কেবল ফেসবুক বিপ্লব নয়, মাঠে নেমে কাজ করতে হবে সকলকে একসঙ্গে।–বিতান চক্রবর্তী, হাওয়াকল প্রকাশনা
১. কবে প্রকাশনা শুরু হল ও কীভাবে?
উত্তরঃ ২০০৯ সালে হাওয়াকল শুরু হয়। শুরুটা কিন্তু খুব একটা পরিকল্পিত ছিল না। তখন আমরা একটা লিটল ম্যাগাজিন করছি। আমরা মানে, কবি অরণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্পকার-ফটোগ্রাফার প্লাবন দাস, আর আমি। পত্রিকার নাম ‘বাউন্ডুলে’। একদিন অরণ্য এসে বলল, একটা কবিতার বই কি আমরা করতে পারি? কবি কিশোর ঘোষের প্রথম পাণ্ডুলিপি, ‘উট-পালকের ডায়েরি’। বাঙালির মেতে ওঠার ঐতিহ্যকে বজায় রেখে আমরা লেগে পড়লাম বই তৈরিতে। তখন সবে আমি টাইপ, পেজ-সেটিং ইত্যাদি শিখেছি ম্যানুয়াল ঘেঁটে ঘেঁটে। কিন্তু বই করার মতো এত প্রফেশনাল বিদ্যে আমাদের ছিল না। অথচ বইটি করতেই হবে। সেই শুরু।
২. কী ধরণের বই আপনারা প্রকাশ করছেন?
উত্তরঃ আমাদের প্রকাশনার প্রথম চার বছর হাত পেকেছে কবিতায়। পরে ধীরে ধীরে সমস্ত জঁরেই আমরা কাজ করেছি। নতুন লেখকের লেখা যা বাংলা সাহিত্যে কিছু নতুন যুক্ত করতে পারে, এমন লেখা প্রকাশ করেছি। তবে সব সময় কি সমস্ত লক্ষ্যই পূরণ করা গেছে? না, যায়নি। যখনই তা আমাদের আতশ কাচের তলায় এসেছে, পরের পাণ্ডুলিপিতে আরও তীক্ষ্ণ হয়েছি আমরা।
৩. আগামীর পরিকল্পনা।
উত্তরঃ ভালো বই প্রকাশ এবং সবচেয়ে বড়ো পরিকল্পনা বিশ্বের যে অসংখ্য পাঠকের কাছে আমরা এখনও পৌঁছোতে পারিনি, তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া।
৪. আপনাদের প্রকাশিত প্রথম বই ও তার সলতে পাকানোর গল্প।
উত্তরঃ ২০০৯ সালে যখন প্রথম অরণ্য এসে বললো আমাদের একটি বই করা উচিত, তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে কিশোর ঘোষকে চিনতাম না। বাউন্ডুলেতে লেখা পড়েছি। বই তৈরির সময় কিশোরদার সঙ্গে এক আত্মীয়তা গড়ে উঠল আমার। আগেই বলেছি, বই তৈরির প্রাথমিক যে কাজ টাইপ ইত্যাদির আমিই করছি, কিন্তু কভার? কিশোরদার প্রস্তাব হিরণদাকে (হিরণ মিত্র) একবার যদি অনুরোধ করা যায়। যাওয়া হল। উনি জানালেন পাণ্ডুলিপি পছন্দ হলে করবেন। পরের সপ্তাহে খোঁজ নিতে বললেন। কিন্তু ফোনটা এলো হিরণদার কাছ থেকেই। মাত্র দু-দিনে। তাঁর লেখাগুলি ভালো লেগেছে, কভার হয়ে গেছে। নিজের উদ্যোগেই সেদিন কভারটি স্ক্যান করিয়ে সিডি করে দিয়েছিলেন হিরণদা। এখানে বলে রাখি হাওয়াকলের লোগোটিও হিরণদার তৈরি করে দেওয়া।
৫. প্রথম কলকাতা বইমেলার অভিজ্ঞতা।
উত্তরঃ প্রকাশর প্রথম দিন থেকেই কিন্তু আমরা কলকাতা বইমেলায় নিজেরা সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের প্রথম বইমেলা ২০১৭। স্টক বলতে গোটা পঞ্চাশেক টাইটেল। ভয় ছিল এত কম টাইটেলে স্টল ভরানো এবং পাঠককে আকৃষ্ট করা। কিন্তু প্রথম বছরেই আমরা নতুন পাঠকের চোখে পড়ি। একটা গল্প বলি, একদিন মেলায় একজন এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, বাংলা ছড়ার বই আছে? মালয়ালম ভাষার মানুষ তিনি। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। বাংলাকে ভালোবেসে ফেলেছেন, তাই ভাষাটা শিখতে চান। আমরা সাজেস্ট করলাম সদ্য প্রকাশিত রাজা চক্রবর্তীর দ্বিতীয় ছড়ার বই ‘পাঁচফোড়ন’। উনি বসে পড়লেন কয়েক পৃষ্ঠা। নিয়ে নিলেন, সঙ্গে আরও কিছু বই। কেবল বাংলা শিখবেন বলে।
৬. আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ দশটি বইয়ের নাম বলতে বললে কোন দশটি আসবে?
উত্তরঃ বাংলা এবং ইংরেজি মিলিয়ে অবশ্যই এই দশটি বই,
১। নাচের ছেলে (এক সমকামী মানুষের আত্মকথা) ২। শব্দশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ (প্রবন্ধ) ৩। চা-বাগানের গল্প (গল্প সংকলন) ৪। মায়া অরণ্য (রহস্য সিরিজ) ৫। সেথায় চরণ পড়ে তোমার (উপন্যাস) ৬। Quesadilla and Other Adventures: Food Poems ৭। Rituals (Poetry) ৮। Reels: 25 movies from the dress circle ৯। The Inevitable Zero (non-fiction) ১০। Birdsongs of Love & Despair (stories from Varanasi)
৭. বই পড়ার অভ্যাস বাড়ানোর জন্য প্রকাশকদের শুধু বিজ্ঞাপন ছাড়া বিকল্প পথ ভাবা জরুরি? সেটা কী হতে পারে? এই প্রেক্ষিতে প্রকাশকদের একসাথে কাজ করাটা কতটা জরুরি?
উত্তরঃ দেখুন তথাকথিত বিজ্ঞাপনের বাইরে আপনি যাই ভাববেন সেটাও কিন্তু একটু অন্য ধরনের বিজ্ঞাপনই হবে। তবে আমাদের এবার নতুন পথে আসা উচিত। নতুন বইয়ের খবর আমরা কিছুটা লিখে প্রচ্ছদসহ প্রকাশ করি, মানে বিজ্ঞাপন করি কিন্তু সেই প্রমোশনাল লেখাগুলোর ওপর ভরসা করে লোকে কিনতে যাবে কেন সেই বই? এবার যদি বইয়ের কিছু অংশ পেশাদার বাচিকশিল্পীকে দিয়ে রেকর্ড করে শোনানো যায় পাঠককে, বা লেখক এবং প্রকাশকের যৌথ উদ্যোগে যদি বইটির প্রি-রিলিজ অনুষ্ঠানে বইটির থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনানোর ব্যবস্থা করা যায়; কেমন হবে? পাঠক কিন্তু এখন চোখে না দেখে, কানে না শুনে কিছুই বিশ্বাস করেন না।
নতুন নতুন আইডিয়া এক্সচেঞ্জ হতেই পারে প্রকাশকদের মধ্যে। এমন অনুষ্ঠানও একসাথে করা যায়। এতে খরচ কমে। লেখকরাও এর অংশীদার। তারা কিন্তু এই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ বইটি প্রথম এবং প্রধানত তাঁর বই। বাংলা অলটারনেটিভ প্রকাশকেরা এক জায়গায় একত্রিত হলে প্রথম সুবিধা হবে বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশনে। একজন প্রকাশকের মাধমে যতটা না এলাকা কভার করা সম্ভব, যদি সেখানে দশটি সংস্থা একযোগে কাজ করেন তাহলে সেই সংখ্যাও বাড়ে। বড়ো প্রকাশকেরা কিন্তু এমনই ইউনিয়ন করে মার্কেট মনোপলি করে এসেছে এতদিন। আজও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এটাকে ভাঙতে গেলে কেবল ফেসবুক বিপ্লব নয়, মাঠে নেমে কাজ করতে হবে সকলকে একসঙ্গে।