শরৎচন্দ্র দাসের ‘তিব্বত যাত্রীর ডায়েরি’। প্রথম পর্ব । অনুবাদে অমৃতা চক্রবর্তী
প্রথম পর্ব
প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক যেদিন আমাকে আমার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লিখতে বললেন তাঁর পত্রিকার জন্য, তখন প্রথমে বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। ঠিক কতটা ঘটনাবহুল আর রোমাঞ্চকর ছিল আমার জীবন সে নিয়ে আমার নিজেরই সন্দেহ হল। কী লিখব তাহলে? পরে অনেক ভেবে দেখলাম, সারা জীবন স্বঘোষিত সভ্য সমাজের সাথে আমার খুব একটা কম ঝামেলা হয়নি! এমনকি মাঝেমধ্যে তাতে নিজের জীবনের বিপদ অব্দি ডেকে এনেছি। সেইসব ঘটনা হিসেব করে দেখে মনে হলো আমার জীবনে লেখার মতো অনেক বিষয় রয়েছে বইকি। আমার জীবনে আমি দুই শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি — ইউরোপীয় ও ভারতীয় এবং চৈনিক ও তিব্বতীয়। প্রথম পক্ষের মানুষ সাধারণত দ্বিতীয় পক্ষকে অর্ধসভ্য বলেই ভেবে থাকে। তবে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি এটুকু বলতে পারি যে, এই দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বিতীয় পক্ষের মানুষ অনেক বেশি সহজ-সরল আর খাঁটি।
আমি চৈনিক এবং তিব্বতীয়দের সঙ্গে শুধু যে একসাথে থেকেছি তাই নয়, অবারিত হৃদয়ে তাদের সাথে মেলামেশাও করেছি। এবং তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। তিব্বতে বসবাস করা কালীন আমার একটা টাকাও খোয়া যায়নি। তবে দেশে ফিরে প্রথম যে ভারতীয়কে বিশ্বাস করেছিলাম, তিনি আমাকে প্রতারণা করে একশত টাকা আত্মসাৎ করেন।
মূলতঃ তিব্বত-সরকারের সাহায্যেই আমার তিব্বত ভ্রমণ সম্ভবপর হয়েছিল। আমার নিজের দেশের সরকারের সাথে আমার সম্পর্কের সমীকরণের ওঠা-পড়া, কিছু সরকারি আধিকারিকের সন্দেহপ্রসূত অসহযোগিতা — এই সব কথা আমি যথাসময়ে বিস্তারিত বলব। আমার দেশের সিংহভাগ লোকেই বন্য এবং দুর্গম স্থানে অভিযানে যেতে ভয় পায়, কারণ তারা কদাচিৎ বাড়ির বাইরে বের হয়। তাই ভূগোল এবং বিজ্ঞানের প্রতি আমার হৃদয়ের বিনীত সমর্পণনকে তারা হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারেনি।
নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করার সময় যখনই অধৈর্য হয়েছি, আমায় স্বস্তি দিয়েছে মহান পার্সি কবির সেই বিখ্যাত পঙক্তিমালা:
“হে রক্ষাকর্তা, ধৈর্য্য ধর, সব প্রতিকূলতায়, নিশিদিন,
একদিন চলার পথে পাবে খুঁজে লক্ষ্য বাধাহীন।
হে হাফিজ, ঝড়-ঝঞ্ঝায় বাঁধো বুক দিবারাত্র,
কোন একদিন মিলে যাবে ঠিক তব বিজয়ক্ষেত্র।”
একটা ছবি তৈরিতে যেমন আলো আর ছায়ার সংস্পর্শ প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে সাফল্য আর ব্যর্থতার মেলবন্ধনেই জীবন। আমার চাকরিজীবনের গোড়ার দিকগুলো যতই রসকষহীন হোক না কেন, আমার ভাগ্য এই যে, পরবর্তীকালে আমি একটা রোমাঞ্চকর জীবন পেয়েছিলাম। নইলে এ আত্মকথন লেখার দরকারই হতো না হয়তো, সম্পাদক মশাইও আমাকে লেখার জন্য অনুরোধ করতেন না।
ডক্টর পল্ ক্যারাস ছিলেন বৌদ্ধধর্মের প্রসিদ্ধ ছাত্র। যদি তাঁর লেখা ‘গসপেল অফ বুদ্ধ’ এবং বৌদ্ধ দর্শনের উপর অন্যান্য কাজগুলো তিব্বতি ভাষায় লেখা হতো, তাহলে তা হয়তো মহাযান প্রবর্তকের দর্শন পাওয়ার সমতুল্য হতো। আমার সহোদর নবীনচন্দ্রের (‘রঘুবংশ’ এর স্বনামধন্য অনুবাদক) কিছু কাজ দেখতে গিয়ে আমি তাঁর কথার উল্লেখ পাই। মূলতঃ ‘লেজেন্ডস এন্ড মিরাকেলস অফ বুদ্ধ’ এবং ‘দ্য এইনশ্যন্ট জিওগ্রাফি অফ এশিয়া’-তে তাঁর ঘটনাবহুল কর্মকাণ্ডের উল্লেখ আমার মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি আমাদের দুই সহোদরের নামে ‘চন্দ্র দাস’ এর উল্লেখ দেখে তাকে আমাদের পদবি বলে ধরে নেন।
ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের তাদের পদবি ধরে ডাকা হয়। তাদের ক্ষেত্রে নিজেদের নামের চেয়ে পদবীর গুরুত্ব বেশি। বহু-ঈশ্বরবাদের দেশ ভারতবর্ষে পুরাকাল থেকে শিশুর নাম পার্থিব কিংবা স্বর্গীয় কোন দৈবশক্তির নামানুসারে রাখার প্রবণতা চলে আসছে। যেমন ভারতবর্ষের বিখ্যাত কবি কালিদাসের নামের তাৎপর্য হল ‘দেবী কালীর দাস’। এটা তাঁর পদবি নয় অবশ্যই। তবে একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হিসাবে তাঁর পদবি হয়তো ‘উপাধ্যায়’ (উপাচার্য), ‘দ্বিবেদী’ অথবা ‘ত্রিবেদী’ (দুই অথবা তিনটি বেদের উপাচার্য)। রামায়ণের পরাক্রমী নায়ক ‘রামচন্দ্র’ এর নামের অর্থ হল ‘রম্যশশী’। ক্ষত্রিয় বংশের উত্তরসূরী হওয়ার দরুণ তাঁর পরিবার নিশ্চয়ই বীরত্বের পরিচায়ক কোন পদবি ধারণ করত। এইভাবে বিক্রমাদিত্য এবং প্রতাপাদিত্য (যথাক্রমে মালব্য এবং বাংলার দুই মহান ব্যক্তিত্ব) নামের তাৎপর্য হলো ‘সূর্যের ন্যায় শক্তিশালী’। আমরা জানি যে প্রতাপাদিত্যের পদবি ছিল ‘রায়’ যার অর্থ হল ‘প্রধান’। সুতরাং এই দৃষ্টান্তগুলো থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, ভারতবর্ষে নামকরণের ক্ষেত্রে পদবি কম গুরুত্বপূর্ণ। তাই পাশ্চাত্যের জানা উচিত যে আমরা ভারতীয়রা আসল নামেই পরিচিত, পদবি দিয়ে নয়। পদবি মূলতঃ জাত এবং পেশার নিরিখে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
আমার নাম শরৎচন্দ্র এবং আমার ভাই নবীনচন্দ্র — এই দুটি নাম আমার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা নামকরণ অনুষ্ঠানে (যেটা আমাদের জন্মের প্রথম মাসেই আয়োজিত হয়) দিয়েছিলেন।
রাঢ়বঙ্গ থেকে আগত সম্ভ্রান্ত বৈদ্য বংশে আমাদের জন্ম। সেখানে মোঘল সাম্রাজ্যের বিজয় লাভের পর চট্টগ্রাম এর পরগনা চাকসলা নামক অখ্যাত এক গ্রামে আমাদের পূর্বপুরুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। যদিও আমাদের পূর্বপুরুষ গোপালচন্দ্র ‘রায়’ পদবি বহন করতেন, কিন্তু পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্নতার কারণে আমাদের পদবি হয়ে যায় দাশগুপ্ত। প্রকৃতপক্ষে এই পদবি বৈদ্যদের যারা ভরদ্বাজ গোত্রের ধর্মানুষ্ঠান পালন করত।
এর সাথে সিকিম হিমালয়ে আমাদের প্রথম অভিযানের কথা যদি যোগ না করি, আমার এই ভূমিকাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ১৮৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিকিম অভিযাত্রার এই রোমাঞ্চকর বর্ণনা নবীনচন্দ্রের লেখা থেকে নেওয়া।
(সম্পাদনাঃ শোভন সরকার)
বইটার পিডিএফ বা বই টা কোথা কিনতে পাবো জানাবেন।