উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৭। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
সে ছিল একদিন কাগজের কলকাতা
পেশার তাগিদে মানুষকে কত কী করতে হয়। ছোটোবেলায় গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়েছিলাম। ক্লাসঘরের জানালায় কোনও কপাট ছিল না। সেই জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম গরু মাঠের ঘাস খেতে খেতে একটা কাগজের টুকরো অবলীলায় খেয়ে ফেলল, তারপর এগিয়ে গিয়ে গেরস্ত বাড়ির সামনে দড়িতে মেলা শাড়ি অবলীলায় চিবোচ্ছে। আর ছাগল সম্পর্কে তো প্রবাদই আছে, ‘ছাগলে কী না খায়’। ছাগলে কী কী খায়, জানি না, তবে কাগজ বা কাপড় খেতে দেখিনি। তবে কাগজওয়ালারা জানে পাবলিক কী খায়! কাগজের মালিকরা, যাঁরা টাকা লগ্নি করেন, তারা কি সত্যিই জানেন? নাকি যেসব বড়ো সহনাগরিকরা, যারা কাগজের দায়িত্ব নেন, তাঁরাই মালিককে বুঝিয়ে দেন পাবলিক কী খায়। অবশ্য কিছু কিছু মালিক আছেন, যাঁরা সব জানেন। আর পাবলিককে খাওয়ানোর জন্য খড়, বিচালি, ঘাস-পাতা যোগান দেন মেঠো সাংবাদিকরা। আর যাঁরা ফ্রি-ল্যান্সার বা মুক্ত সাংবাদিক, তাঁদের তো আরও বেশি নজর রাখতে হয় পাবলিক আর কী কী খায়, সেদিকে। তা এই উড়নচণ্ডী যখন মুক্ত-সাংবাদিকতা করত, তখনই বাংলাবাজারের জনপ্রিয় খেলার কাগজ ছিল ‘খেলার আসর’। দু-একটা খেলা সম্পর্কিত খবর লেখার পর দায়িত্ব পেলাম ‘খেলার আসর’ পত্রিকার কৃষ্ণনগর প্রতিনিধির। দায়িত্ব যখন বর্তেছে, আর মাস গেলে খালি পকেটে যখন দু-চার পয়সা ঢোকার ব্যবস্থা হয়েছে, তখন সুযোগ কে ছাড়ে! এই সময়েই আলাপ হয়ে গেল ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জীবের সঙ্গে। তিনি তখন ‘আনন্দবাজার’-এ। ‘খেলার আসর’ পত্রিকাতেও লেখেন। তবে বেনামে।
আমার লেখা পছন্দ করতেন বলে একটু ভালোও বাসতেন। তা সেই চিরঞ্জীব-এর সঙ্গে নিকট সম্পর্ক তৈরি হলো ইত্যাদি প্রকাশনীর ‘নবম-দশম’ পত্রিকায় যোগ দেবার পর। খেলার আসর তো এই বাড়ি থেকেই বের হতো। আর এই বাড়ির ‘পরিবর্তন’, ‘খেলার আসর’ পত্রিকায় লিখতে লিখতেই বাড়ির দরজা দিয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে দোতলায় একটা টেবিলে বসে পড়েছিলাম। আর এখানেই দেখা পেলাম চিরঞ্জীবের, একটু অন্যভাবে। তখন তিনি ‘আনন্দবাজার’ ছেড়ে পুরোপুরি যোগ দিয়েছেন ইত্যাদি প্রকাশনীতে। ‘খেলার আসর’ পত্রিকার সম্পাদক। আগে যিনি সম্পাদক ছিলেন, সেই অতুল মুখার্জী হলেন প্রধান সম্পাদক। খেলার আসর পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গেই তিনি ‘নবম-দশম’ পত্রিকার উপপাঠ্য বিষয়টির ওপরেও নজরদারি করতেন। ওই বিভাগের দায়িত্ব এই উড়নচণ্ডীর ওপর বর্তেছিল। ফলে চিরঞ্জীবের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে এল। কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো। ক্রমশ তিনি হয়ে উঠলেন চিত্তদা। তাঁর কাছেই শুনেছি, প্রথম জীবনে তিনি চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস নামেই লেখালেখি করতেন। সেই সময়, অর্থাৎ গত শতকের পঞ্চাশের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘মাঠময়দান’ নামে সাপ্তাহিক খেলার পাতা পত্রিকায় থাকতো। চিত্তদা সেই পাতায় প্রথম লেখা শুরু করেন। সাহিত্যিক মতি নন্দী ছিলেন ওই পত্রিকার ক্রীড়া সম্পাদক। তিনিই চিত্তরঞ্জন বিশ্বাসকে ‘চিরঞ্জীব’ করে দেন।
চিত্তদা ছিলেন ইত্যাদি প্রকাশনীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্তত এই রকমই রটনা ছিল। অফিসে চালু ছিল, তিনি রাশিয়ান লবির লোক। এরকম একটা প্রচার ছিল যে, এই প্রকাশনীর যিনি মালিক ছিলেন, কাগজে কলেম চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টার, তিনিও নাকি সিপিআই করতেন এক সময়। এজন্যই বোধহয় প্রকাশনীতে বামপন্থী মানসিকতার লোকের আধিক্য ছিল। চা চিত্তদার সঙ্গে যে রাশিয়ান লবির কোনো একটা যোগসূত্র ছিল, তা টের পাওয়া যেত, যখন তিনি বাম শাসিত দেশগুলিতেই বেশি ভ্রমণ করতেন। সেইসব দেশের খেলাধুলো নিয়ে বেশি লিখতেন।
ইত্যাদি প্রকাশনীতে যোগ দেওয়ার আগে, বিভিন্ন কারণে আমাকেও রাশিয়ান দূতাবাসে যেতে হতো। বিশেষ করে প্রকাশনা বিভাগে। ওখানেই আলাপ হয় সত্যেন সেনের সঙ্গে। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। তিনি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড’ কাগজেও ছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু তাঁর যে কী কাজ, সেটাই বুঝতাম না। তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। টেংরায় তাঁর সরকারি আবাসনেও গিয়েছি। সত্যেন সেনের সঙ্গে হৃদ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোলো যে, আমি যখন ‘খেলার জগৎ’ নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করছিলাম, সেই সময় বউবাজারে পত্রিকা অফিসে তিনি একদিন সপুত্র হাজির। বললেন, ছেলেটাকে একটু দেখো। ও ছবি তুলছে। পড়াশুনা তো তেমন কিছু করল না, দেখো ছবি তুলে যদি কিছু করতে পারে।
পরিচয় হলো ছেলের সঙ্গে। ছবি তুলে নিয়ে এসে দেখায়। সাদা-কালো। চমৎকার ছবি। তারে পাঠালাম ‘আজকাল’ পত্রিকায়। ওখানে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল। দু-চারদিন পর তার ছবি বের হলো। আবার, আবার। বেশ নাম করল। অরণ্য সেন চিত্রসাংবাদিক নামে পরিচিত হয়ে গেল। এক সময় ‘খেলার জগৎ’ বন্ধ হয়ে গেল নানা জটিল কারণে। তার কিছুদিনের মধ্যে যোগ দিলাম ইত্যাদি প্রকাশনীতে। অরণ্যর সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল, কিন্তু তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগটা রয়েই গেল। নানা প্রয়োজনে রাশিয়ান দূতাবাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হতো।
(ক্রমশ)