ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : উনত্রিশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

সিডনিতে ১৯৯২ সলের দ্বিতীয় জানুয়ারি টেস্ট শুরু হয়। বিহারের বাঙালি ক্রিকেটার সুব্রত ব্যানার্জির অভিষেক হয় সেই টেস্টে। জিওফ মার্শকে (৮) দলীয় ২২ রানের মাথায় বোল্ড করেন তিনি। এরপর বুন (১২৯) আর টেলর (৫৬) মিলে ১১৭ অবধি টানেন। টেলরও সুব্রত ব্যানার্জির বলে চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন। খানিক বাদে মার্ক ওয় প্রভাকরের (৫) হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন। বোলার সেই সুব্রত। অস্ট্রেলিয়া ১২৭/৩। এরপর জোন্স (৩৫) আর বুন ৮৩ রান যোগ করলেন। অস্ট্রেলিয়া কিন্তু ২১০/৩ থেকে ৩১৩ রানে শেষ। বাকি উইকেট গুলো কপিলদেব আর প্রভাকর ভাগ করে নেন। তিন উইকেট পড়ে যাওয়ার পর গোটা ইনিংসে সুব্রত কে বল করতে দেন নি আজহার। সুব্রতর বোলিং ফিগার ছিল ১৮-৪-৪৭-৩। সবথেকে বড় কথা; ২৬৯/৮ থেকে যখন বুন ও টেস্টে অভিষেক হওয়া ওয়ার্ন ৭১ মিনিটে ৪৪ রান যোগ করেন, ওয়ার্ন ৭১ মিনিটে ৬৭ বলে ২০ করেন একটা চার মেরে দশম ব্যাটার হিসেবে।

ভারত ব্যাট করতে নামলে সিধু দলীয় ৭ রানের মাথায় খাতা না খুলেই মার্ক ওয়র হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ম্যাকডরমটের বলে। মঞ্জেরেকার আড়াই ঘন্টা ব্যাট করে ৩৪ করে যখন আউট হলেন তখন দল ৮৬। প্রায় তিন ঘন্টায় তখন ৪০ ওভার ব্যাট করে ফেলেছে ভারত। এরপর তৃতীয় উইকেটে ভারত সোয়া তিন ঘন্টায় তোলে ১১১ রান। ভেঙ্গসরকার ৫৪ করে আউট হন ম্যাকডরমটের বলে। ভারত ১৯৭/৩। ছয় ঘণ্টায় প্রায় ৯০ ওভার হয়ে গেছে। অধিনায়ক আজহার নেমেই একটা চার মেরে আউট। ভারতের রান ২০১/৪। নামলেন শচীন।

পরের সাড়ে তিন ঘন্টা ভারত ঝড় তুললো। প্রায় সোয়া নয় ঘন্টা ব্যাট করে শাস্ত্রী আউট হলেন ৪৭২ বলে ২০৪ করে। ভারত তখন ৩৯৭। এরপরের দুঘন্টায় অবশ্য ৮৬ যোগ করে ভারত ইনিংস শেষ করলো ৪৮৩ রানে। শচীন টেস্টে দ্বিতীয় শতরান করেন (অপরাজিত ১৪৮)। ১৮ বছর ৯ মাস বয়স হতে তখনও তাঁর ১৮ দিন বাকি।

খেলার সেটা পঞ্চম দিন। ভারতীয় বোলাররা ঝাঁপিয়ে পড়লো অস্ট্রেলিয়ার ওপর। একঘন্টার মধ্যেই বুন ও মার্শকে তুলে নিলেন কপিল ও শ্রীনাথ। অস্ট্রেলিয়া ৩১/২। আড়াই ঘন্টা কাটার আগেই অস্ট্রেলিয়া ৮৫/৪। জোন্স আর স্টিভ ওয় কে প্রভাকর আর শাস্ত্রী তুলে নিয়েছেন। তখনই ইনিংস ধরেছিলেন মার্ক টেলর (৩৫)। কিন্তু তিন ঘন্টা কাটার পর তিনিও গেলেন। অস্ট্রেলিয়া ১০৬/৫। তখনও ৬৪ রান বাকি ইনিংস পরাজয় এড়াতে। হাতে ৫ উইকেট। আধ ঘন্টা বাদে হিলিকে ফেরালেন শাস্ত্রী। ১১৪/৬। তখন বর্ডার আর মার্ভ হিউজ সোয়া এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলেন। হিউজ আউট হলেন শচীনের বলে ২১ করে। তখন দল ১৬৪/৭। ১৭১ রানের মাথায় ম্যাকডরমট আউট হলেন শাস্ত্রীর বলে। রিড আর বর্ডার (অপরাজিত ৫৩; ১৫৮ মিনিট, ১৫৭ বল, ২×৪) ড্র করে ফিরলেন। ১৭৩/৮ রান তুলতে অস্ট্রেলিয়া ঝাঁপ ফেলা ব্যাট করে। পাঁচ ঘন্টা পাঁচ মিনিটে ৮৪ ওভার ব্যাট করে তাঁরা মাত্র ৪টি চার মারেন। শাস্ত্রী ৪৫ রানে ৪ উইকেট নেন। প্রভাকর, কপিল, শ্রীনাথ ও শাস্ত্রী একটি করে উইকেট নেন। আশ্চর্য জনক কান্ড হলো আজহার অজ্ঞাত কারণে প্রথম ইনিংসের সফলতম বোলার সুব্রত ব্যানার্জিকে দিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে একটিও বল করাননি। সুব্রত আর টেস্টে সুযোগ ও পাননি।

এরপর কিছুদিন বেনসন অ্যান্ড হেজেস এর খেলা চলে। তারপর চতুর্থ টেস্ট শুরু হয় ২৫ শে জানুয়ারি, ১৯৯২, এডিলেটে। গত টেস্টের জের টেনে ভারতীয় বোলাররা বিধ্বংসী বোলিং করে অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ১৪৫ রানে অল আউট করে দেয়। কপিলদেব ৩৩ রানে ৩ উইকেট নেন। রাজু ১১.৪ ওভারে ১১ রানে ৩ উইকেট নেন। শচীন ও প্রভাকর দুটো করে উইকেট পান। জোন্স কেবল ৪১ করেন। তবে ভারত ও কিন্তু দাঁড়াতে পারলো না। ৭০ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে বসে। এবারে রুখে দাঁড়ান কপিল দেব (৫৬) ও প্রভাকর (৩৩)। তারপরে চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত (১৫), রাজু (১৯) ও শ্রীনাথ (২১) ভারতকে ২২৫ অবধি নিয়ে যান। এবার দ্বিতীয় ইনিংসে টেলর (১০০) বুন (১৩৫) ও বর্ডার (অপরাজিত ৯১) অস্ট্রেলিয়াকে ৪৫১ অবধি টেনে নিয়ে যায়। কপিল (৫/১৩০) দীর্ঘ দিন পর ইনিংসে ৫ উইকেট নেন। ভারতের জয়ের জন্য লক্ষ্য ছিল ৩৭২। চতুর্থ দিনের শেষে রান ছিল ৩১/০।

শেষ দিন ভারত খুব লড়াই করে। শ্রীকান্ত (২২), সিধু (৩৫), মঞ্জেরেকার (৪৫) মোটামুটি লড়লেও শচীন (১৭) ও ভেঙ্গসরকার (৪) গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অল্প রানে আউট ভারতকেই চাপে ফেলে দেয়। কপিলও এবার ৫ করে আউট হতে ভারতের রান দাঁড়ায় ১৮২/৬। এবার আজহার (১০৬) ও প্রভাকর (৬৪) সপ্তম উইকেটে ২৮৩ অবধি টানেন। আজহার আউট হলে প্রভাকর পন্ডিত (৭) জুটি দাঁড়াতে পারেনি। রাজুকে (অপরাজিত ৮) জুটি করে নবম উইকেটে ৫২ মিনিটে ৩৬ রান যোগ করে প্রভাকর আউট হতেই সব আশা ভারতের বিলুপ্ত হয়ে যায়। শ্রীনাথ টেকেনি বেশিক্ষণ। ৩৩৩ রানে অল আউট হয়ে ৩৮ রানে হেরে যায় ভারত। দুটো ম্যাচ পরপর জয়ের সুযোগ হারায় ভারত।

পার্থের পঞ্চম টেস্টে (১লা ফেব্রুয়ারি) ভারত বল ভালো করেছিলো। বুন (১০০), বর্ডার (৫৯) আর মুডি (৫০) ছাড়া কেউ টেঁকেনি। পাঁচ উইকেট নেন প্রভাকর। অস্ট্রেলিয়া ৩৪৬ তোলে। ভারতের কিন্তু রান বেশী হয়নি। শচীন ১১৪ না করলে ২৭২ হতো না।  মার্ভ হিউজ ও মাইক হুইটনি ৪ টি করে উইকেট নেন। ভারত ১৫৯/৮ ছিল। নবম উইকেটে ৮১ রান ওঠে মোরে (৪৩) ও শচীন জুটিতে। দ্বিতীয় ইনিংসে জোন্স (অপরাজিত ১৫০) ও মুডি (১০১) ব্যাপক রান তোলেন চতুর্থ উইকেট জুটিতে (১৭৩)। অস্ট্রেলিয়া ৩৬৭/৪। ৪৪২ রান করবে এমন অবস্থায় প্রথম উইকেটে সিধু (৩৫) ও শ্রীকান্ত (৩৮) ৮২ রান তোলার পর হুইটনির (৭/২৭) এর সামনে ভারত ১৪১ রানে শেষ।

শ্রীকান্ত ও ভেঙ্গসরকার জীবনের শেষ টেস্ট খেললেন। এই সফরে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত উভয়েই আশির দশকের এলিজি লিখলো। প্রভাকর সিরিজে ২২৪ রান সহ ১৯টি উইকেট নিলেন। শচীন ৩৬৮ ও শাস্ত্রী ৩০০ করেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ২৫টি উইকেট তোলেন কপিল। ব্যাট হাতে ১৬৫ করেন তিনি। আজহার করেন ১৯২। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকডরমট ৩১টি, হুইটনি ১৭, হিউজ ২২ ও রিড ১২ উইকেট নেন। বুন ৫৫৬, টেলর ৪৪২, জোন্স ৩১০ ও বর্ডার ২৭৫ করেন।

এরপরেই অস্ট্রেলিয়া যায় শ্রীলঙ্কা সফরে। এটি শ্রীলঙ্কার জন্য একটি ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ ছিল কারণ ১৯৮৭ সালের পর এটিই ছিল শ্রীলঙ্কার জন্য প্রথম ঘরোয়া সিরিজ। এই সিরিজেই শেন ওয়ার্নের আবির্ভাব ঘটে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল উইকেট-কিপার ব্যাটার রমেশ কালুভিথারনের করা  এসএসসিতে অভিষেক টেস্টেই প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।

SSC-তে প্রথম টেস্টটি একটি বিখ্যাত টেস্ট ম্যাচ।   কারণ শ্রীলঙ্কা মাত্র ১৮০ রান তাড়া করতে গিয়ে ১৬৪ রানে গুটিয়ে যায়। বিশেষ করে এমন ম্যাচে যেখানে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা স্বাচ্ছন্দ্যে ২৯১ রানে এগিয়ে ছিলো।

হাতুরাসিংঘে, রমানায়েকে আর বিক্রমাসিংঘে(উইকার্মা লেখা থাকতো বাংলা খবরের কাগজে) অসিদের রান ১২৪/৭ করে দেয়। তখন ইয়ান হিলি (অপরাজিত ৬৬) প্রথমে ম্যাকডর্মটকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টম উইকেটে তুললেন ৩৮ রান (৩৯ মিনিটে)। ম্যাকডর্মট আউট হতেই নামলেন ওয়ার্ন (২৪)। নবম উইকেটে ৭৫ মিনিটে যোগ হলো ৪৫। শেষ উইকেটে হুইটনি(১৩) কে সঙ্গে নিয়ে ৪৯ যোগ করলেন হিলি। অস্ট্রেলিয়া ভদ্রস্থ ২৫৬ রান তুললো। হাতুরাসিংঘে ৬৬ রানে ৪ উইকেট ও রমানায়েকে ৫১ রানে ৩ উইকেট নেন।

এরপর মহানামা ৭৮, গুরুসিংঘে ১৩৭, রনতুঙ্গা ১২৭ ও কালুবিতরণে অপরাজিত ১৩২ করায় শ্রীলঙ্কা ৫৪৭/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। ওয়ার্ন ২২ ওভারে ১০৭ রান দেয়। ম্যাথু ৯৩ রানে ৩ উইকেট পান।

২৯১ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া লড়াইয়ে ফিরে আসে। বুন, জোন্স, ম্যাথু, মার্ক ও হাফ সেঞ্চুরি করেন, ওয়ার্ন ৩৫, ম্যাকডরমট ৪০, মার্ক টেলর ৪৩ করায় অস্ট্রেলিয়া ৪৭১ রান তোলে।

জয়ের জন্য শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ১৮১ শেষ দিন হাতে বেশি সময় নেই। টি এর সময় শ্রীলঙ্কা ২৯/২। খেলা শেষ হতে মেরে কেটে যখন ৪৫ মিনিট বাকি, হাতে মাত্র ১৫ ওভার, শ্রীলঙ্কা ১২৭ তুলেছে ২ উইকেট হারিয়ে, এমন সময় একদিকে ম্যাথুজ (২০-২-৭৬-৪) অন্যদিকে ওয়ার্নের ভেল্কি (৫.১-৩-১১-৩) শুরু হলো। মুহুর্তে শ্রীলঙ্কা ১৬৪ রানে শেষ। সেই শুরু হলো ওয়ার্নের।

দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হয়। জোন্স ৭৭ ও অপরাজিত ১০০ করেন। তৃতীয় টেস্টও ড্র হয়। বর্ডার ১০৬ ও ৭৮, হিলি ৭১ ও ৪৯, ম্যাথু ৫৭ ও ৯৬ করেন।

এরপরেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ যার কথা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে আলোচনার সময় বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

এরপরে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজ ১-১ করে (এই সিরিজের প্রথম টেস্টে বর্ডার ভেঙে দেন গাভাস্কারের ১০,১২২ রানের বিশ্বরেকর্ড) অস্ট্রেলিয়া অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড সফরে যায় অ্যাসেজ খেলতে।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *