অকূলের কাল। পর্ব ৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

কাকুর ব্র্যাকেট
ক্ষিতির ধারণা সে ভালো বাংলা লেখে, তার কল্পনাশক্তিও বেশ, সাহিত্যিক সে হতেই পারে। বিভূতি মাণিক তারাশঙ্কর সমরেশ গোত্রের নয়, ভালো ভালো পত্রিকায় গল্প-উপন্যাস ছাপা হওয়ার যোগ্য সাহিত্যিক। কিন্তু সেসব পত্রিকায় লেখা পাঠাতে হয় কেমন করে সেটাই জানে না এখনও। এ-পর্যন্ত তার তিনটে লেখা ছাপা হয়েছে। প্রথমে গড়বেতা স্কুলের ম্যাগাজিনে একটা দেশপ্রেমের কবিতা সেই চিন যুদ্ধের সময়, দ্বিতীয়টা গড়বেতা কলেজের ম্যাগাজিনে, সে যখন ইলেভেনে পড়ে। তবে সেটা ছাপা হয়েছে রবিয়ালের নামে। রবিয়াল তার সঙ্গে গড়বেতার স্কুল বোর্ডিং-এ থাকত, তার থেকে এক ক্লাস উপরে। ক্ষিতি যখন ইলেভেন-এ, সে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে। একদিন বোর্ডিং-এ এসে বলল, কলেজ ম্যাগাজিন বেরোবে, একটা গল্প লিখে দাও। দিল ক্ষিতীশ। এক দম্পতির ভুল-বোঝাবুঝি, শেষে ভুলের নিরসন এবং মিলন। সারা গল্পটাই সংলাপে। গল্পটা লিখতে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি, ভাবতেও হয়নি বিশেষ। তেমন কোনো দম্পতি তার অভিজ্ঞতার ত্রিসীমানায় ছিল না। সম্ভবত তার পড়া অসংখ্য গল্প-উপন্যাস চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমেছিল তার কলমে। তৃতীয়টি নিজেরই নামে ছাপা হয়েছিল গড়বেতা কলেজের ম্যাগাজিনে পরের বছর। সে এক প্রেমে প্রত্যাখাত মহৎ-হৃদয় তরুণের বিয়োগান্ত কাহিনি। প্রায় দেবদাসীয় আখ্যান। লিখতে লিখতেই অঝোরে অশ্রু নেমেছিল ক্ষিতির চোখে। তার ভাষাতেও লেগেছিল অশ্রুর ঝংকার। সে-গল্প পড়ে ধন্য ধন্য করেছিল সবাই। সবাই মানে নিজেরই লোক অবশ্য – বন্ধুবান্ধব, শ্যামলের মেজদি বড়দি মামা। এখন ক্ষিতির যেন আবছা মনে হয়, আবেগটা বোধ হয় বেশিই হয়ে গিয়েছিল গল্পটায়। উপন্যাসটায় তাই এখনও সে তেমনভাবে প্রেমকে পাত্তা দেয়নি। যদি আনতেই হয় আবেগ সামলে রাখতে হবে।
এখন দরকার পাঠক, ভালো পাঠক। যাদের মতামতের উপর নির্ভর করা যায়। দিনু প্রথম দিন থেকেই তার উপন্যাসের পাঠক। খানিক খানিক লেখা হলেই সে দিনুকে পড়ে শোনায়। কখনও কখনও অনুপম আর শচিও এসে বসে। অনুপম মন দিয়েই শোনে, শচি আনমনা, তবে দিনুর মত নিয়মিত কেউ নয়। কিছু দিন পরেই অভাবিতভাবে একজন নিয়মিত পাঠক পেয়ে গেল ক্ষিতি। মলয়। একদিন ১৯ নম্বরে পাঠের আসরে সামান্য সময় এসে বসেছিল। সেদিনই এক নম্বর খাতাটা চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। পরের দিনই দু নম্বরটা নিয়ে গেল। মলয়কে আগ্রহী দেখে বেশ শ্লাঘা বোধ করল ক্ষিতি। সে একটু বিচ্ছিন্ন ভাবেই থাকে। তার রুমে গিয়ে মোটা মোটা ইংরাজি বই দেখেছে ক্ষিতি। সবই পদার্থবিদ্যার নয়, বেশ কিছু আছে ইতিহাসের। সে মন দিয়ে পড়ছে ক্ষিতির উপন্যাস! তবে পড়ার পরে সে ভালোমন্দ কিছুই বলে না। দিনু অবশ্য খুবই মুগ্ধ পাঠক। ক্ষিতির তাতে খুব মন ভরে না। আরও বুঝদার কাউকে পেলে ভালো হয়, যে নিজেও লেখালেখি করে। কেন জানি মনোজিৎদাকে ক্ষিতির খুব আকর্ষক লাগে। শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা, সুদর্শন বলা যাবে না। কিন্তু মুখের মধ্যে বেশ একটা বুদ্ধির ছাপ আছে। কথা কম বলে, নিজের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই বলে না। কিন্তু অন্য ব্যাপারে যখন বলে, ছোট ছোট দুএকটা বাক্যে, তখন বেশ লাগে। এমন অনেক কিছু, যা ক্ষিতি জানে না। বলার মধ্যে সূক্ষ্ম রসবোধের আভাস পাওয়া যায়। মনোজিৎ দা দাবাটাও বেশ ভালো খেলে। ক্ষিতি অল্পস্বল্প শিখেছিল, পশ্চিমি পদ্ধতি, ভারতীয় পদ্ধতি – এসব কিছু জানত না। রাজা মন্ত্রী গজ ঘোড়া নৌকা বোড়ে জানত, কিং কুইন বিশপ নাইট রুক পন আর সেই সঙ্গে কিছু চালের নাম শিখল মনোজিৎদার কাছে। কিন্তু ক্ষিতি দাবাটা ভালো পারে না। শুরু করে চমকপ্রদ ভাবে, খানিক অব্দি সতর্ক থাকে। কিন্তু তার ধৈর্য খুবই কম। একটু পরেই তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে যায়, ওদিকে রক্ষণ যে আলগা হয়ে যাচ্ছে খেয়াল থাকে না। যখন খেয়াল হয় তখন মাত হওয়া ছাড়া রাস্তা থাকে না। একবার তো মনোজিৎদা সাদা বোড়ে আর বিশপের তিন-চারটে চালেই তার কালো রাজাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিল। পরে জানল সেটাকে বলে বিশপ ওপেনিং। তারপর থেকে সেটা বেশ কিছুদিন ক্ষিতির প্রিয় ওপেনিং হয়ে উঠেছিল।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল মলয়ের সঙ্গে মনোজিৎদার দাবা বেশ জমে উঠেছে। অনুপম আর প্রদীপও দাবা খেলায় পোক্ত হয়ে উঠল ক্রমশ। দাবা দিয়ে মনোজিৎদাকে কাছে টানা যাচ্ছে না, আবার অনুপম প্রদীপও সেদিকে চলে যাচ্ছে দেখে ক্ষিতির মন খারাপ হচ্ছিল। একদিন সে একঝাল তাস কিনে নিয়ে এল। তারপর ব্রিজ খেলা আরম্ভ করল। তার গ্রামের নিরক্ষর লোকেরাও অক্সন ব্রিজে ওস্তাদ। সেই ঐতিহ্যের ভাগীদার ক্ষিতিও। অনেক ছোটো থেকেই সে এই খেলা রপ্ত করেছে। দেখা গেল শচি, দিনু, প্রদীপ এবং অনুপমও অক্সন ব্রিজটা খেলতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই দাবা ছেড়ে ব্রিজে ভিড়ে গেল প্রদীপ অনুপম। এই চারজন ক্ষিতির মতোই পড়াশুনায় ফাঁকিবাজ। প্রতি সন্ধেয় আর ছুটির দিনে নিয়মিত তাসের আসর বসতে লাগল। দেখা গেল ক্ষিতিই ব্রিজের সব চাইতে কুশল খেলোয়াড়। কাজেই আসরের মধ্যমণি সে-ই। দিনুর ‘কাকু’ এই আসরেই ক্রমশ সকলের কাকু হয়ে উঠতে লাগল। এখন কাকু উপন্যাসের খাতা নিয়ে লিখতে বসলে কেউ না কেউ এসে বলে, আরে কাকু তোর ভবেনকে এখন ঘুম পাড়িয়ে রাখ। ব্রিজ হবে কখন? লেখার চাইতে ব্রিজের আকর্ষণ ক্রমশ বেশি মনে হচ্ছে কাকুর।
অভীক হস্টেলে এসেছে সবার শেষে। নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হয়েও মাস তিনেকের মধ্যে মহারাজদের সঙ্গে গণ্ডগোলে জড়িয়ে টিসি নিয়ে জয়পুরিয়ায় ঢুকেছে। ফিজিকস। দারুণ চেহারা। লম্বা, ফরসা, চৌকো মুখ, মেদহীন টানটান শরীর। মুখের মধ্যে হালকা কঠোরতার আভাস। কথা বলার সময় চিবুকে রেখা ফেলে প্রতিটি শব্দ চেপে চেপে উচ্চারণ করে। পড়াশুনায় বেশ মনোযোগ। কর্তৃত্ব করার প্রবণতা আছে। ভালো খারাপ নিয়ে স্পষ্ট মতামত তার। সব নেশাই খারাপ, তার মধ্যে তাস খেলা নিকৃষ্টতম। তাসের আসর বসলে তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করে আর মাঝেমাঝেই তার মতামত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতে থাকে। ‘শালা কাকুটাই যত নষ্টের গোড়া, সব বন্ধুদের বারোটা বাজাচ্ছে’। কাকু বা অন্য কেউ তাতে কর্ণপাত করে না। তারা ব্রিজেই একাগ্র হয়ে থাকে। হতাশ না হয়ে অভীক সুযোগ বুঝে তাসের প্যাকেট হাপিশ করতে লাগল। তাতেও যখন আসরে তাসের অভাব দেখা গেল না, পুরনো নিখোঁজ হলে নতুন চলে আসে, অভীক খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারপর একদিন সে নিঃশব্দে এসে কাকুর পিছনে বসে গেল। দেখে দেখে, দরকারে কাকুকে প্রশ্নে প্রশ্নে কণ্টকিত করে ব্রিজ শেখার চেষ্টা করতে লাগল। অবশেষে একদিন ঘোষণা করল, আমিও খেলব আজ, কাকুর পার্টনার।
কাকুর ব্র্যাকেটে অভীকই ঢুকল সবার শেষে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই সে ব্র্যাকেটের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করল নিজেকে। হস্টেলের খাওয়া চলে মেস-পদ্ধতিতে। এক মাসের জন্য একটি ছেলে মেসের ম্যানেজার নিযুক্ত হয়। তার কাজ প্রতিদিন বিকেলের টিফিনসহ তিন দফা খাবারের মেনু ঠিক করা, বাজার করা, হিসাবপত্র রাখা, মাসের শেষে একটা গ্র্যান্ড ফিস্ট দিয়ে সারা মাসের হিসাবপত্র দাখিল করা। পুরো মাসের খরচ অনুসারে ছাত্র পিছু মেস চার্জ হিসাব করে মেস সেক্রেটারির কাছে দাখিল করেই তার ম্যানেজারির মেয়াদ শেষ হয়। পরের মাসে অন্য কোনো ছাত্রকে ম্যানেজার নিযুক্ত করবে মেস সেক্রেটারি। কোন ম্যানেজার কেমন খাওয়াল তার একটা তুলনামূলক চর্চা চলে হস্টেলে। মেস চার্জ সাধারণত চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই পরিমাণও ম্যনেজারের দক্ষতা ও সততার একটা মাপকাঠি হিসাবে বিবেচিত হয়। পরের বছর হোস্টেল কমিটি নির্বাচনের সময় মেস পরিচালনার সাফল্য অসাফল্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। হোস্টেল সুপার এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের পরিচালনায় ছাত্র-কমিটির এই নির্বাচন কখনও হয় সহমতের ভিত্তিতে, কখনও বা ভোটাভুটির মাধ্যমে। নির্বাচিত এগারো জন সদস্য তাদের মধ্য থেকেই চারজন পরিচালন-সেক্রেটারি মনোনীত বা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচিত করে; জেনারেল সেক্রেটারি, মেস সেক্রেটারি, কালচারাল সেক্রেটারি এবং গেম সেক্রেটারি।
তো হস্টেলের খরচ, কলেজের মাইনে, হাতখরচ ইত্যাদি নিয়ে ষাট টাকার কমে মাস চলে না কারোর। সবার বাড়ি থেকে সমান টাকা আসে না। কাকুর ব্র্যাকেটের অভীককে বাদ দিলে আর সকলের বাড়ির একই অবস্থা। কাকুর তো ষাট টাকাও সময়ে আসে না, দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। তার একমাত্র রোজগেরে দাদা অকালে চলে গেছেন। বৃদ্ধ বাবা মনের জোরেই এর তার থেকে হাওলাত নিয়ে টাকা পাঠান এবং একান্নবর্তী পরিবারের কারোর কারোর নীরব অনুযোগ সয়ে ধান বিক্রি করে নির্দিষ্ট সময়েই উত্তমর্ণদের ঋণ শোধ করেন। খুব দেরি হলে অমরশঙ্করের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। অমরশঙ্কর অবশ্য বলা মাত্রই দিয়ে দেন, টাকা কবে ফেরত পাবেন সেই নিয়ে বাক্যব্যয় করেন না। যদিও কাকু এবাবদে তার বাবার অনুসারী, টাকা আসামাত্র প্রথমেই দাদার ধার শোধ করে আসে। দাদা সেক্ষেত্রেও রা-টি কাড়েন না। এই দাদাটির স্থিতধী চরিত্র বুঝে গেছে কাকু। না বলা কথাটি এই যে, লাগলে তো অবশ্যই নিবি, ফেরত দিতে পারলে ভালো, না পারলেও বলার কিছু নেই।
সমূহ দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাল অভীক, কাকুর ব্র্যাকেটের স্বনিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক।
(ক্রমশ)