শরৎচন্দ্র দাসের ‘তিব্বত যাত্রীর ডায়েরি’। দ্বিতীয় পর্ব । অনুবাদে অমৃতা চক্রবর্তী
১৮৭৭ সালের ২৭ শে জানুয়ারি বিকেলে আমরা দার্জিলিং থেকে যাত্রা শুরু করি এবং দিনের শেষ আলো নিভে না যাওয়া পর্যন্ত পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামতেই থাকি। সেই রাত্রিটা আমাদের বাদামতাম নামক একটা জায়গার কাছে বিস্তৃত খোলা আকাশের নিচে কাটাতে হয়। এখানকার তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ; বাঁশের ওপর একটা পর্দা দিয়ে ঢাকার দেওয়ার পর উপরের অঞ্চল থেকে আসা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে আমাদের কিছুটা রক্ষা হয়। বেশ কিছু ভুটিয়া দার্জিলিং এর দিকে যাচ্ছিল। তারাও সেই রাতে আমাদের সাথে আশ্রয় নেয়। পরের দিন সকালে পাখির সুমিষ্ট ডাকে এবং পাহাড়ি ঝরণার কলকল শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই ছোটো ছোটো নদী এবং ঝরনার জলের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এগুলি আসলে গ্রামের উপস্থিতিকে জানান দেয়। প্রত্যেকটি পাহাড়ি গ্রামের পাশেই এক বা একাধিক নির্ঝরণীর অবস্থান দেখা যায়। তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ ছোটো ছোটো নুড়ি এবং বড় পাথর কেটে গতিপথ ঠিক করে নেয়। কিছু ছোটো নদীর ধারা এতই প্রবল যে কোনো কিছুই তার সামনে টিকতে পারে না। শক্ত পাথরের খাঁজ কেটে, ভারী পাথরের চাঁই ভেঙে, গাছের কাণ্ড বা গুঁড়ি ভাসিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। কোনো জায়গায় মৃদু প্রবাহ আবার কোথাও হয়তো শ’ফুটের উচ্চতা থেকে নীচের উপত্যকায় তীব্রবেগে পড়ছে জলপ্রবাহ। সেখানে প্রবল জলোচ্ছাসের সাথে প্রচুর ফেনা তৈরী হতে থাকে। পাহাড়ি বাতাস ঝরনার শাশ্বত সুরে মুখরিত হয় এবং তাদের বন্য রাজকীয়তার জমক চোখকে বড় আরাম দেয়। যদিও এখানকার ঠাণ্ডাটা অবর্ণনীয়। এই ঝরনাগুলি পাহাড়ি নদীর উৎস, যারা সমভূমিকে উর্বর করে তোলে। এরকম ছোটো ছোটো প্রবাহধারা একে অপরের সাথে মিশে প্রচণ্ড স্ফীত তীব্রধারায় পরিণত হয়। যেমন রঙ্গীত এবং তিস্তা নদীর (তিস্তার উৎস ধূসর বরফাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা) সম্মিলিত ধারা। ঠিক তেমনই হয়েছে গঙ্গা নদীর ক্ষেত্রেও। পুরাণে কথিত আছে, শিবের জটা থেকে গঙ্গার উৎপত্তি। হিমালয়ের তুষারাবৃত শিখরকে যদি ঈশ্বরের প্রতীক বলে ধরা হয় তাহলে এটা কখনোই অবাস্তব বলে মনে হয় না। এটা ঠিকই যে বেশিরভাগ নদী গলা বরফে পরিপূর্ণ হয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরাসরি নিচে পড়ছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি পাহাড়ের ধার থেকে শুরু হয়ে পাহাড়েই জলধারাগুলি মিশে গেছে। এই জায়গায় অভিক্ষিপ্ত এক শিলা থেকে ঝরনার জল পড়ছে। সেখান থেকে বাঁশের নল দিয়ে প্রয়োজনীয় পানীয় জল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এরকম দারুণ পদ্ধতিতে স্থানীয় পাহাড়ি লোকেরা নিজস্ব উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সাহায্যে নিজেদের জলের যোগান পূরণ করে। সমতলের বাসিন্দাদের মনে হতেই পারে এখানে জলের আকাল আছে। সেটা এক অর্থে সত্য ঠিকই, কিন্তু অপরপক্ষে এটাও ঠিক, সমতলের বাসিন্দাদের পুকুর কিংবা কুয়ো খুঁড়ে যেমন জলের চাহিদা মেটাতে হয়, পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের সে ঝক্কি নেই। একটা ঝরনার তলায় দাঁড়ালেই বা একটা ছোট নল ব্যবহার করলে কিংবা তিন-চার ফুট দীর্ঘ নলের সাহায্যে কাজ সেরে ফেলা যায়। কোনো মাটির বা ধাতুর তৈরি পাত্রের সাহায্য নিতে হয় না। কৃতজ্ঞতার সাথে আমাদের একটা কথা মনে রাখা উচিত যে, পাহাড়ের সন্তানরাই প্রথম প্রকৃতির এই অপার জল রাশির দানকে গ্রহণ করে। তাদের চাহিদা পূরণের পর সেই অনন্ত জলধারায় সমতলে আমাদের নদীমাতৃক সভ্যতা পালিত হয়।
আমরা যাত্রাপথে বেশ খানিকটা নামার পর সকাল আটটায় বিশালকায় রঙ্গীত নদীর তীরে এসে পৌঁছালাম। এই নদী ইংরেজ অধিকৃত অঞ্চল ও সিকিম রাজ্যের সীমানা। রঙ্গীতের উপর আমি এই প্রথমবার বহুশ্রুত বেতের সেতুকে চাক্ষুষ করি। সেতুটিকে দেখে ভীষণ পুরােনো লাগল আমার এবং বর্ষাকাল ছাড়া খুব একটা ব্যবহৃত হয় না বা প্রয়োজন পড়ে না। এরপর আমরা গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছোটো নৌকার সাহায্যে পথে পড়া একটা ছোটো নদী পার হলাম। সিকিমে রঙ্গীত নদীর তীরে কয়েকটা ঘণ্টা কাটিয়ে দুপুরে ফের যাত্রা শুরু হলো। দিনের বাকি সময়টা আমরা পাহাড় বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকি। যখন নামচি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত প্রথম ভুটিয়া মঠে এসে পৌঁছালাম, তখন চারিদিকে সন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। এখানে নিরেট পাথরের একটি আয়তাকার স্তূপ আছে যেটি প্রায় দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট, ১০ ফুট প্রশস্ত এবং উচ্চতায় ৬ ফুট। অমসৃণ স্তূপটির চারিদিকে ছোটো ছোটো কুলুঙ্গি আছে, এগুলোর ভেতরের দেওয়াল মসৃণ পাথরের চাঁই দিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটা পাথরে বুদ্ধদেবের নানা ভঙ্গির চিত্র, রুদ্র বা মহাকাল এবং দুর্জ্ঞেয় পদ্মের ওপর দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। দেওয়ালের বহির্গাত্রে তিব্বতি ভাষায় নানা দেবদেবীর নাম এবং মন্ত্রের বাণী খোদিত। বৌদ্ধস্তূপ গুলির সামনে এবং পিছনে কিছু পতাকা লাগানো। পতাকাগুলির উপর তিব্বতি হরফ সাজিয়ে সুন্দর আকার তৈরি করা হয়েছে। এই আকারগুলির সাথে দেওয়াল চিত্রের অনেক মিল আছে। পতাকাগুলির আকৃতিও অদ্ভুত রকম — প্রায় আধ গজ প্রশস্ত রেশমের কাপড় এর লম্বা প্রান্ত খুঁটির সঙ্গে জোড়া আছে। এগুলো যখন প্রবল বাতাসে ওড়ে, দেখে যেন মনে হয় বাতাসের দিকে ফেরানো এক একটা ছুরির সুতীক্ষ্ণ ফলা। প্রত্যেকটি ভুটিয়া গ্রামের সামনে লম্বা বাঁশে একই ধরনের পতাকা টানানো আছে। তাদের বিশ্বাস এগুলো অশুভ আত্মাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ঠিক একই উদ্দেশ্যে গাছের শাখায় অজস্র লেখাজোখাময় কাগজের টুকরো বাঁধা থাকতে দেখা যায়।
