অকূলের কাল। পর্ব ৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

ব্র্যাকেটের বাইরে মনোজিৎদার অক্ষরবাস  

কাকুর এখন মনোজিৎদাকে দরকার। ক্ষিতির লেখা তার যদি ভালো লাগে, তাহলে নিশ্চিন্ত হয় কাকু। এখন আর কথাবার্তা শুনে আন্দাজ নয়, পরিষ্কার জেনেছে মনোজিৎদা নিজেও অসাধারণ লেখে, যদিও সে কবিতাই বেশি লেখে। কাকুর দৌড় অবশ্য জীবনানন্দ পর্যন্ত, তাঁর চাইতে আধুনিক কবিদের লেখা খুব একটা পড়েনি সে। ওই এক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – তিনি তো গল্প উপন্যাসই বেশি লিখছেন। ‘দেশ’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় বেরিয়েছিল ‘আত্মপ্রকাশ’। গড়বেতায় থাকতে পড়েছে ক্ষিতি। মেজদি পুজো সংখ্যা দেশ প্রতি বছরই কিনত। মামা আর ক্ষিতি একসঙ্গেই পড়ত। ক্ষিতি খুব তাড়াতাড়ি পড়ে কিন্তু মামার পড়া শেষ না হওয়া অব্দি পাতা উল্টানো যায় না। বেশ নতুন ধরনের লেখা, খুব খোলামেলা। কলকাতায় এসে জেনেছে সে, এই পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে শনিবার শনিবার বেরোয়। অমরশঙ্কর কেনেন। কাকু তাঁর কোয়ার্টারে রবিবার গিয়ে পড়ে আসে। গল্প থাকে, কবিতা থাকে আর থাকে ধারাবাহিক উপন্যাস। সুনীল চেনা নাম হওয়ার জন্যে তাঁর গল্প থাকলে তো পড়েই, সেই সঙ্গে তাঁর কবিতা থাকলেও পড়ে ফেলে।

মনোজিতদাকে নিজের লেখা পড়ানোর জন্য মাঝে মাঝেই তার রুমে যাচ্ছিল কাকু, কিন্তু সুবিধে হচ্ছিল না। তাকে খাতা দিলেই বলে, – ওরে বাবা! হাতে লেখা এত বড়ো লেখা – ও আমি পড়তে পারব না। তারপরেই সে নানারকম গল্প শুরু করে দেয়। কাকুও সেই গল্পে মজে যায়। গল্প বেশির ভাগই যৌনতা ও যৌনকলাপের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের দিকে চলে যায়। ক্ষিতির অভিজ্ঞতার সঙ্গে খানিকটা মিল থাকলেও মনোজিৎদার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। মেয়েদের যৌন-মনস্তত্ত্বে তার অনেক জ্ঞান। ক্ষিতিও যৌনবিজ্ঞানের পত্রিকা পড়েছে কিছু, কিন্তু সে তখনও ফ্রয়েড, ফুকো, হ্যাভলক এলিসের নাম শোনেনি। মনোজিৎদার কাছে প্রথম শুনল। কেবল মনস্তত্ত্ব নয়, মেয়েদের শারীর সুখের কেন্দ্রগুলি, তাদের অর্গাজমের তীব্রতা বিষয়েও তার গভীর জ্ঞান।

এইসব চলতে চলতেই কাকু ক্রমশ মনোজিৎদার অন্য এক পরিচয় আবিষ্কার করে ফেলল। তার হিসাবশাস্ত্রের মোটা মোটা বইয়ের আড়াল থেকে বের করে ফেলল ছোট আকারের বেশ কিছু পত্রিকা – কয়েকটা খুবই শীর্ণ, কয়েকটা বইয়ের মতো মাঝারি আকারের, কৃত্তিবাস, কৌরব ইত্যাদি নাম। তাতে বেশির ভাগই কবিতা, প্রতিটিতেই মনোজিৎ দাশের কবিতা আছে। একই পত্রিকায় সুনীল এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো নামী কবিরও কবিতা আছে। মনোজিৎদার কয়েকটা কবিতা পড়ে দেখল কাকু। ঠিক সুনীলের মতো না হলেও আবছাভাবে মনে হলো যেন একই গোত্রের। আধুনিক কবিতা তেমন না বুঝলেও তার মনে হলো মনোজিৎদা খুব এলেবেলে কবি নয়। আর এই সব পত্রিকা – ক্ষিতির দেখা ‘দেশ’, ‘অমৃত’, ‘নব কল্লোল’ ইত্যাদি পত্রিকার মতো নয়, একেবারেই আলাদা চরিত্রের। কাকু যখন মনোজিৎদার দিকে খানিক মুগ্ধতা, খানিক বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে, তার মুখে স্মিত হাসি। কিচ্ছু বলছে না। নিজের প্রতি একটু করুণা হলো কাকুর, সে কিনা নিজেকে বড় লেখক ভাবছিল! আর এই মনোজিৎদা কবিতা লেখে, তার কবিতা এত এত পত্রিকায় ছাপা হয়, কিচ্ছুটি বলেনি কাউকে! ক্ষিতি একেবারে গোড়ার দিকে দু-চারটে কাঁচা ধরনের কবিতা লিখেছিল বটে, তার পর তো পুরোপুরি গল্পের মধ্যে সেঁধিয়েছে। তার পড়াও মূলত গল্প-উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ, কবিতা খুবই কম পড়ে, ‘দেশ’-এর কবিতাগুলো পড়ে কিন্তু সব বুঝতে পারে না। না বুঝলেও কিছু কিছু কবিতা বেশ লাগে। মনোজিৎদা কাছের মানুষ বলেই কি-না কে জানে, তার কবিতাগুলো বেশ ভালো লাগল। কিছু কিছু কবিতা যৌন-অনুষঙ্গে ভরপুর। একটা কবিতার নাম ‘পর্নোগ্রাফির পাতায় চলে যাচ্ছো, মেয়েরা’। পর্নোগ্রাফি কী – নিদর্শন সহ বুঝিয়ে দিল মনোজিৎদা। তার বিছানার তলা থেকে একটা পাতলা বই বের করল। ইংরাজিতে লেখা, মাঝে মাঝে নগ্ন নারী-পুরুষের সঙ্গমরত ছবি। দু-চার পাতা পড়েই শরীর গরম কাকুর, বুঝল সেই যে বোর্ডিং-এ বঙ্কিম তাকে দেখিয়েছিল বাংলায় লেখা চটি বই, যেটা পড়তে পড়তে তার গা গুলিয়ে উঠেছিল – অনেকটা সেরকমই এই বই; তবে সেখানে যেসব শব্দগুলো তার বিবমিষা জাগিয়েছিল, এখানে হয়তো তেমনই সব শব্দ আছে, কিন্তু সেগুলো ইংরাজিতে লেখা, তার কাছে অপরিচিত বলে তেমন খারাপ লাগছে না। মনোজিৎদা মুচকি হেসে বলল, এইসব অক্ষরই আমার শয্যাসঙ্গি।

কাকুর মন মেনে নিল, লেখক হিসাবে মনোজিৎদা তার উপরের স্তরে আছে। সে তো জানতই না ‘দেশ’ ‘অমৃত’–র বাইরেও ভালো ভালো পত্রিকা আছে। মনোজিৎদা বলল, এগুলোকে বলে লিটল ম্যাগাজিন, সংক্ষেপে লিটল ম্যাগ। শুনতে ছোট পত্রিকা হলেও এগুলো সাহিত্যের আঁতুড় ঘরও বটে, মন্দিরও বটে। এমন অনেক ব্যতিক্রমী এবং দুর্দান্ত প্রতিভাধর লেখক আছেন, যাঁরা লিটল ম্যাগের বাইরে লেখেনই না। কমলকুমার মজুমদার বলে তেমনই একজন সাহিত্যিকের নাম বলল মনোজিৎদা। তাঁর গদ্যের কাঠামো এমনই যে সাধারণ পাঠক পড়ে হিমশিম খায়।

কাকু নিমেষেই মোহিত, ঠিক করল উপন্যাসটা শেষ হলে সে কবিতা লেখার চেষ্টা করবে আর মনোজিৎদার গদ্যভাষা অনুসরণ করে, পারলে দু-একটা গল্প। তার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, ওই ইংরাজি অক্ষরকে সঙ্গে নিয়েই সে বিছানায় শোবে। মনোজিৎদা জানিয়েছে, মেট্রো সিনেমার ফুটপাথে একটা লোক পুরনো বইয়ের পশরা সাজিয়ে বসে। তার কাছে মিলবে এইসব বই। কিনতে হবে না, পাঁচ টাকা জমা রেখে বই দেবে, এক মাস পর্যন্ত রাখা যাবে। তার মধ্যে যেকোনো দিন বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নেওয়া যাবে। ভাড়া মাত্র এক টাকা। বই নেওয়া বন্ধ করতে চাইলে জমা টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু যাকে তাকে বই দেবে না। পরিচিত কাউকে সঙ্গে চাই। একদিন মনোজিৎদার সঙ্গে গিয়ে পরিচয় সম্পন্ন করে এল কাকু।

এই ব্যাপারটা দুজনের মধ্যেই রাখা ভালো, মনোজিৎদা তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। কাকু অবশ্য ঠিক করল, দিনু শচি জানলেও ক্ষতি নেই কিন্তু অভীকের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেই হবে এসব বই। সে কাকুর ব্র্যাকেটের তত্ত্বাবধায়কই কেবল নয়, স্বনিযুক্ত নীতিশিক্ষকও। তাস পর্যন্ত সে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে কেবল ব্র্যাকেটে প্রবেশাধিকার লাভের জন্য। এরপর আরও নিম্নগামিতা দেখলে সে ক্ষেপে যেতে পারে। তাতে ব্র্যাকেটের সমূহ সর্বনাশ। তত্ত্বাবধায়ক ব্র্যাকেটের অর্থসংকট সামলে রেখেছে। তাদের নিত্য অভাব শুনতে শুনতে ক্ষেপে গিয়ে একদিন বলল, তোদের বাড়ি থেকে যার যা টাকা আসবে সব আমার কাছে জমা দিয়ে দিবি। আমি ধোঁয়াখোরদের মাসে দশ টাকা আর অন্যদের পাঁচ টাকা করে দেব। বাকি সমস্ত খরচ আমার দায়িত্ব। হস্টেলের সিট-রেন্ট, মেস-চার্জ, কলেজের ফি – সব। সিনেমা দেখা বা কোথাও ঘুরতে গেলে আমার সঙ্গে গেলে ভালো, সব খরচ আমার। আমার অমতে কোথাও গেলে আমি জানি না, বিপদে পড়লে কোনো শালা তোদের বাঁচাতে আসবে না।

সবাই এক পায়ে খাড়া। সেদিন থেকে কাকুর ব্র্যাকেটের সর্বসম্মত গার্জেন অভীকই। কলেজের দূরত্ব কাকুরই সামান্য বেশি। তাও এমন নয় যে বাসে-ট্রামে চাপতে হবে। কাকুর হেঁটে যেতেই ভালো লাগে। আর জয়পুরিয়া গলিপথে হেঁটে গেলে সাত-আট মিনিটের বেশি লাগে না। হস্টেলে দু-বেলার মিল ছাড়াও সকাল বিকেল টিফিনের ব্যবস্থা। লুচি-ছোলার ডাল, চিড়ে-নারকেলকোরা আর মুড়ি-চানাচুর – এই তিনরকমের টিফিনই ঘুরেফিরে দেওয়া হয়। কাজেই খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত খরচ হওয়ার কথা নয়। বাকি থাকল বিড়ি-সিগারেট আর সিনেমা দেখা। সিনেমায় বা কোথাও ঘুরতে গেলে অভীক সঙ্গে থাকলে অন্য কারুর খরচ নেই। আলাদা কোথাও যাওয়ার তেমন কোনো গরজ এখন পর্যন্ত ব্র্যাকেটের কারোর গজায়নি। কালেভদ্রে একটু দূরের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে কাউকে কাউকে যেতে হয়। কাকু যেমন যায় শ্রীরামপুরে তার ভাইঝির বাড়িতে। তার চেয়ে তিন বছরের ছোট ভাইঝি, তার বড়দার মেজ মেয়ের বর শ্রীরামপুরের একটা হাই ইস্কুলের শিক্ষক। শ্যামবাজার থেকে তিন নম্বর বাসে উঠলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। খরচ এমন কিছু হয় না। অভীকের পাঁচ-দশ হাতখরচের ব্যবস্থায় সবাই নিশ্চিন্তেই আছে। ব্র্যাকেটে অভীক আর অনুপম বাদে বাকি উনিশ নম্বরের চারজনই ধোঁয়াখোর। এক প্যাকেট চারমিনারের দাম উনিশ পয়সা। এক একজনের সারাদিনে চার-পাঁচটা সিগারেট হলেই কুলিয়ে যায়। সবাই ঘরে থাকলে একটা সিগারেট ভাগাভাগি করে খায়। নইলে অর্ধেক খেয়ে নিভিয়ে রেখে দেয় বাকি অর্ধেক পরের বারের জন্যে। শচিরই ধোঁয়া একটু বেশি লাগে, তবে সে বিড়ি টানতেই অভ্যস্ত। রুমমেট কেউ সিগারেট ধরালে দু-এক টান হয়তো দেয়। তবে বিড়ির ধোঁয়া না হলে ঠিক তৃপ্তি পায় না।

খাওয়ার ব্যাপারটাই মাঝে মাঝে ঝামেলা পাকায়। এক একদিন এক একজনের ভালোমন্দ খাওয়ার ঝোঁক চাপে। তাছাড়া টিফিনে হয়তো কারোর ঠিক পেট ভরল না। অথবা একই ধরনের টিফিন রোজ রোজ খেয়ে জিভে অরুচি ধরেছে। তখন লোভ সামলাতে না পারলেই হাতখরচে টান পড়ে যায়।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *