খড়কুটোর জীবন : এক মাঘে যায়নি যে শীত। পর্ব ২ । লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
শীতে আমাদের ছোটোদের আর একটি বিশেষ কাজ ছিলো নেওরভাঙা। নেওর আসলে শিশির। ধানের বীজতলা যাকে আমরা বলতাম ‘পাতুখোলা’, সেই পাতুখোলায় সূর্যোদয়ের পূর্বে গিয়ে পালকের মতো পাটকাঠি বুলিয়ে কচি ধানের শীর্ষদেশে জমা শিশির ভূমিতে মেশানো। যা জল সেচনের কাজ করে দিতো। তবে বৈকালে নয়নজুলির জল বালতি বা দ্রোণে করে সেঁচ দেওয়া হতো। কবে যেন একটা বাহনের গায়ে লেখা দেখেছিলাম – ‘শিশিরে কী ধান হয় জল না পেলে / দূরে থেকে প্রেম হয় কাছে না এলে।’ হুঁ হুঁ শিশিরে ধান হয় না কে বলেছে? নেওর ভেঙে বাড়ি ফিরে বড়োদের বলতাম ‘শৈবাল দিঘিরে কহে উচ্চ করি শির / লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।’ আমিও সবুজ মাঠের এক ছোট্ট রাজা। ধানের চারাগুলোর নরম সবুজ আভা দেখে বিমোহিত হয়ে তার উপর গড়াগড়ি দিতে ইচ্ছে করতো। ঠিক যেন মনে মনে হয়ে উঠতাম রবি ঠাকুরের বলাই। দিদিকে দেখতাম ভাই ফোঁটার দিন দূর্বা ঘাসের উপর থেকে সোনালী শিশির সংগ্রহ করতে। শিশিরের জল দিয়ে চন্দন ঘষে দিদি আমার কপালে দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দিতো। দিদি আজ বহু দূরে। তবু শীত এলেই ঘাসের ডগার শিশিরে দেখি দিদির মুখ।
বেঁটে-খাটো ফর্সা টাক মাথার মিষ্টি বুড়ো। সেকালের নাকি আই-এ পাশ। আমাদের কচিদের সঙ্গে ভাব ছিলো ষোলো আনা। গল্পে আর ছড়ায় আমাদের যেন রূপকথার ছায়াছবি দেখাতেন। শীতের সময় স্কুলে যেতে বা আসতে দেখা হলেই দাদুর কমন কোশ্চেন ছিলো — ‘বলতো, কুজ্ঝটিকা শব্দের মানে কী?’ আমাদের অজ্ঞতা বুঝতে পেরে দাদু নিজেই উত্তর দিতেন –‘হে হে, পারলে না তো! এটার মানে হলো কুয়াশা।’ আশ্চর্য হতাম সন্ধ্যা বা ভোরে প্রকৃতি জুড়ে থাকা সেই ছায়ার ঘোমটাকে ‘কুজ্ঝটিকা’ বলে এটা জেনে। অতীতের কুয়াশারা আজও এসে দাঁড়ায় ঝোপঝাড়ে। সঙ্গে আনে পুরাতন গল্পদের। পাতা ঝড়ার শব্দে শুনি দাদুর হাসি। সে হাসিতে সূর্যোদয়ের রঙিন চিঠি লেখা হয়। আর মনে হয় — ‘কুহেলী গেল, আকাশে আলো দিল যে পরকাশি ধূর্জটির মুখের পানে পার্বতীর হাসি।’
আপনাদের যেমন শীত জুড়ে চলে পিকনিক, আমাদের তেমন চলতো পৌষলা। চড়ুইভাতি নিয়ে বেশ মজা হতো। ভাবতাম চড়ুই পাখি ভাতে দিয়ে খাওয়া যেমন আলুভাতি। এখন ভাবি এ তো হিমানীশ গোস্বামীর ‘অভি ধানাই-পানাই ‘-এর শব্দার্থের ব্যাখ্যা। যেমন, যারা গর্জন করেন তাঁরাই গার্জেন সেইরূপ। গ্রামের লোক সকলে মিলে চাল-পয়সা তুলে হতো মাঠে গিয়ে বনভোজন। খিচুরি আর পালংশাকের ঘ্যাঁট কলাপাতায় গ্রাম্যজীবনে নিয়ে আসতো সম্মিলনের উষ্ণতা। মাটিতে বসে হাপুসহুপুস সাম্যের স্বাদ উঠে আসতো আটপৌরে জিহ্বায়। দশ-মনি কড়াই থেকে বালতি ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারি সারি বসা রাজা-উজির-ভিখারীর পাতে। যেখানে কেউ ব্রাত্য নয়। যেখানে কেউ সেই আনন্দ আহারে গাইছে -‘যেমন দিদি রাঁধেন বাড়েন তেমনি দাদা খান /পেটের খিদে পেটে রেখে উঠে চলে যান।’ খাওয়া শেষ হলে শূন্য মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে শুধু কলাপাতা। শিশিরের জল ধুইয়ে দিতো যেমন সমস্ত গ্রাম্য কলহ-বিবাদ, কুয়াশা ঢেকে দিতো সব অভাব অনটন শীতের সেই বনভোজনে।
আমাদের ছোটোদের অন্তত তিন দিন হতোই পৌষলা। কেননা একদিন করলে কুকুর, দু’দিন করলে মেকুর আর তিনদিন করলে ঠাকুর। সবাই ঠাকুর হতে চাইতাম, কুকুর-মেকুর হলে চলবে না। সকাল থেকে শুরু হতো আমাদের আয়োজন। মেনু বলতে ভাত, বেগুন ভাজা আর গোটা গোটা ডিমের ঝোল। আহা কী আহ্লাদ! বাড়িতে তো হাফ ডিম। সকলের বাড়ি থেকে চাল, তেল, মশলা, আলু, বেগুন, লবণ জোগাড় হতো। জ্বালানি এর ওর বাড়ি থেকে আনা বোঝা খানেক পাটকাঠি। মায়েরা হাঁড়ি-কড়াই দিতেন একটাই শর্তে যে মেজে ধুয়ে সেগুলো আবার বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। সকলে খাওয়ার জন্য নিয়ে যেতাম থালা। খাওয়াও হতো আবার বাজিয়ে গানও হতো – ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে / আসি আসি বলে জ্যোৎস্না ফাঁকি দিয়েছে।’ অথবা – ‘মন মানে না আমার মন মানে না।’ কিশলয়ের পাতা থেকে উঠে এসে আমাদের কেউ যেন গান গাওয়ার দিব্যি দিত – ‘আঃ উঃ কেন কর / শীত লাগে গান ধরো।’
বৈকালের আগেই বাড়ির কাছাকাছি খামারে উনুন খোঁড়া হতো। রান্না শুরুর আগে কাছের বটগাছটিকে পৌষলার নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসতাম। বলতাম – ‘হে, বটবৃক্ষ আজ আমাদের পৌষলা। তোমার অন্তরঙ্গ নিমন্ত্রণ রইলো।’ অন্ধকার নামতেই জ্বলে উঠতো উনুন। প্রথমে ভাত। তারপর ডিমসিদ্ধ। ভাত সিদ্ধ হয়েছে কিনা দেখার জন্য প্রায় সব ভাতই টিপে ফেলতাম। কেউ হয়তো বললো আমার এই ধাঁধাঁর উত্তরটা কে বলতে পারে দেখি – ‘একটু খানি ঘরে / মাছ চুরবুর করে।’ কেউ বলে দিল – ‘ভাত।’ সবার জয়ের হাসি। ভাত হলে একদিকে ডিমের খোসা ছাড়ানো আর একদিকে বেগুন ভাজা। তারপর আলু আর ডিমের ঝোল। রান্না শেষ হলে সবাই গোল হয়ে লম্ফর মিটি মিটি আলোয় খেতে বসা। তবে তার আগে সবার থালা থেকে ভাত, বেগুন ভাজা আর এক চিমটি করে ডিম নিয়ে একটা কলা পাতায় করে নিয়ে দিয়ে আসা হতো নিমন্ত্রিত বটবৃক্ষকে। তিনি দৃষ্টি দিলে তবেই আমাদের খাওয়া। তারপর উত্তুরে হাওয়া প্রবল হলে আঁধারের পথ ধরে পৌষলার স্বাদ জিভে ঘরে ফেরা। ততক্ষণে কেরোসিনের কুপি নিভিয়ে রাত লেপের তলায়।
