সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১। লিখছেন অলোক সান্যাল

আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনা, স্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর
—সুকান্ত ভট্টাচার্য
বধ্যভূমি
……………………
দুপুর পর্যন্ত ভিড়টা গভর্নরের প্রাসাদকে ঘিরে ছিল। গভর্নর পয়েন্টাস পিলেত, অর্থাৎ সেনেটোরিয়াল প্রভিন্স জুডেয়ার প্রোকানসিল। সকাল থেকে বিস্তর হই-হট্টগোলে সরগম হয়ে ছিল জেরুজালেম। কেন্দ্রে একটি মাত্র মানুষ। এক আশ্চর্য মানুষ! ভিড়টা এখন প্রাচীর ঘেরা শহর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। রুক্ষ পাথুরে রাস্তা। এঁকেবেঁকে চলে গেছে গলগাথার দিকে। সার বেঁধে অসংখ্য নারী-পুরুষের দল চলছে করোটি পাহাড়ে। তাদের উল্লাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চরাচরে। উল্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ঠাঁই পেয়েছে বিষণ্ণতাও। যদিও সেই শোক উল্লাসের মাঝে ততটা ভারী হয়ে উঠতে পারেনি।
ভিড়ের সামনে নিজের ক্ষত-বিক্ষত শরীরকে কোনোক্রমে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে অপেক্ষাকৃত শীর্ণকায় আশ্চর্যকর সেই মানুষটা। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক। সকলের হাহাকার ঘিরে রয়েছে তাকে। আসন্ন মৃত্যু তার হাসি মুছে ফেলতে পারেনি। এক অপার্থিব স্নিগ্ধতায় ভরে রয়েছে মুখমণ্ডল! প্রথম দর্শনে তাকে দেখে কোনো রোমান দেবতা বলে মনে হয়েছিল গায়াসের। কোনো শিল্পী ঈশ্বর অথবা বীর নায়কের যেমন চিত্র কিংবা ভাস্কর্য তৈরির স্বপ্ন দেখেন, তেমনই তার উপস্থিতি। দুর্নিবার মানসিক এবং শারীরিক আঘাতও সেই দৃশ্যে তেমন বদল আনতে পারেনি। যুবককে ঘিরে রয়েছে জনা ছয়েক সুসজ্জিত সামারিটান সৈন্য। রোমান নয়। না হলেও তাদের রোমান লিজিয়নের ধাঁচেই গড়ে তোলা হয়েছে। আরও কিছু সেনা ভিড়ের মধ্যে মিশে রয়েছে। অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়াতে তাদের দৃষ্টি যথেষ্ট সতর্ক। চঞ্চল। গায়াস সামান্য পিছনে রয়েছে। গায়াস কাসিয়াস একজন রোমান সেঞ্চুরিয়ান হয়েও এই সহায়ক সামারিটান সৈন্যদলের প্রধান। বিচারসভায় দণ্ডাদেশ কার্যকর করার দায়িত্ব মুখ্যত তারই কাঁধে।
‘বিচার, না প্রহসন?’
নিজেকে প্রশ্ন করল গায়াস। এমনটা যে হতে চলেছে তার আভাস আগে থেকেই ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়েই ধর্ম কারবারিদের স্বার্থে আঘাত হেনেছে মানুষটা। বিচারসভায় সেক্রেটারি ম্যালিনাসের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল গায়াস। কিছুই তার নজরের বাইরে ছিল না।
‘তুমি কি নিজেকে রাজা বলে মনে করো?’
গভর্নর পিলেতের প্রশ্নে সহাস্যে জবাব দিয়েছিল আশ্চর্য মানুষটা। বেঁধে রাখা হাত দুটো তুলে ধরে শান্ত অথচ দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘হে মহান শাসক, আমাকে এই শতচ্ছিন্ন বসন এবং বন্দী দশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখেও আপনার রাজা বলে মনে হচ্ছে! এই নৈতিকতা বিবর্জিত, অসাম্যে ভরা পৃথিবী আমার রাজত্ব নয়। আমি এমন পৃথিবীর রাজা, যেখানে আত্মায় বিশুদ্ধ প্রতিটি মানুষ। শোষণহীন সেই সাম্রাজ্যে শুধু আমি নই, প্রত্যেক শুদ্ধ চিন্তার অধিকারী হবে রাজার অংশ।’
‘ও একটা পাপী।’
‘পাপীকে ক্রুশে ঝোলানো হোক।’
‘পাপীর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’
গর্জন উঠেছিল বিচার সভার জমায়েত থেকে। অথচ, সেই উন্মত্ত হুংকারেও অদ্ভুত শীতল ছিল লোকটার কণ্ঠস্বর! শীতল এবং কঠিন।
‘যাজক এবং জ্ঞানী মানুষেরা, যাঁরা আমার মৃত্যু কামনা করছেন, তাঁদের জানা উচিৎ ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। এবং আমি সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করতেই এসেছি।’
সত্য! এই একটা শব্দ গায়াসের বুকে যেন ছুরির ফলার মতো গিঁথে গিয়েছিল। হয়তো গভর্নর পিলেতকেও একইভাবে আঘাত করেছিল ছোট্ট শব্দটা। সত্য আদতে কী? কে জানে? যে গভর্নরের দুটো হাত কেবল ঘুষের অর্থে ভারী তিনি কি আদৌ জানেন সত্য কী? গায়াস, যার তরবারি রক্তে রাঙানো তারও সত্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। কিংবা মহান রোম সম্রাট, যিনি মাটিতে লাঙল না দিয়েই প্রজাদের ফসল কেটে ঘরে তোলেন, তিনিও কি জানেন সত্য বলে পৃথিবীতে কিছু আছে কিনা? মানুষটা ঠিক কোন রাজ্যের কথা বলতে চেয়েছিল, সভায় উপস্থিত কেউ তার বিন্দুবিসর্গ উপলব্ধি করতে পারেনি।
‘মানুষ, নাকি ঈশ্বরের বরপুত্র?’
