কাফিরনামা । পর্ব ১১। লিখছেন রাণা আলম
প্রথমে আনিশ খান আর তারপরে রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের ভয়াবহ গণহত্যা নিয়ে সম্প্রতি আলোড়ন পড়েছে আমাদের মধ্যে। পুলিশ প্রশাসন এই খুনের কেসটা চেপেই দিত, নাগরিক সমাজ রাস্তায় নামার ফলে প্রশাসন নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হয়। যদিও, বিচারের নামে যেভাবে দীর্ঘসূত্রতা চলছে তাতে এই খুনের কোনো সুবিচার পাওয়া দিনকে দিন আরও শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
আর রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে যে নৃশংস গণহত্যা হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে চারপাশে। মাননীয়ার একচেটিয়া সংখ্যালঘু “ভোটব্যাঙ্ক” এ চিড় ধরা আতংক গ্রাস করেছে শাসকদল কে। শাসক দলের পোষা কাকাতুয়ার দল হিরণ্ময় নীরবতা পালন করছেন। আর গোঁসাই কবি যদিও খানকতক কবিতা লিখেছেন তবুও তা দালালির বাইরে অন্যকিছুর তকমা পাচ্ছে না।
ভোটের আগে এবং পরে নিয়মমাফিক আওয়াজ ওঠে যে সংখ্যালঘুদের নাকি রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে। কিন্ত সংখ্যালঘুরা নিজেদের ব্যবহার করতে দ্যান ক্যানো তা নিয়েও প্রশ্ন থাকা উচিত।
আমার জেলা মুর্শিদাবাদ। একসময় বেতাজ বাদশা ছিলেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী। তার বাহুবলীরা বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। এখন সেই মুসলমান বাহুবলীরা শাসক দলে ভিড়েছেন। এই জেলায় রাজনৈতিক কারণে খুন হওয়া আর খুন করা মানুষদের ভিতরে সংখ্যালঘু মুসলমানেদের সংখ্যাই বেশী।
প্রশ্নটা হচ্ছে ক্যানো? বগটুই এর খুন হওয়া তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ, গ্রেপ্তার হওয়া আনারুল বা ভাঙ্গড়ের আরাবুল এনারা কি নেহাতই বিচ্ছিন্ন উদাহরণ মাত্র? নাকি, প্রান্তিক প্রথাগতভাবে কম শিক্ষিত মুসলমানেদের পলিটিক্যাল পার্টির অ্যান্টি সোসাল রিসোর্স তৈরী করাটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া?
বাংলার মুসলমান এমনিতেই ‘লাথ খাওয়া জাত’। ইচ্ছে করেই শব্দবন্ধটা ব্যবহার করলাম। কারুর খারাপ লাগলে মার্জনা করবেন। আমরা এতটাই ভিখারী যে খুন আনিশ খানের বাবাকে কিনতে ববি হাকিম কে মাথায় ফেজ টুপি পরিয়ে শাসক দলকে পাঠাতে হয়। রিজওয়ানুরের মৃতদেহের উপর ভর করে রুকবানুর বিধায়ক হয়ে যান আর রিজওয়ানুর যাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে গেছিলেন সেই পুলিশ আধিকারিক ক্লিনচিট পেয়ে এখন শাসক দলের প্রিয়পাত্র। সাম্প্রদায়িকতার সুপষ্ট অভিযোগ থাকা লোকেদের আমাদের প্রতিনিধি বানানো হয়।
চাকরির দাবীতে রাস্তায় নেমে খুন হয়ে যান তরুণ মইদুল মিদ্যা। মরার আগে তার আর্ত চিৎকার আমাদের কানে ঢোকে না। সংখ্যালঘুদের মসীহা আসানসোল দাঙ্গায় সরাসরি অভিযুক্ত বাবুল সুপ্রিয় কে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বালিগঞ্জ বিধান সভায় ক্যান্ডিডেট করেন নির্দ্বিধায়।দাঙ্গায় খুন হওয়া কিশোর সেবগাতুল্লাহ-এর মৃতদেহের কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই।
তাহলে দোষটা কার? ওই বগটুই এর আট দশ বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটার যাকে পিটিয়ে কুপিয়ে পেট্রোল ঢেলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারা হল নাকি মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষায় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে থাকা আমাদের মত সেই প্রিভিলেজড অংশের যারা উটপাখির মত বালিতে মুখ গুঁজে প্রাণপণে বিপদ টা না দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি?
গত বিশ বছরে এই বাংলায় সংখ্যালঘুর প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রকাশ্য চেহারা বেড়েছে। এই সাম্প্রদায়িকতা মঙ্গল গ্রহ থেকে টপকায় নি। আমাদের মধ্যেই ছিল। খুব গুছিয়ে সাজিয়ে রাখা ছিল। জাস্ট অ্যাদ্দিন বের করার দরকার পড়েনি এই আর কি…
দেশভাগের পর শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত মুসলমানেদের অধিকাংশই জিন্নাসায়েবের ভরসায় ওপারে পাড়ি দেন। যদিও জিন্নাসায়েব খোদ মুসলমানেদের জন্য তার প্রতিশ্রুত ভূমি পাকিস্তানে জায়গা দিতে পারেন নি। মুহাজির নামে তারা পরিচিত হোন।
আর এপারে পড়ে রইলেন অধিকাংশ অশিক্ষিত মুসলমানেদের দল যারা জিন্নাসায়েবের দেশভাগের থিওরি বোঝেন নি, ভাগের জমিতে চাষ করে বেঁচে রইলেন। কালেক্রমে তারা রাজমিস্ত্রি আর লেবার হয়ে পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যে আর কলকাতাসহ বিভিন্ন রাজ্যে। কলকাতা শহরে যেকটা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হয় তার অধিকাংশ লেবার মিস্ত্রিই মুসলমান। তাদের হাতেই বেডরুম থেকে ঠাকুরঘরের মার্বেলের ফিনিশিং হয়। এবং ফ্ল্যাট তৈরী হবার সেই ফ্ল্যাটে আর কোনো মুসলমানের জায়গা হয় না।
গত কুড়ি বছরে চাকরির বাজারে মুসলমানের সংখ্যা উল্লেখ্যজনক বেড়েছে।এইখানেই কি সাধারণ সংখ্যাগুরুর সমস্যার শুরু হল?
মুসলমান জমিতে চাষ করবে, লেবার মিস্ত্রির কাজ করবে, মাঝে মধ্যে দু-একটা ছিটকে উপরে উঠে আসবে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফেজ টুপি পরবেনা, দাড়ি রাখবেনা, রবীন্দ্রনাথ আওড়াবে আর সংখ্যাগুরু বাঙালি তার দিকে সস্নেহে চেয়ে পাশের চেয়ারে বসিয়ে কইবেন,
“তোকে দেখে কিন্তু মোটেই মুসলমান মনে হয় না। তুই তো আমাদের মতই”।
সংখ্যালঘু মুসলমান তাতেই আত্মপ্রসাদে দাঁত কেলিয়ে তার পিছিয়ে থাকা কম্যুনিটির বাকিদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে।
মোটামুটি এটাই সহজ সমীকরণ চলে আসছিল। বিশ্বাস না হলে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা চালু হবার আগে এবং পরে রাজ্যের স্কুলগুলোতে মুসলিম শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সংখ্যার পার্থক্য গুণে দেখতে পারেন।
মুসলমানেদের শিক্ষাক্ষেত্রে আল-আমীন মিশন একটি বিপ্লব এনেছে। প্রতিবছর তিন চারশো ছেলেমেয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢুকছে। দিন আনি দিন খাই বাড়ির ছেলে নিটে ক্র্যাক করছে। এবং এতদিন আকাশ বা অন্যকোনো কোচিং সেন্টার থেকে বেশি সংখ্যায় ছেলে মেয়েরা মেডিক্যালে পেলে প্রশ্ন তোলা হল যে এরা , এই কাটার বাচ্চারা এত বেশি করে মেডিক্যালে পাচ্ছে ক্যানো?
সরকার কি এদের পাইয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাক চ্যানেল খুলেছে? কোর্টে মামলা অব্দি হয়ে গেল। এবং আক্ষেপের বিষয় এটাই প্রতিবছর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বহু ছেলে খুব ভালো রেজাল্ট করে, তাদের বেলায় এই প্রশ্নটা কিন্তু কখনই ওঠেনা।
ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার পাশাপাশি এরাজ্যে শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত ঝকঝকে মুসলমান ছেলেমেয়েদের সংখ্যা উল্লেখজনক ভাবে বেড়েছে। কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরন ছাড়া কিন্তু তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের প্রতি নিশ্চুপ থাকেন। এবং সংখ্যাগুরুর মত তারাও কোথাও না কোথাও একইরকম ‘ঘেটো’ তৈরী করে ফেলছেন যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না। ‘হিন্দু ওনলি’ আবাসনের মত ‘মুসলমান ওনলি’ ফ্ল্যাটও কিন্তু তৈরী হচ্ছে এখন। হয়ত এটা সংখ্যাগুরুর ধারাবাহিক রিজেকশনের ফল অথবা আমাদের স্বাভাবিক অবক্ষয়ের ক্রমান্বয়িক পরিণতি।
যেকোনো দেশে, প্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর উপর তার ডমিনেশন চালায়। এটা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক পদ্ধতি। বাংলাদেশের হিন্দুদের মাথা নামিয়ে চলতে হয়। এপারের মুসলমানেদেরও মাথা নামিয়ে চলতে হবে, এটাই হয়ত সহজ সমীকরণ। সেই নিয়মেই বাংলাদেশে ঈদ বাঙালির প্রধান উৎসব হয়, দুর্গাপুজো হিন্দুদের পুজো হিসেবে থাকে। আর এপারে ঈদ হয় মুসলমানের পরব, দুর্গাপুজোতে কার্নিভাল হয়।
কিন্তু এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, আমরা, শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মুসলমানেরা আমাদের পিছিয়ে থাকা অংশের জন্য ঠিক করছি টা কি?
রাজনৈতিক দলগুলির নাহয় তাদের স্বার্থে মুসলমান গুন্ডা পোষার দায় আছে, ঠিক যে কারণে রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস নিয়ে সযত্নে সুললিতভাবে মিথ তৈরী করা হয়, ভাড়াটে লেখক প্রোপাগান্ডা লিটারেচার নামান, বাংলা সাহিত্যের বাজারে চরম ইসলামোফোবিক এবং বিদ্বেষ ছড়ানো পপুলার লেখকের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন শিক্ষিত মার্জিত রুচির সংখ্যাগুরু বাঙালির একাংশ। জিজ্ঞেস করলে বলেন,
‘যা লেখে তাতে ওইটুকু দোষ বাদ দেওয়াই যায়’।
অধিকাংশ সংখ্যাগুরুর কাছে সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব আসলে ওই ওইটুকুই। ব্যাটারা জমি চষবে, গড়িয়ার বাজারে সব্জি বেচবে, মিস্ত্রির কাজ করবে, এই অব্দি ঠিক আছে। লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পাশে বসতেই চাইলে সমস্যা শুরু হয়।
আমরা, প্রিভিলেজড সংখ্যালঘুরাও আদতে সংখ্যাগুরুর তৈরী করা পলিটিক্যাল কন্সট্রাক্টে বাস করাটাই ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছি। ওয়াকফ বোর্ডের গুচ্ছের সম্পত্তি পড়ে থাকার পরেও খোদ কলকাতা শহরে মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে না। নাম শুনেই তারা বাদ পড়েন। এটাও আমরা মেনে নিয়েছি।
মেনে নিয়েছি, রাজনৈতিক দলগুলি ললিপপ দেওয়ার মত কোনো মুসলমান মুখ যিনি নিশ্চিতভাবে তার পিছিয়ে থাকা কম্যুনিটির সাথে সংযোগহীন অথবা কম্যুনাল পরিচয় স্পষ্ট এমন কাউকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তাদের মুসলমান দরদ দেখিয়ে যাবে।
আমরা সংখ্যালঘুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম সংস্থান নিয়ে দাবী তুলবো না। ইফতার পার্টির ছবিতেই মগ্ন হয়ে থাকবো। কারণ, আমরা সংখ্যাগুরুর ছায়া আর দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকা প্রিভিলেজড পার্ট, আমাদের বইমেলায় ছবি ওঠে, আমরা কলকাতায় ফ্ল্যাট না পেলে সোসাল সাইটে প্রতিবাদ ওঠে, কিন্তু এই আমাদের ঘিরে থাকা যাবতীয় আলোকমালার বাইরে পড়ে থাকা মানিকচকের ভাগচাষী আস্তারুল সেখ, জঙ্গিপুরের ক্লাস নাইনের ড্রপ আউট রাজমিস্ত্রির হেল্পার শুকচাঁদ আলি’র জন্য আমরা দু-চারটে সেমিনার আর বক্তিমের বাইরে কিস্যু করবো না।
আমাদের সামনে ঝুলবে ক্রমাগত ধর্ষণের হুমকি পাওয়া বছর ঊনিশের তুহিনা খাতুনের লাশ, পুলিশের হাতে খুন হওয়া তরতাজা আনিশ খানের মৃতদেহ আর বগটুই গ্রামের জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের দেহের পোড়া ছাই।
আর আমরা মাতবো কবিতা উৎসবে। কদিন পরে বালিগঞ্জে মিরাকল না হলে ঠিকই বাবুল সুপ্রিয় জিতবেন।
দুধেল গাইদের এর কপালে এর থেকে বেশী কীইবা জোটার আছে?