নদীয়ার চাপড়া অঞ্চল বলয়ের গাজন উৎসবের গান। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

চৈত্র মাস মধু মাস
গাজনেরও ঘটা,
বৈশাখ মাসে জলছত্র
তুলসী গাছে ঝড়া।
গাজন হলো চৈত্র মাসের শেষে শিবের পার্বণ। রাঢ় বঙ্গের শৈব সংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ গাজন।
শিব, নীল, মনসা বা ধর্ম ঠাকুরকে কেন্দ্র করে গাজন উৎসব পালিত হলেও নদীয়ার চাপড়া অঞ্চল বলয়ে শিবের গাজনই পরিলক্ষিত হয়।
গাজন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত গর্জন শব্দ থেকে। শিবের ভক্তগণ বা সন্ন্যাসীরা মহাদেবের নামে গর্জন করে জয়ধ্বনি দেন বলে এরূপ নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গাজন নানার্থক – শিবের উৎসব, শিব সম্বন্ধীয় গান, শিবের মন্দির প্রভৃতি।

চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ ধরে সন্ন্যাসী ও শিব ভক্তদের নিয়ে গাজন অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার পরে এর সমাপন ঘটে। চাপড়ার কল্যাণদহ, মথুরাপুর, হাতিশালা,বড় আন্দুলিয়া, জিধা,হৃদয়পুর, আলফা, শুঁটিয়া, বালিয়াডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানে গাজন অনুষ্ঠিত হয়।

ঘাট-সন্ন্যাস, নীলব্রত ও চড়ক – এই তিন অংশ নিয়ে গাজন উৎসব। আগে মূলত চৈত্রের প্রথম দিন থেকেই শিবের প্রীতি কামনায় ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করতো। এখন কেউ চৈত্র সংক্রান্তির সাতদিন বা পাঁচদিন বা তিনদিন আগে থেকে ব্রত গ্রহণ করেন।

শিবের ভক্তগণ বা সন্ন্যাসীর দল প্রথানুসারে পূজারীর কাছ থেকে শিবের পূজার ফুল গ্রহণ করে প্রতীকী শিবলিঙ্গ, পাট-বাণ মাথায় করে ঢাক, কাঁসর সহযোগে পরিক্রমায় বার হন। কোনো বাড়িতে প্রবেশ করলে গৃহিণীরা একঘটি জল উঠানে ঢেলে দেন। সেই জলকে কেন্দ্র করে সন্ন্যাসীরা পাক দেন আর চিৎকার করেন- ‘ বল ভাই মহাদেব, দেবের দেব। ‘ তারপর হাতের বেতের ছড়িটি ভিজে মাটিতে লাগিয়ে কপালে ঠেকান। অনেক গৃহ স্বামী বাড়ির ফলেরগাছ পাক দিয়ে নেন ভালো ফলের আশায়। চাল-সব্জি সিধে দেওয়া হয় ভক্তদের।
এই পরিক্রমার সময় বা সন্ধ্যায় স্নান সেরে ফেরার পথে মাঝে মাঝে চলতে থাকে গাজনের ছড়া-গান। ছেলের দল সন্ন্যাসীদের চলার পথে মরা সেজে পরে থাকলো হয়তো। তাদের ডিঙিয়ে যাওয়া চলবে না। গাজন গান গেয়ে পথ মুক্ত করতে হবে। কোনো গান হয়তো এককভাবে গীত হলো আবার কোনো গানে রয়েছে চাপান – উত্তর।

এবার আমরা আমাদের সংগৃহীত কিছু গাজন গানের উল্লেখ করবো। যেমন –
(১) এই গানটিতে রয়েছে বাঙালির বারো মাসের পার্বণের কথা:
চৈত্র মাস মধু মাস
গাজনেরও ঘটা,
ওগো, বৈশাখ মাসে জলছত্র
তুলসী গাছে ঝড়া।

জৈষ্ঠ মাসে যমুনার জল
খেলছে বনমালী,
আষাঢ় মাসে রথযাত্রা
লোকে হোড়াহুড়ি।

শ্রাবণ মাসে মনসা পূজা
দিয়ে মাথার চুল,
ভাদ্দুর মাসে লক্ষ্মীপূজা
লাউ-কুমড়োর ফুল।

আশ্বিনে অম্বিকা পূজা
মেষ-পাঁঠার ঘটা,
কার্তিক মাসে ভাই দুতিয়া
ঘরে ঘরে ফোঁটা।

অঘ্রাণে নবান্ন হয় আমন ধান কেটে
পৌষ মাসে পৌষবাউড়ি ঘরে ঘরে পিঠে।

মাঘি মাসে মাঘি সপ্তমী ছেলের হাতে খড়ি
ফাল্গুন মাসে দোলযাত্রা আবীর ছড়াছড়ি।

বারো মাসে তেরো পুজো
সমাপ্ত করিলাম,
ওগো যত আছো শিবের ভক্ত
করো শিবের নাম।
(২)
ফুল তুলিতে গেলামরে ভাই
ফুল নেই মোর গাছে,
কি বলে আর জবাব দেব
বুড়ো শিবের কাছে।

ফুল তুলিতে গেলামরে ভাই
ফুল পাঁজা পাঁজা,
ফুলের উপর বসে আছে
রাক্ষসের রাজা।

ফুল তুলিতে গেলামরে ভাই
পায়ে উঠলো মাটি,
ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো
ধরে ধরে কাটি।

ফুল তুলিতে গেলামরে ভাই
পায়ে উঠলো ছাই,
ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানো
ধরে ধরে খায়।

(৩) পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, স্বর্গ, মর্ত, পাতাল -সমস্ত দ্বার মুক্তির জন্য এই ছড়াটি:

বেতের ঘোড়া
বেতের পালোয়ান
বসুধার পৃষ্ঠে
দেব নির্মল
চিতরে চিতরে ভাই
সত্যের কোটাল
আমি মুক্ত করি
শিবের পূর্ব দুয়ার
পূর্ব দুয়ারে আছে ভোলা মহেশ্বর
তিনার চরণে কোটি কোটি প্রণাম

(৪) শিবের বিয়ে নিয়ে মজাদার গান:

শিব চললো বিয়ের বেশে
নারদ বাজায় বীণে,
পাড়াপড়শীর ঘুম নাইকো
শিবের বিয়ের কথা শুনে।

ওরে ব্যাটা হতভাগা
বিয়ের বড়ো ঘটা,
বৃদ্ধ কালে করবি বিয়ে
নির্বংশীর ব্যাটা।

গালেতে গালি বাঁধবো
পায়েতে জোর তালি ,
নাচি গাহিতে গেলেন
গিরিরাজের বাড়ি।

গিরিরাজ গিরিরাজ
কি কর বসিয়া,
তোমার গৌরীর বর আসিছে
নাচিয়া কুদিয়া।

আমার গৌরীর বিয়ের বর
কারবা বাপের ডর,
ধাক্কা দিয়ে বৃদ্ধ জামায়
বাড়ির বাহির কর।

ধাক্কা কেন মারো মেনকা
ধাক্কা কেন মারো,
তোমার গৌরীর দশখান হস্ত
দেখতে লাগে ভালো।
গানটি মনে করিয়ে দেয় ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের শিবের বিবাহ যাত্রা বা শিববিবাহ অংশের কথা।

(৫) এই গানটিতে রয়েছে শিবনিন্দা :

শোনোগো দিদি ও সুন্দরী
তোর পতি কালা,
আনতে বললাম বড়ো থালা
এনে দিলো ছালা।

শোনোগো দিদি ও সুন্দরী
তোর পতি উরো,
গোঁফ দাড়ি পেকে হলো
জৈষ্ঠ মাসের হুড়ো।

আকাশেতে বাদ্য বাজে
শুনে হৃদয় শীতল হলো,
সেই সময়ে শিব-দুর্গার
যুগল মিলন হলো।

(৬) গাজনের গানকে অনেকে সাঁতলে বলে থাকেন। মালদহে গম্ভীরা গানে যেমন শিবকে নানাহে সম্বোধন করে গান শুরু হয় এখানে ও সাঁতলে বলে গান শুরু হয়। গানে রয়েছে চাপান অর্থাৎ প্রশ্ন এবং উতোর অর্থাৎ উত্তর। যেমন:

(ক) চাপান:
তোমরা তো ভাই সন্ন্যাসী ঠাকুর সব বলিতে পার
কোন সময়ে মহাদেব ঘাটের মাঝি হয়?
উতোর:
দুর্গা যখন ছেলেপুলে সব সঙ্গে নিয়ে
বাপের বাড়ি যায়,
সেই সময়ে শিব ঠাকুর
ঘাটের মাঝি হয়।

(খ) গাজনের সন্ন্যাসীদের প্রশ্ন
চাপান:
কোথা থেকে আসছো তোমরা
কোথায় চলে যাও,
কাহার দুয়ারে তোমরা
ভিখ মেগে খাও?

উতোর:
উত্তর থেকে আসছি মোরা
দখিন চলে যায়,
শিব ঠাকুরের দুয়ারে মোরা
ভিখ মেগে খায়।

(গ)
চাপান:
লম্ফ-ঝম্ফ করে আসে যত সন্ন্যাসী,
রাজপথে বসে আছে তারকা রাক্ষসী।
ঢাকা খাবে, ঢোল খাবে আরো খাবে কাঁসি
সবসুদ্ধ গিলে খাবে গাজনের সন্ন্যাসী।

উতোর:
স্বর্গেতে ছিল রথ সুরপতি শোনো,
মহাদেবের আগে চলে তেত্রিশ কোটি দেবগণ।
আগে চলে রামচন্দ্র হস্তে ধনুর্বাণ,
সেই বাণে বধ করিল রাক্ষসেরও প্রাণ।

রাক্ষস মলোসশিয়া ভালোই হলো
ফেলে আসগা দূরে,
শৃগাল ও কুকুরে খাক ছিঁড়ে ছিঁড়ে।

শৃগাল ও কুকুরে খাক ওদের মহামাংস
রামের বাণেতে কুল করিলাম ধ্বংস।

(ঘ) নানান পুরাণ প্রসঙ্গ আসে এই গানগুলোতে
চাপান:
তুমি তো ভাই সন্ন্যাসী ঠাকুর
সব বলিতে পারো,
কোন সময়ে হনুর মাথায়
শৃগাল ডেকে ছিল?

উতোর:
লক্ষণ পোলো শক্তিশেলে
রাবণের ও বাণে
ঔষধ আনিতে গেল
বীর হনুমানে।

ঔষধ না চিনতে পেরে
পর্বত মাথায় নিলো
সেই সময়ে হনুর মাথায়
শৃগাল ডেকে ছিল।

(ঙ) দেহতত্ত্ব বিষয়ক গান
চাপান:
তুমিতো ভাই পাল্লাদার
তোমায় প্রণাম করি,
তোমায় প্রণাম করে আমি
ঘটের মধ্যে পুরি।
ঘটের মধ্যে ভরে আমি
জল ইলাইয়ারাজা খায়
কেমন করে বাহির হবা
পাল্লাদার ও ভাই।

উতোর:
সূর্য করে ঝিকিমিকি
চন্দ্র করে আলো,
ব্রহ্ম ফুটে বাহির হবো
পাল্লাদার ও ভাই।

( চ ) জল-সন্ন্যাসে সন্ন্যাসীরা একজনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্র নেন।
চাপান:
বান এলো বন্যা এলো
কেশি এলো ভেসে,
তোমার গুরু মন্ত্র দেবে
কোন জায়গায় বসে?

উতোর:
বান এলো বন্যা এলো
কেশি এলো ভেসে,
আমার গুরু মন্ত্র দেবে
তুলসী তলায় বসে।

( ছ )
চাপান:
বলো সাঁতলে,
কেবা হলো গাছের গুঁড়ি,
কেবা হলো ডাল,
কেবা হলো গাছের পাতা
কেবা হলো ফল?
উতোর:
দুর্গা হলো গাছের গুঁড়ি
হস্ত হলো ডাল,
চুল হলো তার গাছের পাতা
স্তন হলো ফল।

( জ ) রঙ্গব্যাঙ্গ মূলক –
চাপান:
কোন কুটুমের কুটুম তুমি
উঠুনে দিলে পা,
উঠুনখানি ছিঁড়ে গেল
সেলাই করে যা।

উতোর:
চালনে করে আনো দুধ
গিলাসে করে খায়,
উঠুনখানি চাগিয়ে ধরো
সিলাই করে যায়।

( ঝ)
চাপান:
ওপর দিইয়ি চিল যায়
চিলের পায়ে সুতো,
আবার যদি সাঁতলে বলিস
মুখে মারবো জুতো।

উতোর:
গর্তর ধারের বাড়িগুলা
ব্যাঙের লাথি খায়,
চুটকো ব্যাঙের ছাঁ হইয়ি
পাল্লা দিতে যায়।

এছাড়াও বেশকিছু গান উদ্ধৃত করা গেল-
( ৭ )
সাঁঝ দিলাম, সলিতা দিলাম
গোয়ালে দিলাম বাতি,
নন্দ ঘোষের কুলে এঁড়ে
মোর বুকে মারলো লাথি।
(গ্রাম্য উপমা রূপকে কৃষ্ণের প্রতি রাধার ক্ষেদোক্তি)

( ৮ ) শিবের গাজন গানে কৃষ্ণ কথা-
কৃষ্ণ ঘুরারে ঘুরারে
ঐ ধবলীর পাল,
খুঁয়াড় ভেঙে খন্দ খাবে
লোকে দেবে গাল।

(৯ )
নন্দ গেলেন বাথানেতে,
যশোদা গেলেন ঘাটে।
শূন্য ঘর পেয়ে কৃষ্ণ
ননীর ভাণ্ড লোটে।

( ১০ )
ও সাঁতলে
আলফা বেতবেড়ি
মধ্যি নলের বেড়া,
মূল সন্ন্যাসী বসে আছে
কানকাটা ভেড়া।

( ১১ )
চাল ডিঙিয়ে ফেললাম রে ভাই
চাড়ালের ও জাল,
গো-ডহরে বসে আছে
যত সন্ন্যাসীর পাল।

( ১২ )
পাড়ায় পাড়ায় মুরগি চড়ে
কড়াই চড়ে ঘি,
কোন মোল্লার ছেলে তুমি
সাঁতলে জানো কি।

( ১৩ )
রাই সরু সরিষা সরু
সরু গঙ্গার বারি,
এখান থেকে প্রণাম জানাই
কালীঘাটের কালী।

কালীঘাটের কালী ও ভাই
কুষ্টিয়া ধর্মরাজ,
সেখান থেকে প্রণাম জানাই
বাবা বুড়োরাজ।

এই লোকসংগীত গুলি গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে রচিত। এখানে যেমন এসেছে নানান পুরাণ প্রসঙ্গ তেমনি এসেছে দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, লড়াই-সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার কথা। উক্ত অঞ্চল বলয়ের ভাষা , সংস্কৃতি সর্বোপরি জীবন বেদ এই গানগুলি। গানগুলির সুর একই। বিশেষত পাঁচালীর ঢংয়ে বলা হয়।
শাস্ত্র ও তন্ত্রের শিব এই সমস্ত গানে মিশে গেছেন লোকায়ত জীবনের সঙ্গে। বাংলাদেশের কৃষক পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছেন। কৃষিদেবতা যে তিনি। শুধু শিব নন, কৃষ্ণ, রাম, হনুমান, দুর্গা আরো কত দেবদেবীর লীলাস্থল
এই গাজন গানগুলি।

নদীয়া জেলার বিচিত্র লোক গান যেমন – কর্তাভজা সম্প্রদায়ের গান, সাহেবধনী সম্প্রদায়ের গান, বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের গান, খুশীবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের গান, লালনশাহী সম্প্রদায়ের গান, কীর্তন গান, বোলান গান, অষ্টক গান, খ্রিস্টিয় কীর্তন গান – এসবের সঙ্গে গাজনের গানও নদীয়ার মাটির গন্ধে সুরভিত।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *