রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৫। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
একটু বয়স হলে দিদার হল চা খাওয়ার নেশা। সেই সময় আমার মা একটা ছোট জনতা স্টোভ আর ফ্লাক্স কিনে দিয়েছিলেন দিদাকে। আমি আর বাপি জিনিসদুটি পৌঁছে দিয়েছিলাম। জিনিসদুটি পেয়ে ছোট বাচ্চার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল দিদার মুখ। সেই অসামান্য হাসিমুখ খুব মনে পড়ে।
দিদার রান্নাঘর সারাজীবনই এমন ছিল। এর বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখি নি। বয়স হলে যখন তিনি রান্নাবান্না ছেড়ে দিলেন, তখন ওই জনতা স্টোভ তার কাছে থাকতো, তাতে চা বানাতেন। শেষের দিকে চায়ের এমন নেশা হয়েছিল যে উপবাসেও চা খেতেন। যেসব উপবাসে রান্নাকরা খাবার খেতে নেই, সেইসব দিন তিনি একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে জল আর চা পাতা দিয়ে চাপা দিয়ে রোদে রেখে আসতেন। সেই হালকা রঙ ধরা নিম-গরম চা টুকু খেতেন তারিয়ে তারিয়ে।
তারপর ক্লাস সেভেনে উঠলাম, আর এক সন্ধ্যাবেলা এই চা টুকুর মায়াও ত্যাগ করে তিনি পাড়ি জমালেন। তখনো তাঁর ফ্লাক্সে জনতা স্টোভে তৈরি করা গরম লিকার চা।
পাঁচফোড়ন
দিদা চলে যাওয়ার পর বড়মামি মেজমামি সেজমামি ন’মামি এদের রান্নাঘর বেশ গুছিয়ে দেখার সুযোগ হল। ফুলমামা আর ছোটমামা বাড়ির বাইরে থাকতেন বলে এদের রান্নাঘর আর দেখা হয়ে ওঠেনি। বড়মামির রান্নাঘরে তেমন আলাদা কিছু দেখিনি। কাঠের উনুনের পাট ধীরে ধীরে চুকে গেল, খালি রান্নাঘরের বার-উনুনটি বড়মামি রেখেছিলেন, ভাতটুকু বা চান-কাচাকুচি ইত্যাদির জল গরমের জন্য। মামাবাড়ির সেই বিশাল বারান্দা ভাগ হয়ে তাতে দেওয়াল উঠল, আর সেই দেওয়ালের গায়ে হল বড়মামির গ্যাসের টেবিল। সাথে ছিল দিদার সেই জনতা স্টোভ। বড়মামির রান্নাবান্নার সমস্ত মশলাপাতি একটি বড় গামলার মধ্যে বিচিত্র আকৃতির অসংখ্য কৌটোর মধ্যে রাখা থাকতো। রোজ রাতে সেই গামলাটিকে তিনি খাটের তলায় চালান করে দিতেন। ভোর হলে আবার তারা বারান্দার রান্নাঘরে এসে হাজির হত। একটিই ঘর ছিল তাঁদের, সেই গোটা ঘরের খাটের তলা বাঙ্ক জুড়ে মামির রান্নাঘর। বড়সড় একটা ঘরের একদিকে একটা সুবিশাল পালঙ্ক আর অন্যদিকে একটা তক্তোপোশ ছিল। তক্তোপোশের নীচে বালির মধ্যে প্রায় সারাবছরের আলু পেঁয়াজ আদা কেনা থাকতো। দুটো দেয়াল আলমারির একটায় বড়মামার ইস্কুলের বিভিন্ন খাতাপত্তর আরেকটায় বড়মামির ঠাকুর দেবতার সাথে দিব্যি মিলে মিশে থেকে যেত মাসকাবারির তেল নুন চিনি ডাল… সবকিছু এক ঘরে থাকায় সবসময় একটা অদ্ভুত গন্ধ ঘর জুড়ে বসে থাকতো। আমার দমবন্ধ লাগতো অই ঘরে ঢুকলে। তখনকার দিনে প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে আমার বড়মামা নতুন করে আর ঘরবাড়ি করে উঠতে পারেননি। আর, ছিলেনও বিশ্রী রগচটা লোক। তবে বড়মামির আন্তরিকতায় কখনো কোনো ত্রুটি থাকতো না। তিনি যেন সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো সবকিছু সহ্য করে কর্তব্য পালন করতে শিখেছিলেন।
মেজোমামা একসময় মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন। ফুটবল খেলার রেডিও-কমেন্ট্রীতে মা তাঁর মেজদাদার নাম শুনে পুলকিত হচ্ছেন, এমন গল্প আমরা খুব শুনেছি। খেলার সূত্রেই মেজমামার রেলের চাকরি। মামার বাড়ির দোতলার ও তিনতলার সিঁড়ি এবং ন’মামার থাকার ঘর তিনিই তৈরি করেছিলেন। উঠোনের উত্তরমুখে বাড়ির পাশে একধারে একটি আলাদা পাকা রান্নাঘর করেছিলেন তিনি মামির জন্য। গ্যাস আসার আগে অবধি সেই রান্নাঘরে দিদার রান্নাঘরের মতোই জোড়া আর এক কোণে কাঠের জ্বালের উনুন ছিল। তাতে সেই বুম্মির বাড়ির মতো আলকাতরার পোঁচ দেওয়া একই ধরণের জানালা ছিল। আমার এই রান্নাঘরে ঢুকলেই ওই জানালার জন্যই নিজেদের রান্নাঘরের মতো মনে হত। তবে এই রান্নাঘরে একটু করকরে হলেও সিমেন্টের মেঝে ছিল। উনুন থেকে খানিক দূরে দরজার এপাশে একটা বড় সিমেন্টের তাক ছিল বাসনকোসন আর মশলাপাতি রাখার জন্য। তবে ইঁদুরের উপদ্রবের জন্য এখানেও সেই গামলা সিস্টেমে মশলা রাখা থাকতো, যা রাতের বেলায় তুলে নেওয়া হত ঘরের মধ্যে। মেজোমামির মাসকাবারি রাখার জন্য নীচের ঘরে একটা মস্ত দেওয়াল আলমারি ছিল, সেখানেই মেজমামির সারামাসের সমস্ত সরঞ্জাম গোছানো থাকতো। আর খাটের পাশে থাকত একটা জাল লাগানো মিটকেস। এতেই রান্নাবান্না গুছিয়ে রাখতেন মামি।
মামাবাড়ি গেলে সবচেয়ে বেশি আদর এই মেজোমামার বাড়িতেই পেয়েছি। মেজোমামাই একমাত্রজন, যিনি আমরা গেলেই এত্ত দই-মিষ্টি নিয়ে আসতেন। মেজমামার ছোটমেয়ে টুসি আমার সমবয়সী, খুব বন্ধু ছিল আমার। সবার আগে ও ই হাত ধরে বলত, মুনমুন আজ আমার সঙ্গে খাবে। মা তার বড়বৌদি ছাড়া কারো কাছে খেতে চাইতেন না, মায়ের সাথে বোন ও সেখানে। আমি একা একা আলাদা বাড়িতে খাবো, এর মধ্যে একটা দারুণ স্বাধীনতা কাজ করতো। মামি খুব যত্ন করে খাওয়াতেন। নীচের তলার ঘরে খাটের পাশে আসন পেতে বসে টুসির সাথে গল্প করতে করতে খেতাম, মামিও সেই গল্পে টুকটাক যোগ দিতেন। ভাত ডাল তরকারি মাছের ঝোলের মতো সাধারণ খাবার শুধু পরিবেশন আর গল্পের গুণে অসাধারণ হয়ে উঠত। তারপর খেয়ে উঠে দুই ভাঁড় দই নিয়ে আমরা চলে যেতাম ছাদের ঘরে, সেখানে যতরাজ্যের পুরোনো অ্যালবাম আর পুরোনো “চাঁদমামা” নিয়ে আমাদের দুপুর কাটতো।
বাড়িতে রান্নার গ্যাস প্রবেশ করার পর সিঁড়ির নীচে মেজোমামি আলাদা একটি রান্নাঘর করলেন। বহুদিন পর্যন্ত দেখতাম তিনি সকালের রান্না কাঠের জ্বালে করে, বিকালের রান্না গ্যাসে করছেন। মধ্যবিত্ত বাড়িতে এভাবে তখন গ্যাস বাঁচানোর প্রবণতা কাজ করত।
ন’মামা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন এবং মাঝে মাঝেই চাকরীহীন হয়ে পড়তেন। এই অবস্থায় ন’মামি নিজেও বেসরকারি সংস্থায় কাজ খুঁজতে শুরু করলেন এবং পেয়েও গেলেন। ৮ এর দশকে গ্রামে থাকা একজন মহিলার পক্ষে এ কম কথা নয়। সামান্য ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রী নিয়ে তিনি সাহস দেখিয়েছিলেন বলে সংসারটি সেই সময় বেঁচে গেছিল। ওদের একমাত্র ছেলের পড়াশুনা ধরতে গেলে মামি একার চেষ্টায় চালিয়ে গেছিলেন। সহনশীল এবং তুমুল আশাবাদী এই মানুষটি আমার অসম্ভব শ্রদ্ধার জন।
ন’মামির রান্নাঘর ছিল দোতলার বারান্দায় দরমা দিয়ে ঘেরা। তাঁর রান্নাঘরে কাঠের উনুনের গল্প ছিল না। কেরোসিনের একটা পাম্প দেওয়া স্টোভ আর গ্যাসে তিনি রান্না করতেন। তিঁনি অত কষ্টের মধ্যেও সুন্দরের পূজারী ছিলেন। সৌখিনতা করার অবস্থা তাঁর ছিল না, কিন্তু রান্নাঘর এবং ঘরদোর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার মন ছিল তাঁর। এই রান্নাঘরেই প্রথম আমি একধরণের কৌটোয় মশলা এবং রান্নার উপকরণ সাজিয়ে রাখতে দেখেছিলাম। তাকের উপর রাখা ছোটবড় আকৃতি কিন্তু একই ধরণের মশলাপাতির কৌটো, প্রায় প্রত্যেকটি মশলার কৌটোর ভেতর ছোট ছোট স্টীলের চামচ রাখা, এই ব্যাপারটি আমি প্রথম এখানেই দেখলাম। এর জন্য হয়তো তিঁনি সারাদিনের কাজের শেষে আরো দুমাইল হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। সেই পয়সা জমিয়ে অমন সুন্দর করে সাজিয়েছেন তাঁর রান্নাঘর। আমরা দিন দুয়েক মামাবাড়ি থাকলে দ্বিতীয়দিন তিনি আমাদের অবশ্যই রেঁধে খাওয়াতেন। তাঁর গলায় মুনমুন ডাকটি বড় মধুর ছিল, এখনো সে ডাক কানে লেগে আছে। তিনিই আমার একমাত্র মামি যিনি বোনের বিয়ের সময় আমার জন্য একখানি শাড়ি এনেছিলেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন,”তোকে তো কিছু দিই নি, এই দিলাম”। অতি প্রিয় সেই শাড়ি খানি আজও আলমারিতে রাখা আছে, শাড়ি পরি না বলে বাদ দিতে পারিনি।
সেজোমামার একটি বড়সড় মুদি দোকান ছিল। দোকানের উপরতলার মামা মামি আর তাদের দুই কন্যা থাকতেন। দুই কন্যা পাপিয়া ডালিয়া আমার প্রায় সমবয়সী।
সেজোমামির রান্নাঘরও ছিল দোকান ঘরের উপরে। এই রান্নাঘরের সাথে আমার খুব বেশি সখ্যতা নেই। তবে এই রান্নাঘরে খুব তরিবত করে রাঁধা চাউমিন আমি খেতাম। মামাবাড়ি গেলে বেশিরভাগ দিনই বিকেলের টিফিনে মামি দারুণ চাউমিন করে খেতে ডাকতেন। ডালিয়া পাপিয়ার সঙ্গে বসে সেই চাউমিন খাওয়ার কথা খুব মনে পড়ে। সেই চাউমিনের ভিতর পনীরের মতো চৌকো বেশ মোটা মোটা ডিমের টুকরো থাকতো। এই চৌকো ডিমের টুকরো আমার দারুণ প্রিয় ছিল।
(ক্রমশ)