কাগজের নৌকো। পর্ব ৭। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
আজ আকাশে মেঘ নেই, আষাঢ় দ্বিপ্রহরে অবিরল স্রোতধারার মতো বৃষ্টিপাতের পর এখন বর্ষণক্ষান্ত আকাশ দিনান্তের আলোয় উজ্জ্বল, মন্দ মন্দ বাতাসে উত্তরবাহিনী সুরধুনী ধীর ছন্দে বয়ে চলেছে-প্রহ্লাদ ঘাটের পোস্তায় জগতের এই শান্ত রূপের মাঝে বসে সহসা ঐন্দ্রীর মনে হল, রক্তবীজের রুধিরপায়িনী দিগবসনা চামুণ্ড যেন তাঁর রুধিরাক্ত লোলজিহ্বায় পশ্চিম দিগন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছেন-অতিবিস্তারবদনার সেই অপরূপ সৌন্দর্য পানে চেয়ে তার সমগ্র অস্তিত্ব আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠল, কোনও শঙ্কা নয়, মৃত্যুভয় নয়, ঐন্দ্রীর মনোজগত সেই অতিভৈরবার মঙ্গলময়ী এবং ভীষণা-দুটি রূপই স্পষ্ট অনুভব করতে পারল, তিনি যেমন একধারে স্নেহময়ী জননী আবার তিনিই মৃত্যুরূপা মহাকালী, কী বিচিত্র তাঁর লীলা, নির্জন ঘাটে ঐন্দ্রীর চোখদুটি ধীরে ধীরে সজল হয়ে উঠল।
প্রহ্লাদঘাট আজ প্রায় জনহীন, অলস স্মৃতিচারণার মতো দু-একটি পানসি গঙ্গাবক্ষে ভাসমান, সূর্যাস্তের পরেও আষাঢ়ের দীর্ঘ বেলা এখনও যৌবনবতী-অদূরে নৃসিংহ ও জগন্নাথ মন্দিরে সন্ধ্যার পূর্বেই কেউ দীপ জ্বেলে দিয়েছেন, এক কিশোর গঙ্গা স্নানের জন্য ঘাটে এসেছে, মুণ্ডিত মস্তক, পরনে একখানি পরিষ্কার সাদা ধুতি, উপবীতটি অলঙ্কারের মতো উজ্জ্বল, আরেকটি ধুতি পৈঠায় রেখে সুরধুনীকে করজোড়ে প্রণাম জানিয়ে সে ধীর পায়ে পবিত্র স্রোত স্পর্শ করল-অপরিচিত কিশোরকে দেখে ঐন্দ্রীর ভারি ভালো লাগল, যেন শতাব্দী প্রাচীন ভারতাত্মা পুনরায় বারাণসীর এই প্রহ্লাদ ঘাটে ফিরে এসেছে।
হাতঘড়ি দেখল একবার ঐন্দ্রী, ছ’টা বেজে দশ মিনিট, প্রায় দেড় ঘণ্টা হল সে এই ঘাটে বসে রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বৃদ্ধ পণ্ডিত শূলপাণি আচার্য্য আজ বৈকালে এখানেই আসতে বলেছিলেন, সন্ধ্যালগ্ন আগতপ্রায় অথচ বৃদ্ধের এখনও দেখা নাই। কোথায় থাকেন তাও স্পষ্ট জানে না ঐন্দ্রী, গতকাল তুলসী ঘাটে দেখা হয়েছিল-হরিদয়াল জ্যাঠামশাই কলকাতায় চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, বৈকাল চার ঘটিকায় তুলসী ঘাটে শূলপাণি মহাশয় তোমার জন্য অপেক্ষা করিবেন, বিলম্ব করিও না, বৃদ্ধ সময়ের অপচয় সহ্য করিতে পারেন না। সময়ের অপচয় সহ্য করতে পারেন না অথচ আজ তিনিই অনুপস্থিত, কাল দীর্ঘক্ষণ কথায় এটুকু বুঝতে পেরেছে কথার খেলাপ করার মানুষ শূলপাণি আচার্য্য নন তবে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? খোঁজই বা কার কাছে করবে এখন! মনে মনে স্থির করল, রাত্রে হরিদয়াল জ্যাঠাকে ফোন করে বৃদ্ধের ঠিকানাটি নিয়ে কাল সকালে নাহয় সেখানেই একবার যাবে, মোবাইল ব্যবহার করলে ফোন এখনই করা যেত, এই প্রথম ক্ষণিকের জন্য ভাবল অন্যান্য পাঁচজনের মতো মোবাইল ফোন থাকলে মন্দ হত না! পরক্ষণেই মনে পড়ল মোবাইল থাকলেও সুবিধা হত না কারণ ঘাটশিলায় হরিদয়াল জ্যাঠাকে এখন ফোন করলেও পাওয়া যেত না, তিনিও মোবাইল ব্যবহার করেন না আর ওঁর বাড়ির ল্যান্ডলাইন কয়েকদিন হল মৃত। বিপত্নীক মানুষটি একাই থাকেন, একজন দেখাশোনার লোক রয়েছে কিন্তু তার মোবাইল আছে কিনা কখনও খোঁজ নেওয়া হয়নি। তাহলে শূলপাণি আচার্য্যের বাড়ির ঠিকানা কী করে পাবে?
অস্তমিত আলোয় ঐন্দ্রীর মুখখানি জুড়ে চিন্তার এলোমেলো মেঘ ফুটে উঠল।
নিঃসঙ্গ ঘাটের পোস্তায় একাকিনী ঐন্দ্রীকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে বহুকাল ধরে সে এখানেই প্রতীক্ষারতা, সামনে একখানি বোর্ডে গতকালের অসমাপ্ত ছবিটি রাখা, পাশে একটি বড়ো পাত্রে নানাবিধ ব্রাশ, রঙের টিউব, জলের ছোট কৌটো, কাপড়ের ঝোলার মধ্যে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও রয়েছে। ছবিটি সামনে নিয়ে বসে আছে অথচ একটিও আঁচড় পড়েনি কাগজে, গতকাল সন্ধ্যায় বৃদ্ধ আচার্য্য বলেছিলেন-ঐন্দ্রীর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কতগুলি কথা বলবেন আজ, কী সেই কথা? সম্ভবত ওই অশ্রুত ঘটনা শোনার জন্যই সে ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছে।
গঙ্গাস্রোতে রক্তবর্ণা সন্ধ্যাকাশের ছায়া নেমে এসেছে, অল্পক্ষণ পূর্বে মহাদেবীর সেই রূপ এখন অদৃশ্য- চরাচরে মনোবৃত্তির মতো কত দ্রুত রূপঢেউ আসে আবার ফিরে যায়, পূর্বগামিনী বাতাসে আষাঢ় পুনরায় তার মায়াকাজল বিস্তার করেছে, সন্ধ্যাদেবী মনে হয় নদীর পরপারে তাঁর ছায়া-আঁচলটি বিছিয়ে অপেক্ষা করেছেন-অল্পক্ষণ পরেই ঝুমকোলতার মতো নূপুরে রিণিঝিণি সুর তুলে এই প্রাচীন প্রহ্লাদ ঘাটে আসবেন! জগত সত্যই বড়ো আশ্চর্য ক্রীড়াভূমি!
কী মনে হওয়ায় কাপড়ের ঝোলা থেকে আরেকটি কাগজ বের করে দ্রুত হাতে ছয়-বি পেন্সিলে কতগুলি রেখা টানতে শুরু করল ঐন্দ্রী, অদূরে প্রহ্লাদেশ্বর ও শীতলা মন্দিরের আদল ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে, নিঃসঙ্গ ঘাটের আখ্যানে একটি দীর্ঘকায় পুরুষের ছায়াও এসে উপস্থিত হয়েছে কাগজে, মগ্না ঐন্দ্রী নিজেও যেন এই চিত্রেরই একটি অংশ, হাতখোঁপাটি নিঃশব্দে পিঠের উপর ভেঙে পড়েছে, নিরাভরণ দুটি নয়ন পটচিত্রে স্থির, পরনের সাদা শাড়িটির শিথিল আঁচল একপাশে অবসন্ন পড়ে রয়েছে,আলতো আদরের মতো সুকোমল হাতদুটি শুধু সদা সঞ্চারণশীল! সহসা আসন্ন সন্ধ্যার মলিন আলোয় একটি নরম পুরুষকণ্ঠে ঐন্দ্রীর মগ্ন জগত ছিন্ন হল, মুখ তুলে দেখল স্নানান্তে কিশোরটি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, ‘আপনি কি শূলপাণি আচার্য্যের সহিত সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন?’
অপরিচিত কিশোরের মুখে স্পষ্ট বাঙলা শুনে ঈষৎ বিস্মিত হল ঐন্দ্রী, পরমুহূর্তে আচার্য্যের নামটি তার চিত্রাচ্ছন্ন মস্তিস্কে সজোরে আঘাত করায় দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলল, ‘হ্যাঁ, পণ্ডিত শূলপাণি আচার্য্য আজ এখানে আমাকে আসতে বলেছিলেন, কিন্তু আপনি কী করে’ , কথার মাঝেই দক্ষিণ হস্ত শূন্যে প্রসারিত করে মৃদু হেসে কিশোর বলল, ‘আমি জানি।’
ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ দুটি তুলে তাকাল ঐন্দ্রী, মেঘবতীর সজল কেশভার শিথিল, আঁচলখানিও ঈষৎ এলোমেলো, বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি জানেন?’
অন্যসময় হলে এই কিশোরকে হয়তো তুমিই বলতো কিন্তু এখন উত্তেজনার মুহূর্তে সে-কথা খেয়াল নাই।
স্নানশেষে কিশোরের পরনে একটি সাদা ধুতি, চোখ দুটি বহু দূরের শরৎ মেঘের পানসির মতো নির্ভার ও আনন্দোজ্জ্বল, বয়স সম্ভবত ত্রয়োদশ কি চতুর্দশ অথচ লাবণ্যে পূর্ণ মুখখানি ভাবগম্ভীর-কৈশোরের সহজাত চাপল্যের লেশমাত্র নাই, মৃদু স্বরে বলল, ‘আচার্য্য আজ বিশেষ কারণবশত আসিতে পারিবেন না, আপনি গৃহে ফিরিয়া যান।’, কথাটি শেষ করে এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর পুনরায় বলল, ‘কাশী আসিয়া অবধি ঢুণ্ঢীরাজের দর্শন করিতে যান নাই, আগামী কাল দর্শন করিয়া প্রণাম করিবেন-তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে কেহই কাশীধামে প্রবেশ করিতে পারিবে না।’
বাক্য সমাপ্ত হতেই বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে কিশোর ঘাট পার হয়ে সামনে গলির দিকে এগিয়ে গেল।
‘ঢুণ্ঢিরাজ ‘-শব্দটি ক্ষণিকের জন্য ঐন্দ্রীর চেতনাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করতেই বহুদিন পূর্বে শোনা সেই মেঘগম্ভীর পুরুষকণ্ঠের কথা চকিতে মনোকাশে ভেসে উঠল, সেজন্যেই কাশী ছুটে আসা কিন্তু এই কিশোর অবিকল একই কথা বলল কী প্রকারে? কে এই কিশোর, প্রায়ান্ধকার নির্জন ঘাটে আকস্মিক এসে উপস্থিত হল!
তার অপসৃয়মান ছায়া এখনও দেখা যাচ্ছে, উঁচু গলায় ঐন্দ্রী বেজে উঠল, ‘শুনুন, এক মিনিট একটু দাঁড়ান, প্লিজ!’
বামাকণ্ঠ কিশোরের পথরোধ করায় পেছন ফিরে কয়েক পা এগিয়ে এসে ধীর স্বরে ঐন্দ্রীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমায় কহিতেছেন?’
দ্রুত লয়ে সন্ধ্যাদেবী তাঁর বীণার সুরঝঙ্কারে আচ্ছন্ন করে চলেছেন চরাচর, গৃহাভিমুখী পাখির দল ঘাটের অদূরে একটি প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের সুউচ্চ শাখা অতিক্রম করে উড়ে চলেছে আরও পশ্চিমে, সুরধুনীর স্রোতে একটি একাকী দীপ অলস ভঙ্গিমায় ভেসে কোন্ দূর দেশের উদ্দেশ্যে যেন পাড়ি দিয়েছে, কোনও মন্দিরে বেজে উঠল মঙ্গলশঙ্খধ্বনি-এই অপরূপ চালচিত্রের মাঝে কিশোরের স্থির দৃষ্টি পানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল ঐন্দ্রী, এমন পূর্ণ ভাবস্থ চক্ষু তো কোনও কিশোরের হতে পারে না-মনে হচ্ছে সহস্র বৎসর পূর্বের কোনও জ্ঞানী পুরুষ যেন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, সসংকোচে মিনতির সুরে বলল, ‘অনুগ্রহ করে আমার দুটি কথা শুধু শুনুন!’
