কাফিরনামা । পর্ব ৭। লিখছেন রাণা আলম
ইসলাম ধর্মে সন্তানের জন্মের পর কানে কানে দোয়া করে শোনাতে দিতে হয়। ওই খুদাতলার খাস বেহেস্ত থেকে আদম সন্তানের মর্ত্যে আগমনের ওয়েলকাম নোট আর কি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মৌলানা সায়েব আমার কানে সেই মন্তর পড়ার সময় বোধহয় দেখেছিলেন ছোকরার মাথার ভিতর গোবর ভর্তি, তাই তিনি আর অযথা সময় নষ্ট করেন নি। সেই কারণে, ধর্মে-টর্মে বিশেষ কিছু মতি হল না, নামাজ-রোজায় নিত্য কামাই দিয়ে গেলাম, জান্নাতের টিকিটখানিও পাকা হল না আর ইহকালে পড়াশুনোর সময়কালটা সারাটাজীবন লাস্ট বেঞ্চে ঘষটে ঘষটে কেটে গেল। বড় হয়েও যে বিশেষ কিছু সুবিধে করতে পেরেছি তা নয়। কিছু বুঝতে না পারলে হাঁ করে থাকতুম বলে গোটা আকাদেমিক লাইফটাই হাঁ করেই থাকতে হল।
মাঝখান থেকে আমার সেলুনের দাদা থেকে আপিসের বড়কর্তা, যে যেরম পারলেন জ্ঞান বিলিয়ে গেলেন অকাতরে। এই তো কদিন আগে কলকাতায় খুব বৃষ্টি। আর রোজ সকালে পেটের দায়ে যে চত্বরে যেতে হয়, সেখানে এম্নিতেই এট্টু বৃষ্টি হলেই রাজপথ থইথই হয়ে নৃত্য করতে শুরু করে।নিন্দুকেরা বলেন বিদ্যাসাগরের যে দামোদর পেরোনোর গপ্প শোনা যায় তা আদতে বর্ষাকালে দুরন্ত ঠনঠনিয়া থেকে আমহার্স্ট স্ট্রীট পেরোনোর ইতিহাস। বিদ্যাসাগর নাটা মানুষ ছিলেন আর ঠনঠনিয়ার বিশাল আকারের ঢেউ তার কাছে আক্ষরিক অর্থেই দামোদরসমান ছিল।
তা সেই বৃষ্টিতে রাত্তির বেলায় শেয়ালদা স্টেশনে পা দিয়ে মনে পড়লো ছাতা ভুলে গেছি। যাদবপুর স্টেশনের বাইরে সুকান্ত সেতুর নিচে মার্কেটে ছাতা বিক্রি হয়। সোয়া-দশটার সময় মার্কেট তখন প্রায় বন্ধ, ছাতার দোকান টা খোলা। গিয়ে জিগালুম,
‘দাদা, ছাতা আছে?’
লম্বাটে চেহারার দোকানদার খানিক নুইয়ে আমার দিকে চেয়ে হাতের চায়ের ভাঁড় টা ফেলে মুজতবা আলী’ টুকে তাকালেন,
‘বেছে নিন মহারাজ’।
তাকিয়ে দেখলুম, সাকুল্যে দু পিস ছাতা পড়ে আছে।
‘মাত্তর দু টো’, আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘কন কি সার?’, চোখ কপালে তুলে কইলেন দোকানদার, ‘কিনবেন তো মোটে একটা, তা আপনার জন্য পুরো গোডাউন সাজাবো নাকি? আর নাকি সার আপনি নতুন কলা বৌ এয়েচেন যে একটা শাড়ি কিনতে গেলে হাজারটা দেখতে হয়?’
এমন কটুবাক্যের পর আর কথা বাড়ানো চলে না। এমনিতে আমি ছাতা নিয়ে এমএ পাশ করিনি, তাও কিনতে গেলে একবার খুলে দেখতে হয়। খুলতে গিয়ে হ্যাঁচকা টান দিতে হল, তারপর দেখি ছাতায় অসংখ্য ফুটো, পুরো আকাশ দেখা যাচ্ছে। পুরো ‘সি থ্রু’ ছাতা। মুশকিল হচ্ছে ‘সি থ্রু’ ছাতার কদর কোনোকালেই খুব ছিল না। তাই দোকানদার কে জিগালুম,
‘দাদা, এতে তো পুরো আকাশ দেখা যাচ্ছে’।
আত্মগর্বে গর্বিত দাদা বাঁকাচোখে অবজ্ঞাভরে আমার দিকে চাইলেন,
‘তা নব্বই টাকায় আকাশ দেখবেন না তো কি আলিয়া ভট্ট কে দেখবেন?’
‘কিন্তু, বৃষ্টিও তো…’, আমার কাতর প্রশ্ন
‘আজব খরিদ্দার মাইরি। বৃষ্টি দেখার জন্য কেউ ছাতা কেনে নাকি। সেতো এম্নিই দেখা যায়’। দোকানদার দাদা এইবার চোখ পাকালেন।
বিবাহিত লোকের তর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুঃসাহসিক প্র্যাকটিস থাকা উচিত নয়। তাই ছাতা ছাড়াই আস্তানার দিকে রওনা দিলাম।
অবশ্যি আমার অজ্ঞতার ইতিহাস বহু পুরোনো। এই কদিন আগেই পুরো দমে কলেজ খোলা সত্ত্বেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা স্নাতক স্তরের সেমেস্টারের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করায়, সঞ্জয়দার ক্যান্টিনে কফির কাপে তুফান তুলে অথরিটি কে হেব্বি নিন্দেমন্দ করেছিলাম।
এই গতকাল থেকেই আভাস পাচ্ছিলাম, আজ প্রতীতি হল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর কর্তারা আদতে নস্ট্রাডামুসের খুড়তুতো ভাই-বেরাদর, নইলে তারা জানলেন কি করে কোভিড ফের অ্যায়সা জাম্প দেবে যে ইস্কুল-কলেজ বন্ধ করতেই হবে, আবার আসিব ফিরে, অনলাইনের তীরে গোছের স্ট্যান্ড নিতে হবে।
আরও ইন্টারেস্টিং তথ্য হল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথরিটিরা জানলেও আমাদের রাজ্য প্রশাসনের দন্ডমুন্ডের কর্তাব্যক্তিরা বুঝতেই পারেন নি যে কোভিড ফের হানা দেবে, তাই তারা নিশ্চিন্তে দুর্গা পুজোতে অকারণ ভিড় জমতে দিয়েছেন, রাজনৈতিক মিটিং মিছিল করেছেন, বড়দিন, বর্ষ বিদায়, বর্ষ বরণ নামক ফেস্টিভ্যালে পার্ক স্ট্রীটে গুচ্ছের জমায়েত করে তাপ্পর করোনা সংক্রমণের হালত দেখে ঘোষণা করেছেন,
‘ইস্কুল, কলেজ সব বন্ধ। পানশালা খোলা আর লোকাল ট্রেন চলবে সন্ধে ৭টা অব্দি’।
নির্দেশিকা গুলো খুঁটিয়ে দেখছিলাম। মহামান্য রাজ্য সরকার যখন এগুলো বের করেছেন তখন নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই করেছেন।
পানশালা খোলা বোধহয় যাতে ছেলে পুলে গুলো এক একটা ‘গালিব’ হয়ে ওঠে। কি চমৎকার ভাবনা, বেশ আপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলুম। কলেজ কাটা ছেলে পুলেরা শ্যাম্পেনের বোতল আঁকড়ে এক একটা কালজয়ী কাব্য রচনা করছে। আমলার দল ঘিরে ‘এনকোর’ দিচ্ছে আর আগামী নোবেল নমিনেশনের জন্য নাম পাঠাচ্ছে।
তবে নোবেল নমিনেশনের জন্য আমলারা নিজেদের নামও পাঠাতে পারতেন নির্বিঘ্নে। এই যে সন্ধে ৭টার পর লোকাল ট্রেন চলবে না। এটা কি অবিশ্বাস্য মাস্টার স্ট্রোক বলুন তো সার?
এই যে জানা গেছে করোনা ভাইরাস সারাদিন নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে সন্ধে ৭টার সময় হেলেদুলে শেয়ালদা কি হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে আসে, এটা কি কম বড় আবিষ্কার? যার মাথা থেকে এটা বেরিয়েছে তার এইট বি’র মোড়ে স্ট্যাচু বসানো উচিত।
কিংবা এই ইশকুল-কলেজ বন্ধ। কিন্তু গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধের নোটিস নেই। অর্থাৎ, পাপী করোনা ভাইরাস গঙ্গাসাগরের অ্যাড্রেস জানেনা। কিন্তু ডাইস রিপোর্ট পড়ে যাবতীয় ইশকুল-কলেজের ঠিকানা জেনে নিয়ে সেখানে ওত পেতে বসে আছে।
এই অসাধারণ হাইপোথেসিস যারা ভেবেছেন তাদের হাজারো কুর্নিশ।
এম্নিতেই শিক্ষা আর স্বাস্থ্য, এই দুটো ক্ষেত্রে সরকারের কোনো রেভেনিউ হয় না। বেশ কবছর ধরেই চেষ্টা চলছে এদুটোকে বেসরকারী করে দেওয়ার। এই অপরিকল্পিত লক ডাউনের ফলে সেই উদ্দেশ্যই সফল হতে যাচ্ছে আর কি।
ছেলে পুলে পড়বে না, শিখবে না, সেই সুবাদে প্রশ্নও করবে না।
শাসক ক্ষমতার গজদন্ত মিনারে বসে স্তাবকদের হাততালি কুড়োবেন।
আমরা তো চোখ বেঁধেই বসে আছি। সমস্যা কি?