শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ২–লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঁচ ছয়ের দশক জুড়ে যুবক শঙ্করের মননে চেতনায় যাত্রার ঢেউ। সেই আলো অন্ধকারে, ছায়ায় মায়ায় সে ঘুরে বেড়ায়।মঞ্চ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পৌরাণিক,ঐতিহাসিক, সামাজিক চরিত্রগুলির খোলসে ঢুকে পড়ে সে। গোঁসাই বাড়ির যাত্রামঞ্চ ‘বাঙালী’ যাত্রাপালায় মুগ্ধ হয়। শঙ্করের গলায় মালা পড়ায়।ঐতিহাসিক চরিত্র শঙ্করের বড় প্রিয়। ‘শাজাহান’ যাত্রাপালা ‘দিলদার’ শঙ্করকে কুর্নিশ জানায়। মঞ্চ থেকে মঞ্চে প্রবাহ বয়ে চলে- তিন পয়সার পালা, পলাশীর প্রান্তর, হাসির হাটে কান্না, সোনাই দিঘী, রক্তে রোয়া ধান, বিনয় বাদল দীনেশ…
স্বাধীনতা পরবর্তী সে সময়টায় সারা দেশে জীবন সংগ্রাম ছিল অনেক কঠিন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সঙ্কটে, যাপনের ক্ষেত্রটা ছিল এবড়ো খেবড়ো। সমাজজীবনের স্তরে স্তরে দ্বন্দ্ব ও যন্ত্রণা প্রবল। আদর্শের সঙ্গে খিদের দ্বন্দ্ব। শ্রমের সঙ্গে সুযোগের দ্বন্দ্ব। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। হঠাৎ করে ‘ওদেশীয়’ হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের শিকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা। ঘটি ও বাঙালের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। জলসাঘড়ের ঝাড়বাতি নিভে যাওয়ার যন্ত্রণা। পাশাপাশি সমাজ গড়ার, দেশ গড়ার স্বপ্ন, রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভাঙার সাহস নিয়ে সীমিত ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া। যুগে যুগে কালে কালে সংস্কৃতির যে কোন শাখায় সেসবের প্রতিফলন ঘটে। গ্রাম বাংলার একমাত্র বিনোদন পাঁচশো বছরের পুরোনো যাত্রাপালা। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, সামাজিক পালাগুলিতে মিশে যায় সমসাময়িকতা, তার স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, নস্ট্যালজিয়া। বাদশাহী আমলের চাকচিক্য, তার জটিলতা গ্রহণীয় হয়ে ওঠে পৈতেধারী ব্রাহ্মণের কাছে। ব্রিটিশের অত্যাচার বা স্বদেশী আন্দোলনের আবেগ অথবা সমাজসংস্কারকের সংগ্রাম মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে মঞ্চের সামনে।
আর সে যুগের গ্রামবাংলার নারীদের একটা বিশাল অংশ, যারা হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতে রক্ষণশীলতার ঘোমটার আড়ালে আপন পুরুষের চোখে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের গল্প শোনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ স্পর্শ করা বা পেরুনোর সুযোগ সমাজ দেয় না, রঙিন সুতোয় চটের আসনে ‘মায়ের চরণ’ বুনে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে তাদের সৃষ্টিশীলতা আটকে রাখতে বাধ্য হয় অথবা যারা মাঠে মাঠে চাষের কাজে ঘাম ঝরায়, ঘুঁটেয় দেওয়াল ভরিয়ে, বাবুর বাড়ির কুয়োতলায় বাসন মেজে দিন যায় যাদের, তারা যাত্রার আসরে জমির আসনে নিজেদের সঁপে দেয়, শান্তি পায়।
নদীমাতৃক এই জনপদও বাকি গ্রামবাংলার সঙ্গে একই আসনে আসীন। নগর ও গ্রামের মধ্যে ফারাকটা তখন আস্মান-জমিন। বর্হিবিশ্বের দরজা, দূর শহরের জানলা দিয়ে যে বাতাস বয়ে যায় তার কতটুকুই বা এসে পৌঁছায় এই জনপদের পাতায় পাতায়! তাই অম্বুবাচীর উপোস থেকে নেহেরুর চিন্তাধারা, কাকাবাবুর যৌথ খামার থেকে চালের ব্ল্যাক মার্কেট বুঝতে জানতে দরকার পড়ে একজন বিনয় সরকার, একজন শেখর সেন, একজন শিবশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, একজন নরেশ মল্লিক, একজন ষষ্টীবাবু, একজন রবিবাবু…
আর বিনোদনের পসরা নিয়ে গোঁসাইবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, রামনবমী মেলা, ফরিদপুর, বাজারের আটচালা বা অন্য কোন মঞ্চ ডাক দিলে, দলে দলে ভিড় জমায় মানুষ। তবে এ বার্ধিষ্ণু জনপদ শুধু যাত্রা দেখেই ক্ষান্ত নয়, সৃষ্টিও করে। তরুণদলের সেই সৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসেন বিনয় সরকার, শেখর সেন, নাড়ু গোঁসাই এর মত মানুষরা। সেই সৃষ্টি থেকেই একদল মানুষ আহরণ করে জীবনীশক্তি।
যেমন শঙ্কর মাস্টার। যাত্রাকে অবলম্বন করে সে ভুলে যায় তার জীবনযন্ত্রণা, স্বপ্নভঙ্গের দুঃখ-কষ্ট। স্কুলমাস্টারির আগে ও পরে মাস্টারি ছাড়াও সে কখনো স্কুলে স্কুলে ঘোরে প্রকাশকের হয়ে ‘বই ধরানো’-র কাজে, কখনো ব্যরিস্টার বাড়িতে দলিল লেখে (সুন্দর হস্তাক্ষর ছিল তার) আবার ‘বুড়ো বাবাজীর সিনেমাহল’-এর কাউন্টারে বসে টিকিট বিক্রিও করে সে। আর সেখান থেকেই উঠে আসে যাত্রার সংলাপ। মুদ্রিত অক্ষরের চরিত্রগুলো অন্যরূপ পায়। শঙ্কর মাস্টারও ভুলে যায় তার যাপনের যন্ত্রণা, প্রিয়জনের অবজ্ঞা, অবহেলার কষ্ট। তার এই সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হয়েছিল। কিন্তু তাতে তার কোন আক্ষেপ ছিল না। আক্ষেপ ছিল কলেজের গেট দিয়ে ঢুকে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা চালিয়ে না যেতে পারার আর আক্ষেপ ছিল যাত্রা নিয়ে আরও এগিয়ে যেতে না পারার।
প্রান্তরের গান
‘গল্পদাদুর আসর’ আর ‘ছোট্ট বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা’-র ‘শিশুমহল’ চেটেপুটে খাওয়া শৈশব-কৈশোর, সত্তর-আশির দশকের মাটিয়ারির যাত্রা প্যাণ্ডেলের ধুলোয় আমোদিত। দাসপাড়ায় বাঁশঝাড়ের পাশ থেকে, সেনপাড়ায় সাহেবের কলঘর থেকে, ‘আকাশবাণী কলকাতা’র মিডিয়াম ওয়েভে তরঙ্গায়িত মল্লভূমের ‘লালবাঈ’। ‘ও চাষীভাই, বাদলা পোকা হানা দিতে পারে রে’-র ‘কৃষিকথার আসর’ এর যাত্রাপালা শুনতে শুনতে ফুটবল মাঠ ফেরত বুধবারের (সম্ভবতঃ)বিকাল-সন্ধ্যা ঘড়ে ফেরে। পুজো-পার্বণ, উৎসবের দুপুরগুলোয়, ল্যাম্পপোস্টে,প্যাণ্ডেলের বাঁশে, টিকি বাঁধা অ্যালুমিনিয়ামের চোঙাগুলো গিরীশ ঘোষীয় রেনেসাঁস শোনায় – ‘কৃষ্ণ বলে কাঁদো মা জননী, কেঁদো না নিমাই বলে/ কৃষ্ণ বলে কাঁদিলে সকলই পাবে/ কাঁদিলে নিমাই বলে নিমাই হারাবে/ কৃষ্ণ নাহি পাবে’। (নটী বিনোদিনী)
আর পাড়ার মোড়ে মোড়ে ‘এত দ্বারা মাটিয়ারির সকল জনগণকে জানানো যাইতেছে যে…’ বাণেশ্বরীয় ঢেঁড়ির শব্দে, ‘আজকের যাত্রাপালা ঠিক রাত দশটায়’ আস্রাফীয় প্রচারে, আকাশ বাতাস তোলপাড় হয় যখন, দল দঙ্গল ‘জায়গা রাখিস’ বলে কেরোসিন কূপীর আলোয় আলোকিত ডালার সামনে চার আনার এক ঠোঙা চিনেবাদাম কিনতে দাঁড়িয়ে পড়ে।
আমার শৈশবের দিনগুলিতে ‘ভোর হল দোর খোলো’-র সাথে মিশে যাচ্ছে ‘কুর্ণিশ’, ‘বন্দেগী জাঁহাপনা’, ‘কানী মনসা’, ‘খোদাতাল্লা’……এসব শব্দগুচ্ছ।রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, সুনির্মল বসুর পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল চৌধুরীর নাম।
কোনো পাড়াতে যাত্রা হবে, শঙ্কর মাস্টারের কাছে চলে এল দু’তিনটে যাত্রার বই। পালা বাছতে হবে। শঙ্কর মাস্টার পড়ছে। বাতিল করছে। অন্য বই আসছে। বাছাই পর্ব শেষ। শুরু হল এডিটিং। ক’জন অভিনেতা, কে কে অভিনয় করবে, ‘বিবেক’-এর গানের কি ব্যবস্থা। ‘ফিমেল’ চরিত্রের জন্য যোগাযোগ কর বেণু (বর্ণালী ব্যানার্জ্জী), ডলি বিশ্বাস বা ছবি করকে, বল মাস্টারমশাই বলেছেন । চরিত্র বাদ যাচ্ছে, যোগ হচ্ছে। চরিত্রের গুরুত্ব বাড়ছে বা কমছে। সংলাপ বদলে যাচ্ছে। হয়তঃ সে যাত্রাপালার নির্দেশক অন্য কেউ, হয়তঃ সে পালা মঞ্চের মুখই দেখবে না, তবু থেমে নেই। কেউ বলেছে, ‘পাঠ’ দেখিয়ে দিতে হবে, শঙ্কর মাস্টার বই চেয়ে নিয়ে পড়ছে। তার সংলাপ লিখে দিচ্ছে। যখন অভিনয় করে দেখাচ্ছে, সে সংলাপ মুখে মুখে বদলে যাচ্ছে। সহ-অভিনেতার ‘ক্যাচিং মিস্’ হলে ম্যানেজ করে আবার ক্যাচ লাইনে ফিরতে হবে। সহ-আভিনেতাকে বলছে, নার্ভাস না হয়ে ‘ক্যাচ লাইন’-এর জন্য অপেক্ষা কর ।
এই যাত্রাময় পরিবেশে সেনপাড়ার বাড়ির ছাদ, বারান্দা, কাঁঠালতলার উঠোন সচকিত হয় মহড়ায়। কালের স্রোতে বিবর্ণ যে কাঠের চেয়ারটি, এখনও ফেলে দিতে পারি নি, সেই চেয়ারে বসে শঙ্কর মাস্টার, পকেট ডায়েরি, ‘গোল্ডেন ঈগল’ ‘বঙ্গলিপি’ খাতার পাতায় (আমাদের কালির আঁচড়ে যা ছিল বঙ্গজিলিপি),সুলেখা কালির দোয়াতে, আর্টেক্স পেনের আঁচড়ে, মুক্তোর মত হাতের লেখায়, দৃশ্যের পরিবর্ধণ,পরিমার্জণ, পুণনির্মান করে, শব্দ জুড়ে যায়, বর্জিত হয়, আর শঙ্কর মাস্টার একা একা হাসে, কাঁদে, বিড়বিড় করে, মাথার চুল ছেঁড়ে, দুহাত ছড়িয়ে সংলাপ বলে ওঠে।
শঙ্কর মাষ্টার দ্বিতীয় পর্বটিও বেশ ভালো লাগলো, এরপরেরটার অপেক্ষায় থাকলাম।।