সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৮। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
শহরপত্তন: মহারাণী ভিক্টরিয়া ও ডম্বর চক
কিছুক্ষণ মাত্র। আজকের কালিম্পং-এ পুরোনো সায়েবসময়কে খুঁজে খুঁজে বার করতে হয়। আদি সায়েবি কালিম্পং অর্থাৎ পুরোনো মিশন এলাকাটিকে বেড় দিয়ে ধূসর হতকুচ্ছিত বাড়িঘর উঠেছে। গীর্জা থেকে দু পা এগুলে সরকারি হাসপাতাল, তার নোংরা, শহরের নোংরা, উল্টোদিকে রাস্তার পাশে উবুড় করে রাখা। গীর্জা থেকে যে দিকেই যাওয়া যায়, সরু গলিপথ, তার দুদিকেই উঁচু উঁচু বাড়ি। ভালো করে হাঁটা যায় না, গাড়ি করে যাওয়াও তথৈবচ। বাড়ির, লোকজনের, জমা ময়লার ভিড়ে নীলচে-ধূসর ম্যাকফারলেন গীর্জা, তার চমকপ্রদ গথিক স্থাপত্য, উপাসনা ঘরের ভেতরকার খ্রীষ্টবাণী, সবটাই কেমন চাপা পড়ে যায়।
ভেবে নেওয়াই যায়, আদি সায়েবি কালিম্পং এরকম ছিলো না। ও’ম্যালির দার্জিলিং গ্যাজেটিয়ার দেখছিলাম। বিশ শতকের গোড়ার দিকের কথা, কালিম্পং বলতেই তখন গীল্ড মিশন। ‘গীল্ড’ কেন? ও’ম্যালি বলছেন, পূর্ব হিমালয়ে স্কটদেশিয় গীর্জার যে কাজকর্ম ছিলো, তা চলতো গীর্জার আওতায় থাকা স্কটদেশের বিভিন্ন গীল্ড বা সংঘের পয়সায়। সেই থেকে গীল্ড মিশন। ও’ম্যালির জবানিতে মিশন এলাকার ঘরবাড়ির বর্ণনা শোনা যাক:
কালিম্পং-এর প্রধানতম দ্রষ্টব্য হইতেছে বাজারের উপরকার মনোরম গথিক গীর্জা, তৎসংলগ্ন সুউচ্চ ঘন্টাঘর।…গীর্জার নিকটবর্তী পর্বতোপরি গীল্ড মিশনের বিভিন্ন কুঠিসকল। তন্মধ্যে…সুসজ্জিত চর্টেরিস হাসপাতাল, চিকিৎসা মিশন গৃহ, মহিলা মিশন গৃহ ও বিদ্যালয়, স্কটদেশিয় বিশ্ববিদ্যালয় মিশন গৃহ, শিক্ষণ গৃহ ও উচ্চ বিদ্যালয়, ছাত্রাবাস ও তিব্বতী মিশন গৃহ। গীর্জার সন্মুখে গীল্ড মিশন গৃহ, ওয়েলস রাজকুমার শিল্প বিদ্যালয়। উহার নিম্নে, বাজার ইলাকায়, রাজ্যাভিষেক ঔষধ বিতরণ কেন্দ্র ও তিব্বতি শৈলীতে নির্মিত ভিক্টরিয়া স্মারক সৌধ, মহারাণী ভিক্টরিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত নয়নাভিরাম উন্মুক্ত চাতাল বিশেষ। এই সৌধের উজ্জ্বল বর্ণে মন্ডিত খিলান ও কর্নিসগুলি সিখিম হইতে আগত তিব্বতীয় লামারা তৈয়ার করিয়াছে…তন্মধ্যে মহারাণীর আবক্ষ ব্রোঞ্জ ধাতুনির্মিত মূর্তিখানি স্থাপিত হইয়াছে….
যে ঘরবাড়ির কথা ও’ম্যালির গ্যাজেটিয়ারে আছে, জীর্ণ লোল অবস্থায় তাদের কোন কোনটি টিকে আছে। বাড়ির সামনে ফলক বা ওই জাতীয় কিছু না থাকায়, কোন বাড়ির আদি পরিচয় কি ছিলো, বোঝা দুষ্কর। ২০১১ র ভূমিকম্পে জখম হবার পরেও গীল্ড মিশন বাড়িটা খাড়া ছিলো, যদ্দুর জানি এখনো আছে। ২৮ শয্যার পুরোনো চর্টেরিস হাসপাতাল, যেখানে কম্পাউন্ডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, তার চৌহদ্দিতে এখনকার সরকারি হাসপাতালটা চলে। বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় সেখানে নতুন চৌকো বাড়ি হয়েছে, গ্রাহাম সায়েব এবং তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন(কেট নামে সমধিক পরিচিত) যে হাসপাতালটা লম্বা সময় ধরে অল্প অল্প করে বানিয়েছিলেন, নতুন বাড়ির নতুন সময়ের জঙ্গলে সেটাকে আলাদা করে চিনে ওঠাটাও মুশকিল।
গীর্জার নিচে, তিন রাস্তার মোড়ে ও বাজারের কেন্দ্রে, ভিক্টরিয়া স্মারক সৌধটি রঙ করা কাঠের খিলান কার্নিশ ও তাদের তিব্বতি স্থাপত্য শুদ্ধ প্রায় অবিকৃত অবস্থায় আছে। কতদিন ধরে কালিম্পং-এ আসাযাওয়া, ভিড়ঠাসা ব্যস্ত পথে ছোটবড় মোটরগাড়ির ভেঁপু, ব্যস্ত বাজারের হাজার বিচিত্র আওয়াজ। সেসবের মধ্যিখানে ওই রঙীন চাতাল চোখে পড়েছে কতবার। ওই জায়গাটার নাম এখন ডম্বর চক(গোর্খা লীগ দলের আদি নেতা ডম্বর সিং গুরুং-এর নামে) রাজনৈতিক জমায়েত টমায়েত হয়, দিনরাত দেদার লোকজন ঘুরঘুর করে, পথের পাশের রেলিংয়ে, চাতালের গায়ে, ভিতরের বেঞ্চিতে, বস্তা ও দড়ির কুন্ডলি কাঁধে ফেলে কাজের প্রত্যাশায় বসে থাকেন অসংখ্য শ্রমিক। সায়েব গেলো, দেশ স্বাধীন হলো, নতুন গোর্খাদেশের দাবীতে কত আন্দোলন হলো, ঘরবাড়ি পুড়লো, কত মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেলেন, পাহাড় ঢেকে গেলো চাঁদি ও ক্ষমতার ঝনঝনে, শ্রমিকরা বসে আছেন তো আছেনই। যারা কাজ পাচ্ছেন, মাল টানছেন, কপালের ফেট্টিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা বড় বড় তক্তা, লম্বা লম্বা রড, বিশাল বস্তায় ভর্তি হরেক রকম পণ্যসামগ্রী। উঁচু উঁচু বাড়ির মাঝখানে যে গলিগুলো পাহাড় বেয়ে উঠেছে নেমেছে, সে সুড়ঙ্গে গাড়ি ঢোকে না। ডম্বর চকে বসে থাকা শ্রমিকরা সেখানে মাল পৌঁছে দেন, দিতেই থাকেন। এ অবধি জানা ছিলো, দেখা ছিলো। কে জানতো এই এতকিছুর মধ্যে মহারাণী ভিক্টরিয়া স্বয়ং বসে আছেন, নষ্ট হয়ে যাওয়া সায়েবসময়ের ভুতুড়ে স্মারক হয়ে?
ভিক্টরিয়া আছেন এবং নেইও। অনেক ভেবেটেবে, স্মৃতির ভাঁড়ার তোলপাড় করে ফেলেও, ডম্বর চকের ত্রিসীমানায় মহারাণীর মূর্তির কথা মনে পড়লো না। চাতালের মাঝখানে একটা যেমনতেমন বেদির ওপর ডম্বর সিং গুরুং-য়ের আবক্ষ মূর্তি। নিতান্তই সাদামাটা, এলেবেলে। কোথায় সেই সাম্রাজ্যগরিমা, রাজবৈভব, তেজ, শান শওকত? কোথায় মহারাণী?
দেখা গেলো, মহারাণী বিলীন হয়ে জাননি, কাছাকাছিই আছেন। দেখা গেলো বলছি বটে, তবে দেখাটা নিজের চোখে নয়। পুরোনো সময়ের তুলনায় এই সময়ের নিজস্ব কিছু খাস মজা বা যাকে বলে খাসিয়ত আছে। তার একটা হচ্ছে নানারকম খবরাখবর বাড়িতে বসেই অল্পায়াসে পেয়ে যাওয়া, স্মার্টফোন কি কমপিউটার, এবং নেটযোগাযোগ থাকলেই হলো। নেটে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম, শহরের এক তরুণ ভিডিওকার ডম্বর চকের ইতিহাস খুঁজতে খুঁজতে ভিক্টরিয়ার হারানো মূর্তি নিয়ে একটা ছোট খবর করে ফেলেছেন। তাঁর করা ভিডিও ছবিতে ডম্বর চকের চিরচেনা চেহারাটা দেখা তো গেলোই, হারিয়ে যাওয়া রাণীমূর্তির সন্ধানও পাওয়া গেলো। ডম্বর চক থেকে রিংকিংপং পথের দিকে গেলে, সে পথের সঙ্গে তিস্তা-শিলিগুড়ি যাবার বড় রাস্তার মোড়ের মাথায় কালিম্পং থানার একতলা বাড়ি। অবাক হয়ে দেখলাম থানার মধ্যেই রাণীমূর্তিকে পালিশটালিশ করে যথামর্যাদায় নতুন করে বসানো হয়েছে। কালিম্পং থানার একশো বছর পূর্তি উদযাপন উৎসবের আগে থানার গুদামঘরে মূর্তিটার সন্ধান পাওয়া যায়। কি করে সেটা থানায় জমা হয়েছিলো কে জানে! থানার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর উৎসাহী মানুষ, তিনি খোঁজটোজ নিয়ে জানতে পারেন, মূর্তি আদতে মহারাণী ভিক্টরিয়ার, এবং তার আদি নিবাস ডম্বর চক, যার আদি নাম মহারাণী চক। ভিডিওতে পরিষ্কার করে বলা নেই, কিন্তু সম্ভবত ১৯৮৬-৮৭-র প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় রাণীমূর্তি উৎখাত করে ডম্বরমূর্তি বসানো হয়, চকের নামও বদলে যায়। গোর্খাল্যান্ডপন্থী নেতারা কোনকালেই বড় একটা সায়েববিরোধী ছিলেন না। অথচ তাঁদের জমানায় সায়েবি আমলের ঘরবাড়ি চিহ্ন যেমনতেমন করে নষ্ট করা হয়েছে বেশি। পাহাড়ের সর্বত্র যেমন, কালিম্পং-এও।
(ক্রমশ)