কাফিরনামা । পর্ব ১০। লিখছেন রাণা আলম
মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে বেরিয়ে ২৩০ ধরার জন্য যাওয়ার রাস্তায় বাম দিকে টায়ারের দোকানগুলো পেরিয়ে একজন পাউরুটি টোস্ট বিক্রি করেন। অন্তত এই লক ডাউনের আগে অব্দি করতেন। লম্বা পাউরুটিকে লাল করে সেঁকে সেটাকে ছুরি দিয়ে একটু ফালাফাল করে মাঘা ঘুগনি স্টাফ করা হত। তার উপরে ছড়ানো থাকতো পেঁয়াজ আর লঙ্কা কুচি। ডিম হাফ বয়েল করে সেটাকে কুচি কুচি করে কেটে এর উপরে সাজিয়ে দেওয়া থাকতো। খিদের মুখে পঁচিশ টাকায় একরকম অমৃত বলা চলে। অবশ্য, কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট এরম অপার্থিব খাবার দাবারে ভর্তি।
কলেজ স্ট্রীটের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এর বাইরের ফুটপাথে সেঁকা পাউরুটি আর পেঁয়াজ লঙ্কা দেওয়া ঘুগনি পাওয়া যায়। খাতা দেখার তলব পড়লে দুপুরে ওইটের স্বাদ নিতে যেতাম। কলকাতার মত সস্তায় পেট ভরার খাবার আর কোথাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ আছে। এবং রাস্তার খাবারের স্বাদ নেওয়ার সেরা সময় বোধহয় ছাত্রজীবন যখন পকেটে টাকা থাকে না কিন্তু খিদে থাকে অনেক। মেস কিংবা হোস্টেলের খাবারে ঔদাসীন্য এলে কুড়ি একুশের হৃদয় রাস্তার ধারে পকেট ফ্রেন্ডলি অমুকদার ধাবা বা রেস্তোরায় উঁকি দ্যায়। কুড়ির তরুণ ট্যুইশনির টাকা জমিয়ে প্রিয়তমাকে রেস্তোরায় নিয়ে গিয়ে মেনুকার্ডে আলগোছে দাম দ্যাখে। বুদ্ধিমতী প্রেমিকা স্রেফ কফি আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে সময় কাটায়। কতশত শেষ না হওয়া গল্পের রেশ পড়ে থাকে এইসব চেয়ার টেবিলে।
যারা মনে করেন যে দামী রেস্তোরা ছাড়া ভালো খাবার হয় না, তাদের প্রতি ঠিক সেরম সিম্প্যাথি রাখবেন, তৃণমূল সাপোর্টার রা রাজীব ব্যানার্জির প্রতি এখন যেরম রাখেন। ভালো খাবার তৈরী করাতে ভালো হৃদয় আর একটা পাকা রাঁধুনীর মন দরকার। রান্নাঘরে টাইলস আছে নাকি খাবার খাওয়ার জায়গায় এসি চলছে, এটা কখনই ক্রাইটেরিয়া হতে পারে না। মনে রাখবেন, ভেজ বিরিয়ানি আর পরিষ্কার পাকশালা, এদুটোই মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়। মিষ্টির দোকানে মাকড়সা ঘুরবে, আরশোলা চরবে, রসগোল্লার কড়াই এর উপরে কালো ঝুল নাদিয়া কোমানিচির মত ঝুলে থাকবে, তবেই তো স্বাদ বাড়বে।
আর খাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই জরুরী শব্দ হচ্ছে অ্যাম্বিয়েন্স। শুনুন সার, এসি ঘরে বসে সিঙ্গাড়া খাওয়া যায় না। এমনকি কখনই যেমন তেমন ভাবে সিঙ্গাড়া খাওয়া যায় না। ধরুন, আপিসে বড়সায়েবের কাছে কারণে বা অকারণে গুচ্ছের ঝাড় খেয়ে নিজেকে কল্যাণ বাঁড়ুয্যে মনে হচ্ছে, বড়সায়েব কে অন্ধকারে পেলে ভেংচি কাটবেন নাকি বাঙালির সার্বজনীন ল্যাং মারবেন তা ঠিক করতে পারছেন না। বিকেলের আকাশ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর মুখের মত তাকাচ্ছে।
অগত্যা উদ্দেশ্যহীন হাঁটার পথে দেখলেন রাস্তার ধারে সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। উত্তপ্ত কড়াই থেকে ক্লিওপেট্রার নাকের সাইজের সিঙ্গাড়া গরম তেলে চান করে উঠে আসছে। প্রথমে দুমিনিট প্রাণভরে গন্ধ নেবেন সিঙ্গাড়ার। তারপর শালপাতায় ঠোঙ্গায় দুটো সিঙ্গাড়া আসবে চাটনি সমেত। সিঙ্গাড়ার এক টুকরো ভেঙ্গে চাটনিতে ডুবিয়ে এক কামড় দিন। রাস্তার ভিড়, বাস-ট্রামের শব্দ-গন্ধ আর তার সাথে গরম সিঙ্গাড়ার ভিতরের আলুর পুরের স্বাদ, সব মিলিয়ে যে অপার্থিব পরিবেশ তৈরী হয় তা আপনি মোকাম্বোতে পাবেন কোথায়?
