শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ১–লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

1

‘ভাঙবে বাঁশি বিদায় বেলা / থামবে খুশি সকল খেলা / বিস্মরণে বাঁশির কথা / ভাঙা বাঁশির কথকতা/ কেউ কি মনে রাখবে!/ সেদিন তার সুরের বাহার/ শূন্যে শূন্যে ভাসবে।’ (শঙ্কর মাস্টার)

 

কনসার্ট

মোমবাতির কাঁপা শিখায় ঘর জুড়ে আলো ছায়ার ত্রিকোণমিতি। লোডশেডিং। গুটিকয় তারা, চাঁদের আভাস নিয়ে সন্ধ্যা নিবিড় হয়। খোলা জানলার ওপাশে খণ্ডিত অন্ধকারে গাছেরা  দোলায় মাথা। সান্ধ্য টিউশুনির শতরঞ্চিতে জনা সাতেক কিশোর। স্কুলের ইংরাজী শিক্ষক তরুণ অলোকবাবুর দৃষ্টি চলে যায় জানলার ওপারের মায়া অন্ধকারে।  অলোকবাবু উচ্চারণ করেন- ‘Tell them I came’

 

আমি, গত শতাব্দীর আটের দশকের এক মুগ্ধ কিশোর, গুরুপ্রণাম সেরে বেড়িয়ে পড়ি। গোঁসাই বাড়ির পাশ দিয়ে, সেনপাড়ার ধুলো মেখে, ভরা কৃষ্ণচূড়ার আলোয়, হাঁটতে হাঁটতে, ছুটতে ছুটতে, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে আবর্তিত হতে হতে, সাড়ে তিন দশক জুড়ে খণ্ডিত হই। এসে দাঁড়াই বিলুপ্ত এক প্রবাহের পাশে। খণ্ডের সাথে জুড়ে দিই বিখণ্ড। তখনই ক্ল্যারিওনেট বেজে ওঠে।

–মেয়েকে পোড়ো বাড়ি দেখাতে নিয়ে এসেছো! ওই খাঁচাটুকই যা আছে। কাঁঠাল গাছ, ইঁদারা, বারান্দা, সব গেছে। ছাদটাও। সাবধানে যাও। ঝোপ জঙ্গলে বড় বড় সাপ আছে।

যে পরিচিত দিদি সাবধান করে দিল, সময় তার চুলে রূপোলী রঙ লাগিয়েছে যত্ন করে। বুনো ঝোপের মাঝে চুলের সিঁথির মত রাস্তা এক। আমি এগিয়ে যাই আমার মেয়েকে নিয়ে। লতা, বুনো ঝোপ আমার পা জড়িয়ে ধরে। আমার মেয়ে দেখে সাপের গর্ত। আমি হাসি। আমি জানি, আমিই জানি, ওই গর্তের অনেক নিচে, এই ঝোপ জঙ্গলের শিকড় পেড়িয়ে আরও গভীরে, আমার শিকড়। শিকড় ঘিরে বয়ে চলা এক পূণ্যপ্রবাহ, যার পাড় ধরে চলতে চলতে একদিন আমি ভিজেছিলাম, ভিজতে চেয়েছিলাম। এখানেই আমার জমিজমা, কাগজ-নৌকা ঘুড়ি। এখানেই রঙিন চিলেকোঠা, উজান-ভাটির ফেরি।

 

শারদীয়া পুজো প্যাণ্ডেল থেকে ভেসে আসে অরিজিৎ সিং। আমার মেয়ে শোনে। আমি শুনি অনেক কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপ ঢেউ এর মত দোলে, ভাঙে, আছড়ে পড়ে… আমার মেয়ে শোনে ঝোপের গভীরে শব্দ কিছু। আমি শুনি প্রবাহের বয়ে চলার সুর, তাল, ছন্দ… ধারারেখ প্রবাহ… যে প্রবাহের নাম শঙ্কর মাস্টার।

 

যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমার শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবন জুড়ে সেনপাড়ার দশ টাকার ভাড়াবাড়ির কাঁঠাল গাছের উঠোন। উঠোন থেকে সাতটা সিঁড়ি ওপরে এক লম্বা চওড়া বারান্দা। দোতলায় এক উদার ছাদ, যে ছাদের মাঝ বরাবর আধ হাত চওড়া একটা শির যা ছাদটাকে দুটো সমান ভাগে ভাগ করেছে। একটা ভাগ অপরটার থেকে একটু উঁচু। আমাদের  ভাইবোনের কাছে – মঞ্চ- সিংহাসন- গ্রীনরুম।

 

সেনপাড়ার ওই বাড়ির উঠোনে, ছাদে যাত্রার মহড়া, আবৃত্তির আসর, গীতিআলেখ্যর রিহার্সাল। মাদুর পেতে যাত্রিক আড্ডা । চক দিয়ে আয়তক্ষেত্র এক। স্টেজের সীমারেখা, উইংস, অভিনেতাদের অবস্থানের জ্যামিতি । শঙ্কর মাস্টার একা একা অভিনয় করে যায়। আপন মনে সংলাপ বলে।  ভোম্বলদা, নবদা, ছোটকাকু, অমরকালী মাস্টার, আস্‌রাফদা, পূর্ণিমাদি, বলাইবাবু, কত কত সদ্যতরুণ, প্রতিষ্ঠিত নট, আবৃত্তিশিল্পী।  মহড়া বসে। আর আমার পরিচয় হয়ে যায় সোনার তরী, বিন্দুর ছেলে, নক্‌শী কাঁথার মাঠ, বনলতা সেন, একটি মোরগের কাহিনীর  সঙ্গে। আমার দেখা যায়  টুকরো টুকরো  লুৎফার কান্না,  অচল পয়সা, ছত্রপতি শিবাজি, হাসির হাটে কান্না… কাঁঠালের ছায়া, শীতার্ত সিঁড়ির রোদ্দুর, রামধনু ছাদ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। হাত ধরে হাঁটতে শেখায়…

 

মেয়ের হাত ধরে দোতলার জীর্ণ সিঁড়ি ভাঙি আমি। একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙি। এক একটা করে দশক।ক্ল্যারিওনেট বেজে ওঠে।

তিন পয়সার পালা

আমাদের শাক-ভাতের জীবনে শঙ্কর মাস্টারকে আক্ষেপ করতে শুনেছি- সেদিন যদি ছোটফণির হাত ধরে যাত্রাদলে নাম লেখাতাম তবে বোধহয় ভাল হত। আর্থিক সঙ্কট এর থেকে বেশি আর কি  হত! তবু তো নিজের জগত নিয়ে থাকতে পারতাম!

মাটিয়ারি। সদ্য স্বাধীন দেশের এক নদীমাতৃক জনপদ।  ‘রেডিও’ নামক টিকিধারী বিশালাকার বাক্সটি হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতে। স্বাধীনতার আতঙ্কিত লগ্নে, ইথারে তরঙ্গায়িত পাকিস্তান থেকে ভারতভুক্তির খবরে, সেখানে পায়েসের মহোৎসব  বসে।গঙ্গা পেড়িয়ে ধুলো-কাদা মেখে দূরের দাঁইহাট স্টেশন। সারাদিনে কয়েকবার কালো ধোঁয়া ছেড়ে হুইসেল দিতে দিতে কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ি যায়। পাইক বরকন্দাজের আভিজাত্যের শেষ রেশটুকু নিয়ে গুটিকয় ‘বাবু’দের বাড়ি। পেতলের ঠং ঠং শব্দ থেমে গেলে হ্যারিকেনের রাত্রি নামে।

 

পাড়ায় পাড়ায় তরুণরা টিমটিমে আলোয় যাত্রার রিহার্সালে নামে। কখনো ‘বোর্ডিং’, কখনো হাইস্কুলে বসে মহড়া। একটা গোঁসাইবাড়ি, একটা মল্লিক বাড়ি, একটা রামনবমী মেলা, একটা বাজারের আটচালার মঞ্চ তাদের কাছে অনুপ্রেরণা। আশেপাশের আসরে তারা যাত্রা করে আসে। এ গাঁয়েও আসে বাইরের যাত্রাদল। কখনো কখনো নির্ধারিত দিনের দু’একদিন আগেই তারা আসে। স্থানীয়দের অভিনয় দেখে। রামনবমী মেলায় চিৎপুরের যাত্রাপাড়ার পেশাদারি দলের যাত্রার আসর।  প্রথম দু এক রাতের মঞ্চ স্থানীয় নটদের।

 

