সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

কালিম্পং:শহর পত্তন

কালিম্পং শহরের গল্প বলার আগে নেহাৎই ব্যাক্তিগত অন্য একটা প্রসঙ্গে(বা গল্পে) আসতে হয়। কেন, তা ক্রমশ প্রকাশ্য।

 

গপ্পবাজ এই লেখকের ছোটবেলা যেখানে কেটেছে, বুড়োবেলাটাও কাটছে কোনরকম, সেখান থেকে পাহাড় বেশি দূর নয়। বড় রাস্তায়(একটাই বড় রাস্তা ছিলো, সেটাই পাহাড়ে চলে যেতো সোজা) বেরুলেই  উত্তর পূব পশ্চিম জুড়ে উঁচু পাহাড়ের সারি, রোদ-ঝলমল পরিষ্কার দিনে কালচে নীল, অন্য সময় ঝাপসা। অনেক দিন আগের কথা সেসব, হুট বললেই বেরিয়ে পড়া যেতো না। কিসে যাওয়া হবে, কে নিয়ে যাবে, গেলে কি হবে, ফেরাই বা কি করে যাবে ইত্যাদি মেলা ঝকমারি। এখন বুঝতে পারি, বাড়ির বড়দের হাতে কখনোই উদ্বৃত্ত  টাকাপয়সা বিশেষ থাকতো না। ফলে, ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়া, পড়ে পাহাড়ে চলে যাওয়া, হয় কি করে? আমার বাবা উত্তর কলকাতার বাসাবাড়ি ছেড়ে দার্জিলিং পাহাড়ে ডেরা বেঁধেছিলেন মধ্য চল্লিশে, সম্ভবত দেশ স্বাধীন হবার আগেই। তিনি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাহাড় ছেড়ে সমতলে এলেন, কিছুকাল পরে মা’ও ইস্কুলের চাকরি নিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন। রাজনীতির জীবন ছেড়ে বাবা সংসার করতে শুরু করলেন বটে, পাহাড়ের সঙ্গে যোগাযোগটা থেকে গেলো। সেখানে অনেক বন্ধুবান্ধব পরিচিতজন, তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করবার জন্যই হোক বা অন্য কেজো প্রয়োজনে(উত্তর-রাজনৈতিক জীবনে বাবা সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘকাল) যখন তখন পাহাড়ে উঠে যেতেন। দার্জিলিং যেতেন বেশি, তবে  কালিম্পং-এও যেতে হতো। একাই যেতেন, অবরেসবরে আমরা পিছু নিতাম। সেই সুযোগ বিশেষ আসতো না, পাহাড়ের ভিতরে গিয়ে পাহাড় দেখাও হতো না। যে ইসকুলটায় পড়তাম, তার দোতলার জানলা থেকে প্রায় সারাবছর পাহাড় দেখা যেতো। বাড়িঘর তত ছিলো না, চোখ আটকাতো না কোথাও। ছোট্ট শহর শেষ হয়ে গেলে নীল দিগন্তে পাহাড়ের ঢেউ, রোদ পড়ে ঘরবাড়ির টিনের চাল চকচক করছে, বর্ষায় ঘন মেঘের কালোসাদা পুঞ্জ নেমে আসছে শৈলশানু অবধি। বাইরে থেকে কেউ এসে  পড়লে কচিৎ কখনো সেভক করোনেশান ব্রীজ যাওয়া হতো। বিকেল বিকেল, সন্ধ্যা নামলেই ফিরে আসা। যাওয়া এইটুকুনি, না যাওয়াটা অনেক অনেক বেশি। ওদিকে দিন নেই রাত নেই নিঃশব্দে ও তুমুল কল্লোলে পাহাড় চলে আসছে কাছে, রাশিরাশি রঙ ও আলোছায়া নিয়ে, সারস পাখির মতো দীর্ঘ ডানা ছড়িয়ে ডাকছে। পাহাড়ে না যেতে পারার, না যাবার দীর্ঘ বাকি সময়টা কাটে কি করে, বুক হুহু করা মন-খারাপের সব সময়? 

বাড়িতে ইংরেজি বই বিশেষ ছিলো না। যা ছিলো প্রায় সব কটাই ‘বড়দের’। একে পড়তে নেই, তার ওপর ক্ষুদে ক্ষুদে ইংরেজি অক্ষরের দুর্বোধ্য ঠাসবুনোট, পড়ে কার সাধ্যি। তবু তার মধ্যে একটা বই চোখ টানতো, হয়তো মনও। জন্মাবধি সে বই দেখেছি, চৌকোমতো, পুরু আর ভারি সাদা পাতার বই, তাতে ছবির পর ছবি। সাদাকালো ফটোগ্রাফ, কখনো পুরো পাতা, কখনো পাতার এক দিক জুড়ে, ছবির কোনগুলো ঝাপসামতো, যাকে কেতাবি ভাষায় বলে ভিনেট। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, মানুষ, ঘরবাড়ি, রাস্তা। কত বছর ধরে কতবার, কত হাজার বার যে ছবিগুলো দেখেছি, বইয়ের মসৃণ সাদা পাতায় হাত বুলিয়েছি, কে জানে। ইংরেজি পড়ার একটু-আধটু অভ্যাস হলে বুঝলাম, বইটা কালিম্পং নিয়ে। আর একটু বেশি পড়া হলে জানলাম, বইটা আসলে খৃষ্টান ধর্মপ্রচারকদের কালিম্পং আসার, বসত গড়ে তুলবার কাহিনী। বাবা বলতেন, ওরে, খুব দামি বই, যত্ন করে রাখ। ওই পর্যন্ত। পুরো বই পড়ে ওঠাটা হলো না। কোথাকার জল কোথায় গড়ালো, কাঠবাঁশ দিয়ে তৈরি আমাদের একতলা পুরোনো বাড়িটা কোথায় মিলিয়ে গেলো, বাবা চলে গেলেন, মা’ও, খুব দামি, যত্নে রাখবার সে বই পড়ে রইলো অন্য দশটা বইয়ের আড়ালে অনাদরে, অবহেলায়। পুরোনো, খুব পুরোনো বই, আরো আরো পুরোনো হলো, কবে কখন আলগা হয়ে এলো মলাট(নাকি মলাট ছিলোই না মোটে?), বইয়ের বাঁধুনি, পাতা আলগা হয়ে হলুদ হতে শুরু করলো, হারিয়ে, নষ্ট হয়েও গেলো। অনেক অনেকদিন পর খোঁজ নিয়ে দেখলাম, বইটা আছে বটে, তবে নেইও। সামনের পিছনের পাতাগুলো একেবারেই নেই, মাঝের কয়েক পাতা যেটুকু আছে হলদে হয়ে যাওয়া সেই স্মৃতির পৃথিবী খুঁড়ে গর্ত করে ঢুকে এসেছে কিলবিলে বই-খাওয়া পোকার দল। বইয়ের নামটা অবধি ভালো করে তখনো দেখিনি, সে বই অন্য কোথাও আছে কি নেই, জানবো কী করে?

পাহাড় নিয়ে, কালিম্পং নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি, একটা বইয়ের নাম বারবার দেখতাম। অন দি থ্রেসোল্ড অফ থ্রী ক্লোজড ল্যান্ডস, রেভরেন্ড গ্রাহামের লেখা। স্মৃতির ভুলভুলাইয়ায় সব গুলিয়ে যেতে পারে, যায়ও। আমার খুব চেনা, ক্ষয়ে যাওয়া ধ্বংস হতে থাকা বইটার সঙ্গে এই লেখাটাকে মেলাই নি। নেটের উর্ণনাভে, নতুন করে খুঁজতে খুঁজতে খুব সম্প্রতি লেখাটা আবার পাওয়া গেলো, কি ভেবে সেটা নামিয়ে ফেলে যুগপৎ অবাক ও রোমাঞ্চিত হয়ে দেখি, সেই বই, অবিকল, হুবহু। পাতায় পাতায় ছোটবড় ছবি, আদি কালিমপঙের বাজার, প্রথম চার্চ, প্রথম সায়েব মেমসায়েব মিশনারিরা, তাঁদের গোরস্থান, কালিমপঙের প্রথম হাসপাতাল, তিব্বত-ভূটান সীমান্তের উঁচু বরফের পাহাড়, খেরেস্তান হয়ে যাওয়া এবং না হওয়া পাহাড়ের মানুষ, লেপচা, তিব্বতি, ভোটে, নেপালি(বা গুর্খা), সমতল থেকে পাহাড়ে উঠবার পথে দেড়শো বছর আগেকার তিস্তা নদী, সেই নদী পেরুনোর জন্য প্রথমে বাঁশ-বেতের, পরে তারের ঝোলা সাঁকো। সত্যিকারের বই নয়, বইয়ের সাংখ্য অর্থাৎ ডিজিটাল অবতার, ফলে ছবি কিছু ঝাপসা, মলিন, কাগজের গন্ধ নেই, ছাপা ছবির সাদা-হলদে-বাদামি রঙ নেই। না থাকুক। পৃথিবী জীবন নদী পাহাড় মাটি বন সব শুকিয়ে ধূসর রঙহীন হয়ে যাচ্ছে, নেটের এককোনে গুঁজে রাখা ডিজিটাল বইয়ের কি দোষ? খুঁজে যে পাওয়া গেলো সেইই তো যথেষ্ট। বড় আনন্দ হলো।             

অন্যত্র পাওয়া যায় এমন গুটিকত ছবি ছাড়া, বইটা অবশ্য তেমন মজাদার ঠেকলো না, সুখপাঠ্য তো নয়ই। গ্রাহাম সায়েব কর্মযোগী মানুষ ছিলেন, সুসংগঠক ও দক্ষ ধর্মপ্রচারক, কিন্তু সুলেখক নন। মন বসলো না। স্কটদেশিয় মিশনারিরা না থাকলে কালিমপং শহরের পত্তন  হতো কিনা সন্দেহ। যদিও গ্রাহাম সায়েবের হাত ধরে ঠিক শহরপত্তনটা ঘটেনি, তিনি কালিমপং-য়ের মূল সায়েব, শহরবাবা, দার্জিলিং-য়ের যেমন ক্যাম্পবেল,  সেরকম। তাঁর কথা এ বৃত্তান্তে ঘুরেফিরে আসবে।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *