অক্সিজেন। পর্ব ৩৮। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
দুর্গম গিরি
এভারেস্ট ওঠার অনেক হ্যাপা। তাছাড়া প্রচুর টাকার ব্যাপার।মৈত্রেয়ীদির সঙ্গে কথা হবার পর ও মন থেকেই আপাততঃ ওই ইচ্ছেটা বাদ দিল।
মৈত্রেয়ীদি মানুষটা পাহাড় পাগল। সারাবছর একটা না একটা পাহাড়ে চড়ে বসে থাকেন।বিয়ে করেননি।লম্বায় প্রায় পাঁচ সাতের মত।রেলে কাজ করেন, শক্ত সমর্থ চেহারা।সোজাসুজি কথা বলেন।শক্তিদার কথামত ওনার বাড়িতে গেলে উনি নিজেই দরজা খুলে বসালেন ওকে।
প্রথমেই বললেন “আমার সঙ্গে তোমার অবস্থার বিরাট ফারাক আছে।আমার পৈ্ত্রিক লোহা লক্করের ব্যবসার বার্ষিক আয় কম নয়।পুরোটাই ভাই দেখাশুনা করে।আমি আর ওর ফ্যামেলি একসঙ্গেই থাকি।বাড়ির যাবতীয় খরচ ব্যবসা থেকেই আসে। তাছাড়া আমার সঙ্গে ওর এই শর্তে ব্যবস্থা আছে যে আমি যখন টাকা চাইব, আমাকে তা দিতে হবে। এছাড়া আমি রেলের অফিসার। আমার কোথাও ট্রেন ভাড়া লাগেনা,ভালো মাইনে পাই।একা মানুষ।এই যে এভারেস্ট হলনা,আবার যাব। তোমার তো তা নয়।প্রতিটি পয়সা যোগাড় করতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে,যদি না কোন স্পন্সর পাও।।কাজেই এভারেস্টের প্রোগ্রামে শেরপা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে আটঘাট বেঁধে এগিও।”
ওনার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিল কুহু । কেননা ওর মনে হচ্ছিল, নতুন কোন ইঙ্গিত উনি দিতে চাইছেন,যা ওর ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে দেবে।
উনি খুব সংক্ষেপেই জানালেন, সব ব্যবস্থা সত্ত্বেও কিভাবে অসৎ শেরপার জন্য আট হাজার চারশো ত্রিশ মিটারের সামিট ক্যাম্প থেকে তাকে ফিরে আসতে হয়। তিনি বললেন, “ তোমাকে বরং সবটাই খুলে বলি। এপ্রিল মাসের প্রথমেই হাওড়া থেকে গিয়েছিলাম রক্সোল । সেখান থেকে পরদিন কাটমান্ডুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হল।কাটমান্ডুতে কয়েকদিন থাকতেই হয় সবাইকে। কেননা অনেক অফিসিয়াল কাজকর্ম থাকে।কাটমান্ডু থেকে রামেরছাপ বিমানবন্দর, সেখান থেকে প্লেনে লুথলা বিমানবন্দরে পৌঁছই।লুথলা থেকে নামচেবাজার। নামচেবাজারে অনেক লোক দেখে বেশ অবাক লাগছিল।তারপর এক এক করে হাঁটাপথে ডিবু্চে থেকে ডিম্বোচে, ডিম্বোচে থেকে লবুচে পৌঁছে যাই ।এরপরে আর লোকজন ছিলনা।”
উনি বলেন, “ শরীরের সক্ষমতা আমার একটু বেশি।তাছাড়া পাহাড়ে পা দিলে আমার মনে অন্য ধরণের উৎসাহ পাই।আমি অন্যদের থেকে অনেক বেশি তাড়াতাড়ি এগোতে পারি । এর পরে দ্রুত চলতে থাকি ।পরদিনই মালপত্র নিয়ে পাঁচহাজার তিনশো চৌষট্টি মিটার এর বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাই।সেখানে কদিন থেকে নিজেকে ধাতস্থ করার কথা।কিন্তু আমার মনে হয় আমি ঠিক এগিয়ে যেতে পারব।তার পর দিন ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছই, যার উচ্চতা ছিল ছ’হাজারমিটার, আর তারপর দিন আবার ক্যাম্প টু এ ছ’হাজার চারশো মিটারে পৌঁছে যাই।এর পর থেকেই আমাকে শেরপা ক্রমাগত বাধা দিতে থাকে।আমার ভালো ভালো ইকুইপমেন্ট সে বদলা বদলি করে নিয়ে নেয়।আমাকে খাবার গরম করে দেওয়া বা বরফ থেকে গরম করে জল তৈরি করে দেওয়ার মত কোন কাজই সে করতে চায়না।উপরন্তু বারবার আমাকে ফিরে যেতে বলে। এমনকি বিনা কারণে আমাকে ঠেলা মারতে থাকে।ওই উচ্চতায় আমি ঝামেলা না করে তাকে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করি।”
“ এরপরে সে অক্সিজেন নষ্ট করে দিতে থাকে, যেখানে আমি যতটা পারি সেটা বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। তিন নং ক্যাম্প ছিল সাত হাজার দুশো মিটারে,আর ক্যাম্প ফোর ছিল সাত হাজার নশো মিটারে ।সেগুলো অতিক্রম করে আমি ব্যালকনিতে পৌঁছে যাই।যার উচ্চতা ছিল আট হাজার চারশো ত্রিশমিটার।ওখানে সুবিধেমত জায়গা পেয়ে প্রাকৃতিক কাজ সেরে আমি ভারমুক্ত হই আর নতুন উদ্যমে উঠতে শুরু করি।বাকি মাত্র চারশো মিটার।কিন্তু আমার শেরপা এমন মারধোর শুরু করে আমি এগোতে পারছিলাম না।।এরপরে শামিট ক্যাম্প। কিন্তু শেরপা জানায় অক্সিজেন একেবারেই শেষ।তখন আমি ফিরে আসি।ও আমাকে এমন ঠেলা মারছিল, ভয় হয় মেরে না দেয়।তাই আমি রেসকিউ তে অসুস্থতার কথা জানালে ওরা আমাকে নিয়ে আসে।জানি না ও কেন এমন করল।এসবের পেছনে কার কোন লাভ লুকিয়ে আছে।আট হাজার আটশো উনপঞ্চাশ মিটার এভারেস্টের উচ্চতা।মোটে চারশো মিটারের জন্য আমার সামিট হল না।এ আফশোস যাবার নয়। ”
“আমি জানি আবার আমি যাব।টাকাপয়সাও যোগাড় করতে পারব।কিন্তু তোমাকে একবারেই পারতে হবে।তাই সবটা খুলে বললাম। দেখো এসব কথা তোমার কাজে লাগে কিনা। তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি ধবলগিরিটা একবার চেষ্টা করতে পারো।আরো অন্যগুলো মানে লোতসে,অন্নপূর্ণা, …।ওগুলো এভারেস্টের অর্ধেক খরচে হবে।তারপর অবশ্যই একদিন তুমি এভারেস্টে উঠবে।সেদিন যেন আমি বেঁচে থাকি।
মৈত্রেয়ীদির সঙ্গে কথা বলে বাড়ি আসতে আসতে ও ভাবছিল আর একটা পথনির্দেশ এলো ওর সামনে।না।প্রথমেই এভারেস্ট নয়।অন্য শৃঙ্গগুলোর কথা ভাবতে হবে।
(ক্রমশ)
অপূর্ব