আমরা মঠে পৌঁছােতেই, প্রচুর যুবক এবং বৃদ্ধ ভুটিয়া আমাদের দেখার জন্য ভিড় করে আসল। চোখেমুখে বিস্ময় তাদের। বাকিদের সবার থেকে একটু আলাদা, অপেক্ষাকৃত প্রবীণ একজন ব্যক্তি এগিয়ে এসে আমাদের সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা জানান। তিনি এই মঠ-প্রধান বা লামা।
নামচি গুম্ফাটি নতুন। কাঠের স্তম্ভগুলোর সিংহভাগ রুচিসম্মত বৌদ্ধ শৈলীতে অলংকৃত এবং বেশ নয়নাভিরাম। রাতে খাওয়ার পর সারাদিনের ক্লান্তি আমাদের গভীর ঘুমের দিকে ঠেলে দিল।
সকালে উঠে আমরা টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরের দিকে ওঠা শুরু করলাম। সিকিমের পাহাড় বাংলার সমতলের পাহাড়ের মতো নয়। এখানে পাহাড়ের উপর পাহাড়। আমরা একটু করে উপরে উঠছিলাম আর কুয়াশা ঘেরা নতুন এক একটা চূড়া আমাদের সামনে এসে হাজির হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম সমতলের মানুষ বলে আমাদের এতটা ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল।
দুপুর বেলায় একটা সুবিস্তৃত ওক গাছে ঘেরা জঙ্গলে পৌঁছালাম। পথের দু’দিকে যতদূর চোখ যায়, দেখি অন্তহীন, সুউচ্চ, খাড়া ওক গাছের সারি, স্বমহিমায় বিরাজমান। জায়গাটি এতই ঘন অরণ্যময় যে হয়তো কোনো বন্যপশুও ঠিকভাবে ছুটতে পারবে না। বেশিরভাগ গাছ প্রায় শত বছরের পুরােনো। তাদের গুঁড়িগুলো পতাকা দণ্ডের মত ঋজু, প্রায় তিন চারশো ফুট উঁচু। উপরের শাখা-প্রশাখারাজি চারিদিকে ছাতার মতো বিস্তৃত। দেখলে মনে যেন একটা সম্ভ্রম জাগে। কয়েক ইঞ্চি পুরু সবুজ মসের আবরণে গাছগুলি ঢাকা। তাতে গাছগুলির প্রাচীনত্বের ভার বেড়ে গেছে। আমার মনে পড়ে বেশ কিছু বছর আগে শোনা এক হিন্দু সন্ন্যাসীর কথা। শুনেছিলাম তাঁর কেশ এক যুগকাল ধরে দীর্ঘায়িত হবার পর তবেই ঝরত। অনেকটা গাছের উপরে এই সবুজ মসের আবরণের মতোই।
সবুজ ভেলভেটের মতো দেখতে মসের এই পুরু আস্তরণ অতিরিক্ত তুষারপাতের হাত থেকে গাছগুলিকে রক্ষা করে। মস দ্বারা আবৃত প্রাচীন অসংখ্য লতাপাতা প্রায় শ’ফুট উচ্চতা থেকে যষ্টির ন্যায় ঝুলে আছে। মাথার উপরে কিছু গুল্মরাশি চমৎকারভাবে একদিক থেকে আরেকদিকে ওক গাছে জুড়ে গেছে। উচ্চতা, বিশালতা, অবস্থান এবং প্রাচীনত্বের বিচারে হিমালয়ের এই ওকসারিগুলি একজন কবিকে বিমুগ্ধ করতে বাধ্য। হিমালয়ের সামনে যেন স্বর্গের খিলান হয়ে সুবিশাল স্তম্ভবৎ বিরাজমান। এই ঘন বনের মধ্যে দিয়ে দুপুরবেলায় চলতে গিয়ে মনে হচ্ছিল যেন ইতিমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাত্র কুড়ি গজ দূরেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিভ্রম হওয়ায় বেশ কয়েকবার আমার দাদাকে (শরৎচন্দ্র দাস) ডাকতে হলো আমাকে রাস্তা দেখানোর জন্য। আসলে আমরা তখন একটা মেঘের মধ্যে দিয়ে চলছিলাম, মেঘটা সমস্ত জঙ্গলকে ঢেকে ফেলেছিলো। আমাদের সব জামাকাপড় ঘন বাষ্পে ভিজে যাচ্ছিল। ভুটিয়াদের যে কম্বলটা গায়ে জড়িয়েছিলাম সেটা ভেদ করে তীক্ষ্ণ ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে বিঁধছিল। আমার হাত-পা প্রায় এতটাই অসাড় হয়ে গিয়েছিল যে আমার টাট্টু ঘোড়াটিকে ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
জঙ্গল পেরিয়ে আমরা নিচের অভিমুখে বন্ধুর পথ ধরলাম। আমাদের চলার পথে বিপদ আরও বেড়ে গেল বৃষ্টিতে। আমাদের সামনের সমস্ত রাস্তাটা ভিজে পিচ্ছিল হয়ে সাংঘাতিক রূপ নিল নিমেষে। আমরা প্রায়ই ঘোড়া থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছিলাম কারণ ওই বিপজ্জনক পথে তারা ভার বহন করতে পারছিল না এবং কষ্ট পাচ্ছিল। প্রতিপদে পিছলে যাওয়ার ভয় ছিল। আর আমি প্রতিক্ষণে শ’ফুট গভীর খাদের অতলস্পর্শী গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিলাম। ভুটিয়া পরিচারক এবং কুলিরা আমাদের মতো কোনো কষ্ট পাচ্ছিল না। খাড়া এবং পিচ্ছিল পথ তাদের কাছে যেন খুব সাধারণ ব্যাপার। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে উতরাই পথে চলার পর দিনের শেষে, আমরা তিমি নামের গ্রামে একটা ভুটিয়া বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। বাড়িটির পরিবেশ ছিল খুবই ঘরোয়া প্রকৃতির। ঘরের ছাউনির চারদিকের ঢালগুলি লম্বা ঘাসের পরিবর্তে ঠিক একই পদ্ধতিতে পাকানো বাঁশের টুকরো দিয়ে ছাওয়া। এতে হয়তো ছাউনিটা দেখতে সমান ও সুন্দর হয়নি, কিন্তু মজবুত হয়েছে। মেঝেটা ভূমি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু স্তম্ভের উপর কাঠের তক্তা পেতে তৈরি। এই মেঝের নিচের তলার ঘর ভেড়া ও শূকর এর জন্য সংরক্ষিত। বাড়িটিতে মোট দু’টি ঘর। সামনের ঘরটিতে একটি চুলাকে ঘিরে পরিবারের সকলে একসাথে বসে মনোরম উষ্ণতা উপভোগ করে। এই ঘর গরম রাখার চুলাটি পাথর এবং মাটি দিয়ে বাঁধানো। পিছনের ঘরটি বেশ বড়সড়। এটাই হল বৈঠকখানা এবং শোয়ার ঘর। এখানে ছাদের ঠিক নিচেই বাঁশের তৈরি একটা তাকে খাদ্য-রসদ সংগৃহীত থাকে। এই তাক থেকে ভুট্টা এবং শস্যদানাগুলি সারিবদ্ধভাবে এমন করে ঝোলানো রয়েছে যে দূর থেকে দেখে মনে হয় গোলাকৃতি মুক্তো চুনির সমাহার। দেওয়াল গুলো বাঁশের তৈরি। তবে একমাত্র যে জিনিসটা আমাদের ধাক্কা দেয় তা হল ঘরের একটি কোণে ঝুলন্ত কোনো পশুর পাঁজরের মাংস। দৃশ্যটি খুবই অস্বস্তিকর। ঘরের অপেক্ষাকৃত পেছনের দিকের দেয়ালে কাঠের তৈরি আলমারির মতো অংশ আছে। এটা পারিবারিক প্রার্থনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর তাকগুলিতে শাক্যমুনি এবং তাঁর শিষ্যদের ছোটো ছোটো মূর্তি সাজানো। একটা প্রদীপ এই মূর্তিগুলোর সামনে সারারাত ধরে প্রজ্বলিত থাকে।
(সম্পাদনাঃ শোভন সরকার)