লেহ তে সাধারণত এপ্রিলের ১৫-২০ তারিখের মধ্যে বসন্ত এসে গেলেও এবছর শীতকালটা বেশ অনেকদিন ধরে চলছে। ২৪-শে মে, সকাল ছটায় ঘুম ভেঙে দেখি চারিদিক সাদা, ভালরকম তুষারপাত তখনও হয়ে চলেছে। মে মাসের শেষের দিকে সচরাচর বরফ পড়ে না, এরপরেই গরম পড়ে যাবে, ডিসেম্বরের আগে আর না হওয়াই স্বাভাবিক, তাই মরশুমের শেষ তুষার উপভোগ করতে আলসেমি ঝেড়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়া গেল। বাসা থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূর দিয়ে বয়ে গেছে খারদুং হিমবাহ গলে তৈরি হওয়া গ্যাংলাস নালা। বিভিন্ন দূরত্বে ছটা প্রায় সমান্তরাল রাস্তা কালভার্ট হয়ে নালাটা পেরিয়ে লেহ শহরের দিকে চলে গেছে। এর মধ্যে আপার টুকচা রোড, টুকচা মেইন রোড আর লোয়ার টুকচা রোড এই তিনটে রাস্তা অপেক্ষাকৃত সরু, গাড়ির যাতায়াত কম, এবং নির্জন। হাঁটার জন্য এই তিনটে রাস্তাই শ্রেয়।
আপার টুকচা রোডে আনেলে-র বাড়ি থেকে বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে বড় রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে আবার বাঁদিকে খানিকটা নেমে গিয়ে টুকচা মেইন রোড দিয়ে একটু গেলেই ডানদিকে পরবে সাংক্তো ভিলা রিসর্ট। ভিলা পেরিয়ে গ্যাংলাস নালার ঠিক পাশেই একটা সদ্য গজিয়ে ওঠা মিনারেল ওয়াটার বটলিং প্ল্যান্ট। পাহাড় থেকে চুঁইয়ে বেরনো প্রকৃতির অকৃপণ জলধারা বোতলবন্দী করে চড়াদামে ট্যরিস্টদের কাছে বিক্রি করার কল। প্রকৃতি এখন প্রায় সর্বত্রই বহুজাতিকের থাবার তলায়, প্রাকৃতিক জল পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয়, আর খালি বোতলগুলো আবর্জনা হিসেবে জমা হয় পাহাড়ের গায়ে।
নালা পেরিয়ে হিডেন লীফ হোমস্টে। এই চত্ত্বরে টোকপোর ধারের ফাঁকা জায়গায় রেইনলিলির মতো ছোট ছোট গাছ হয়েছে, তাতে ঝলমলে বেগুনি রঙের ফুল। চিনতে পারলাম না। মাঠে চাষের কাজ করছিলেন কয়েকজন, তাঁদের জিজ্ঞেস করে জানলাম এই ফুলের স্থানীয় নাম টেসমা, এর লম্বা পাতা পাকিয়ে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন এঁরা, শীতকালে ঘরের ছাদ ছাইতে আর জ্বালানি হিসেবেও কাজে লাগে। ঘরে এসে গুগল লেন্সে ছবি মিলিয়ে দেখি, এ এক বিখ্যাত ফুল, আইরিস। গ্রীক মাইথোলজিতে আইরিস রংধনুর দেবী, মানবজাতির সঙ্গে স্বর্গের যোগসূত্র। তাঁর উজ্জ্বল রঙকে মনে করেই এই ফুলের এমন নাম।
লাদাখের পথঘাটে চলতে চলতে এমন অনেক গাছ দেখা যায়, যার পরিচয় পাশ্চাত্যের। হাঁটার রাস্তার দুপাশেই বিভিন্ন ধরনের উইলো, পপলার আর অ্যাসপেনের ঘন বন। কখনো বা দু একটা বার্চ বা অশ্বত্থ গাছের মত ঝাঁকড়া ব্ল্যাক কটনউড পপলার, স্থানীয় লোকেরা যে গাছকে গ্রামরক্ষক হিসেবে পুজো করেন, কাঠের প্রয়োজনে অন্য গাছ কাটলেও এই গাছকে সযত্নে রক্ষা করেন। আর আছে পথের দুপাশে মে-জুন মাসে মাতাল করা গন্ধের লাইল্যাক বীথিকা। আর প্রায় সব বাড়িতেই চার পাঁচটা করে অ্যাপ্রিকট গাছ। প্রশ্ন জাগে, এসব গাছ এলো কোথা থেকে? লাদাখের সঙ্গে ইউরোপীয়দের যোগাযোগের ইতিহাস তো মাত্রই শ’চারেক বছরের। এই এত সব ইউরোপীয় গাছ লাদাখে এলো কার হাত দিয়ে?
লাদাখে প্রথম ইউরোপীয়ান এক পর্তুগীজ বণিক, নাম ডিয়েগো ডি আলমেইডা। ১৬০১ সালে, লাদাখে তখন রাজা জামইয়াং নামগিয়াল রাজত্ব করছেন, নতুন জায়গায় ব্যবসার টানে আলমেইডা লাদাখে এসে পৌঁছোন। ফিরোজা পাথর, ম্যালাকাইট আর পশমিনার রমরমা ব্যবসা ছিল তাঁর। টানা দু’বছর লাদাখে থাকার পরে গোয়ায় ফিরে তাঁর রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনীর রিপোর্ট তিনি পেশ করেন আর্চবিশপের কাছে। ১৬০৩ সালে কুইম্ব্রাতে সেই ভ্রমণকাহিনী ছাপা হয় ‘Jornada do Arcebispo de Goa’ নামে। সময়টা যদি আমরা ভাল করে দেখি তবে খেয়াল করব শ্রীরামপুরের ছাপাখানা তৈরি হতে তখনও প্রায় দু’শো বছর দেরি। দিল্লিতে সম্রাট আকবরের রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশ সিংহের অগ্রদূতদের ভারতবর্ষে পৌঁছুতে তখনো ন’বছর দেরি। এই সময়েও কিন্তু পর্তুগীজ বণিকটির লেখার ভালই পরিচিতি হয়েছিল। একই বিষয় নিয়ে তাঁর দ্বিতীয় একটি বই প্রকাশিত হয় লিসবন থেকে ১৬১৩ সালে। এই বই দুটিই ইউরোপীয় বিদগ্ধজনের কাছে পেশ হওয়া লাদাখের ভূগোল ও সমাজ বিষয়ক প্রথম উপক্রমণিকা।
আলমেইডা লাদাখে পৌঁছুবার একশো পাঁচ বছর আগে ১৪৯৮ সাল নাগাদ কালিকটে যখন রাজা সামরী সিংহাসনে আসীন, ভাস্কো ডা গামা ভারতের মাটিতে পা রাখেন। সেই প্রথম ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার যোগাযোগ। রাজা সামরীর রাজসভা আর ভারতভূমির প্রাচুর্য্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ভাস্কো ডা গামা। তার পরের কথা লেখা আছে শরদিন্দুর রক্তসন্ধ্যায়। ক্রমে ক্রমে ১৫০৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষের দক্ষিণ উপকূলে তৈরি হয় পর্তুগীজ ইন্ডিয়ার ভিত্তি। প্রথমে কোচিন আর তারপর গোয়া ভারতবর্ষে পর্তুগীজ উপনিবেশের রাজধানী হয়ে ওঠে। ফিবছর সমুদ্রপাড়ি দিয়ে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে আসতে থাকেন পর্তুগীজরা।
১৫৭৮ সালে লিসবনে জন্মেছিলেন ফ্রান্সিসকো ডি অ্যাজিভেডো। ঠিক তার দু’বছর আগে তৈরি হয়েছে সুবে বাংলা, আইন-ই-আকবরী তখনও লেখা হয়নি। খুব ছেলেবেলায় অ্যাজিভেডো বাবা-মার সঙ্গে চলে এসেছিলেন ভারতবর্ষে, গোয়ার পর্তুগীজ কলোনিতে। ১৫৯৭ সালে জেসুইট মিশনারি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেন অ্যাজিভেডো, কয়েকবছর অভিজ্ঞতা লাভের পর নতুন নতুন দেশের অখ্রিস্টানদের মধ্যে যীশুর পবিত্র প্রেমের বাণী ছড়াবার স্বাধীন দায়িত্ব নিয়ে ১৬১৪ থেকে শুরু হল তাঁর ভ্রমণ। প্রথমে দিউ, দমন হয়ে তিনি পাড়ি জমালেন আফ্রিকার মোজাম্বিকে। ১৬২৭-এ ফের ভারতবর্ষে ফিরে যোগ দিলেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ‘মোগর মিশন’-এ। কেবল মোগলশাসিত ভারতভূমিই নয়, দুর্গম হিমালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে, প্রকৃত্যার্থে লাদাখ ও তিব্বতে খ্রিস্টধর্মের প্রচার এই ক্যাথলিক মিশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল।
অ্যাজিভেডোর যাওয়ার বছর তিনেক আগে আরো দুই পর্তুগীজ মিশনারী, অ্যান্টোনিও ডি অ্যাণ্ড্রেড এবং ম্যানুয়েল মার্কুইজ বদ্রীনাথ হয়ে মানা পাস পেরিয়ে লাঙ্কেন জাঙ্গবো (Langqên Zangbo) বা শতদ্রু নদীর তিব্বতি অংশের ধারে গড়ে ওঠা প্রাচীন গুগে রাজ্যের রাজধানী ৎসাপারাং-এ গিয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন। পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলের গুগে রাজ্য আজকের চীনের জান্ডা কাউন্টি। ৎসাপারাং-এ আজও পুরোন দিনের প্রাসাদ মন্দির গুহার অবশেষ বর্তমান৷ (স্বচক্ষে দেখা হয়তো হয়ে উঠবে না, উৎসাহীরা গুগল ম্যাপে Tsaparang বা Ge Ge Wang Guo Yi Zhi সার্চ করে লোকেশান আর কিছু ছবি দেখে নিতে পারেন।)
গুগের তৎকালীন রাজা ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন হলুদটুপি বা নব্য গেলুগ ঘরানার বৌদ্ধ। সময়টা ছিল প্রাচীনপন্থী লালটুপি আর হলুদটুপি বৌদ্ধদের অন্তর্দ্বন্দ্বের। গুগে প্রদেশের রাজা তাই ধর্মীয় রাজনৈতিক কারণেই বিদেশি শক্তি জেস্যুইটদের সাদর অভ্যর্থনা করেছিলেন। এদিকে জামিয়াং নামগিয়ালের ছেলে সেঙ্গে (সিংহ) নামগিয়াল ছিলেন লালটুপি শিবিরের। তাঁর সঙ্গে গুগের রাজার যুদ্ধের কারণও এই ধর্মীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। সেই যুদ্ধে রাজা সিংহ নামগিয়াল জয়ী হন, আর ফলশ্রুতিতে লাদাখ-তিব্বতের সদ্য ধর্মান্তরিত ক্যাথলিকরা উলুখাগড়া হয়ে পড়ে, তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, ক্রীতদাস বানিয়ে লাদাখি রাজপুরুষদের সংসারে চালান দেওয়া হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সব প্রচেষ্টাকে সমূলে নষ্ট করতে উদ্যত হন সিংহ নামগিয়াল। ৎসাপারাং-এর সদ্য স্থাপিত চ্যাপেলটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তাড়িয়ে দেওয়া হয় পর্তুগীজ পাদ্রীদের। গুগে-র রাজাকে বন্দী করে রাখা হয় লেহ প্যালেসের পাশে ওল্ড লেহ-র একটি বাড়িতে।
লাদাখের নব্য খ্রিস্টানদের এ হেন দুরবস্থা দেখে তিব্বতে ধর্মপ্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখ্য ধর্মযাজক ফাদার অ্যাণ্ড্রেড ১৬৩১ সালে অ্যাজিভেডোকে জেস্যুইট ক্যাথলিকদের হয়ে রাজা সিংহ নামগিয়ালের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেন। ১৬৩১ সালের ২৮ জুন অ্যাজিভেডো আর জোয়াও ডি অলিভিয়েরা আগ্রা থেকে রওনা দেন, কোটদ্বার হয়ে জুলাই মাসে এঁরা পৌঁছান উত্তরাখন্ডের শ্রীনগরে। সেখানেই গুগে-লাদাখ যুদ্ধের সাম্প্রতিক খবরাখবর নিয়ে আসেন ফাদার ম্যানুয়েল মার্কুইজ। তিন ধর্মযাজক অভিযাত্রী শ্রীনগর থেকে জুলাইয়ের শেষে পশ্চিম তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। অলকানন্দা নদীর উজানে যাত্রা করে, যোশিমঠ থেকে বদ্রিনাথ হয়ে মানা পাস দিয়ে সুউচ্চ হিমালয়পর্বতরাজি পেরিয়ে প্রায় দু-মাস পর ৎসাপারাং-এ পৌঁছান। সেখানকার খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের দুরবস্থা দেখে আতঙ্কিত হন অ্যাজিভেডো, তাদের রক্ষা করার জন্য রাজা সিংহ নামগিয়ালের দর্শনপ্রার্থী হন। ৎসাপারাং-এ কিছুদিন অন্তরীণ থাকার পর ৪ ঠা অক্টোবর ৫৩ বছর বয়সী অ্যাজিভেডো আর তাঁর দুই সঙ্গী পায়ে হেঁটে রওনা দেন প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে লাদাখের রাজধানী লেহ’র দিকে। তিব্বতী বণিকদের এক ক্যারাভান জুটে যায় পথে, তাই অবশেষে লেহ তে পৌঁছাতে পারেন তাঁরা। নয়তো, পরমেশ্বরের নামে পঙ্গু যতই গিরি লঙ্ঘন করুক, অক্টোবরের লাদাখে পদব্রজে এতখানি পথ চলাটা অসম্ভব, রাস্তাতেই নিশ্চিত মৃত্যু।
যাত্রাপথ ও তার বিবরণ অ্যাজিভেডো নিয়মিত লিখে যেতেন। সেখানেই ৎসাপারাং থেকে লেহ, এই একুশ দিনের যাত্রাপথের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইতিহাসে এই প্রথম বার কোনও ইউরোপীয় গুগে প্রদেশ হয়ে লেহ শহরে পৌঁছলেন। অ্যাজিভেডোরা অবশ্য নিজেদের ভেবেছিলেন লেহ্’তে যাওয়া প্রথম ইউরোপীয়, কারণ ওঁরা ডিয়েগো ডি আলমেইডা কথা জানতেন না। তবে অ্যালমেইডাও অবশ্য ঠিক লেহ্’তে থাকেন নি, লেহ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে বাসগোতে ছিল লাদাখের পূর্বতন রাজধানী, সেখানেই রাজানুগ্রহে এক ভিলা বানিয়ে রাজার হালে থাকতেন অ্যালমেইডা। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ অব্ধি বাসগোই ছিল লাদাখের রাজধানী৷ এখনো লেহ থেকে খালসি যাওয়ার পথে রাস্তার ডানদিকে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ এবং গোম্ফা বিদ্যমান। রাজপ্রাসাদ পরিত্যক্ত হলেও গোম্ফাটিতে এখনো পূজার্চনা হয়।
তিব্বতী বণিকদের ক্যরাভ্যানটি পথ চলেছিল দ্রুত, নয়তো এই সময় বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। অ্যাজিভেডো যাত্রাপথে এক বিস্তৃত বিরান তুষারাবৃত মরুভূমির কথা লিখেছেন, সম্ভবতঃ সেটি আজকের চাংথাং প্রান্তর। পাথুরে সেই মরুভূমির উপত্যকায় কেবল ছাগপালক জনজাতিরা তাঁবুতে দিন কাটায়, কোথাও বা পাহাড়ের কন্দরে তাদের নিবাস। ৪৫০০ থেকে ৪২০০ মিটার উচ্চতার এই উন্মুক্ত প্রান্তরে কনকনে ঠান্ডায় সারাদিন হুহুঙ্কার করে বয়ে যেতো বরফিলা হাওয়া। গুগে থেকে রওনা হওয়ার পর টানা আটদিন এই ছোট্ট দলটা কোনওরকম জ্বালানি ছাড়াই পথ হেঁটেছিল। শেষে হ্যানলের গোম্পায় পৌঁছুলে উত্তাপ ও খাদ্যে ইশা নবীর ধর্মপ্রচারকদের প্রাণ বাঁচান তথাগত।
কিন্তু লেহ্ তখনও ‘বহুত দূর দিল্লী’। অ্যাজিভেডো লিখেছেন পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে, হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় তখন তাঁদের আধমরা দশা। তা সত্বেও এগিয়ে চলে একে একে নায়োমা, মাহে, চুমাথাং, কিয়ারি পেরিয়ে যাত্রাবিরতি হলো গ্যা গ্রামে। সেখানে থেকে খানিক চাঙ্গা হয়ে এঁরা পৌঁছোন উপসি। উপসি থেকে লেহ শহরের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। এই উপসির পরেই আপার লাদাখ শেষ হয়ে মিডল লাদাখ শুরু। এখানে পাহাড়ের উপর থেকে অ্যাজিভেডো আর তাঁর সঙ্গীরা নিচে তাকাতেই তাঁদের সামনে জাদুই কার্পেটের মতো লেহ উপত্যকা খুলে গেলো। চাষের জমিতে তখন পাকা ফসল, সিন্ধুনদের ধারে বাগিচা আর বনানীতে ঢাকা এক অপূর্ব দেশ। এই দীর্ঘ উদ্বেগময় যাত্রা শেষ হয়ে এলো বলে আরামের শ্বাস ফেললেন তাঁরা, ঠিক তিনশ নব্বই বছর আগে।
রবি ঠাকুর কবিতায় লিখেছেন বণিকের মানদন্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে, পোহাতে শর্বরী। বস্তুতঃ শর্বরী পোহানোর আগেই ধর্মপ্রচার শুরু হয়। ধর্ম সবসময়ই প্রশাসনিক ক্ষমতার অগ্রদূত। যীশু যা বলে গেছেন তা প্রেমের বাণী। কিন্তু খ্রিস্টধর্মপ্রচারের যে নৃশংসতা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তা অচিন্ত্যনীয়। অ্যাজিভেডোর ঠিক সমসময়ে পূর্ববঙ্গের উপকূল জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব করছিল পর্তুগীজ জলদস্যুরা। অনেকক্ষেত্রেই পর্তুগীজ ধর্মযাজকরা এই দুর্বৃত্তদের সহায়তা করতেন। মেদিনীপুর, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি অঞ্চলের উপকূলবর্তী নিরীহ মানুষদের অপহরণ করে বন্দী বানিয়ে দাসব্যবসা চলতো। হার্মাদদের সেই ভয় কাটতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েক শতাব্দী। রাজা সিংহ নামগিয়াল সেইসময় কড়া হাতে খ্রিস্ট ধর্মপ্রচার বন্ধ না করলে কালে কালে যে লাদাখেও তেমন হতো না, সে কথা বলা কঠিন। তবে দুর্দম পর্তুগীজেরা সামুদ্রিক ক্রিয়াকলাপে যত প্রবল ছিল, গিরিলঙ্ঘনে তত পটু ছিল না। সেই কারণেই হয়তো অ্যালমেইডার পরে দ্বিতীয় পর্তুগীজের লাদাখে আসতে লেগে গেছিল প্রায় তিরিশ বছর। এতদসত্বেও আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে বদ্রীনাথ থেকে অলকাপুরী হয়ে মানা গিরিপথ পেরিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে তাঁদের এই যাত্রার কথা ভাবলে অবাক লাগে ৷
লেহ’তে এসে অ্যাজিভেডো রাজা সিংহ নামগিয়ালের সঙ্গে দেখা করে ক্যাথলিকদের তরফ থেকে সর্বান্তকরণে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই রাজসাক্ষাৎ-এর বর্ণনা নিয়েই অ্যাজিভেডোর গল্পের দ্বিতীয় অংশ, তবে সেই গল্প পরে একদিন হবে।
হিমালয়ের এই অঞ্চলটি বিগত প্রায় দেড়-দু হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মিলনক্ষেত্র। সুদূর অতীতের ধর্মবোধহীন পার্বত্য ভ্রাম্যমাণ জীবন থেকে বাণিজ্যে যাবার রেশমপথটি ধরে আসা চীনা, তিব্বতী, মোঙ্গল, কাজাখ, তাজিক, বালটি, কাশ্মীরি, পারসিক, বন, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান… সকলকেই লাদাখের কষ্টসাধ্য প্রকৃতি নিজের ছাঁচে মিলিয়ে মিশিয়ে ঢালাই করে নিয়েছে। লেহ’র আধুনিক যাপনে কোথাও সেই প্রক্রিয়ার উচ্চকিত চিহ্ন দেখা যায় না। এখানে সকলেই পাহাড়ী মানুষ। নম্র, ভদ্র, নিয়মানুবর্তী। কেবল লাদাখের বিভিন্ন গাছপালা: চুলি, য়্যুলাত, মালচাং, শুকপা, টেসমা অনুসন্ধিৎসু পথিকের মনে নিরুচ্চারে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে, তারা কাদের সঙ্গে, কাদের সময়ে এসেছিল?
ভিনসেন্ট ভ্যানগখ আর ক্লদ মোনের আঁকা এই আইরিস ফুলের দুটি আলাদা রকম অভিব্যক্তি রয়েছে। ঘন পার্পল ফুল। মোনের ছবিতে তারা শিশুর স্বপ্নের মতো রঙিন, সকলি শোভন, সকলি কোমল। এরই বিপ্রতীপে অ্যাসাইলামে যাবার সপ্তাহখানেকের মধ্যে বাগানের বেগুনি রঙের আইরিসের দল উঠে আসতে থাকে গখের ক্যানভাসে। গখ ভাবতেন উজ্জ্বল এই ফুলের ছবি তাঁর ক্রমাগত উৎকেন্দ্রিকতা থেকে তাঁকে দূরে নিয়ে যাবে। তাই ভ্যানগখের ছবির আঁচড়ে পাওয়া যায় বাস্তবের ধুলোমাটির ঘ্রাণ৷
ক্রিশ্চিয়ানিটিতে আইরিসকে ডাকা হয়, লেডি অফ দ্য সরো। অকালমৃত মেয়েদের কবরের উপর লাগানো হতো আইরিস, যেন প্রাচীন গ্রীক লোককথার দেবী আইরিস দুঃখিনী মেয়েটির আত্মাকে সুপথে নিয়ে যেতে পারেন। চীনা লোককথা বলে সারা শীতকাল বাগানের চারিদিকে পাহারা দেয় আইরিস। সাপ ঢুকতে পারে না। কিন্তু হেমন্ত এলেই মাটির নীচে মুখ লুকায় এই ফুল, বসন্ত এলে আবার মাথা তোলে। এই অনুষঙ্গে স্বর্গের বাগানের কথা সহজেই মনে আসে। তবুও বিধাতাপুরুষের শাসন এড়িয়ে সাপ আসে বনে, প্ররোচনা দেয়, স্বর্গ বদলে যায় নরকে।
লাদাখে আজকাল উন্নয়নের বসন্তকাল। চাষজমিতে, নদীর ধারে, পাহাড়ে কেবল হোটেল আর গেস্ট হাউসের নির্মীয়মান কঙ্কাল। গাছ কেটে, পাহাড় সমান করে মাথা তুলছে তারা। হিমেল হাওয়ায় সংখ্যালঘু আইরিসের দল টোকপোর পাশে মাথা দুলায়। জিজ্ঞেস করি, ওহে! হেমন্ত কতদূর? আসছে হেমন্ত অবধি বেঁচে থাকবে তো?