ছবির সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে প্রহ্লাদ ঘাটের পোস্তায় কিশোরের সম্মুখে বসেছে ঐন্দ্রী, দিনের আলো প্রায় নিঃশেষিত-ক্ষীণ মায়াদীপের মতো গোধূলি আচ্ছন্ন চরাচরে সুললিত ধীর স্বরে কিশোর জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কথা কহিবেন?’
— আপনি কি আচার্য্যের পরিচিত?
মৃদু হাস্য সন্ধ্যা-কুসুম হয়ে ফুটে উঠল কিশোরের ওষ্ঠে, ‘কাশীধামে আচার্য্যদেব দীর্ঘদিন অধ্যাপনা ও বেদান্তচর্চা করিতেছেন-সেই সূত্রেই তিনি আমার পরিচিত।’
— আর আপনার পরিচয়?
— আমি বিদ্যার্থী, অধ্যয়নই আমার তপস্যা-ইহা ব্যতীত অন্য পরিচয় অপ্রয়োজনীয়। আপনার অধিক কিছু জিজ্ঞাস্য না থাকিলে বিদায় চাহিতেছি, সন্ধ্যা সমাসন্ন, নিজ কার্যে যাইবার সময় হইয়াছে।
কিশোরের দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে অভিভূত ঐন্দ্রী কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর মৃদু স্বরে বলল,
‘আমাকে একবার আচার্য্যের কাছে নিয়ে যেতে পারেন? বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে বলেই আপনাকে এই অনুরোধ করছি।’
— কী প্রয়োজন?
অপরিচিত কিশোরকে নিজের ব্যক্তিগত গোপন কথা বলা উচিত হবে কিনা এক মুহূর্ত চিন্তা করল ঐন্দ্রী, তাছাড়া এই অতি নবীন সে-স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনেও কোনও দিশা দিতে পারবে কি? বালকের কতটুকুই বা অভিজ্ঞতা!
সহসা চিন্তার মাঝেই শুনতে পেল বিদ্যার্থীর কৌতুক মিশ্রিত কণ্ঠস্বর, ‘বয়স এবং জ্ঞান দুটিই সম্পূর্ণ সম্পর্করহিত বস্তু, সেরূপ না হইলে জগতের সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধ মানুষই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলিয়া পরিচিত হইতেন!’
বিস্মিত ঐন্দ্রী কিশোরের মুখপানে চেয়ে দেখল ভাবগম্ভীর মুখমণ্ডলে মৃদু কৌতুকহাস্য শরতের রৌদ্র ও মেঘের মতো ক্রীড়ারত, মৃদু হেসে ঐন্দ্রী বলল, ‘আপনার কথা সম্পূর্ণ সত্যি, দুটি ঘটনার কথা বলছি, হয়তো আপনি কোনও দিশা আমাকে দেখাতে পারবেন।’
আধো তন্দ্রায় শোনা সেই পুরুষকণ্ঠ, তিনমাস ধরে এঁকে চলা অপরিচিত ঘাট ও নদীর কথা, গত রাত্রে আঁকা আশ্চর্য ছবি-সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বলার পর ঐন্দ্রী সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, এমনকি এর আগে কখনও বারাণসীও আসিনি, এর অর্থ কী? গতকাল সন্ধ্যায় আচার্য্য বলেছিলেন, আজ আমার জীবনের একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা বলবেন! এই কি সেই ঘটনা?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল কিশোর, পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারা সজল আঁখির মতো জগতপানে তাকিয়ে রয়েছে, এখন শুক্লপক্ষ, অল্পক্ষণ পরেই চরাচর জ্যোৎস্নালোকে ভাসিয়ে চাঁদ উঠে আসবে পূর্বাকাশে তখন এই চেনা ভুবনের মাঝে অচেনা কোনও জগতের দুয়ার খুলে যায়, সুদূর গন্ধর্বলোক থেকে নেমে আসেন সুর গান্ধর্বীদের দল, বাতাসে অস্পষ্ট পাল তুলে দেয় তাঁদের অপরূপ সুর-তরণী। একজন রমণী প্রহ্লাদ ঘাট সংলগ্ন মন্দিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন-সেই আবছা স্মৃতির মতোই দীপালোকে সমস্ত ঘাট যেন সহস্র বৎসর অতীতের রূপ ফিরে পেয়েছে, মৃদু কণ্ঠে কিশোর বলল, ‘কার্য এবং কারণ সর্বদা বুঝিতে পারা যায় না, বুঝিবার প্রয়োজনও নাই। আপনি কাশী আসিয়াছেন, আগামী কয়েকদিন শুদ্ধ চিত্তে কাশী দর্শন করাই আপনার পক্ষে শ্রেয়। সুপ্রাচীন এই নগরী দিব্যভাবে উজ্জ্বল, প্রতিটি ঘাট, সহস্র মন্দির, তাহাদের আশ্চর্য আখ্যান এবং সর্বোপরি নিজ সংস্কার-সমস্ত লইয়া আপনার মনোজগতে একটি নূতন পটচিত্র গড়িয়া উঠিবে, ইহার পর প্রভু বিশ্বনাথের ইচ্ছা হইলে নিশ্চয় কার্য-কারণ সম্বন্ধ বুঝিতে পারিবেন।’
নবীন বিদ্যার্থীর কথায় সামান্য হতাশ হল ঐন্দ্রী, তার সূক্ষ্ম মন হয়তো কোনও অতীন্দ্রিয় ঘটনার প্রত্যাশী ছিল কিন্তু কিশোরের যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যায় আশাহত স্বরে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাশীর কথা জানব কী উপায়ে?’
— তাহার সহস্র উপায় রহিয়াছে। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, সুলিখিত পুস্তক, লোককথা-কোনও বস্তুরই অভাব নাই, তদুপরি আচার্য্যদেব স্বয়ং রহিয়াছেন, আপনার চিন্তার কারণ দেখিতে পাইতেছি না। তথাপি ঢুণ্ঢীরাজের মাহাত্ম্য আমি এক্ষণে আপনাকে কহিতেছি, মনোযোগ পূর্বক উহা শ্রবণ করুন।
আষাঢ়ের সজল মেঘের অন্তরাল হতে তন্দ্রাচ্ছন্ন কৌমুদী সুবাসে বরুণা ও অসি নদীর সঙ্গমে অবস্থিত এই প্রাচীন নগরী ভরে উঠেছে, অদূরে সুরধুনীর স্রোত যুবতীর রূপোর বিছাহারের মতো মৃদুমন্দ ভঙ্গিতে বয়ে চলেছে, জনশূন্য প্রহ্লাদ ঘাটে পোস্তায় কিশোরের কন্ঠস্বর প্রাচীন কোনও কথক ঠাকুরের সুরে বেজে উঠল, ‘তিনমাস তথা, মাঘাদি সর্ব্বথা, চারমাস ধরি। ঢুণ্ঢিরাজ পূজি, হবিষ্যান্নভোজী, হবে পূর্ব্বদিনে। প্রভাত রজনী, উত্তরবাহিনী, করে নর স্নানে। পূজি বিশ্বেশ্বর, গিয়া তদন্তর, নির্ব্বাণমণ্ডপে। হর-পার্ব্বতীর, পূজা করি ধীর, করিবে সংকল্পে।’
‘ঢুণ্ঢি ধাতুর অর্থ অণ্বেষণ, সমস্ত বিষয়ই তাঁহার অণ্বেষিত, তাই তাঁহার নাম ঢুণ্ঢি। কাশীখণ্ডে স্বয়ং বিশ্বনাথ বলিতেছেন, ঢুণ্ঢিরাজের সন্তোষ ব্যতিরেকে কাহারও কাশী প্রবেশ সম্ভব নহে। কাশীবাসী যে ব্যক্তি প্রথমে ঢুণ্ঢি গণেশ মহারাজের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া বিশ্বনাথ দর্শন করেন, তাঁহাকে পুনরায় জন্মচক্রে প্রবেশ করিতে হয় না, কেবলমাত্র তাহাই নহে, রাজা দিবোদাস কাশী অধিকার করিয়া বসিলে এই স্থল মহাদেবেরও দুষ্প্রাপ্য হইয়া পড়িয়াছিল, অতঃপর ঢুণ্ঢিরাজের প্রসাদেই তিনি নিজপুরী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই সকল কারণেই কাশী পরিক্রমারম্ভে সর্বপ্রথমেই ঢুণ্ঢি গনেশের পূজা বিহিত রহিয়াছে। আপনিও আগামী কাল প্রভাতে তাঁহার দর্শন ও পূজাদি সাঙ্গ করিয়া এই প্রাচীন নগরী পরিক্রমা আরম্ভ করিবেন, উহা নিশ্চিতরূপে আপনার পক্ষে বিশেষ ফলপ্রদ হইবে।’
সাগ্রহে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘ঢুণ্ঢি গণেশ দর্শনের পর বিশ্বনাথ মন্দির, আর তারপর?’
— তাহার পর কালভৈরব, বিশ্বেশ্বর মন্দিরের প্রায় অর্ধক্রোশ উত্তরে কপালমোচনতীর্থের সম্মুখে তাঁহার মন্দির অবস্থিত। দেবাদিদেব মহেশ্বর প্রজাপতি ব্রহ্মার গর্ব খর্ব করিবার জন্য নিজের অসীম ক্রোধ হইতে এক ভৈরব পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছিলেন-তিনিই জগতে কালভৈরব নামে খ্যাত। কালভৈরবের সনিষ্ঠ পূজা সকল কামনা পূর্ণ করিয়া থাকে, তাঁহার মূর্তি ঘন নীল এবং পশ্চাতে অপর একটি রূপ কুক্কুররূপে বর্তমান, সুপ্রাচীন এই মন্দির নশ্বর মানবের নিকট অতি মঙ্গলময়।
অতঃপর দর্শন করিবেন দণ্ডপাণি-বিনায়ক, কথিত রহিয়াছে কাশীতে তাঁহার পূজা না করিলে কাহারও সুখলাভ হইতে পারে না।
ইহার পর যাইবেন মণিকর্ণিকা ঘাট, শিবপুরাণ মতে শ্রীবিষ্ণুর কর্ণ হইতে মণিভূষণ এইস্থলে পতিত হইয়াছিল। পূণ্যভূমি এই ঘাটে স্বয়ং বিশ্বেশ্বর অন্তিমকালে সাধুদিগের কর্ণকুহরে তারকব্রহ্ম মন্ত্র দিয়া জীবকে মুক্তি প্রদান করিয়া থাকেন, আমার বিশ্বাস এই স্থানমুক্তিলক্ষ্মীর মহাপীঠের মণিস্বরূপ এবং তাঁহার চরণকমলের কর্ণিকাস্বরূপ, এই মোক্ষভূমি তুল্য তীর্থ ভুভারতে আর কোথাও আপনি দেখিতে পাইবেন না।
সহসা কথার মাঝে একটি অতিক্ষীণ ধ্বনি যেন গঙ্গার দিক হতে শোনা গেল, অনেকটা ওঁ-কার তুল্য সেই ধ্বনি শুনেই অতি দ্রুত উঠে দাঁড়াল কিশোর, ঐন্দ্রীর পানে চেয়ে ধীর স্বরে বলল, ‘পরিক্রমার পরবর্তী অংশ আচার্য্যদেব কহিবেন, এক্ষণে আমাকে সত্ত্বর যাইতে হইবে। শিবশম্ভূর কৃপায় আপনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করুন-ইহাই আমার একমাত্র প্রার্থনা।’
বাক্যটি শেষ করে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না কিশোর, ঐন্দ্রীকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত পায়ে ঘাট থেকে নেমে গলির দিকে হাঁটতে শুরু করল, পেছন থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ঐন্দ্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘অনুগ্রহ করে আপনার নামটি অন্তত বলে যান!’
অদূরে গঙ্গাস্রোতের কলকল মৃদু শব্দে সন্ধ্যা পরিপূর্ণ, অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় পদচারণা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সেই আশ্চর্য কিশোর, চোখদুটি দিব্যভাবে উজ্জ্বল, সর্বাঙ্গ চন্দনগন্ধী বাতাসের মতো নির্ভার, পারিজাত কুসুমের হাসি ওষ্ঠাধরে, তার মধুক্ষরা কণ্ঠ প্রাচীন ভারতভূমির আদর্শ হয়ে নির্জন জনহীন সন্ধ্যাঘাটে বেজে উঠল,
‘ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ন ভোক্তা চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।
ন মৃত্যুর্ন শঙ্কা ন মে জাতিভেদঃ পিতা নৈব মে নৈব মাতা ন জন্ম
ন বন্ধুর্ন মিত্রং গুরুর্নৈব শিষ্যশ্চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্।’
শ্লোক শেষ হতেই পেছন ফিরে দ্রুত পায়ে জনশূন্য অন্ধকার গলি পার হয়ে গেল কিশোর আর চন্দ্রাহত সন্ধ্যায় সেই অনির্বাণ যাত্রাপথের পানে নির্নিমেষ চেয়ে রইল ঐন্দ্রী।
(ক্রমশ)