এই দামী রেস্তোরার কথা শুনলে আমার আগের আপিসের এক বড়কর্তার কথা মনে পড়ে। কোনোকাজে তার আপিসে যেতে হলে আমরা বেশ আতংকে থাকতাম। অন্যকিছু নয়, বড়সায়েব সামনের চেয়ারে বসে জিগাতেন,
“তাপ্পর কি পড়ান, মাস্টার মশাই?’
ধরুন আপনি বললেন যে ইংরেজি। সেটা শুনে খানিক আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি কইতেন,
‘ম্যাকবেথ পড়া আছে তো?”
এখন পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি নিয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়লে ম্যাকবেথ পড়তেই হয়, না পড়ে রেহাই নেই। সেটা জেনে বড়সায়েব আবার ছাদের দিকে তাকিয়ে শুভাপ্রসন্ন যেমন কাক খোঁজেন, সেরমই কিছু একটা খুঁজতেন।তারপর ফের জিগাতেন,
“ডানকানের মৃত্যু নিয়ে আপনার কি মত? তাকে কি আর অন্যভাবে মারা যেত?”
এখন মাসান্তে যিনি বেতনের বিলে সই করেন তিনি ডানকান কে ম্যাকবেথের হাতে মারাবেন নাকি নিজেই নস্যাস্ত্র ছুঁড়ে মেরে আসবেন তা নিয়ে কারুর খুব একটা মাথাব্যথা থাকতো না।
কিন্তু সমস্যা একটাই, ডানকানের মার্ডার মেথড নিয়ে ডিসকাশনে সাড়ে পাঁচটার আপ লোকাল হামেশাই মিস হয়ে যেত।
বড়সায়েবের আরেকটা সমস্যা ছিল যে তার ধারণা ছিল, তিনি খুব ভালো ইংরেজি জানেন। আমরা যে রিপোর্টই জমা দিতাম তাতে তিনি কলম চালাতেন। হয়ত একটা সমার্থক শব্দ বা কমা বসিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসতেন। অথচ, নিজে কোনোদিন একটা নোটিস লেখার দরকার হলে আপিসের কেরাণীবাবুকে ডেকে পাঠাতেন।
একবার তার মেইল হ্যাক হয়ে আমাদের সবার কাছে টাকা চেয়ে মেইল এসেছিল। ফ্রড কেস বুঝতে পেরে আমি তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট করেছিলাম। বড়সায়েব আপসে ডেকে থ্যাঙ্কু দিয়ে কইলেন,
“আচ্ছা, ওটা যে ফ্রড মেইল তা আপনি বুঝলেন কি ভাবে?”
সরকারী কর্মচারীর দাঁত ক্যালানোর দক্ষতা থাকতেই হয়। তাই, দাঁত কেলিয়ে কইলাম,
“স্যার, এটা আপিসের সব্বাই ধরে ফেলেছে। দশ বছর চাকরিতে আপনাকে কখনও চার লাইন ঠিকঠাক ইংরেজি লিখতে দ্যাখেনি। ফ্রড মেইলটা তাও তো ছলাইনের ছিল”।