খড়কুটোর জীবন : রোগ-বালাই। পর্ব ২৮। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
জ্বরের নামও কী সুন্দর! চুমকী জ্বর। কাঁপুনি দিয়ে আসতো সে জ্বর। তখন লেপ- কাঁথা চাপিয়েও চমকে চমকে ওঠা শরীরের কাঁপুনি থামানো যেতো না। কয়েকজন মিলে শরীর চেপে ধরতো। তারপর একটা সময় শরীরে জ্বর বয়ে যেতো প্রশান্ত নদীর মতো। কুলু কুলু ঘামের মধ্য দিয়ে খালি গায়ে উঠে বসতাম। ঘোলাটে চোখে চেয়ে দেখতাম টালির চালের দিকে। মাঝে মাঝে জ্বরের বিকারে ফিট হয়ে যেতাম। ফিট মানে অচৈতন্য। চৈতন্যের দেশে একেবারে অচৈতন্য। তখন কাকারা বা বাবা পাশের পাথুরিয়া গ্রামের জহির ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসতো। সেই ওষুধ সেবনান্তে একটা সময় জ্বর বাবাজী বিদায় নিতেন। তো তিনি তার রাজ্যপাট মোটামুটি দিন দশেক তো চালাতেনই। জ্বরের দিনগুলিতে ভাত খাওয়া আর স্নান করা মানা থাকতো। দুধ-সাগু, বার্লি বা পাঁউরুটি পেতাম সেসব দিনগুলিতে। মা গরম জলে গা- মুছিয়ে দিতো। বারান্দায় নিয়ে এসে বালিশে শুইয়ে দিয়ে ঘাড়ের নীচে কচু বা মানের পাতা দিয়ে মাথায় ঠাণ্ডা জল ঢালা হতো। কচু বা মানের পাতা ব্যবহারের ফলে বালিশ ভিজতো না। জ্বর বাড়লে কপালে জল পট্টি দেওয়া হতো।জ্বর তাড়াতে সে এক বিশাল আয়োজন বটে। জ্বর এলেই আমি ঠাকুমার মতো হুঁ হুঁ করে একটা সুর ধরতাম। তার সঙ্গে দাঁতে দাঁতে ঠক্করের সঙ্গত চলতো। সেই জ্বরগীতিতে মুখরিত হয়ে উঠতো সমগ্র বাড়ি। এভাবেই একদিন বিদায় নিতো জ্বর। শরীরে রেখে যেতো তার প্রভাব। সে একেবারে রতিপতি মদন দেবের মতো। শরীর না থাকলেও সে যেমন লোকের মনে মনে তার প্রভাব জাহির করে ঠিক তেমনি। জ্বর উত্তর পর্বে স্নান হতো। এত দিনের তিত মুখে উঠতো ঝোল ভাত। জ্বরের মাঝে একবার টক খাওয়াতে মুখ ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো জ্বরঠুটিতে। সে ঘায়ের দাগ থেকে যেতো বহুদিন।
জ্বর নিয়ে গ্রামে একটা গল্প প্রচলিত ছিলো। গ্রামের ফকির শা বলতেন – ‘ জ্বর এলে কিছু না খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে সাতদিন শুয়ে থাকলেই জ্বর পালাবে। খেলেই জ্বর জাঁকিয়ে বসবে। জ্বর হোক আদুলের অশোক বাবুর। বড়লোক। বেদানা, আপেল খেয়ে জ্বর পুষুক। ‘ তো অশোক বাবুর মতো ধনাঢ্যের অসুখ হোক। আমাদের কেন অসুখে ধারদেনাতে জীবন কাটবে?
আমার মাঝে মাঝে গায়ে অ্যালার্জি বার হতো। ঠাকুমা বলতো – ‘ গায়ে আসর বেরিয়েছে। যা মেজদাদুর গরুর গোপালী দিয়ে বানানো ছাঁদন দড়ি দিয়ে পিঠটা আগে চুলকে নেগে। তারপর গোয়ালে গিয়ে গড়াগড়ি দিবি। সব আসর মিলিয়ে যাবে। ‘ ঠাকুমার এই টোটকাতে আসর মাটি হতো মাঝে মাঝে। তবে এমনিতেই অ্যালার্জি মিলিয়ে যেতো কিনা জানিনা।
ছোটো কাকার মাথা যন্ত্রণা হলেই চুল টানা আর কপাল টেপা কাজ ছিলো আমার। পায়ে যন্ত্রণা হলেই কাকা ফালতি দিয়ে পা বেঁধে রাখতো। মাথায় যন্ত্রণা হলে মা আমার মাথায় সর্ষের তেল আর জল দিয়ে দিতো। আজ এতদিন পর হাসি পায়। চোখের পলকের উপর দূর্বা ঘাস বুলিয়ে বুলিয়ে নীচে কাঁসার থালা রেখে নাকি পোকা বারকরা যায়। দাঁতে যন্ত্রণা অনেকেরই হতো। কথায় আছে না – ‘ দাঁত শূল না বুক শূল। ‘ তো অনেককেই দেখতাম গ্রামের হৃদয় ঘোষের বউ এর কাছে দাঁতের পোকা বার করতে যাচ্ছে। মনো দিদিকে ঠাকুমা একবার নিয়ে গেছে সঙ্গে আমি। তো হৃদয় ঘোষের বউ কলাগাছের পেটকো আর হলুদ শিলে বেঁটে দিদির দুই গালে লাগিয়ে দিলো। আধ ঘণ্টা পর সেই প্রলেপ তুলে তার মধ্যে পোকা খোঁজা শুরু হলো। দুএকটি ছোটো সাদা পোকা দৃশ্যমান হলো। চমৎকার। দিদির ব্যথা একটু কমলো বটে। কিন্তু রাত্রিতে আবার শুরু হলো। হৃদয় ঘোষের বউ বললো – ‘ সাতদিন টানা ঝাঁড়াতে হবে। তবেই পোকার বিনষ্ট। ‘ এসব বুজরুকির প্রতি বিশ্বাস দেখে শুধু হয়রানি হতে হয়।
পেটে ব্যথা হলে অনেকে বলতো নাড় উঠেছে। সেই নাড় বসাতে ওঝা বা গুণীনের কাছে যাওয়ার চল ছিলো। পেটে তেল জল দিয়ে বা ঘটি দিয়ে ডলে সেই নাড় বসানো হতো।অনেকে আবার দূর থেকেই রূগীর নামে মন্ত্র পড়ে নাড় ঝেড়ে দিতো। এক গুণীনের কাছে শুনেছিলাম সেই মন্ত্র। –
‘ আস কামড়ে আল্লা
খোদার কামড়ে খোদ
আল্লা মুহম্মদ শীল
ফুঁ দিয়ে শুষে নিলাম
অমকের নাড় ওঠা বীষ। ‘
কুচকি ফুললে ঠাকুমা দিয়ে দিতেন নোড়া ছ্যাঁকা। সলতে পুড়িয়ে পায়ের আঙুলের ফাঁকে পাকুই লাগলে দেওয়া হতো ছ্যাঁকা। শুধু মানুষ নর গরুর বাদল খোঁড়া রোগ হলেও দেওয়া হতো ছ্যাঁকা। আর শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে চুন আর চিনি দিয়ে বেঁধে দেওয়ার চল ছিলো। অনেক সময় দূর্বা বা গাঁদার পাতা থেতো করে লাগানো হতো। যেকোনো ব্যথাতে হলুদ গরম করে লাগিয়ে দেওয়া হতো। কেউ যাতে ক্ষতস্থান মন্দ করতে না পারে তার জন্য নিমুখো লতার বালা বানিয়ে হাতে বা পায়ে পরিয়ে দেওয়া হতো। চোখ উঠলে অর্থাৎ চোখে জয়বাংলা হলে দেওয়া হতো হাতির শুঁড় নামক এক ভেষজ গাছের নির্যাস। শরীরের কোথাও দগ্ধ হলে ডিম ভেঙে বা আলু কেটে লাগানো হতো। শিশুদের শরীরে ঘা হলে পুরানারাঙ্গা বলে এক ধরনের উদ্ভিদকে ব্যবহার করা হতো। শীতকালে পা ফেটে গেলো অনেকে পা ভিজিয়ে নিতো গোমূত্রে। অনেকে এই দ্রব্যটি পানও করতেন। সর্দি কাশি হলে মধু বা তুলসী পাতার রস খাওয়া হতো। শিশুদের ও খাওয়ানো হতো। তবে ঐ যে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় আছেনা – সর্দি লাগলে ওষুধ খেলে সারতে লাগে এক সপ্তাহ, আর না খেলে লাগে সাতদিন। ব্যাপারটা হতো এইরকম।
এবার একটা মজার কথা বলি। প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা।বাবা কোয়াক ডাক্তার হওয়ার সূত্রে বাড়িতে নানান ধরনের রুগী আসতো। তো একদিন একলোক দুটাকা নিয়ে এসে বাবাকে বললে – ডাক্তার, আমার বউ এর প্যাটে যন্ত্রণা। এই দু টাকার ওষুধ দাও। ‘ তো বাবা একটা ব্যারেলগান ট্যাবলেট হাতে ধরিয়ে দিতেই সে লোকের জিজ্ঞাসা – এটা কী করবো? বাবা মুচকি হসে বললো – তোমার বউ এর নাকে তিনবার শুঁকিয়ে চালের বাতায় গুঁজে রাখবে। সে লোক পরের দিন এসে জানালো কথা মতো কাজ হয়েছে কিন্তু যন্ত্রণা কমেনি। বাবা চেম্বারে বসে থাকা লোকদের ঘটনাটা বলতেই আহাম্মকটাকে সকলে এই মারি কি সেই মারি।
অনেকের হতো আঙুলহারা রোগ। এই রোগ পায়ের বা হাতের আঙুলে হতো।আঙুল ফুলে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা হতো। তারপর পেকে ঘা হয়ে যেতো। অনেক সময় আঙুল বিকৃত হয়ে যেতো।
লোকমুখে কথিত আছে যে রাজা দশরথের একবার আঙুলহারা রোগ হয়েছিলো। সেই সময় রাণী কেকয়ী সেই আঙুল মুখের মধ্যে রেখে রাজার যন্ত্রণা লাঘব করতেন। আর এই সময়ই তার সেবাতে মুগ্ধ হয়ে রাজা বরদান করেন রাণীকে। আমরা জানি সেই বরের ফলেই রামের বনবাস হয়। তাই আঙুলহারা রাজ্য হারারও কারণ হতে পারে। এই রোগে কোনো টোটকাই কাজ দিতো না। সব রোগের তো আর ওষুধ থাকেনা।
(ক্রমশ)