নায়িকার ভূমিকায়। ষষ্ঠ পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
১৮৩৫ সালের ৬ই অক্টোবর কলকাতার শ্যামবাজারের নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে সে এক হই হই রই রই কাণ্ড! এযুগের নিরিখে দেখলে কাণ্ড অবশ্য তেমন কিছুই নয় – নাটকের অভিনয়ে মেয়েদের অংশ নেওয়া মাত্র। যুগের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বসু মহাশয়ের বাড়িতে যখন ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটক মঞ্চস্থ হল, মহিলা চরিত্রে অভিনয় করলেন অভিনেত্রীরা। ব্যাপার এইটুকুই। কিন্তু সেযুগের অন্তঃপুরের বাইরে নারী অভিনেতাদের (/অভিনেত্রী) এরকম সাহসী উপস্থিতি নাড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বঙ্গসমাজকে। নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠল সমাজের ‘শিক্ষিত’ পুরুষ সম্প্রদায়ের ভেতরেই। অভিনেত্রীদের সু-অভিনয় দেখার কৌতূহল ছাপিয়ে মুদ্রণ সংস্কৃতির পাতার পর পাতা ভরে উঠল নাটকের অভিনয়ের প্রস্তাবনা ও উচিত- অনুচিতের নির্দেশনামায় । মেয়েদের অভিনয়ের বিরোধিতা এতই বেশি ছিল যে “নাট্যশালা বেশ্যাশালায় পরিণত হইবে” এই ভয়ে নারীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল অভিনয়ের অধিকার। সমাজের এই সব গণ্য মান্য অভিভাবকদের সম্বন্ধে ঐতিহাসিক অজিত কুমার ঘোষ লিখেছেন – “যদিও বারাঙ্গনা গমনে তাঁদের প্রবল অনুরাগ ছিল, কিন্তু বারাঙ্গনা নিয়ে অভিনয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না’।
চলচ্চিত্রের পর্দার বাইরে নায়িকার যে নির্মাণ নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম এই ধারাবাহিকের আগের পর্বে , তার একদিকে যেমন ছিল বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক নির্মাণ (স্ত্রী স্বাধীনতা/ স্ত্রীশিক্ষার প্রশ্নে বহুবিধ মত, অন্তপুরের বাইরের জগতে মহিলাদের সীমানা নির্দেশ ইত্যাদি) অন্যদিকে আবার জরুরি ছিল অন্য মাধ্যমগত নানা নির্মাণ- থিয়েটারে মেয়েদের অভিনয় করা নিয়ে সমাজের মাথাদের রাগ-ক্ষোভ ও নিন্দেমন্দ! উনবিংশ শতকের শেষে এসে অবশ্য মঞ্চে মেয়েদের উপস্থিতি স্বাভাবিক হয় অনেকটাই । আর পরের শতকে জনপরিসর ও বিশেষত নাট্যমোদীরা স্বীকৃতি দিতে শুরু করে মঞ্চের “দুঃসাহসিকা”দের! সমসাময়িক মুদ্রণ সংস্কৃতিতে মঞ্চের নায়িকাদের নিয়ে পাতার পর পাতা আলোচনা তারই দলিল। চলচ্চিত্রের পর্দার নায়িকাদের নিয়ে আলোচনার পূর্বসূরী বলা যেতে পারে থিয়েটারের নটীদের নিয়ে মুদ্রণ সংস্কৃতির এই আগ্রহ-আলোচনা, বিশ্লেষণের আসর।
নাটক ও তার নট-নটী দের নিয়ে আগ্রহ-আলোচনা জানান দেয় যে, বিংশ শতকের প্রথম দুটি দশকে বাংলার চলচ্চিত্র শিল্প যখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিচ্ছে তখন বাংলার অন্যান্য কিছু বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু নতুন ভাবে গড়ে উঠছে । তাদের মধ্যে থিয়েটার ও সঙ্গীত জগৎ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। একদিকে ম্যাডান, অরোরা প্রভৃতি স্টুডিও নির্মাণ, নতুন প্রযুক্তি ইত্যাদির সাহায্যে গল্প বলে চলচ্চিত্র যেমন জনপ্রিয় বিনোদন ও কর্ম সংস্কৃতির নির্মাণের মধ্যে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছিল। অন্যদিকে থিয়েটার পাড়া- বিশেষ ভাবে মিনার্ভা ও স্টারের মতো কিছু সংস্থা ও বেতার জগৎ ও সাড়া জাগিয়েছিল । মাধ্যমগত প্রতিযোগিতা তো ছিলই, কিন্তু এই দুই বিনোদন মাধ্যম ও তাদের কলাকুশলীদের থেকে সিনেমা পাড়া উপকৃত ও হয়েছিল।
এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য হল নায়িকার ভূমিকা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা ইহুদি নর্তকী বা অভিনেত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলচ্চিত্রের পর্দায় অভিনয় করছিলেন মঞ্চের নটীরা। নাটকের অভিনয়ের তালিম তাঁদের এগিয়ে রেখেছিল অন্যান্য নায়িকাদের চেয়ে। অন্য দিকে অনেক নাটক পরিচালকেরাই এই সময় চলচ্চিত্রে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁদের হাত ধরেও মঞ্চের নটীরা আসেন পর্দার নায়িকার ভূমিকায়। তারক বালা (মিস লাইট), মনোরমা দেবী, নিভাননী দেবী, কুসুম কুমারী, হরি সুন্দরী, নীরদা সুন্দরী, শিশু বালা, শশীমুখী একের পর এক মঞ্চ নায়িকারা দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন ছবির পর্দায় । মঞ্চের নায়িকারা তাই পর্দা ও পর্দার নায়িকাদের শুধু সমান্তরাল এক নির্মাণই নন। অনেক সময়েই মঞ্চ, পর্দা, নাট্য ও চিত্রনাট্য সবটা মিলে মিশেই নায়িকার নির্মাণ। মঞ্চের নামজাদা নায়িকারা অনেক সময়ে সঙ্গীতের তালিম নিয়ে হয়ে উঠছেন বিখ্যাত বেতার গায়িকা । আবার বেতারের জগৎ থেকে অনেকেই হয়ে উঠছেন পর্দার খ্যাতনামা তারকা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নর্তকী বা অভিনেত্রীদের তুলনায় এই থিয়েটার-বেতার- পর্দার গায়িকা-নায়িকাদের কেরিয়ার অন্য রকম ভাবে বর্নময়। তাই মনে হল এইসব পর্দা ও মঞ্চের নায়িকাদের নিয়েও দু’এক কথা বলা দরকার ।
থিয়েটার গবেষকদের লেখায় যিনি প্রথমেই উল্লেখ্য তিনি তারক বালা বা মিস লাইট। নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথা “নিজেরে হারায়ে খুঁজি” তে লিখেছেন সে সময়ের আর্ট থিয়েটারের একটি বিশেষ প্রযোজনার একটি ট্রিক সিনের কথা – যেই দৃশ্যে একটি ছোট্ট মেয়ে স্টেজে এসে দাঁড়ালে তার গা দিয়ে আলো বেরিয়ে আসতো । সবটাই একটা ফিট করা তার আর লুকোনো সুইচের কারসাজি, আর সেই ছোট্ট মেয়েটিকে দিয়ে বারবার রিহারসাল করানো হতো। সেই বাচ্চা মেয়েটি খেলাচ্ছলে এদিক সেদিক চলে গেলেই এই দৃশ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত পটল বাবু বলে উঠতেন , “এই দ্যাখ দেখি লাইট মেয়েটা আবার কোথায় গেল!” এই ‘লাইট মেয়ে’, ‘লাইট মেয়ে’ করতে করতেই মঞ্চ ও পর্দার নায়িকা তারক বালা মিস লাইট হয়ে গিয়েছিলেন! পরবর্তী কালে ‘ফুল্লরা’ নাটকে নাম ভূমিকায়, ‘শ্রী বৎস’ নাটকে মালিনী, ‘রাজসিংহ’ নাটকে ‘পানওয়ালী’ এরকম বহু বহু আইকনিক চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মিস লাইট। এরপর যোগদান চলচ্চিত্রের পর্দায়। সে সময়ের নামী পরিচালক নরেশ মিত্র ফিল্মে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন তারক বালাকে। আর তাজমহল ফিল্ম কোম্পানি থেকে অরোরা একের পর এক স্টুডিও কর্তৃপক্ষ-এর বড় প্রযোজনাগুলোয় কাজ করেন তিনি । ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯২৪), ‘কৃষ্ণসখা’ (১৯২৭) – পর্দায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে কুড়ির দশকে ফিল্মের তারকা হয়ে ওঠেন তারক বালা। শুধু মঞ্চ আর পর্দাই নয়, বেতারেও ওঁর খ্যাতি ছিল। সঙ্গীতের জগতে এসেই প্রথমে সখ্যতা ও পরে প্রেম ও পরিণয় প্রখ্যাত দৃষ্টীহীন সঙ্গীতকার কৃষ্ণচন্দ্র দে’র স ঙ্গে । ১৯৪০ এর গোড়ায় সন্তান শোকে মঞ্চ-বেতার ও পর্দার জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি ।
ছবিতে মিস লাইট। ছবিটি ১৯৩৩ এ মুক্তিপ্রাপ্ত নরেশ মিত্র পরিচালিত সাবিত্রী’র প্রচার চিত্র থেকে নেওয়া ।
এরপর যাঁর কথায় আসব তাঁর নাম মনোরমা হলেও কাপ্তেন মোনা বা ক্যাপ্টেন মোনা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। নাচে, গানে, অভিনয়ে পারদর্শিনী এই নায়িকার বোহেমিয়ান জীবনের নানা গল্প ও সেই জীবনের নানা রকম ওঠা-পড়ার পর্ব থেকে পর্বান্তর পাল্লা দেবে তাঁর অভিনীত যে কোনও ছবির চরিত্রকে। প্রীতিদেবী মুখোপাধ্যায় মোনার পরিচয়ে লিখেছিলেন “কোনও সেনা বাহিনী বা ঝাঁসির রাণীবাহিনীর কোনও ক্যাপ্টেন নন। এককালে টাকা আর জীবনটা খোলামকুচির মতো দুই তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে জীবন জুয়ায় মত্ত হয়েছিলেন বলেই অন্তরঙ্গদের কাছ থেকে তিনি কাপ্তেন মোনা উপাধি পেয়েছিলেন। অজস্র উপার্জন করেছিলেন, বেপরোয়া ভাবে জীবনটাকে ছুটিয়ে দিয়েছিলেন বলগাহীন অশ্বের মতো।” তাঁর নাটকে অভিনয়ের কেরিয়ারে প্রথমে মিনার্ভা, পরে কোহিনূর, তারপরে আর্ট থিয়েটার ও তারও পরে মিত্র থিয়েটারে বারে বারে কর্মক্ষেত্র বদলেছেন তিনি। বিশের দশকের মাঝামাঝি হঠাৎই থিয়েটারের অভিনয় ছেড়ে যোগ দিলেন চলচ্চিত্রে। ম্যাডানের প্রযোজনায় ‘জয়দেব’ (১৯২৬), ‘চণ্ডীদাস’ (১৯২৭) সহ আরও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ছবিতে কাজ করেন তিনি। তারপরে চলে যান বাংলার বাইরে, বেশ কিছু কাজ করেন পাঞ্জাব ও লাহোরে। ১৯৩৬ এ চলচ্চিত্রের দুনিয়া থেকে আবার ফিরে আসেন থিয়েটারে, কিন্তু তারপর আবার যোগ দেন সিনেমায়। এই দ্বিতীয় পর্বের কাপ্তেন মোনার সিনেমার জীবন নিয়ে প্রখ্যাত থিয়েটার গবেষক অমিত মৈত্র লিখেছেন – “আবার অর্থের বর্ষণ আর লাগামছেঁড়া জীবন … স্বাধীনতার যুগ পর্যন্ত মনোরমার চলচ্চিত্র জীবনের সাফল্য আজও অভিনেত্রীদের ঈর্ষা জাগাবার পক্ষে যথেষ্ট”। শোনা যায়, এরকম সফল, গুণী ও সর্বঅর্থেই ক্যারিশমাটিক নায়িকার শেষ জীবন নাকি কেটেছিল প্রবল অর্থকষ্টে, দারিদ্রে, অবহেলা ও লাঞ্ছনায়। বেহিসেবী জীবন কাটিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে উনি নাকি অ্যামেচার নাটকে ছোট পার্ট করে দিন চালাতেন। জীবনের সেই দিনগুলিতে বিশিষ্ট নাট্য গবেষক দেব নারায়ণ গুপ্তকে উনি একদিন বলেছিলেন “ঐশ্বর্যে সুখ নেই দাদা, দুঃখে সুখ আছে”। কাপ্তেন মোনা সেইসময়কার শুধু একজন অভিনেত্রীই নন, একটি মিথ – যাঁর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত সবটা জুড়েই একটা রোমহর্ষক ছবির অভিনয় চলেছিল যেন। পর্দার অগুনতি নায়িকার চরিত্রের বাইরেও নিজের জীবনের সেই রোমাঞ্চকর ছায়াছবির নায়িকার ভূমিকায়ও ছিলেন কাপ্তেন মোনা!
(চলবে )
তথ্যসূত্রঃ
অজিত কুমার ঘোষ, “বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস”, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৫।
অহীন্দ্র চৌধুরী, “নিজেরে হারায়ে খুঁজি্”, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড প্রাইভেট লিমিটেড।
অমিত মৈত্র, “রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী”, আনন্দ, ২০০৪।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।