কাগজের নৌকো। পর্ব ১। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
বহু বৎসর পূর্বের কথা, সেইসব দিন অবিনাশের আর তেমন ভালো করে মনেও পড়ে না, পঁচিশ ছাব্বিশ বছর কেমন যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেছে মহাশূন্যে।
আজ এই সন্ধ্যায় রতনবাবুর শ্মশানঘাটে বসে হঠাৎ মনে পড়ল পুরাতন দিনগুলি। একখানি ডিঙি নৌকোর মতো তারা ভেসে ভেসে পশ্চিমে চলেছে, সামনের বড়ো অশ্বত্থ গাছের মাথাখানি গৃহমুখী পাখিদের কোলাহলে চঞ্চল, অন্যান্য দিনের তুলনায় সন্ধ্যাকাশের রূপসজ্জা আজ যেন একটু বেশি, একেই বোধহয় রক্তসন্ধ্যা বলে, হরিনামের ধুয়া তুলে আবার একটি মৃতদেহ নিয়ে এল শ্মশানবন্ধুর দল, অবিনাশ চেয়ে দেখল অল্পবয়সী এক যুবতিকে ভবনদীর শেষ খেয়ায় তুলে দেবে বলে নিয়ে এসেছে তারা, এদিকে এখনও কাঠচিতার চল আছে তবে তাড়াতাড়ি হবে বলে সকলে বিজলি চুল্লিই চায়, চুল্লির দুয়ারে দুটি মৃতদেহ আগে থেকেই সার দিয়ে শোয়ানো রয়েছে অর্থাৎ এই যুবতিকে মায়া সংসারে আরও দেড়-দু ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
সুরধুনীর তীরে এই শ্মশানঘাটটি বড়ো প্রিয় অবিনাশের, প্রায়শই অস্ত বৈকাল আর সন্ধ্যার ব্যক্তিগত প্রণয়কথার মাঝে ঘাটের জীর্ণ পৈঠায় এসে বসে, এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ প্রতি সন্ধ্যায় ঘাটে স্নান করতে আসেন, দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ, জলে নামার আগে পৈঠায় বসে ভালো করে সর্ষের তেল মাখার সময় অবিনাশের সঙ্গে কখনও দু-চারটি কথা বলেন, আজও মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সব কুশল তো?’
কার্তিক মাস, কান পাতলে উত্তরপথগামী বাতাসে ধানশিষের দুধের মতো শীতকালের পদধ্বনি শোনা যায়, মুগার পাতলা চাদরটি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে সামান্য হেসে অবিনাশ বলল, ‘হ্যাঁ, চলে যাচ্ছে আর কী!’
দু-এক মুহূর্ত পর কী মনে হওয়ায় বৃদ্ধকে মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, ‘এইসময় স্নান করেন প্রতিদিন, ঠাণ্ডা লেগে অসুখ বিসুখ হবে যে।’
নাকে সর্ষের তেল নিচ্ছিলেন ব্রাহ্মণ, অবিনাশের কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থামলেন তারপর নাক টেনে বললেন, ‘এ কি আজকের অব্যেস বাবা, আজ চল্লিশ বচ্ছর হল, বারোমাস তিরিশকাল দুবেলা গঙ্গা স্নান না করে জলস্পর্শ করি না! বরং একদিন মা গঙ্গার চরণ না ছুঁলে শরীর খারাপ করে।’
–আর জ্বরজারি হলে? তখনও ঘাটে আসেন?
–আসি বৈকি বাবা, তবে মা তারার কৃপায় এই দেহযন্ত্র তেমন বিগড়োয় না! সেই যে-বছর কলকাতায় খুব বান হল তকন হয়চিল ‘মায়ের দয়া’, সারা শরীরে এই বড়ো বড়ো গোটা, তোমার মতো এক ডাক্তার দেকে বললে, বুকে জলও জমেচে, কী হবে বলা কটিন!
বৃদ্ধের কথা বলার ধরনে একটু মজা পেয়েই অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘তারপর?’
–মরে যে যাইনি একনও তা তো দেকচই, তবে হাঁ ভোগান্তি হয়চিল। সেই তকনই ডাক্তার দেকেচিলাম নীলরতনে, যেমন দেকতে তেমন গুণ, গটমট করে হেঁটে এসে বুকে যন্তর না বসিয়ে শুধু এই হাতখানার নাড়ি দেকে বললে, কিচু হবে না, ওষুদ দিচ্চি ঠিক হয়ে যাবেন। কী বলব বাবা দু-দাগ ওষুদ পড়েচে কি পড়েনি, কোতায় জ্বর কোতায় কাশি, দশদিনের মাতায় গোটার মামড়ি খসে চনমনে হয়ে উটলাম।
নিভু নিভু দিনের আলোয় শ্যাওলা ছাওয়া ঘাটের জীর্ণ পৈঠা বেয়ে বৃদ্ধ নেমে যাচ্ছেন জলে, করজোড়ে সুরধুনীকে প্রণাম করে গুনে গুনে ঠিক তিনটি ডুব দেবেন এইবার, অনেকদিন ধরে দেখে অবিনাশের মুখস্থ হয়ে গেছে ওঁর স্নানদৃশ্য, শ্মশানের দিক থেকে নারীকণ্ঠের বিলাপ ভেসে আসছে-ওগো তুমি কোতায় গেলা গো, ওগো আমার কী হবে গো, কার হাতে দিয়া গেলা গো আমারে, অবিনাশ মনে মনে সামান্য হাসল, কত মৃত্যু দেখেছে জীবনে আবার রোগীর শিয়রে সেই অন্ধ বধির পিঙ্গলকেশীকে বসে থাকতে দেখেও দৃঢ় হাতে লড়াই করেছে, কখনও পরম করুণাময়ী জীবকে নিয়ে ফিরে গেছেন আবার কখনও অবিনাশ সেবারের মতো উল্টে দিয়েছে পাশার দান, তবে সে নিশ্চিত জানে জীবিতের এই শোক ক্ষণস্থায়ী, আজ শোকে বিহ্বলা ওই বিলাপকারিণীও কয়েকদিন পর পুত্র কন্যাকে নিয়ে সংসারসুখে চাঁপা ফুলের মতো হেসে উঠবে, যে চলে গেল তার ধুলামলিন পটচিত্রের উপর অলীক আখ্যানকারের মতো শুধু জেগে থাকবে মহাকাল। ভাবনার মাঝেই চোখ বন্ধ করল অবিনাশ, ফিরে এল অল্পক্ষণ পূর্বে মনে ঢেউ তোলা পুরাতন দিন।
এমনই কার্তিক মাস, রাত্রি প্রায় এগারোটা নাগাদ ঝাঁঝা ইস্টিশানে রেলগাড়ি থেকে নেমেছিল অবিনাশ, সঙ্গে একটা সুটকেস আর হোল্ডওলে বাঁধা বিছানা, যেতে হবে মাইল দশেক দূরে কুসমি গ্রামে, কিছুদিন আগে উত্তরবঙ্গের চালসা হাসপাতালের চাকরি নিজের ইচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে, সুপারের সঙ্গে ঝামেলা থানা পুলিশ অবধি গড়িয়েছিল-সে এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর অধ্যায়। শেষ অবধি ন্যাশানাল মেডিকেল কলেজের সিনিয়র বাসুদেব সামন্তর কথায় এখানে আসা, কুসমি গ্রামে প্রায় নিজের উদ্যোগেই একটি বেসরকারি দাতব্য হাসপাতাল চালাচ্ছেন বাসুদেবদা, দশ বছর ধরে শত বাধা বিপত্তি পার হয়েই চলছে হাসপাতাল, নিজের মায়ের নামে নাম দিয়েছেন ‘কমলিনী সেবা প্রতিষ্ঠান’। সেই নব্বই সালের গোড়ার দিকে ফোন আর কোথায়, চিঠিতে আসার দিনক্ষণ জানিয়েছিল অবিনাশ, ফিরতি চিঠিতে বাসুদেবদা লিখেছিলেন একখানি টাঙা অবিনাশের জন্য থাকবে ঝাঁঝা ইস্টিশানে কিন্তু আজ গাড়ি ছয় সাত ঘণ্টা লেট, পৌঁছানোর কথা ছিল বিকেল চারটেয় আর এখন বাজে রাত্রি এগারোটা! কার্তিক মাসেই বিহারে কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে, প্রায় নিঝুম চারপাশ,একখানি চা-দোকান ম্লান সন্ধ্যাতারার মতো প্ল্যাটফর্মের উপর জেগে আছে, উনানের আঁচও প্রায় নিভু নিভু, দু-চারটি কুকুর ধিকিধিকি আগুনের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে, দোকানি হয়তো এখনই ঝাঁপ ফেলে বাড়ি ফিরবে, ওই অপরিচিত দোকানির কথা আজও মনে আছে অবিনাশের, গিরধারী প্রসাদ, প্রৌঢ় মানুষ, পরনে একখানি ফতুয়া আর খেটো ধুতি, দোকানে রঘুবীরের ছোট্ট পট হলুদ গাঁদাফুলের মালায় সাজানো, বড়ো যত্নে শেষ আঁচে চা তৈরি করে খাইয়েছিল অবিনাশকে, কতদিন হয়ে গেল তবুও দরিদ্র মানুষটির মুখ স্মৃতিপটে এখনও আষাঢ়ের বর্ষণক্ষান্ত অপরাহ্নের মতো উজ্জ্বল, চায়ের গেলাস দুহাতে নিয়ে অবিনাশের সামনে রেখে বলেছিল, ‘বাবুজি, থোড়া পি লিজিয়ে, আপকো খালি মু যানে দেনে সে মেরা রঘুবীর নারাজ হো যায়েগা!’
এক আশ্চর্য জীবন শুরু হয়েছিল কুসমি গ্রামে, কত রকমের রোগী, দরিদ্র ভারতবর্ষের সরল সহজ মানুষগুলি ধুলামলিন রুক্ষ পথে সাত মাইল আট মাইল খালি পায়ে হেঁটে এসে বসে থাকতো হাসপাতালের বারান্দায়, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে কারোর হাতে এত বড়ো কার্বাঙ্কল পেকে টসটসে, গর্ভবতী দেহাতি রমণীর রক্তশূন্য ক্লান্ত রুক্ষ শরীর এলিয়ে পড়েছে বারান্দার এককোণে তবুও রোগজর্জর মানুষগুলির মুখে একফোঁটাও অভিযোগ নাই, বিরক্তি নাই, ডাগদার সাব দেখবেন এই আনন্দেই তারা যেন নিজেদের কৃতার্থ মনে করতো! অবিনাশের সামনে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে হাসিমুখে বলে উঠত, পরনাম ছোটা সাহিব!
শুধু সুঁই মানে ইঞ্জেকশন না দিলে তাদের মন উঠতো না, যতই ওষুধ দেওয়া হোক না কেন ইঞ্জেকশনের জন্য করুণ মুখে এসে দাঁড়িয়ে থাকত, বাধ্য হয়েই অবিনাশ মন ভোলানোর জন্য অনেক সময় একটা গ্লুকোজ ইঞ্জেকশন দিত, তখন মুখে কী হাসি! ওষুধ আর চিকিৎসকের প্রতি রোগীর আস্থাই যে আরোগ্য পথ তৈরি করে সেকথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল অবিনাশ, কুসমি গ্রামের সরল সহজ মানুষেরা সেই তরুণ বয়সেই তাকে চিকিৎসার মূল কথাটি শিখিয়েছিল। তবে তাদের বড়ো ভয় ছিল অপারেশনে, ছোটখাটো অপারেশন করতে হত বৈকি, জমির ঝামেলায় হয়তো মেরে কেউ মাথা ফাটিয়ে হাঁ করে দিয়েছে, তখন সেলাই ইঞ্জেকশন সবই নিপুন হাতে সামলে দিত অবিনাশ,আজ এই ঘাটে বসে সেই পুরনো যুবক অবিনাশকে হঠাৎ যেন দেখতে পেল, ওই যে ঘাটের একপাশে বসে রয়েছে, মুখে তরুণ আলোর মতো হাসি, পরনে চিকিৎসকের সাদা পোশাক, গলায় স্টেথো, সে যেন অস্ফূট স্বরে বলছে, ‘সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলার মতো আনন্দ এই জগতে আর কোথাও নাই অবিনাশ!
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্নান সেরে উপরে উঠে আসছেন, সারা শরীর থেকে মোমরঙা জল ঝরে পড়ছে, অবিনাশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একমুহূর্তের জন্য থামলেন, আলতো ভালোবাসার সুরে বললেন, ‘বাড়ি যাও বাবা, এই ভর সন্দেয় শ্মশান ঘাটে বসে থাকা কি ভালো! ওতে কিচুই হয় না বাবা শুদু ক্ষণকালের জন্য মর্কট বৈরাগ্য আসে মনে, কাজের কাজ কিচুই হয় না! বাড়ি যাও বাড়ি যাও।’
ঘাড় নেড়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ আনমনা গলায় উত্তর দিল , ‘হ্যাঁ, এই ফিরব!’
ফেরার কথা মুখে বললেও বাড়ির নাম শুনলে আজকাল একটু হাসিই পায় অবিনাশের, বিচিত্র জীবনে কিছুই তার হাতে নাই, পদ্মপাতায় জলের মতো চঞ্চল এই কাল, কোথায় থিতু হবে মানুষ, স্থির হয়ে সংসার পাটে বসার বাসনাই মানুষকে ছলনাময়ীর মতো মিথ্যা আশায় ভুলিয়ে রাখে এই মায়াভুবনে, ওই যে গঙ্গা বেয়ে একখানি স্টিমার ভোঁ তুলে চলেছে, কোথায় যাচ্ছে কে জানে, একেক সময় অবিনাশের মনে হয় লিখে রাখে এই কথাগুলি পরক্ষণেই ভাবে কী হবে! লেখা তো ছিল, সেই যে কুসুম হারের মতো একগুচ্ছ শব্দ কাগজে পরম যত্নে কালি কলমে লিখে নৌকো করে ভাসিয়ে দিত জলে, কাগজের নৌকো, তারাই বা অস্ত অপরাহ্নে বর্ষা মেঘের নিচে সোনা গলানো আলোর ভুবন পার হয়ে কোথায় যেত কে জানে! কেউ জানে না তাদের কথা, নাকি কেউ জানে ?
(ক্রমশ)
অন্য দুটোর মতো এটিও এক এক অদ্ভুত আকর্ষণে টেনে নিচ্ছে আমাকে। অবিনাশের চোখ দিয়ে দেখছি এই জগত ও জীবন। বড় সুন্দর ও মায়াবী তোমার লেখা। চলুক কলম।
সুন্দর সূচনা। গল্প গড়ে ওঠার অপেক্ষায়
বেশ।