হ্যাজাকের আলোয় মাইক্রোফোনহীন মঞ্চের সেই সময়ে যুবক শিবশঙ্কর ব্যানার্জ্জী দলবল নিয়ে যাত্রায় মেতেছেন। অনুজ শঙ্কর সে যাত্রায় সামিল। পাড়ায় পাড়ায় ছকু পণ্ডিত, মোহন চন্দ্র মিশ্র, ঘন্টু চক্রবর্তী, নারায়ণ বাবাজী। অনেক নাম, প্রবাহের নানান শাখা-প্রশাখা।

এমনই এক সময়ে শঙ্করের অভিনয় চোখ টানে ছোটফণির। যাত্রাজগতে তখন ছোটফণির নামডাক ছিল।

–আমার সঙ্গে চলে আয়, তোকে গড়ে পিঠে নেব।

হাত বাড়িয়ে দেন ছোটফণি। সে হাত ধরা হয় নি শঙ্কর মাস্টারের।

 

আমার দাদু ভবানীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায় (দোকড়ি ঠাকুর) অনুমতি দেননি। সেই সমাজব্যবস্থায় বাড়ির ছেলে পেশাদারি যাত্রাদলে নাম লেখাবে – না পস্‌ন্দ। এর সঙ্গে ছিল দাদুর ব্রাহ্মণ্যবাদের অহংকার। ফলে মাটিয়ারির বাইরে পা দেওয়া হয়নি শঙ্করের।  রয়ে গেল হা হা করা দারিদ্র্য। আর পারিবারিক দায়িত্ব।

 

তারও আগে শঙ্করের যাত্রা দেখতে যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি বেড়িয়ে পড়ত সে। সঙ্গী নন্দ সেন, প্রণব সেন, গোরাদা (সেন)। পরবর্তীকালে শেখর সেনের সহায়তায় যাত্রা করার অনুমতি মেলে। উপরি পাওনা হিসাবে  কিছু গঞ্জনাও।

এ গল্প যে শুধু শঙ্করের তা নয়,  এ গল্প অনেকেরই। নাগরিক সমাজ থেকে বহুদূরে, সে সমাজ জুড়ে তখনও ‘লোকে কয় অভিনয় কভূ নিন্দীয় নয়, নিন্দার ভাজন শুধু অভিনেতাগণ’। এ সমাজ গ্রাম বাংলার সমাজের এক দর্পণ।

সময়ের বাঁকে বাঁকে বন্ধন শিথীল হয়।  কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী পরিবার থেকে উঠে আসি আমি, ব্রাহ্মণ্যবাদের  কড়া সমালোচক এক। আর এই বাড়ি থেকেই বেড়িয়ে আসে দুই তুখোড় অভিনেতা, আমৃত্যু যারা কাটিয়েছে অভিনয়ের প্রতি গভীর অনুরাগ নিয়ে। একজন বড় ছেলে শঙ্কর আর একজন ছোটছেলে দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (দিলু)।

 

যাত্রাদলে নাম লেখানো হয়নি শঙ্করের কিন্তু ছোটফণির কাছে মাটিয়ারিতে বসে এবং পরবর্তীকালে কলকাতায় দিন কয়েকের পাঠ নেওয়া হয়েছিল। ছোটফণি শিখিয়েছিলেন, কুর্ণিশের খুঁটিনাটি, বাদশাহী চরিত্রের সংলাপ ও উচ্চারণের সাথে পদমর্যাদা অনুযায়ী বেতনভুক কর্ম্মচারি বা  আমজনতার সংলাপ ও উচ্চারণের কী পার্থক্য, ইত্যাদি ইত্যদি। আজীবন তাঁকেই শঙ্কর মাস্টার ‘গুরু’ হিসাবে স্মরণ করেছে আর চেষ্টা করেছে অন্যদের মধ্যে সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে। (চলবে, পরের পর্ব আগামী রবিবার ৩১/০৫/২০২০)

Author

1 thought on “শঙ্কর মাস্টার: পর্ব ১–লিখছেন বরুণদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

  1. অনেক কিছু অজানা সত্য জানতে পারলাম। বরুনকাকা আমার বেশ ভালো লেগেছে। তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। কারন তুমি আমার থেকে শিক্ষা দিক্ষা ও বয়সে অনেক উচুতে। যাইহোক পরের লেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *