উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৩৬। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল

0

(গত পর্বের পর)

এই যে উড়নচণ্ডীর পরিব্রাজন, তা তো অনন্তকাল চলতে পারে না। একদিন থামতেই হয় জীবনের নিয়মে। এই যে কত মানুষের সঙ্গে দেখা, পরিচয়, কারো কারো সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে থাকা। এই কি কম নাকি! কতজন তো হারিয়ে যায়। তাদের স্মৃতি উড়ে যায় পাখির পালকের মতো। হয়তো কোনো এক ঝোড়ো দিনে হঠাৎই উড়ে এসে বসলেন চোখের সামনে, সেদিন স্মৃতি হাতড়েও তার রেখা খুঁজে পেলাম না। যদি পাইও – তাকে নিয়ে সময় নষ্ট করতে মন চায় না। আবার সে যদি নাছোড় হয়ে যায়, তখন তো আলাপে-বিলাপে কিছুটা সময় দিতেই হয়। এই যেমন, কৃষ্ণনগর থেকে মাঝে মধ্যেই রিংটোন বাজিয়ে হাজির হয় নির্মল। তার পদবি কিছুতেই মনে থাকে না। বছরে বারতিনেক মুঠোফোনে কণ্ঠ নিয়ে হাজির হয়। কণ্ঠস্বরে শুধু চিনতে পারি তাকে। একদা সংগ্রামী, প্রতিবাদী নির্মল একবার রাষ্ট্রিয় অনাচারের বিরুদ্ধে একক আশা করেছিল শহরের মধ্যস্থলে। প্রশাসন তাকে টলাতে পারেনি। সেই নির্মল ছড়া লিখতো। ছড়ায় প্রতিবাদ করতো। এখন সে প্রায় চলচ্ছক্তিহীন। একবার শহরে আমার উপস্থিতির সময় সে সমস্ত বাধা ঠেলে দেখা করতে এসেছিল নড়বড়ে শরীর নিয়ে। এ কি কম পাওয়া! ভুলতে চাইলেও কি তাকে ভোলা যায়! স্মৃতির পাতা ভর ভারন্ত হলেও এককোলে তাকে ঠাঁয় না দিয়ে উপায় কি? হয়তো কোনও এক সময় পথ চলার সঙ্গী হয়েছিল সে।

এমনভাবে কত পথ চলার সঙ্গীই তো হারিয়ে গেছে। স্মৃতিভাবে ক্লান্ত এই উড়নচণ্ডী হয়তো নিজেই ভুলে যেতে চেয়েছে তাদের। কিন্তু মাঝেমধ্যে স্মৃতি বড় বেসামাল হয়ে পড়ে। ঝোড়ো বাতাসে পর্দা সরিয়ে দেয়। তখন বহুদূর থেকে ছুটে এসে কোনও কোনও মুখ উঁকি দিয়ে যায়। কোনো এক অবসরে এভাবেই উঁকি মেরেছিল দেবুদা। শান্তশিষ্ট, ধীরস্থির, মৃদুভাষী এক যুবক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। নিয়িমত কলেজ করে প্রথম শ্রেণিতে পাশও করেছিল। তারপর তার হদিশ পাওয়া যায়নি। শোনা গিয়েছিল, সে নাকি গ্রামে চলে গেছে কৃষকদের সংগঠিত করে জোতদার খতমের অভিযান করতে। তখন তো নকশাল বিপ্লবীরা অনেকেই গ্রামে চলে গিয়েছিল, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার জন্য। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাদের পূরণ হয়নি। উল্টে ক্রমশ শহরই গ্রাম ঘিরে ফেললো।

সেই দেবুদার সঙ্গে হঠাৎই দেখা কৃষ্ণনগর থানার লকআপে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। রাজ্যে সাধারণ নির্বাচন চলছে। সন্ধ্যেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে গরে ফেরার কিছুক্ষণ পরেই ভাই এসে খবর দিল, হুগলি তলায় মিলিটারি খুন হয়েছে। সারা পাড়া ঘিরে ফেলেছে পুলিশে। সেটা টের পেলাম মাঝ রাতে। এগারোটা কি বারোটা হবে। পুলিশ পড়লো আমাদের বাড়ি। তখন তো নির্বিচারে গ্রেপ্তার চলছে। আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলল কেন্দ্রীয় বাহিনী। তারা নাকি এক বিখ্যাত নকশাল নেতাকে ধরতে এসেছে। সে এই বাড়িতেই থাকে। পুলিশের খোঁচর সেই খবরই থানায় দিয়েছে। তা সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত নকশাল নেতাটি যে স্বয়ং আমি। সেটা নিজেই জানতাম না। জানলাম পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতেই। বাড়ির সকলেই চলল এক এক প্রস্থ পুলিশের লাঠিযুদ্ধ। ওদের নিজেদের লাঠিতে লাঠিতে এতো ঠোকাঠুকি হচ্ছিল যে, তার প্রায় কিছুই আমার গায়ে পড়েনি। মাঝখানে এক  সি আর পি এফ আমার হাতে বেয়নেটের খোঁচা মারল। গল গল করে বেরোতে লাগল রক্ত। পুলিশ ভ্যানে বসে চললাম থানায়। লক আপে ঢুকে দেখি বেশ কিছু পরিচিত মুখ। অপরিচিতও।

পরদিন নির্বাচন। সকাল থেকেই পুলিশি ব্যস্ততা চলছে। আমরা চুপচাপ বসে আছি। কখনও কথা বলছি নিচুস্বরে। হঠাৎই কানে এলো নাকাশিপাড়ায় না কোথায় এক কংগ্রেস প্রার্থীর সমর্থনে বিপুল ভোট পড়ছে। ব্যালট বাক্স প্রায় কোলে করে ভোট দিয়ে চলেছে কংগ্রেস কর্মীরা। এক দারোগার এই সন্দেশে অন্য এক দারোগা বললেন, আরে ওকে তো গরু চুরির কেসে ধরেছিলাম।

খ্যা খ্যা করে হেসে আরেকজন বললেন, গরু চোরকেই তো সেলাম ঠুকবেন।

পুলিশের দল আসছে যাচ্ছে। গরাদের ভিতরে বসেই খবর পাচ্ছি নির্বাচনের। হঠাৎই থানা চঞ্চল হয়ে উঠল। লম্বা গোছের এক যুবককে তিন-চারজন সি আর পি এফ ঘিরে নিয়ে এসে গরাদে ঢুকিয়ে দিল। গায়ে ডোরাকাটা হাফ হাতা শার্ট আর পা জামা। সে এসে বসতে না বসতেই আবার তাকে বের করে সামনের পুলিশ-টেবিলের সামনে দাঁড় করালো। এই পঞ্চাশ বছর পরেও স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে না। কী করে যেন ছবিটা দেখতে পাচ্ছি, সেই যুবক বলছে, বিশ্বাস করুন স্যার, আমি নকশাল-টকশাল নই। আমি সমীর। রজনের ব্যবসা করি। গালা কিনতে এসেছিলাম। শুধু শুধু আপনারা আমাকে ধরে আনলেন।

দারোগাবাবুরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা কথা বলছিলেন আর বুঝতে পারেনি। দেখলাম যুবক আবার গারদে। এসে বসলো। চোখে উদাস চাহনি। আমার দিকে তাকালো। আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করল, কবে?

–কাল রাতে।

দেখলাম আরও দু-একজনের সঙ্গে নিচুস্বরে কথা বলছে। আমি চিনে ফেললাম দেবুদাকে, থানার খাতায় সে সমীর। দুপুরেই তাকে আবার বের করে নিয়ে যাওয়া হল আদালতে। বিশেষ আদালতে পেশ করা হবে। সন্ধ্যে নাগাদ খবর পেলাম, মানে পুলিশবাবুদের কথাবার্তাতেই জানতে পারলাম, গোয়েন্দা পুলিশ শক্তি দারোগা তাকে চিনে ফেলেছেন। ধরা পড়ে গেছে দেবুদা। তাকে চালান করে দেওয়া হয়েছে জেলে।

পরদিন আমাকেও পাঠানো হলো জেলে। একই কক্ষে দেবুদার সঙ্গী। বিচারাধীন বন্দী। জেলের ভিতর দুটো ভাগ দেখেছিলাম। কুলিন কমরেডরা দোতলায় সুন্দর ব্যবস্থাপনায় থাকতো। নীচে ছিল তপশিল কমরেডরা। আমাদের ছিল অনেক বাধানিষেধ। যদিও আমি মাঝে মাঝেই উপরে চলে যেতাম, কিন্তু দেবুদা কদাচ যেতো না। বাইরে বেরিয়ে অন্যান্য বিচারাধীন বন্দীদের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করতো। সেলের ভিতরে বলে সুমিষ্ট কণ্ঠে গান গাইতো। অন্যদের শেখাতো। আমরা অনেক গান শিখেছিলাম দেবুদার কাছ থেকে।

মাস পাঁচেক পর আমি জামিন পেলাম। দেবুদাকে বারবার আদালত ঘুরিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছিল। জেলে বসেই খবর পেয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের। বাইরে এসে জানলাম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে রাজকার বাহিনীর হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে মানুষ এপার বাংলায় চলে এসেছে। বিভিন্ন জায়গায় সরকারি ক্যাম্প করে তাদের রাখা হয়েছে।  আমাদের অনেক নিকট আত্মীয়ও রয়েছে সেই সব অস্থায়ী ছাউনিতে। ইচ্ছে হলো তাদের কাছে যাওয়ার। কিন্তু উপায় নেই। শহর ছাড়ার হুকুম নেই।

এদিকে নকশালবাড়ি পন্থীদের ভিতর অর্ন্তদ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর সেটা আরও বাড়ল। পার্টি খন্ড-উপখন্ডে বিভাজিত হলো। এই দ্বিধাগ্রস্ত সময়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে এলাম। মন দিলাম পড়াশোনায়। চলে গেলাম লোকসেবা শিবিরে, বড় আন্দুলিয়ায়। সেখানে এক বিকেলে দেখি শিবিরে প্রবেশ পথের কাছে খড়ের ছাউনির নীচে কে একজন বসে আছে। মুখোমুখি হতেই দেখি দেবুদা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে?

শান্ত কণ্ঠে বলল, এক জায়গায় যাবো। চারিদিকে পুলিশে নজর রেখেছে, বেরোতে পারছি না। তোর এখানে দুদিন থাকা যাবে?

দ্বিধা জড়িত স্বরে বললাম, যদি জানতে পারে?

–জানবে না। শোন আমি তোর মাসতুতো দাদা। একটা সরকারি কাজে এলে আটকে গেছে।

তারপর কী একটা যেন বলেছিলো, এখন আর মনে নেই। একটু অন্ধকার হতেই আমার হস্টেলে নিয়ে এলাম। আমি থাকতাম বিবেকানন্দ হস্টেলে। ঘরে একটা খাট ফাঁকা ছিল, তাই রক্ষে। রান্নাঘর থেকে বেশ গোপনেই খাবার এনে দিতাম। আমি চলে যেতাম দৈনিক পাঠদানের কাজে। দেবুদা ঘরেই থাকতো অন্তরীন হয়ে। পরদিন দেবুদার কাছেই জানলাম, রবীন্দ্র ভবন আর বিদ্যাসাগর ভবনে দু’জন কমরেড আছে। তারা আবাসিক। তারা নাকি গোপনে বড় আন্দুলিয়া গ্রামে গোপন সংগঠন গড়ার কাজে লিপ্ত আছে। এসব শুনে আমি তো প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম। দেবুদা দুদিনের জায়গায় রয়ে গেল আরও দুদিন। দিনের অনেকটা সময় আমি থাকতাম না। সুতরাং কার সাথে কোথায় যোগাযোগ করছে জানতাম না। দিন চারেক পর বেসিক ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ নোটিশ জারি করলেন, যাদের ঘরে অতিথি আছে, তাদের চলে যেতে হবে। হস্টেলে অতিথি রাখা চলবে না।