গায়াস নিজেও এর উত্তর জানে না। অন্তত এখনো নয়। গভর্নর পিলাতের নির্দেশ মেনে দীর্ঘ সময় ধরে নাজরাতীয় জিশুকে অনুসরণ করেছে সে। গালীল, দিকাপলি, জেরুজালেম, যিহূদিয়া থেকে যর্দ্দনের ওপার পর্যন্ত। ঘিরে থাকা সমাজের নিচু স্তরের মানুষদের মাঝে দাঁড়িয়ে স্বর্গীয় কন্ঠে শিক্ষা দান করতে দেখেছে নাজরাতীয় জিশুকে। নাহ্, বিধি কিংবা বিশ্বাস ভঙ্গের মতো কোনো আচরণই তার চোখে পড়েনি। এমনকি রোমান শাসকের প্রতি অসন্তোষের ছোঁয়াও নয়। কিন্তু যাবতীয় দুষ্কর্ম্মের জন্য কেবল ঈশ্বরকে ভয় করার কথা বললে, কিংবা মন্দিরে দান ধ্যানের বিনিময়ে স্বর্গের পিতার কাছ থেকে পুরষ্কারের আশা অনুচিত— এ কথা ঘোষণার পর পাদরিদের রোষানলে পড়তেই হবে। তাই-ই হয়েছে। মহাযাজক কাইয়াফাস সুচতুরভাবে নাজরাতীয় জিশুর পরিণতি লিখেছেন।
অথচ অন্যরকম পরিসমাপ্তি চেয়েছিলেন গভর্নর পিলেত। তাঁর চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। অন্তত গায়াসের তেমনটাই মনে হয়েছিল। ইহুদিদের বিচারসভা সানহেদ্রিনের সিদ্ধান্তকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন গভর্নর পিলেত। রোমান ইম্পেরিয়াল আইনে এমন তুচ্ছ কারণে কারোর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ম বিরুদ্ধ। তাঁর কথায় ঝড় উঠেছিল বিচারসভায়। অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল জেরুজালেমের আনাচেকানাচে। মাত্র সাড়ে চারশো সেনা নিয়ে সেই উন্মত্ত ঝড়ের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বিশেষত নিস্তারপর্ব চলাকালীন শহরে যখন পুণ্যার্থীদের ঢল নামে। তাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের।
‘মাননীয় গভর্নর’, সভার হট্টগোল ছাপিয়ে বলেছিলেন মহাযাজক কাইয়াফাস, ‘আমাদের সমাজের সবচেয়ে বিজ্ঞ এবং প্রবীণ বাহাত্তর জনকে নিয়ে সানহেদ্রিন প্রতিষ্ঠিত। এই যাজকসভা আমাদের সমাজের আভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ এবং নীতি নির্ধারণকারী। রোম একে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ যাজকসভা জঘন্য অপরাধের জন্য এই মানুষটির শাস্তি বিধান করেছে। যে আমাদের পবিত্র মন্দিরকে ধ্বংসের আহ্বান জানিয়েছে, যে আমাদের সমাজকে কলুষিত করে চলেছে, যে নিজেকেই রাজা বলে ঘোষণা করার স্পর্ধা দেখিয়েছে, সে আপনার চোখে নিরপরাধী! আমাদের আস্থা এবং বিশ্বাসকে শব্দের ছুরি দিয়ে ফালাফালা করেছে যে, তার জন্য সানহাদ্রিনের একমাত্র সিদ্ধান্ত মৃত্যু। যোগ্য শাস্তি। এবং আপনি, মাননীয় গভর্নর, জুডেয়ায় রোমান শাসনের স্তম্ভ হিসেবে আমাদের এই দাবিকে অস্বীকার করতে পারেন না। যদি করেন, তবে তার ফলভোগের জন্য প্রস্তুত থাকবেন। আমরা আমাদের দাবি নিয়ে সিজারের কাছে যাব।’
তাঁর কথা শেষ হওয়া মাত্র সমবেত ধ্বনিতে কেঁপে উঠেছিল বিচার সভাগৃহ— ‘ক্রুশে চড়াও পাপীকে।’
সেই ভীষণ অস্থির সময়েও আশ্চর্য মানুষটাকে একই রকম অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে গায়াস। না, মহাযাজক কাইয়াফাসের যুক্তি এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গভর্নর পিলেত নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। সরে এসেছিলেন।
‘কাইয়াফাস, নাকি ঈশ্বরের সন্তান নিজেই নিজের বধ্যভূমি নির্বাচন করেছে?’