মুসলমান পাড়ার ছেলেরা একটা বাঁশের ডগায় ঝালর দেওয়া সবুজ কাপড় আর ফুলের মালা নিয়ে মানিক পীরের নামে বাড়ি বাড়ি চাল তুলতো। মুখে বলতো – ‘মানিক চাঁদ, মানিক চাঁদ মা মরেছে / জোহরে নমাজ পড়ে ফকির হয়েছে।’ তার পর ফিরে গিয়ে তারা করতো এলা। এলা হলো ঐ আমাদের পৌষলা।
জামাই ষষ্ঠীর মতো গ্রামে পৌষপিঠেতে জামাই আনার চল ছিল। কোনো কোনো জামাই সন্ধ্যার পর এসে আবার ভোর বেলা বাড়ির পথ ধরতো। এমন জামাইদের মসকরা করে বলা হতো – ‘রেতের রাজা কেদার রায় / রেতে আসে রেতে যায়।’ শুধু জামাই কেন বাড়ির সবার জন্যই মা, ঠাকুমারা আপন আপন শৈলী অনুসারে বানাতেন – সরা পিঠে, আন্দসা (অন্দরসা), দুধপুলি, ভাজাপুলি, কলাই ডাল, বেগুন ভাজা, সরু চাকলি, পায়েস প্রভৃতি। পিঠে বানানোর জন্য কুমোর বাড়ি থেকে আনা হতো সরা আর ঢাকা। চালের ময়দা গুলে উনুনে তপ্ত সরায় এককাপ পরিমাণ গোলা ঢেলে দিয়ে ঢাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। কয়েক মিনিট পরেই ঢাকা খুলে ফুলে ওঠা পিঠে তুলে নেওয়া। মেয়েরা ভালো পিঠে বানানোর জন্য মন্ত্র বলতো – ‘কাণ্টায় শিয়াল ফোলে, উনানে পিঠা ফোলে।’ তবে অনেকে ‘বকের পাখনা’ বলে পিঠে মন্দ করতো বলে বিশ্বাস। ঐ কথা বললে নাকি পিঠে কাঁচা থাকে। ক্রমশ বেতের ধামা ভরে উঠতো সাদা পিঠেয়। খেজুর গুড়ের সঙ্গে খাওয়াও শুরু হয়ে যেতো গরম গরম। রবি ঠাকুরের ‘পেটে ও পিঠে’ গল্পটা মনে এসে যেতো তখন। বারবার বলতাম – ‘পেটে খেলে পিঠে সয় কিন্তু পিঠে খেলে পেটে সয়না।’ পৌষ সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যা বেলা বিচালি ভিজিয়ে এনে বাড়ির বিভিন্ন আসবাব ও দরজার শিকলে বেঁধে রাখা হতো। আর মুখে বলা হতো – ‘পৌষ পালালো, পৌষ পালালো সদর দরজা দিয়ে / পৌষকে আমি বাঁধবো নাঙ্গালা দড়ি দিয়ে।’ রাতে উঠানের বিভিন্ন স্থানে, গোয়ালের সামনে, সদর দরজায় আতপচাল, সিঁদুর আর ফুল দিয়ে আতালি পাতা হতো। সকালে মেয়েরা এগুলো আর পৌষ আগলানো খড় গুলো জলে দিয়ে স্নান করে আসতো।
শীতের শুরুতেই লেপওয়ালারা চলে আসতো। সাইকেলের পিছনে কেউ তুলোর বস্তা, কেউ লেপ বা তোষকের খোলের বান্ডিল আর কেউ তুলো ধোনার ধনুচি নিয়ে। খেজুর পাতার মাদুরের তুলো ধুনে লাল শালুর মধ্যে ঢুকিয়ে শুরু হতো সেলাই। সূচটা মাথার সর্ষের তেলে বার বার ছুঁইয়ে নিয়ে লাল শালুর তুলো ভরা বুকে সেলাই এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হতো পদ্ম বা শালুক ফুল।
সেলায়ের সময় আঙুলের অগ্রভাগকে বাঁচানোর জন্য লাগানো হতো লোহার বিশেষ ক্যাপ। স্মৃতির আকাশে এখনো ওড়াউড়ি করে সেই ধুনাই করা শিমুল তুলো।
সোয়েটার, টুপি, মাফলার বোনার ধুম লেগে যেত মেয়েমহলে। ক্রুশে গেঁথে তুলতেন তাঁরা ভালোবাসার উষ্ণতা। তারপর কবে ‘মাঘ মরিল ফাগুন হয়ে খেয়ে ফুলের মার গো’ জানতেই পারতাম না।
(ক্রমশ)