উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১৬। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
সিনেমাপাড়ার বর্ণিল মানুষেরা
সিনেমাপাড়ায় যখন ঘোরাঘুরি করছি, তখন তো বহু মানুষের সঙ্গে পেশার কারণেই আলাপ হয়েছিল। কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যেমন হয়, তেমনি কারো কারো সঙ্গে আলগা বন্ধুত্বও হয়। কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষ এই পাড়ায় যাতায়াত করে প্রতিদিন। কারও স্বপ্ন ভাঙে, কারও স্বপ্নপূরণ হয়। সকলকে মনেও থাকে না। মনে রাখার দায়ও নেই। তবুও পুরনো ছবি দেখতে দেখতে কত জনের কথাই তো মন পড়ে যায়। কতদিনেরই বা আলগা তাদের সঙ্গে, তবুও তাদের সান্নিধ্যই বা কম কীসের। যেমন আনন্দদা। আনন্দ মুখোপাধ্যায়। প্রৌঢ়ত্বেও সৌন্দর্য ধরে রেখেছিলেন শরীরে। মুখে ভাঁজ পড়তে দেননি। সুঠাম চেহারা। আটের দশক পর্যন্ত প্রায় ছবিতেই তাঁর উপস্থিতি ছিল। কিন্তু ওই যে, পার্শ্বচরিত্রে ক্ষণিকের অতিথি। শেষের দিকে দু-চার দৃশ্য ছাড়া তাকে দেখা যেত না। কিন্তু তাতেও কুছ পরোয়া নেহি। উত্তমকুমারের যুগে মহানায়কের প্রায় সব ছবিতেই তাঁকে দেখা যেত। তবে বেশ কিছু ছবিতে একটু বড়ো চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। সুদর্শন এই মানুষটি ছিলেন মজারু। উত্তমকুমারের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফলে চায়ের দোকানের আড্ডায় (হ্যাঁ, টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর কাছে একটি নির্দিষ্ট চায়ের দোকানে আমরা কয়েকজন বসতাম, সেই দোকানে তিনি আসতেন।) আনন্দদা উত্তমকুমারের রসিকতার গল্প বলতেন। তার মধ্যে অনেক স্থূল বিষয়ও থাকত। সত্য-মিথ্য জানা না থাকায় সেসব আর উল্লেখ করছি না।
কোনও অন্ধকার ছিল না মানুষটার। সকলের সঙ্গে সহজ সরল সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন। একদিন বলেছিলেন, নায়ক যে হইনি এমন নয়। দু-একটা ছবিতে নায়কের কাজ করেচি তো। উত্তমদার সঙ্গে অভিনয় করা তো কম কথা নয়। সমান্তরাল চরিত্রেও অভিনয় করেছি। ভিলেন করেছি। আবার কী চাই? এই তো জীবন। এমনই ছিলেন আনন্দদা। সেই আনন্দদা মারা যাওয়ার পর মধ্যশ্রেণীর দৈনিকে পাঁচ লাইনে ঠাই পেয়েছিলেন। তার পর বাঙালি যেমন বিস্মৃত হয়, তেমনই বিস্মৃতির পাতায় তিনি আজ।
এই চায়ের দোকানেই প্রতি সন্ধ্যায় আসতেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সত্তরের মাঝামাঝি ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ বাংলা ব্যান্ড করে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ব্যান্ড যখন বন্ধ হলো, তখন তিনি সিনেমা নিয়ে মাতলেন। তার আগে শিক্ষানবিশী করলেন ‘চিত্রবাণী’তে। চলচ্চিত্রের পণ্ডিত ফাদার গাঁস্তো রবেজ ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। যখন আলাপ হলো তার সঙ্গে কখন তিনি ‘নাগমতি’ ছবি করছেন। প্রতি সন্ধ্যায় চলছে আড্ডা। টাকিতে শুটিং হলো। সেখানেও গেলাম। সে ছবিতে নিজেই সংগীত পরিচালনা করলেন। ছিলেন জাত বোহেমিয়ান। বেশ মনে আছে যখন নাগমতির কাজ নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত, তখন তার পুত্র জন্মায়। একজিন সখেদে বললেন, এখনো ছেলের মুখ দেখিনি। কাজের এত চাপ ছিল যে, তার নবজাত সন্তানকে দেখতে পারেননি। এরকমই কাজের মানুষ ছিলেন তিনি। পরে আরও একটা ছবি করেছিলেন। বাজার পাননি। তার জীবনের শেষের দিকে আবার ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। সেই সময় কিছু লেখালেখিও করছিলেন। কলেজস্ট্রীটে অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ে বেশ মেতে ছিলেন তিনি।
গৌতম চট্টোপাধ্যায় ‘নাগমতি’ করার সময় তার সহকারী ছিলেন বাপিদা। বাপী ব্যানার্জী। টালিগঞ্জে নির্ভরযোগ্য সহকারীদের অন্যতম। তিনি নিজে ছবি করেননি, অন্যের বহু ছবি করে দিয়েছেন। একদা পার্থপ্রতিম চৌধুরীর সহকারী ছিলেন। নিজে ভালো অভিনয় করতেন।। একসময় নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করতেন। সিনেমাপাড়ায় আসার পর আর নাটক তেমন করা হয়ে ওঠেনি। কত পরিচালকের চিত্রনাট্য সিনেমা-উপযোগী করে দিয়েছেন তিনি। সেই সময়ে, মানে আটের দশকে সৈকত ভট্টাচার্য নামে এক পরিচালক এসেছিলেন ছবি করতে। তিনি মূলত জার্মান টিভির জন্য ছোটো ছোটো ছবি বানাতেন। জার্মান ভাষা ভালোই জানতেন। তখন বামফ্রন্টের তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী প্রভাস ফাদিকর। তার আমলে ঠিক হয় সরকারি সাহায্যে ছোটো ছোটো ছবি করে, দুটো ছবি এক সঙ্গে প্রদর্শন করা হবে। ছবি করলেন গৌতম ঘোষ, জোছন দস্তিদার সহ বেশ কিছু নতুন পরিচালক। সৈকত ভট্টাচার্যও ছবি করার টাকা পেয়েছিলেন। সেই ছবির মুখ্য সহকারী ছিলেন বাপীদা। স্টুডিওপাড়ায় কানাঘুষো ছিল, চিত্রনাট্যটা বাপিদাই লিখে দিয়েছেন। পরের ছবি ‘দুলিয়া’। আদিবাসী পরিবারের কাহিনী। ছবিটি বোধহয় কিছু পুরস্কারও পেয়েছিল। এই ছবির প্রধান সহকারী ছিল বিষ্ণু পালচৌধুরী। মেদিনীপুরে আউটডোর শুটিংয়ে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। সৈকতবাবুর সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। তার বাড়িতেও গিয়েছি বার দুয়েক। নিঃসন্তান পরিবার। তার শেষ ছবি (নাম মনে নেই) নিয়েও লিখেছিলাম। অকস্মাত তিনি চলে গেলেন। নিঃশব্দে।
এই যে নতুন এক ঝাঁক পরিচালক এলেন, এদের মধ্যে ছিলেন রাজা মিত্র। কবিতা লেখেন, সিনেমা বানান, একটি সরকারি চলচ্চিত্র শিক্ষায়তেন পড়ান– এমনই শুনেছি। প্রথম ছবি করলেন ‘একটি জীবন’। বুদ্ধদেব বসুর কাহিনী, অভিদান রচয়িতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনে। আঞ্চলিক ভাষায় প্রথম চলচ্চিত্রকার হিসেবে তিনি ইন্দিরা গান্ধি পুরস্কার পান। এই ছবির শুটিংয়ে হাজির তেকেও তার কাজ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চরিত্রে। একবার শুটিংয়ের ফাঁকে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নাকি পরিবারের সকলকে নিয়ে একটা সিনেমা করার পরিকল্পনা করছেন?
উনি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, সিনেমা নয়। নাটক করব ঠিক করেছিলাম। সেটা আর হবে না।
কথাটা বলেই চুপ করে গেলেন। এক গাছতলায় বাঁধানো চাতালে একা বসে আছেন। বুঝলাম, তিনি অভিনীত চরিত্রের মধ্যে ঢুকছেন। অনতি বিলম্বে ডাক পড়লো পরবর্তী শট দেওয়ার জন্য। তিনি ধীর পদে উঠে গেলেন।
এর আগে-পরেও দু-একবার কথা হয়েছে শুটিংয়ের ফাঁকে। যেদিন জেনেছিলেন এই উড়নচণ্ডী কৃষ্ণনগরের নাগরিক, সেদিন থেকে একটু অন্য চোখে দেখতেন। এক বিকেলে কোনও একটা শুটিংয়ের শেষে ফ্লোরের বাইরে চেয়ারে বসেছিলেন। সেবার কবিতা নিয়ে, এক্ষণ পত্রিকা নিয়ে দু-চার কথা হয়েছিল। বললেন, আমি তো সময় দিতে পারছি না। নির্মাল্য একাই যতটা পারছে করছে।
সিনেমাপাড়ায় এমন কত মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, যাঁদের পরিমাপ করা সহজ নয়। বাংলা সিনেমায় তেমন কদরও হয়তো পাননি। কত ভালো অভিনেতা উপযুক্ত চরিত্র না পাওয়ায় সিনেমাপাড়া ছেড়ে দিয়েছেন। এজন্যই বোধহয় অভিনেতা সুনীল মুখার্জী দেখা হলেই বলতেন, বাবু ধরতে বেরিয়েছি। বুঝলে, প্রতিদিন একবার করে আসি। বাবু ধরি, যদি একটা কাজ দেয়। আমার তো ছোটোখাটো পার্ট হলেও চলে। পার্ট না করলে খাবো কী?
একবুক হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দিলেন সুনীলদা। তাঁর মতো কত গুণী শিল্পী হতাশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে টালিগঞ্জের বাতাস ভারী করে তুলছে, তার কতটুকু আমরা জানি!
(ক্রমশ)