বিগত দিনগুলোর হিসেব নিয়ে বসলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে গায়াসকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। গভর্নর পিলেত যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন অহেতুক রক্তপাত এড়ানোর। কিন্তু মহাযাজক কাইয়াফাসের সাজানো সাক্ষীরা যেমন সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলেছে, একই সঙ্গে উন্মাদ মানুষটিও অধিকাংশ সময় নীরব থেকে, এবং মাঝেমধ্যে ধাঁধা তৈরি করে সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলেছিল। বিচারসভার হাজারো বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়েছিল পূর্ব নির্ধারিত শর্তে। আর এখন, গলগাথায় এতদিনের যাবতীয় ষড়যন্ত্রের উপসংহার টানা হবে। জঘন্যতম হলেও গায়াস নিজের দায়িত্ব পালনে এতটুকু শিথিলতা দেখাবে না। গত কুড়ি বছর ধরে রোমের অনুগত সেনা হিসেবে রক্ত ঝরানোয় কোনো কার্পণ্য দেখায়নি সে। মেসোপটেমিয়া, আরিয়ানা (আফগানিস্তান) থেকে তাইমুর, যেখানে প্রয়োজন পড়েছে, নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে যুদ্ধে। হাতের বর্শায়, যা একদিন রোমের ত্রাতা সিজার তার পূর্বপুরুষকে বীরত্বের স্বীকৃতিরূপে দিয়েছিলেন, বিদ্ধ করেছে শত্রুশরীর। নিজেও ধারণ করেছে সহস্র ক্ষত। তার জন্য আক্ষেপ নয়, বরং গর্বিত হয়েছে। আর এখন, অবসরের দোরগোড়ায় এসে, ধর্ম কারবারিদের ঘৃণ্য চক্রান্তের ক্রীড়ানক সে!
কেউ বলে লোকটা পেগান গড। কেউ বলে ঈশ্বরের পুত্র। নাজরাতীয়রা বলে মাসিহা। লোকটা আদতে যে ঠিক কী, এতদিন অনুসরণ করেও সম্পূর্ণ উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি গায়াস। হ্যাঁ, উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্ব, শান্ত অথচ শানিত বাচনভঙ্গি বাকিদের থেকে তাকে আলাদা করেছে ঠিকই। অসহায় নিপীড়িত জনগণের প্রতি লোকটার অপার করুণা গায়াস অস্বীকার করতে পারবে না। অলৌকিক শক্তিধর বলে যারা, তারাও খুচরো অনেক কৌশল রাস্তায় সস্তার জাদুকরের কাছে দেখেছে। দু-একবার অবশ্য গায়াস নিজেও অবাক হয়েছে লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে। সেক্ষেত্রে নাজরাতীয় জিশুর জাদু দক্ষতা কিংবা নিজের অস্বচ্ছ দৃষ্টিকেই দায়ী মনে হয়েছিল। মানুষটা ঈশ্বরের সন্তান কিনা সে জানে না, শুধু আজই তার শেষ দিন ভেবে অব্যক্ত এক যন্ত্রণা বুকের কাছে ক্রমশ ঘন হচ্ছে।
ভিড়টা করোটি পাহাড়ে উঠে এসেছে অনেকক্ষণ। সাব্যাথের আগেই যাবতীয় কাজ শেষ করতে হবে। এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সামারিটান সৈন্যরা খুশি মনে তা পালনে ব্যস্ত। ইহুদিদের প্রতি তাদের জন্মগত ঘৃণা। ফরীশী হোক কিংবা সদ্দূকী সম্প্রদায়ের, ধর্মগত ভাবে ইহুদি হলেই তাদের প্রতি নিজেদের মনের ভাব সামারিটানরা আর আড়ালে রাখে না। শুরু থেকেই তারা দীর্ঘ দশকের সঞ্চিত ঘৃণা উজাড় করে দিয়েছে নাজরাতীয় জিশুর প্রতি। কাইয়াফাসের আদেশ ঠিক এমনই ছিল। অনুরাগীরাদের সামনে তাদের প্রভুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করার। গায়াস নিজে সেই পাপকার্যে অংশগ্রহণ করেনি, তবে নীরব ছিল। মান্য করার এক সুদীর্ঘ অভ্যাস তাকে চালিত করেছে। কিন্তু এরপর যা হতে চলেছে, তা সহ্য করা অসম্ভব মনে হচ্ছে। ওই তো, একজন সামারিটান সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে ক্রুশবিদ্ধ মানুষটার দিকে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। অপরাধীর পা দুটো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, যাতে মৃত্যুর আগেও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভবে অতৃপ্তি না থাকে। খানিক আগে বাকি দুই সাধারণ অপরাধীদের ক্ষেত্রে একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। ক্রুশবিদ্ধকরণের এক বহু অভ্যাসজনিত পদ্ধতি। গায়াসের হাতের মুঠো অজান্তেই আরও জোরে চেপে বসল প্রাচীন বর্শার গায়ে। আর ঠিক তখনই সূর্য দেবতা অদৃশ্য হলেন আকাশ থেকে! গায়াসের হৃদয় চুঁইয়ে অন্ধকার জমতে শুরু করল করোটি পাহাড়ে। সমবেত অনুরাগীদের কান্না যেন জাগিয়ে তুলল পৃথিবীকে! কেঁপে উঠল মাটি। জেগে উঠল গায়াসও। অনুগত রোমান সৈনিক, তার দীর্ঘ যোদ্ধাজীবনের ধর্ম ভুলে ছুটে গেল সামনে।