পরে শুনেছিলাম, স্থানীয় থানা থেকে জানানো হয়েছিল, প্রায় প্রত্যেক ভবনেই নকশাল-বিপ্লবীরা রয়েছে। যে কোনো সময় তল্লাশি হতে পারে। ফলে দেবুদাও চলে গেল।

সমস্ত পরিস্তিতির মধ্যে মাথা উঁচু করে চলতে পারতো। এক সময় আত্মসমর্পণ করে ফিরে এসেছিল বাড়িতে। ততদিনে বিয়ে করেছে। বাড়িতে তার এক শ্যালিকা এবং আরেক মহিলা পার্টি কর্মীকে আশ্রয় দিয়েছে। শুরু হয়েছে কৃচ্ছ্রসাধন। কাগজের ঠোঙা তৈরি করে দোকানে দোকানে বিক্রি করতো। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছেলে কাগজের ঠোঙা বিক্রি করতো। শুনেছিলাম, কলকাতায় লর্ড সিনহা রোডে তাকে মাঝে মধ্যেই হাজিরা দিতে হয়। দেবুদাকে দেখতাম, রাজনীতির কথা আর বলতো না।  কতগুলো মানুষের অন্নসংস্থানের চিন্তায় বিভোর। প্রায় বছর খানেক পর একদিন দেখা। বলল, সে পান্নালাল দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত সংস্থায় আছে। গ্রামে গ্রামে উন্নয়নের কাজ করে। সে একসময় ‘কম্পাস’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন পান্নালাল দাশগুপ্ত। ছিলেন ভারতের বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টি (আর সি পি আই)-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন সৌমেন ঠাকুরের সঙ্গী। পরে অবশ্য সৌমেন ঠাকুরের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে তিনি সমান্তরাল আর সি পি আই গড়ে তুললেন। একটি ঠাকুরপন্থী, অন্যটি দাশগুপ্ত পন্থী। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের শেষদিকেই তিনি গ্রাম উন্নয়নে মন দেন। মাথার উপর ছাদ, পানীয় জল আর সুস্বাস্থ্য — এই নিয়ে শুরু করলেন কাজ। গড়ে তুললেন নিজস্ব সংগঠন। আত্ম-সমর্পিত নকশাল বিপ্লবী বা পার্টি ছেড়ে দেওয়া কমরেডদের তিনি গ্রাম সংগঠনের কাজে লাগিয়েছিলেন। বার কয়েক গেছি সেই অফিসে। মনে হতো যেন শ্মশানের নীরবতা কাজ করছে অফিস ঘরে। বেশি কথা নয়, অপ্রয়োজনীয় কথা নয়, রাজনীতির কথা নয়। শুধু গ্রাম উন্নয়নের কথা। পরিবেশ আমার ভালো লাগেনি। ফলে আর যেতাম না। তারও বেশ কিছু বছর বাদে, সম্ভবত নয়ের দশকে কোনো এক দূত মারফৎ খবর পেয়েছিলাম, দেবুদা মারা গেছে। ভেবেছিলাম, একটা মাথা উঁচু করে চলা মানুষ মাথা নিচু করতে করতেই শেষ হয়ে গেল! এমনও হয়।

হয়। হয় বলেই তো কত স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। জীবনের এই যাত্রাপথে কম তো দেখা হলো না। সব কি বলা যায়? যায় না। কত কিছু উপেক্ষিত রয়ে যায়। হারিয়ে যায়। জীর্ণ পাতারা উড়ে যায় এক এক ঘূর্ণিঝড়ে। এই যে উড়নচণ্ডী মন, এই মনও কি বশে থাকল? থাকল না। দেহটাকে এক জায়গায় রেখে মনটা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে পালায়। কিছুতেই তাকে বসে রাখা যায় না। এবারেও গেল না। সে আপন খেয়ালে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়ল, পাঁচালির পৃষ্ঠা মুড়িয়ে।

(শেষ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *