সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

নেলি
জেনকে অনুসরণ করে, নেলির গল্পটা আরো একটু বিশদে বলা যাক। হোমের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য দিশি মেয়েদের(এবং মায়েদের) কথা জানবার উপায় নেই, তামাম বিশ্বব্রহ্মান্ড থেকে এঁরা পুরোপুরি মুছে গিয়েছেন, কোথাও তাঁদের অস্তিত্বের রেখামাত্র নেই। যা যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, বলি। নেলির গল্প আসলে তো শুধুই একজন খাসি মহিলার নয়, যাঁর ছেলেরা হোম থেকে নিউজিল্যান্ড গিয়েছিলো। সাম্রাজ্য ও রাজধর্ম যাঁদের অচ্ছুৎ, অপবিত্র এবং বদ রক্তের ধারক মনে করতো, যাবতীয় নথি ও ইতিহাস থেকে হিসেব কষে যাঁদের মুছে ফেলা হয়েছিলো, সেই সব নামহীন পরিচয়হীন মুখহীন মেয়েদের সবাইকার।
আরো বহু বহু সাহেবের মতো, মর্টিমার দিশি বৌ, ছেলেমেয়ে ও চা বাগান ছেড়ে দেশে ফিরলেন। নেলি পড়লেন অকূল পাথারে। ১৯১৬ সাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে, হোমে টাকার টানাটানি, চেরাপুঞ্জির মিশন থেকে গ্রাহামকে চিঠি দিচ্ছেন সেখানকার এক ওয়েলশ পাদ্রীর স্ত্রী, অ্যানি জোন্স। অস্থির সময়ে হোমে নতুন আবাসিক পাঠাতে চাইছেন, সেকারণে দুঃখপ্রকাশ করে অ্যানি লিখছেন:
দুইটি শিশু রহিয়াছে, ইহাদের মাতা জাতিতে খাসি…শিশুদের পিতা পাঁচ বৎসর পূর্বে ফার্লোতে যাইবার পর, মাতাটি নিজ গৃহে ফিরত আসে, এবং খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবে আপন ব্যভিচারী জীবন প্রত্যাখ্যান করিয়া চরচে যোগ দেয়। ইহার পরিবার খুবই দাম্ভিক, এবং খৃষ্টধর্ম বিরোধী। নিজ পরিবারের সম্মান রক্ষা করিয়া জীবন নির্বাহ করিবার উপযুক্ত সংগতি নাই, শিশুপুত্রদের অন্য কাহার কাছে রাখিয়া বাহিরে কর্ম করিবার উপায়ও নাই।… বারম্বার উপরোধ করা সত্বেও শিশুদিগে কালিম্পং পাঠাইতে সে রাজি হয় নাই। বর্তমানে উহার কাছে মাত্র কয়েক মাসের খরচা অবশিষ্ট রহিয়াছে…শিশুদের পিতার সহিত উহার পত্রাচার চলিত জনৈক রেভরন্ড জে হোয়াইটের মাধ্যমে, কিন্তু ১৯১৫-য় শেষ পাঁচশত টাকা এককালীন দিয়া ইস্তক সে এই বিষয়ে আর কোনরূপ দায়িত্ব নিবে না বলিয়া দিয়াছে, মাতাটি উহা মানিয়া লইয়া কাগজে সহি করিয়া দিয়াছে।…(ফলে) যদিও সে বলিতেছে ছেলের খরচা বাবদ হোমে প্রতি মাসে ২-৩ টাকা করিয়া পাঠাইবে, মেয়ের ও গৃহের খরচা চালাইয়া কি করিয়া তাহা সম্ভব হইবে, জানা নাই।…অবশ্য যদি উহার দুই সন্তানকেই হোম যদি গ্রহণ করে, ইহা সম্ভব এবং কচ্চিৎ কখনো ৪-৫ টাকাও সে পাঠাইতে পারে…
১৯১৭-র গোড়ায়, অ্যানি জোন্স আবার চিঠি লিখছেন হোমে, নেলি তাঁর বাচ্চাদের নিয়ে নিজেই কালিম্পং পৌঁছবেন, সে সংবাদ জানিয়ে। এরকম ঘটনা যে সচরাচর ঘটে না, অ্যানি সে বিষয়ে অবহিত ছিলেন, মনে হয়। গ্রাহামকে নেলির জন্য কয়েক রাতের বাসস্থল ঠিক করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলছেন:
উহার পক্ষে বিষয়টি খুবই কঠিন ও হৃদয়বিদারক, কেননা মাতারূপে সে সন্তানদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ…ভাবিয়া আশ্চর্য লাগে যে কি সাহসে আপন সন্তানদের ছাড়িয়া দিতে ও সম্মত হইলো। উহার পরিবার খুবই সম্ভ্রান্ত, এবং আপন পূর্ব জীবনের পদবিক্ষেপ সত্ত্বেও, ও একজন সাধারণ কুলি মহিলার মতো কদাপি নহে। ইহা বলিলাম যাহাতে আপনি উহার পক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি নির্দিষ্ট করিতে পারেন।…উহার আশা, যথোপযুক্ত রোজগার করিয়া কখনো আপন সন্তানদের ছুটি চলাকালীন নিজের কাছে নিয়া রাখিবে…আপনি এ বিষয়ে সম্মতি দিতে দ্বিধা করিবেন না, উহার গৃহ সর্বপ্রকারে পরিষ্কার ও সম্ভ্রান্ত।
কা নগেলবু ওরফে নেলি রীতি ভেঙে হোমের বেড়া বসানো চৌহদ্দিতে ঢোকেন, নিজের বাচ্চাদের নিজেই ভর্তি করেন। এদের ভবিষ্যত কর্মস্থল কোথায় হবে, ভর্তিফর্মে সেই কথা লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া’।
এই ঘটনার একশো বছর পর, নিজের শিকড় খুঁজতে কালিম্পং পৌঁছচ্ছেন জেন ম্যাকেব, অবাক হয়ে দেখছেন, প্ল্যান্টার সাহেবের বাংলো, নিজের সম্ভ্রান্ত খাসি পরিবার, স্ব-ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ, এই সব আলাদা আলাদা পৃথিবী ও পরিসরের মধ্যে অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই মহিলা, বাচ্চাদের নিয়ে একা একা কালিম্পং চলে আসছেন, অন্য কারুর জিম্মায় ছাড়ছেন না। সেসময়ের খাসিসমাজ মাতৃঅনুসারি, মেয়েরা অনেক কিছু করে ফেলতে পারতেন, হয়তো সেই সামাজিক অধিকারবোধ ও সাহস নেলির ভিতর সঞ্চারিত হয়েছিলো, হয়তো আর্থিক দুরবস্থা তাঁকে হোমের শরণাপন্ন হতে বাধ্য করেছিলো। হোম কর্তৃপক্ষ তাঁকে থাকতে দিয়েছিলেন, নিজের পরিচয়ে তাঁর বাচ্চাদের ভর্তিও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে কিছু এসে যায়নি, নেলির ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তাঁকে না জানিয়েই তাঁর বাচ্চাদের সাগরপাড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
হোমের ফাইল থেকে নেলির একখন্ড ছবি উদ্ধার করেছেন জেন। অন্য ছবির কোনা কেটে বের করে আনা সেই একটুকরো ছোট্ট সাদাকালো ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নেলির মুখ, তাঁর বিমর্ষ শংকিত চোখ। জেন জানতে চাইছেন, তাঁর সঙ্গে আমরাও, কি দেখছেন নেলি, কি বলতে চাইছে তাঁর বাঙময় চোখ?
(ক্রমশ)