরচ-পাতির তালিকায় “খেলোয়াড়দের পেমেন্ট” নামে আলাদা হিসাব থাকত। যদিও “পেশাদার” বলতে বিশ শতকের প্রথমে বা উনিশ শতকে যা বলত তা এটা নয়। এমনকি আজকের দিনেও “পেশাদার ক্রিকেটার” ব্যাপারটা অনেক ভিন্ন।
যাই হোক প্রথম যুগে যখন বেটিং বৈধ ছিল তখন “খেলোয়াড়”, মানে প্লেয়ারসদের দাপটে খেলা নাকি ‘কৌলীন্য’ হারাচ্ছিল।
এই সময়ে জেন্টলম্যানস দল খুব একটা ভালো খেলেনি। বহু ক্ষেত্রে প্লেয়ার্স থেকে খেলোয়াড় নিয়ে দল পূর্ণ হত। এই প্রথাটি অত্যন্ত নোংরা
একটি প্রথা। কোনো পেশাদার ক্রিকেটার এই বার্ষিক ম্যাচে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলে তাঁকে আগে ‘জেন্টলম্যান’স’ দলে খেলতে হত (ভারতের গ্রামীণ সমাজের অধুনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এক কুপ্রথার মতো)। কিন্তু দলের নামকরণ
হত ‘ফিফটিন অফ জেন্টলম্যান উইথ মিস্টার অমুক’। অর্থাৎ ভদ্রলোকদের নাম আগে, আর ‘পেশাদার’দের নাম পরে। একই দলে খেললেও যাতে চিহ্নিত করা যায় কে ‘পেশাদার’। ম্যাচ গড়াপেটা এতটাই হত যে প্লেয়ার্সদের পৃষ্ঠপোষক লর্ডস্ট্যাথাভ্যানকে ১৮১৯ সালে প্লেয়ার্সদের দলে খেলানো হয়। দলের নাম ছিল ‘ইলেভেন অফ প্লেয়ার্স উইথ লর্ডস্ট্যাথাভ্যান। এটাই পরে নিয়ম হয়ে যায়। ডব্লু সি পায়ার্স কেও ১৮২৫ সালে প্লেয়ার্স দলে খেলতে হয়ে ছিল। এতদসত্বেও আসল রূপ ধারণও ভদ্রলোকেরা সর্বদাই করে ফেলতো। লুকোতে পারত না। কীভাবে?
দেখা যাচ্ছে ১৮২৯ সালের খেলায় প্লেয়ারসদের ব্যাটিং স্কোরশিটে ক্যাচ ও স্ট্যাম্পের সাথে বোলারদের নাম আছে। কিন্তু জেন্টলম্যানদের ইনিংসে নেই।
আরও দেখা যায় ১৮৩২ সালের ১৫তম খেলায় জেন্টলম্যান দলে ভিনসেন্ট কটন নামে এক বিখ্যাত জুয়াড়ি খেলেছিলেন(ইনি অনেকগুলো ম্যাচ খেলছেন যাকে প্রথম শ্রেণী ধরা হয়, এমনকি নিজের নামে দল করেও খেলেছেন)।
শুধু তাই নয়, ১৮৩৬ সালের ১৯তম ম্যাচ ছিল ঐতিহাসিক। প্রথম আধুনিক স্কোর পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু শুধু জেন্টলম্যানদের ইনিংসে।
এরপরে ১৮৩৭ সালের প্লেয়ার্সরা ব্যাট করতে নামে ৪টে করে স্ট্যাম্প নিয়ে। সেগুলি আকৃতিতেও বিরাট। ৩ ফুট লম্বা আর একফুট বেধ। মানে বল ফসকালে আউট। কিন্তু জেন্টলম্যান খেলতে নামে তিনটে উইকেট নিয়ে যা স্বাভাবিক মানের অর্থাৎ ২৭ ইঞ্চি লম্বা আর ৮ ইঞ্চি বেধ। উইলিয়াম ওয়ার্ডের এই অদ্ভুত নিয়ম সত্বেও প্লেয়ারস (৯৯ রান) এক ইনিংস ও ১০ রানে জেতে।
সবথেকে মজার ব্যাপার অধিকাংশ ম্যাচে জেন্টলম্যান দল নামতো ১৩,১৪,১৫,১৬,১৭ এমনকি ১৮ জনের দল নিয়ে। প্লেয়ার্স রা ১১ বা ১২ জনের দল নিয়ে খেলত।
এরপরেও যদি কারোর মনে হয় ‘ক্রিকেট ভদ্রলোক’-এর খেলা তাহলে তিনি নেহাৎই নিষ্পাপ মনের অধিকারী।
সে যাই হোক, রঙিন পোশাক – ব্যক্তিগত দল – ম্যাচের সঙ্গে চলা পার্টি, খেলার শেষে ব্যান্ড ও মিউজিক, সমাজের মাথাদের খেলা দেখতে আসা, গড়াপেটা, জুয়া এবং সীমিত সময়ের ম্যাচ। আজকের আধুনিক সংস্করণ কে যাঁরা মনে করেন মেকি জাঁকজমক, মোটেই ‘আসল ক্রিকেট’ নয় – তাঁরা জেনে রাখুন – সাদা পোশাকের ‘ টেস্ট ‘ ম্যাচই আসলে অর্বাচীন। সীমিত সময়ের ক্রিকেট ই প্রাচীন।
আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করতে হয়েছে। রেলগাড়ির প্রচলন দূর দূরান্তের দল গুলির মধ্যে সংযোগ ঘটায়। আজ আর বলতে দ্বিধা নেই রেল না থাকলে কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রচলন হতো না। তেমনই হতো টেস্ট ক্রিকেট যদি না স্টিম কে কাজে লাগিয়ে জাহাজ চালানো হতো। বস্তুত সমুদ্রযাত্রা বা সাগরপাড়ি দেওয়াই ক্রিকেটকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছিয়ে দেয়। অবশ্যই নতুন বিতর্ক কে জন্ম দিয়ে।
১৮৭৩ সালে ডব্লিউ জি গ্রেস, তখন তিনি ২৫ বছরের যুবক, ক্রিকেটের পিতামহ নন, যদিও অস্বাভাবিক রান করা ও উইকেট নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। সেই সময় তিনি দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে যান। সেই সফর থেকে যা আয় হয়েছিলো অত পরিমাণ অর্থ ইংল্যান্ডে ক্রিকেটের পিছনে আইনি বে আইনি কোনও প্রকারের জুয়াতেই খাটে না, সারা বছর ধরেও না।
এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই জন লিলিহোয়াইট জেমস সাউদার্টন কে পাঠালেন অস্ট্রেলিয়ায়। লক্ষ্য হলো সেখানে কথা বলে একটা ক্রীড়াসূচী বানানো। সাউদার্টন সেই কাজ সম্পন্ন করে ইংল্যান্ডে খবর পাঠালে দল পৌঁছায়।
এখান থেকেই শুরু লিলিহোয়াইট – উইজডেনের বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব। ১৮৭৬-৭৭ সালে যখন ইংল্যান্ড থেকে প্রথম প্রতিনিধিত্ব মূলক সফরে যাওয়া হল অস্ট্রেলিয়ায়, তখন উইজডেনের সম্পাদক নাইট গোটা সফর কে নিয়ে লিখলেন বটে–কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা আলাদা অংশে এবং যাকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম টেস্ট ম্যাচ বলে ধরা হয়, তা প্রায় অনুল্লেখিত থেকে গেল।
এমনকি নাইটের মৃত্যু(১৮৭৯) এর পর যখন জর্জ ওয়েস্ট সম্পাদক হলেন তখনও ১৮৮০ সালের খেলা গুলির সাথে কয়েকটা মাত্র লাইন লিখলেন গোটা সফর কে নিয়ে।
এখন প্রশ্ন হল কেন? কেউ কেউ বলেন যে ১৮৭২ সালের পরবর্তীকালে যখন সমুদ্রের তলাদিয়ে টেলেগ্রাফ লাইন পাতা হয় তখন তার খরচা ছিল খুব বেশি, ফলে উইজডেন- তখন জাহাজ গুলিতে পাওয়া যায় এমন কাগজ ব্যাবহার করতেন,– যেমন “লিডার”, “অস্ট্রেলিয়ান”, “স্পোর্টসম্যান” প্রভৃতি।
আসলে তা নাও হতে পারে। সেই সময় উইজডেন দাবি করত যে তারা তাদের পুরোন প্রতিষ্ঠিত প্রতিদ্বন্ধি দের প্রচার সংখ্যার নিরিখে পিছনে ফেলে দিয়েছে , ঠিক তখন জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়র তার দল নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যান এবং সেখানে ভিক্টোরিয়া ও নিউ সাউথ ওয়েলসএর যৌথ দলের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ খেলেন তাই ১৮৯৫ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচের সন্মান পায়। যেহেতু লিলিওহোয়াইট এর দল– তাই উইজডেন ঐ বিষয়ে কিছুই লেখেনি।
ইতমধ্যে ফ্রেড লিলিহোয়াইটের মৃত্যু হওয়াতে (১৮৬৬) জন লিলিহোয়াইট তৈরি করেছেন “জন লিলহোয়াইট ক্রিকেটারস কম্প্যানিয়ন”। তারা আবার দাবি করত যে তাদের গ্রন্থ খেলাটির সর্ববৃহৎ বার্ষিকী অন্যান্য দের তুলনায়। আবার এও বলত যে বাকিরা নাকি “ফ্যাক্ট” এর প্রতি খুব একটা নজর দেয় না। ফলে তাদের ১৮৭৮ সালের সংস্করণে তারা ১৮৭৭ এর ঐ ম্যাচ গুলির পূর্ণ খবর ছাপে।
১৯০০ সালে তাদের(লিলিহোয়াইটদের) প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের ভুত উইজডেন কে তাড়া করে বেড়াত। কারন ১৯৩০ সালে কেইন যখন সম্পাদক তখন উইসডেন দাবি করেছিল যে ১৮৭৭ সালের লিলিহোয়াইট বা ১৮৭৮-৭৯ সালের লর্ড হ্যারিসের দল কোনটাই ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারন প্রথম দল ছিল আর্থিক উদ্দেশ্যে তৈরি আর দ্বিতীয় দল চরম অপেশাদার। মনে রাখবে স্পফোর্থ এই দলের বিরুদ্ধে হ্যাট্রিক করেছিল যা টেস্টে প্রথম বলে ধরা হয়। মজার ব্যাপার। এর ফলে ১৮৮০ সালের লর্ডস টেস্ট কে তাহলে প্রথম বলে ধরতে হয়। কিন্তু তা তারা কোনোদিন ধরেনি। ধরেছে কিন্তু ১৮৭৭ কেই। কারন? দীর্ঘদিন ধরে উইজডেনের পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন সিডনি সাউদারটন। যার বাবা জেমস সাউদারটন ঐ ১৮৭৭ এর খেলায় ছিলেন ( মনে রাখবেন জর্জীয় যুগের যে কজন হাতে গোনা ক্রিকেটার টেস্ট খেলেছেন ইনি তাদের একজন।আজও সবথেকে বেশি বয়সে টেস্ট এ অভিষেকের রেকর্ড এর নামে আছে।)।
যাই হোক, মেলবোর্নে লিলিহোয়াইট দল মুখোমুখি হলো নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়ার যৌথ দলের। এই ম্যাচের টিকিট ও জুয়া থেকে বিপুল আয় হলো। ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারা অনুরোধ করলেন লিলিহোয়াইট দল কে আরও এই ধরনের ম্যাচ খেলতে। তাঁরা আরও দুটো এই রকম ম্যাচ খেলেন।
অনেক পরে ১৮৯৪ সালের মে মাসে এম.সি.সি যে ঘোষণা করে তাতে বলা ছিলঃ যে সমস্ত ক্লাব গুলি আর এম.সি.সি. এবং অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশাগত বড় দল (তখন শুধু অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকা) এবং যে দল গুলি এম.সি.সি. কখন-সখন তৈরি করে যেমন নর্থ, সাউথ, জেন্টলম্যান, প্লেয়ার্স প্রভৃতি দলগুলির মধ্যে আয়োজিত খেলাই হল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। আর ইংল্যান্ড যদি বিদেশে খেলতে গিয়ে এই ধরনের কোনও দলের বিরুদ্ধে খেলে তাহলে সেগুলিও প্রথম শ্রেণির খেলা বলে বিবেচিত হবে। এত কিছু বলা হল কিন্তু ১৮৯৪ এর আগে কোন ম্যাচ প্রথম শ্রেণির তা বলা হল না। টেস্ট ম্যাচ সম্পর্কে বলা হল যে শুধু ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে খেলা হল টেস্ট ম্যাচ। আর এই সময়েই ১৮৭৭ থেকে প্রথম টেস্ট ম্যাচ ধরা হল। লিলিহোয়াইট একাদশ হয়ে গেল ইংল্যান্ড আর নিউ সাউথ ওয়েলস ও ভিক্টোরিয়া সংযুক্ত একাদশ হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া।
এই সময় হলো সেই সময় যখন পুরোনো লেসেফেয়ার অর্থনীতি শেষ হয়ে গেছে, পুঁজি একচেটিয়া বাজার তৈরী করে ক্রমশঃ সাম্রাজ্যবাদী পর্বে প্রবেশ করছে। এমন সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূত্রপাত। বিতর্ক সহ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ক্রিকেটে দু’টি বড় পরিবর্তন আসে। প্রথমটি হল, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদে অন্যান্য উপনিবেশগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয়টি হল পিচ অনেক বেশি ব্যাটিং সহায়ক হয়ে গিয়ে রানের সংখ্যা বৃদ্ধি।
নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারত বিশ্বযুদ্ধের পনেরো বছরের মধ্যে টেস্ট খেলে। এই সমস্ত দেশগুলিতে নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচের আসর বসে। এমনকি, ব্যক্তিগত দল তৈরি করে বড় বড় সফর শুরু হয়, যা ক্রিকেটের প্রথম যুগে ব্যক্তিগত দলের ধাঁচের পুনরাবৃত্তি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। উল্লেখ করা যায়, এগুলি আজকের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের পূর্বসূরি। তবে এই পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, ব্যাটিং সহায়ক পিচ।
বিশ্বযুদ্ধের আগে রান খুব কম উঠত। টেস্ট ক্রিকেটে তো বটেই, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ট্রিপল সেঞ্চুরি কম হত, একটিমাত্র কোয়াড্রিপল সেঞ্চুরি হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের এক দশকের মধ্যেই এই সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যায়। শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই তিনটি কোয়াড্রিপল সেঞ্চুরি হয় এবং টেস্ট ক্রিকেটেও একাধিক ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়।
এখানে একটা কথা উল্লেখ করা উচিত, যদি এক দশকের সমস্ত টেস্টের সমস্ত রান ও উইকেট হিসাব করে রানকে উইকেট দিয়ে ভাগ করা হয়, তাহলে উইকেটপ্রতি গড় রান পাওয়া যায়। এই রান যদি তিরিশের নীচে হয়, তাহলে সেই দশককে বলা হয় বোলারদের দশক। দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী পর্বে এরকম কোনো দশকই ছিল না, যা বোলারদের দশক বলে চিহ্নিত করা যায়। এই যুগেই ডন ব্র্যাডম্যান, বিল পনসফোর্ড, লেন হাটন, ওয়ালি হ্যামন্ড, জর্জ হ্যাডলিদের মতো ‘রানমেশিন’সম ব্যাটারদের আবির্ভাব ঘটে। এ কথাও সত্যি যে, লারউডের মতো পেস বোলার এই যুগেই জন্মান।
উল্লেখ করা যায়, যখন বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক ধ্বস নামে, ঠিক তখনই সবথেকে বেশি রানের বৃষ্টি দেখা গিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পঞ্চাশের দশক ছিল বোলারদের দশক। এই যুগেই রানের গতি কমতে থাকে এবং বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত আর্থিক সংকটের কারণে মাঠে দর্শকের সংখ্যাও কমতে থাকে। ক্রিকেট আবার নতুন মোড় নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই ঘটনাগুলি বারংবার প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ক্রিকেটের নীতি নির্ধারণ ও প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে ক্রিকেটে ব্যাপক মন্দা আসে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ অর্থাৎ টেস্ট ম্যাচ ছাড়া মাঠে লোক হচ্ছিল না। এখন যেমন আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে ঘরোয়া ক্রিকেট এর একটা বড় খরচ ওঠে,
তখন ব্যাপার ছিলো উল্টো। ঘরোয়া ক্রিকেটের অর্থের যোগান আন্তর্জাতিক ম্যাচ সংগঠিত করতে সাহায্য করত। ফলে কাউন্টি ম্যাচে সমস্যা শুরু হয়।
এই সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী এমসিসি সীমিত ওভারের খেলা শুরু করে। প্রথমে ১৯৬২ সালে লিস্টারশায়ার, নটিংহ্যামশায়ার, নর্দাম্পটনশায়ার ও ডার্বিশায়ার এর মধ্যে শুরু হয় মিডল্যান্ড নক-আউট কম্পিটিশন। ব্যাপক সাড়া ফেলে, টিভি সম্প্রচার হয় এই টুর্নামেন্টের।
এমসিসি সিদ্ধান্ত নেয় বড় আকারের টুর্নামেন্ট করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৩ সালের পয়লা মে শুরু হল জিলেট কাপ। সীমিত ওভারের ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ব্যাপক ভাবে। আস্তে আস্তে সীমিত ওভারের খেলা সর্বত্র শুরু হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও একে কিভাবে প্রয়োগ করা যায় তাই নিয়ে ভাবনা শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে জিলেট কাপ জয়ী ইয়র্কশায়ারকে সুযোগ করে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটি সীমিত ওভারের ম্যাচ খেলার, কিন্তু ম্যাচটি বৃষ্টির জন্য হয়নি। আবার ওই বছরেই ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ইংল্যান্ড ট্যুর করে, সবকটি ম্যাচ ছিলো ৪০ ওভারের। এর মধ্যে সাসেক্সের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ তাঁরা খেলেন, সেই ম্যাচে সাসেক্সের হয়ে মনসুর আলী খান পতৌদি খেলেছিলেন, এবং শেষ ম্যাচটি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে ম্যাচে গ্যারি সোবার্স ৬১ করেন।
এখানে বলে রাখা ভালো নব্বইয়ের দশক থেকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ গুলির মধ্যে যে গুলি প্রথম শ্রেণীর দল খেলে সেগুলিকে লিস্ট এ ম্যাচ বলা হয়। এই ‘লিস্ট এ’ তকমাটির আবিষ্কার করেন এসোসিয়েশন অফ ক্রিকেট স্ট্যাটিস্টিয়ান আ্যন্ড হিস্টোরিয়ান নামে একটি সংস্থা। ২০০৬ সাল থেকে ICC এই তকমা সরকারিভাবে মেনে নেয়। প্রতিটি odi কিন্তু লিস্ট এ ম্যাচ ও বটে।
জিলেট কাপ লিস্ট এ ম্যাচ ছিল কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স দলের কোনো খেলাই এই স্বীকৃতি পায়নি, যদিও এই ম্যাচ গুলি সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচের জনপ্রিয়তা ব্যাপক বাড়িয়ে দেয়। সম্ভবত পতৌদির শেষ নবাব-ই প্রথম ভারতীয় যিনি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেন। ১৯৬৬ সালে জিলেট কাপ জেতে ওয়ারউইকশায়ার। সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটা ম্যাচ খেলে। এছাড়া সারের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলে একটি একদিনের ম্যাচ আয়োজন করা হয়। যথারীতি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স সফর করে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলে। এরই মধ্যে রথম্যান্স ওয়ার্ল্ডসিরিজ কাপ খেলা হয়। বিশ্ব একাদশ ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিলে অঘোষিত ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই ম্যাচ প্রকৃত অর্থে প্রথম আন্তর্জাতিক একদিনের ম্যাচ হওয়ার যোগ্য কিন্তু এই ম্যাচের এমনকি লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।
৪ঠা মার্চ, ১৯৬৭। জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ৫০ ওভারের খেলায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩২৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জিতে যায়। মজার ব্যাপার ঐসফরের টেস্ট ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে ধরা হলেও এই ম্যাচটি odi স্বীকৃতি পায়নি, যদিও লিস্ট এ স্বীকৃতি পায়। আসলে ওই সময় কমনওয়েলথ এর বাইরে চলে যাওয়ায় আইসিসি এই ম্যাচ গুলিকে টেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা একপ্রকার জোর করে একে টেস্ট ধরে। যেহেতু তখন odi বা লিস্ট এ সম্পর্কেকোনও ধারণা ছিল না তাই এই ম্যাচ লিস্ট এ হিসেবে পরে ধরা হলেও ওডিআই স্বীকৃতি পায়নি।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান রথম্যান্স ওয়ার্ল্ডক্রিকেট কাপ জেতে। এখানেও ১১সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান লিস্ট-এ বা ওডিআই ধরা হয়নি। যদিও পাকিস্তান কেন্টের বিরুদ্ধে একটা লিস্ট এ খেলে, পাকিস্তানের সব ক্রিকেটারের লিস্ট এ ক্রিকেটে ডেবিউ হয়।
ভারত ও ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স এর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে ৪০ ওভারের। ভারত ৪০ ওভারে ২৩২ রান তুলে ১৫ রানে হেরে যায়। রমেশ সাকসেনা ৭১, হনুমন্ত সিং ৫০ ও অজিত ওয়াদেকার ৪৭ করেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ২৪৭ করেছিল। সোবার্স ও লয়েড ৮৬ করেন।
১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে এই প্রায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাভেলিয়ার্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি খেলতে পারেনি।
আসলে এই সময় প্রায় সব ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটার কাউন্টি খেলতে ইংল্যান্ডে থাকতেন। ফলে প্রদর্শনী ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম নিয়ে এরা খেলতেন বোর্ডের অনুমতি ছাড়া। সম্ভবত এই কারণে এই ম্যাচ গুলির কোনও লিস্ট এ স্বীকৃতিও নেই।
১৯৭০ সাল থেকে জিলেট কাপের পাশাপাশি জন প্লেয়ার লিগ চালু হয়। সব সিনিয়র কাউন্টি দল একে ওপরের বিরুদ্ধে খেলে। জিলেট কাপে কিছু মাইনর কাউন্টি দলও খেলে। এরপরেই বছরেই ইতিহাস তৈরি হয়।
১৯৭০/৭১ মরশুমে এমসিসি গিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ৭ টি টেস্ট খেলা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মেলবোর্ন এর তৃতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে শেষ দিন দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য ৮ বলের ৪০ ওভারের ম্যাচ খেলা শুরু হয়। জিওফ বয়কট, জন এডরিচ, কিথ ফ্লেচার, বেসিল ডি অলিভিয়েরা, কলিন কাউড্রে, রে ইলিংওয়ার্থ, জন স্নো, এলান নট, প্রভৃতি মূলত টেস্ট খেলে বিখ্যাত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা খেলতে নামেন বিল লরি, ইয়ান চ্যাপেল, ইয়ান রেডপাথ, গ্রেগ চ্যাপেল, রডনি মার্শ, ডগ ওয়াল্টার্স, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, কিথ স্ট্যাকপোলদের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ব্যাটিং নেয়। ৩৯.৪ ওভারে ১৯০ করে তাঁরা অল আউট হন। জন এডরিচ ৮২ করেন। এটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম অর্ধ-শতাধিক রান। জবাবে অস্ট্রেলিয়া ৩৪.৬ ওভারে (আগেই বলেছি ৮ বলের ওভার)
৫ উইকেট হারিয়ে ১৯১ রান তুলে নেন। ইয়ান চ্যাপেল ৬০ রান করেন। ৪৬,০০৬ জন দর্শকদের উপস্থিতিতে ৩৩,৮৯৪.৬০ মার্কিন ডলার উপার্জন হয়েছিল।
পরের বছরেই এর সাফল্য সুনিশ্চিত ভেবে প্রুডেন্সিয়াল কাপ চালু হয় ইংল্যান্ডে। অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের এই দ্বি-পাক্ষিক সিরিজে ইংল্যান্ড ২-১ এ জেতে। প্রথম ম্যাচেই ডেনিস আমিস শতরান করেন।
এরপরেই চলে আসে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড। বেভান কংডনের দল অতি সহজে ইন্তিখাব আলমের দলকে হারায়। ১৯৭৩ সালে প্রুডেন্সিয়াল কোম্পানি দুটো সিরিজ স্পন্সর করে। নিউজিল্যান্ড বনাম ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ড যার প্রথম ম্যাচে ৩ বল বাকি থাকতে ১ উইকেটে জেতে ইংল্যান্ড, গ্যারি সোবার্সের জীবনের প্রথম ও শেষ odi ম্যাচ, পরের ম্যাচে অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৮ উইকেটে জয়ী হয় রয় ফ্রেডরিক্স এর ১২২ বলে করা ১০৫ রানের সুবাদে।
এরপরেই শুরু হল অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড সিরিজ (১৯৭৪)।
১৯৭৪ সালের ১৩ জুলাই। দিনটার গুরুত্ব ভারতের কাছে ২৫ শে জুন ১৯৩২ এর মতোই হওয়া উচিত ছিল। লিডসে ভারত মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। একদিনের ক্রিকেটে প্রায় নবাগত (সংগঠিত ভাবে) ভারত ৫৩.৫ ওভারে ২৬৫ করে। ব্রিজেশ প্যাটেল ৭৮ বলে ৮২ করেন, অজিত ওয়াদেকার ৮২ বলে ৬৭ করেন। গাভাস্কার ৩৫ বলে ২৮ রানই শুধু করেননি, একটা ছয় ও মেরেছিলেন।
তবে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বোলারদের অনভিজ্ঞতা ইংল্যান্ড কে মাত্র ৫১.১ ওভারে ২৬৬ রান তুলতে সাহায্য করে। এর পরের ম্যাচে ভারত খুবই খারাপ ভাবে হারে, সেই ম্যাচে প্রথম বাঙালি হিসেবে odi খেলার রেকর্ড গড়েন গোপাল বসু।
ভারতে একদিনের ক্রিকেট অর্থাৎ যে সব ম্যাচ পরে লিস্ট এ তকমা পায় তা শুরু হয় ১৯৭৩/৭৪ সালে। দেওধর ট্রফি নামের সেই প্রতিযোগিতা ছিলো প্রফেসর বলবন্ত দেওধরের নামে। তাঁর তখন বয়স ৮১ বছর। এই জীবন্ত কিংবদন্তির নামে শুরু হওয়া প্রতিযোগিতা ছিল জোনাল ফরম্যাটের। জয়ী হয় পশ্চিমাঞ্চল। প্রথম ম্যাচে হেরে বিদায় নিলেও পূর্বাঞ্চলের গোপাল বসুর করা ৫২ (বনাম দক্ষিণাঞ্চল) শুধু প্রথম হাফ সেঞ্চুরি নয়, ওই প্রতিযোগিতার তৃতীয় ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ছিলো। এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য ছিলো ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি।
ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বকাপ (অবশ্যই পুরুষদের; কারণ মহিলাদের প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হয় ১৯৭৩ সালে) বসে ১৯৭৫ সালে। প্রুডেন্সিয়াল
কোম্পানি বিশ্বকাপ স্পন্সর করে। প্রথম দিন ভারত বনাম ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বনাম পাকিস্তান এর ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তী পর্বের।