পাশাপাশি তিনটি ক্রুশবিদ্ধ শরীর। দু’জন সাধারণ অপরাধী। মাঝের জন, মাথায় কাঁটার মুকুট এবং মুখে ঐশ্বরিক হাসি নিয়ে এমনকি মৃত্যুকেও সমানে হতাশ করে চলেছে। রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াস তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মুহুর্তের জন্য থমকে গেল সে। ক্রুশবিদ্ধ নাজরাতীয় রাজার ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর তার কানে এল, ‘হে ঈশ্বর, এদের তুমি ক্ষমা করো, এরা কী করেছে নিজেরা জানে না।’
বোধহয় এই কথাটুকুই যথেষ্ট ছিল গায়াসের কাছে।
‘হে ঈশ্বরের সন্তান, এবার অন্তত তোমার পিতার কাছে যাও।’
মনের মধ্যে কথাগুলো ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ দক্ষতায় গায়াসের হাতের বর্শা স্পর্শ করল ক্রুশবিদ্ধ শরীরকে। সেই স্পর্শে জন্ম নেওয়া হৃদয়ের ছিদ্রপথে ছুটে বেরিয়ে এল পবিত্র রক্ত। ভিজিয়ে দিল রোমান সেঞ্চুরিয়ানের মুখমণ্ডল। সহসা গায়াসের ধূসর দৃষ্টি কেউ যেন মুছে দিল! সযত্নে। পৃথিবীকে বুঝি অন্ধকারের চাদর দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে এক দুর্ভেদ্য নিস্তব্ধতা। সেই অদম্য অন্ধকারে দৃশ্যমান কেবল গায়াসের হাতে ধরা বর্শা ফলক। সোনার হৃদয় ফুঁড়ে দেওয়া ফলকের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে সোনালি তরল! তার নেমে আসার পথে বদলে যেতে চলেছে রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াসের পরিচিতি। জন্ম নিতে চলেছে এক অবিস্মরণীয় অলৌকিক শ্রুতিকথা।
হত্যা ও কিছু প্রশ্ন
…………………………
রোজনামচায় কোনো পরিবর্তন ছিল না। সপ্তাহের সাত দিন, বছরের হিসেবে তিনশো পঁয়ষট্টি, বিকেলের আলো পুরোপুরি নিভে এলে ভদ্রলোক ধীরেসুস্থে হেঁটে বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর একপাশের সেকেলে ধরনের বেঞ্চিতে বসেন। একা নয়। অন্য দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গিনী, ডায়ানা, যাকে খুব শিগগির পাকাপাকিভাবে জীবনের সঙ্গে বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা ছিল, পাশেই বসে থাকত। গত দু’দিন ধরে বেঞ্চিতে একজনের জায়গা বাড়তি। ভদ্রলোক অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশি সময় দাঁড়িয়ে রইলেন। লম্বা শরীরকে আরও লম্বা করে ছায়া ছায়া আকশের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। ঠিক এই সময়ে কেউ তাঁকে দেখলে নির্ঘাৎ নক্ষত্র সন্ধানী ঠাওরাত। কাপুথে সে সম্ভাবনা নেই।
কাপুথ। শুইলোসি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত একটা জার্মান গ্রাম। সম্ভ্রান্ত, পরিচ্ছন্ন, এবং শিক্ষিত। সে কারণে এখানে অপরের ঘরে উঁকি দেওয়া মানুষের সংখ্যা শূন্য। অবশ্য তার অন্য একটা কারণও আছে৷ গ্রাম হলেও ধনী শহুরে মানুষদের দীর্ঘ ছুটি কাটানোর জন্য পছন্দের ঠিকানা কাপুথ। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। কয়েক পুরুষের বাস।
ভদ্রলোক ক্রিস্টোফ লুডল্ফ। ক্ল্যাসিক্যাল আর্কিওলজি জগতের সুপরিচিত নাম। ছয় ফুট লম্বা। বয়সে যাটের কোঠা পার করেছেন। সম্ভবত সেটাই শরীরের ইতস্তত অতিরিক্ত মেদ সঞ্চারের কারণ। তবে তা কোনোভাবেই স্থুলকায়দের দলে ফেলার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এই অতিরিক্ত মেদটুকু তাঁকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে তুলেছে। চৌকোনা মুখের চামড়ায় বলিরেখা স্পষ্ট।
কালো রং এখন আকাশকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছে। দূরের বাড়িগুলোতে একটা দুটো করে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে। আকাশেও আবার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে শত সহস্র বছর প্রাচীন নক্ষত্র। তাদের মধ্যে কিছু হয়তো ইতিমধ্যে মৃত। শেষ নিশ্বাসটুকু বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে এখনো ভেসে আসছে পৃথিবীতে। অন্ধকারে বেঁচে থাকা সহস্র তারাদের মধ্যে নতুন কাউকে খুঁজে চলেছেন লুডল্ফ। ছোটোবেলায় শোনা কথাটা আজ এই বার্ধক্যে এসে আবার মনে পড়ছে। যারা মরে যায়, তারা নক্ষত্রদের ভিড়ে মিশে যায়। নেহাতই ছেলেভুলোনো কথা, তবুও আকাশের কোনো কোণে ডায়ানা আছে ভেবে একাকিত্বকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। দীর্ঘ চোদ্দো বছর কেউ পাশেপাশে থাকলে একটা অভ্যাস গড়ে ওঠে৷ আচমকা সেই অভ্যাসে ছেদ পড়লে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় তো লাগেই। সুতীব্র আঘাত শরীরের কোনো অংশকে থেঁতলে দিলে যেমন অসারভাব কাজ করে, অঙ্গ হানির যন্ত্রণা উপলব্ধি করা যায় না, এই মুহুর্তে তাঁর মনের অবস্থা কতকটা তেমনই। সুদীর্ঘ ব্যস্ততা, প্রাপ্তির সম্ভাবনা, সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর উত্তেজনা, কিছুই আর আলাদা করে অনুভূতি জোটাতে পারছে না।
‘এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।’
লুডল্ফের মস্তিষ্কে ফিসফিস করে কেউ বলে উঠল। যেন সতর্ক করল। আকাশ থেকে দৃষ্টি নেমে এল পৃথিবীর কাছাকাছি।
‘এমন কী কারণ থাকতে পারে যার জন্য কোনো মানুষ নিজের অস্তিত্ব মুছে দিতে চায়? অর্থ, অপমান, অসাফল্য?’
গত দু’দিন ধরে ঘুরেফিরে এই একটা প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন লুডল্ফ। প্রতিবার আলাদা আলাদা উত্তর ভেসে উঠছে। কোনোটাই যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে না। ডায়ানার আত্মহত্যা গত দু’দিন ধরে তাঁকে একই জায়গায় আটকে রেখেছে। যেন কোনো বাতিল ফোনোগ্রাফ রেকর্ডে আটকে যাওয়া হেডশেল। অবাঞ্ছিত আঁচড়ে তৈরি খাঁজে আটকে যাওয়া কার্টিজ ঘুরে ফিরে একই শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন লুডল্ফ। কাপুথে থাকাকালীন সারাদিনের কাজের শেষে সন্ধের এই সময়টুকু অবসরের ঠিকানা। তাঁর এবং ডায়ানারও। লুডল্ফ ডানপাশের সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া হাতলটার পাশে বসলেন। সপ্তাহের সাত, বছরের হিসেবে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এখানেই বসেন। পাশের জায়গাটুকু বাড়তিই পড়ে রইল।
অন্ধকার থেকে তাকে আলাদা করা যাচ্ছে না। সুবিধা করে দিয়েছে পরনের পোশাক। গোড়ালি ঢাকা কালো আলখাল্লা। বাকিদের থেকে পাদরিকে আলাদা করে যে পোশাক। সন্ধের ঠিক মুখে হাজির হয়েছিল সে। এল্ডার গাছগুলোর জমায়েতের মাঝামাঝি একটা সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়েছিল। চট্ করে কারোর নজরে আটকাবে না এমন। অবশ্য এ পথে লোক চলাচল সামান্যই। বেলা ফুরোলে শূন্যের কাছে এসে ঠেকে। তবুও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এতটুকু অসাবধানতাকে লাই দেওয়ার নিয়ম নেই। কথাটা মনে রেখেছে সে। গত তিনদিন। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের। এখনো তাই-ই করছে৷ প্রায় চল্লিশ মিনিট স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে। এল্ডার গাছের গুঁড়ির মতোন। এতটুকু নড়েনি। ওই যে, ধৈর্য্য…। লোকটা অন্যদিন এ সময়ে ঘরে ফিরে যায়। আজ ঠায় বসে। নিক, যতটা পারে সময় নিক। সে অপেক্ষা করবে।
কতক্ষণ একভাবে বসে ছিলেন লুডফ্লের সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না। অন্য দিনের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশিই হবে হয়তো। গ্রামের গীর্জায় বেল টাওয়ারের ঘণ্টা ধ্বনি তাঁকে এলোমেলো চিন্তা থেকে বের করে নিয়ে এল। সাতটা বেজে গেছে! নিজেকে ধাক্কা মেরে তুললেন লুডল্ফ। অন্ধকারকে চাদর করে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো গাছ থেকে একটা নাইটজার পাখি ডেকে উঠল ‘গুব গুব… উঁহু উঁহু’ সুরে। তার স্বর চারপাশের নিস্তব্ধতাকে যেন আরও বেশি প্রকট করে তুলল। প্রকৃতির মাঝে মৃত্যুর কোনো বিলাপ নেই। মানুষের জীবনেও কথাটা প্রযোজ্য। হ্যাঁ, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা কিছুকাল হয়তো তাড়িয়ে বেড়ায়, তবে সময়ের দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। বিষাদকে শিকেয় তুলে রেখে কাজে ফিরতেই হয়। কথাটা লুডল্ফের মতো মানুষদের ক্ষেত্রে আরও বেশি করে প্রযোজ্য। বিশেষত তিনি এবং সদ্য প্রয়াত বান্ধবী ডায়ানা, দু’জনে যখন লক্ষ্যের এত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন, তখন কেবল অতীতের সুখস্মৃতির কথা ভেবে বিলাপ করা মানায় না। নিয়ম বিরুদ্ধ তা। ঘরের দিকে দ্রুত দু’পা ফেলেও থমকে দাঁড়ালেন তিনি। থকথকে কালো কালি মেখে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। প্রেতাত্মার মতো ছায়া শরীর নিয়ে। সন্ধের মুখে যখন বেরিয়ে ছিলেন, আলোগুলো জ্বালিয়ে রাখার কথা মনে ছিল না। সারাদিনের কাজের ছেলেটি আজ বিকেল থেকে দুটো দিন ছুটি নিয়েছে। এমন দিনগুলোতে ডায়ানা আর বাড়ি ফিরত না। এখানেই থেকে যেত। সুতরাং আলো জ্বালানো কিংবা খাওয়া নিয়ে চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন সে-সবের ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হবে। লুডল্ফের পা জোড়া আবার সচল হল। ঘরে ঢুকে ফ্লুরোসেন্ট বাতিগুলো এক এক করে সবকটা জ্বালিয়ে দিলেন তিনি। অন্ধকারের সমুদ্রের মাঝে আলোকদ্বীপের মতো জেগে উঠল বাড়িটা।
‘আশ্চর্য এক মানুষ বটে! যোদ্ধার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি মুছে দিনের পর দিন সম্পুর্ণ আলাদা পরিচয় বহন করা সহজ নয়। অবশ্য ইতিহাসে এমন আশ্চর্য মানুষ আরও আছেন। সম্রাট অশোকই যেমন। চণ্ডাশোক থেকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন ধর্মাশোকে। সম্রাট অশোক সম্পর্কে তাও জানা যায়। প্রচুর প্রামাণ্য নথি রয়েছে৷ কিন্তু এই মানুষটা? অদ্ভুত এক রহস্যে মুড়ে রেখেছেন নিজেকে! তবে আর বেশিদিন নয়। খুব শিগগিরই পৃথিবী এক আশ্চর্য মানুষের কথা জানতে পারবে।’
টেবিলের ওপরে খোলা খাতা। খাতার প্রায় প্রতি পাতায় তাঁর সঙ্গে ডায়ানার তীব্র উপস্থিতি। খাতা দুটো ছাড়া কিছু ফাইলও রয়েছে৷ মুখবন্ধ। খাতার অজস্র হিসেব, কাটাকুটি, সিদ্ধান্ত থেকে মুখবন্ধ ফাইল পর্যন্ত পৌঁছাতে অগুনতি বিনিদ্র রাত, ব্যস্ত দিন পার করতে হয়েছে৷ সম্ভবত এবার শেষ ধাপ। আশ্চর্য সন্ন্যাসীর পিছু নিয়ে লুডল্ফ অনেক দূর এগিয়েছেন। এবার বাকি শুধু রহস্যময় দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। কড়া নাড়া। সে জন্য তাঁকে নিজেই যেতে হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রবীণ গবেষক। দুটো খাতাই তাঁর হাতে ধরা। সবাই প্রিয় মানুষের স্মৃতিকে শেষ দিন পর্যন্ত আগলে রাখতে চায়। লুডল্ফও তার ব্যতিক্রম নন। বড়ো আলমারির ঠিক পাশটায় মেটাল চেস্ট। পুরোনো আমলের। ডিজিটাল নয়, চাবি দিয়ে খোলে। খাতা দুটো সেখানেই রাখার কথা ছিল লুডল্ফের, তবে তার আগেই ‘ডিং ডং’।
‘এখন আবার কে এল!’
শোক জ্ঞানপনের পালা গতকালেই শেষ হয়ে গেছে। সকালেও জনা দুয়েক পরিচিত এসেছিলেন বটে, কিন্তু এখন তো সন্ধেও চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে। এখন আবার কে? উত্তরের খোঁজে হাতের খাতা দুটো আলমারিতে, সাজিয়ে রাখা বইগুলোর পাশে গুঁজে দরজা খুললেন লুডল্ফ।
‘শুভসন্ধ্যা ডক্টর। ভেতরে আসতে পারি?’
কালো পোশাক। সরু সাদা ক্ল্যারিক্যল কলার দেখেই বোঝা যাচ্ছে আগন্তুক ঈশ্বরের উপাসক। কাপুথ চার্চের পাদরি? হতে পারে। লুডল্ফ মায়ের হাত ধরে গ্রামের চার্চে পা রেখেছিলেন। তারপর ওই পথে হাঁটা হয়নি বহুবছর। আবার যাওয়া ডায়ানাকে সমাধিস্থ করতে। সেই পর্বও মিটে গেছে। সুতরাং চার্চের কেউ এখন তাঁর দরজায় উপস্থিত হবেন কেন? কারণ যাইহোক, শিষ্টাচার বলে অভিধানে একটা শব্দ আছে। বিশেষত কাপুথের মতো নির্বিবাদী নির্ঝঞ্ঝাট গ্রামে। মনের ভাবনাগুলো চটজলদি সরিয়ে লুডল্ফ বললেন,
‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে?’
‘গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার কারণে এই অসময়ে বিরক্ত করতে হল। অবশ্যই যদি আপনি অনুমতি দেন…’
এরপর দরজার মুখ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা অভদ্রতার নামান্তর। লুডল্ফ সামান্য সরে আগন্তুক ঈশ্বরের উপাসককে আহ্বান জানালেন, ‘আসুন।’
চা এবং কফির বিকল্প থেকে ঈশ্বরের উপাসক দ্বিতীয়টি পছন্দ করেছিলেন। তাতে লুডল্ফের সুবিধাই হয়েছে। কফির সাজ-সরঞ্জাম স্টাডিতেই থাকে। তাছাড়া জিনিসটা তৈরিতে হাঙ্গামা কম। দুটো লম্বাটে কাপে কালো কফি, একটা বাটিতে চিনি, অন্যটায় ক্রিম। পরপর টেবিলে রাখলেন লুডল্ফ। পাদরি ইতিমধ্যে তাঁর চেয়ার খানি দখল করেছেন। অগত্যা ঘরের অন্য পাশ থেকে আরেকটি চেয়ার তাঁকে বয়ে নিয়ে আসতে হলো। নিজের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে লুডল্ফ বললেন, ‘বলুন। চার্চের সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ নেই। আপনি কি কাপুথ চার্চের সঙ্গে যুক্ত?’
প্রসঙ্গ এড়িয়ে পাদরি বললেন, ‘আপনার সহকর্মীর মৃত্যুর জন্য দুঃখিত। ডায়ানা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাঁকে স্বর্গের পথ নির্দেশ করবেন।’
‘আপনি কি তার পরিচিত?’
পাদরির অসময়ে তাঁর দরজায় উপস্থিত হওয়ার সম্ভাব্য একটা কারণ খুঁজে পেলেন লুডল্ফ। ডায়ানা তাঁর মতো ঘোর নাস্তিক ছিল না। ইতিহাসের পাশাপাশি ঈশ্বরেও তার সমান আস্থা ছিল।
‘আমার সঙ্গেই তাঁর শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল।’
‘শেষ! মানে, পরশু দিন?’
নড়েচড়ে বসলেন লুডল্ফ। ঈশ্বরের উপাসক চট্ করে জবাব দিলেন না। ধীরেসুস্থে কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলেন। কফির স্বাদ, নাকি শেষ সাক্ষাতের মুহুর্ত মনে করে তিনি সময় নিলেন বোঝা গেল না। তারপর চোখ খুলে বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে দিলেন।
‘ডায়ানার কথা আপনি মেনে নিলে এসবের প্রয়োজন পড়ত না ডক্টর লুডল্ফ।’
‘ঠিক কী বলতে চাইছেন? কোন কথা?’
‘যা অগোচরে আছে, তাকে সকলের সামনে নিয়ে আসার কথা ডক্টর। আপনাদের সাবধান করা হয়েছিল। অনুসন্ধান থেকে সরে এলে এই মুহুর্তে ডায়ানা আপনার পাশেই থাকত।’
‘মানে! তার মানে ডায়ানা…’
লুডল্ফ কথা শেষ করতে পারলেন না। চোয়াল যেন অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছে! নাড়াতে পারছেন না। জিভের অবস্থাও এক। কফিতে চুমুক দেওয়ার পরই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। দ্রুত সেই অনুভব মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু মুখ নয়, একটা অসারভাব ঘাড় বেয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শিরদাঁড়াকে অনেক চেষ্টা করে সোজা রাখতে হচ্ছে।
প্রফেসরের অবস্থা দেখে ধীরে সুস্থে কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল সে। বলিষ্ঠ হাত জোড়া লুডল্ফকে তুলে ধরল। লুডল্ফ হাত বাড়িয়ে ঈশ্বরের উপাসককে ছুঁতে চাইলেন। পারলেন না। হাত দুটো ছেঁড়া তারের মতো ঝুলতে থাকল। অসারতা কোমর বেয়ে নিচে এখনো পুরোপুরি নেমে আসেনি। তাই তাঁকে তুলে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া গেল সহজেই। বছরের পর বছর এই চেয়ারে বসেই ড. ক্রিস্টোফ লুডল্ফ হাজারো প্রাচীন পুথি-পত্র ঘেঁটেছেন। দরকার মতো নোটস নিয়েছেন খাতায়। পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসে যোগ্য সঙ্গত করেছে একসময়ের সহকর্মী থেকে ক্রমে মনের মানুষ হয়ে ওঠা ডায়ানা। নিজেকে আর সোজা ধরে রাখতে পারলেন না লুডল্ফ। শরীরের জোর নিঃশেষিত প্রায়। ধীরে ধীরে তাঁর মাথা টেবিলে ঝুঁকে পড়ল। গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা বড়ো বট গাছ যেভাবে মাটি ছোঁয়। হাত দুটো দু’পাশে ঝুলতেই থাকল। ছেঁড়া তারের মতো।
গলার সরু সাদা ক্ল্যারিক্যলটা খুলে পকেটে ভরে নিল সে। তারপর ব্যবহার করা কফির পেয়ালা দুটো নিয়ে স্টাডি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। অব্যবহিত পরে ফিরেও এল। ধোওয়া পেয়ালা দুটিকে নিজের রুমাল দিয়ে ভালো করে মুছে রেখে দিল কফি মেশিনের পাশটায়। যেখানে আগে রাখা ছিল। একটায় কফির মধ্যে বিশেষ রাসায়নিক মিশে ছিল। অন্য কাপে তার ঠোঁটের ছোঁয়া ডিএনএ-এর ছাপ ফেলেছিল। হয়তো এতদূর ভাবার প্রয়োজন ছিল না, তবুও মুছে দেওয়া হয়েছে। সতর্কতা সবসময়ই ভালো পন্থা। হাতের কাজ শেষ করে এবার সে নজর ফেরাল লুডল্ফের দিকে।
‘ডায়ানা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ডক্টর। স্বর্গের পথে।’
বিষণ্ণ সুর খেলে গেল তার গলায়। শেষের এই মুহূর্তগুলো বরাবরই যন্ত্রণাদায়ক। আফসোস হয় সামনের মানুষগুলোর জন্য। সঠিক পথে থাকলে হয়তো তাদের আয়ু এত দ্রুত ফুরিয়ে যেত না। এসব ক্ষেত্রে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার রীতি নেই। তেমন হলে তার সঙ্গে সাধারণ অপরাধীর পার্থক্য থাকত না। শুধু খেয়াল রাখতে হয়, আবেগের পাশাপাশি কর্তব্য যেন একই গুরুত্ব পায়। এক পবিত্র উদ্দেশ্যের সৈনিক তারা। মুহূর্তের জন্যও এই সত্য নিয়ে যেন সংশয় না জাগে। বারংবার নিজেকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া অন্যতম নিয়ম।
‘সাংকতা ভেরিতাস’, ল্যাটিন ভাষায় বিরবির করে পবিত্র সত্যকে রক্ষা করার প্রাচীন নিয়মকে ঝালিয়ে নিল সে। তারপর টেবিলের কাছে এগিয়ে এল । লুডল্ফের ঝুলতে থাকা হাত দুটো পরম যত্নে টেবিলে কাছাকাছি তুলে রাখল। ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানোর কোনো চেষ্টা ছাড়াই। স্বচ্ছ দস্তানা তার আঙুলের ছাপকে আড়াল করে রেখেছে। পকেট থেকে ধারালো সার্জিক্যাল নাইফ বের করে অকম্পিত গম্ভীর স্বরে বলল, ‘যদি আমরা জীবিত থাকি, তবে প্রভুর উদ্দেশ্যে জীবিত থাকি, এবং যদি মৃত্যু হয়, তবে তাও প্রভুর উদ্দেশে। অর্থাৎ জীবিত বা মৃত, সদাসর্বদা আমরা প্রভুরই। স্বর্গের পথে আপনার যাত্রা শুভ হোক ডক্টর ক্রিস্টোফ লুডল্ফ।’
(ক্রমশ)