রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৪। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য
সোনামুগের ডাল
ছোটখাটো ছুটিছাটায় বা শনিবারের বিকেলে আমরা মাঝেসাঝে টুক করে ঘুরে আসতাম মাসির বাড়ি। আর ছুটি একটু বড় হলে দুদিনের জন্য মামাবাড়ি। তার মধ্যে ভাইফোঁটা পয়লা বৈশাখ পিঠে পার্বণ বা শীত-গরমের ছুটিতে দুতিন দিনের জন্য মামাবাড়ি তো যেতামই। এই বেড়াতে যাওয়ার সাথে সাথেই আমার দিদা মাসি আর মামীদের রান্নাঘরের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। দিদা দুই মাসি আর ছয় মামী, মোট নয় জন। এর মধ্যে দুই মাসির বাড়ি আলাদা, ফলে রান্নাঘর আলাদা। মামাবাড়িতে প্রথমদিকে ছয়মামা একহাঁড়িতে থাকলেও পরে তা আবশ্যিকভাবেই আলাদা হয়। ছোটমামা মেজমামা ন’মামা এরা মামাবাড়ি থাকলেও এঁদের হেঁসেল আলাদা হল, তখন আমি ক্লাস ওয়ান বা টু এ পড়ি। বড়মামা সেজমামা ও দিদা একহাঁড়িতে থেকেছেন দিদার মৃত্যুর আগে অবধি। ফুলমামা চাকরীসূত্রে বাইরে থাকতেন বিয়ের আগে থেকেই। ফলে কিছুদিন পর, মামাবাড়িতে তিনটি হেঁসেল হল। দিদার চলে যাওয়ার পর চারটি। সবগুলির কথাই বলবো, তবে ছয়মামা যখন একসংসারে ছিলেন, সেই সময়ের রান্নাঘরের গল্প আগে বলে নেবো।
দিদার ছয় ছেলে ছয় বৌমা, তাদের মোট ১২ জন নাতিনাতনি, যারে কয় ভরা সংসার। এদিকে মেয়ের ঘরেও নয় নয় করে আরো দশজন নাতিনাতনি। উৎসবে অনুষ্ঠানে হইহই রইরই যজ্ঞিবাড়ি। এতজন মানুষের রান্নাবান্না সামান্য কথা নয়। উৎসব অনুষ্ঠান ছাড়া তখন প্রতিদিন তখন ২২ জন মানুষের পাত পড়ত। সেটাও বেশ বড় ব্যাপার। এর মধ্যে মেজোমামা ন’মামা ছোটমামা ছোটমামী ৯ টার ট্রেন ধরতেন চাকরীসূত্রে। বড়মামা আর ছানাপোনারা স্কুল বেরোত সকাল দশটায়। বড়মামা ছিলেন ইস্কুলের হেডমাস্টার। ফলে ঝোলভাতটুকু অন্তত: সকাল দশটায় হয়ে যেত। দিদার রান্নাঘরে আমিষ নিরামিষ রান্নার দিন নির্দিষ্ট ছিল। যতদূর মনে পড়ে বৃহস্পতিবার আর শনিবার নিরামিষ, বাকিদিন মাছ বা ডিম, মাসে একবার মাংস এই নিয়মই মোটামুটি ঘোরাফেরা করতো। তখন মাংস বলতে খাসি বা পাঁঠাই আসতো, মুরগীর চল তখনো এ বঙ্গে হয় নি। এর মধ্যে দিদার একাদশী পড়ত বা বিভিন্ন ধরণের উপবাস, সেদিন আবার দিদার জন্য নিরামিষ বা রান্না না করা খাবারদাবার ইত্যাদি ব্যাপার থাকতো।
আমার মামার বাড়িটি ছিল ইংরেজি এল প্যাটার্নের। এল-এর ছোট দাঁড়ি বরাবর ছিল মামারবাড়ির আদি মাটির ঘর আর টানা বারান্দা। পরপর তিনটি মাটির ঘরের একটায় দিদা থাকতেন, মাঝের ছোটঘরটি ছিল ভাঁড়ার ঘর, আর ওপাশের আরেকটি ঘরে থাকতেন মেজদিদা। তিনি দিদার মেজো জা। আর L-এর বড় দাঁড়ি বরাবর ছিল তিনটি পাকা ঘর টানা বারান্দা, সিঁড়ি। এই ঘরে পরপর থাকতেন ছোটমামা, বড়মামা, মেজোমামা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে মেজোমামার আরেকটি ঘর ছিল, তার পাশের ঘরে ন’মামা। আর বারান্দার ঠিক মাঝখানে ছিল গোল সিঁড়ি, যেটি আমার সবিশেষ প্রিয় ছিল। তারপর উঠোন, উঠোন পেরিয়ে পুকুরের লাগোয়া জমিতে মাটির রান্নাঘর, তাতে খড়ের চাল।
এই রান্নাঘর নবান্নের আগে আগে ভেঙে ফেলা হত। এই বিষয়টা আমি জানতাম না। একবার ঐ সময় মামাবাড়ি গেছি, ভোরে উঠে দেখি রান্নাঘর নেই। আমি সবিস্ময়ে জিগ্যেস করছি এবার কোথায় তবে রান্না হবে!! এই নিয়ে সবাই আমাকে রাগাতে লাগলো। কি হবে এবার! মুনমুন কী খাবে আজ! আমার মামাবাড়ির ডাকনাম মুনমুন। তারপর ঝুনুদিদি আমাকে বসিয়ে বোঝালো, সারাবছর অনেক ঝুলকালি জমে যায় তো, তাই ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়া হবে। ততক্ষণে রান্নাঘরের বাইরে বার-উনুনে এই এত্তবড় হাঁড়ি চেপেছে, তাতে চাল চৈতে মুগ ডাল আর আলুসেদ্দ চড়ে গেছে। ওই ভাত দিদা আর মামীরা ফ্যানা ভাত করে নামিয়ে ফেলল। তারপর লোহার কড়ায় ডিমসেদ্দ বসে গেল। সেদ্দআলুগুলিকে লঙ্কাপোড়া নুন সর্ষে তেল এ মেখে ফেনা ফেনা ডালভাত আর ডিমসেদ্দর সঙ্গে খাওয়া হবে এইবার। তারপর,” সাতঘরামী মিলে চক্ষের পলকে” সেই ভাঙা রান্নাঘরকে সোনার মতো করে বাঁধিয়ে দিল। চালে নতুন খড়, দেওয়ালে নতুন মাটির আস্তর…নতুন রান্নাঘরে ঢুকে দিদা কাদামাটি দিয়ে উনুন গুলিকে নতুন করে গড়তে বসলেন।
রান্নাঘরে ছিল একটা জোড় উনুন, আর একটা একানে উনুন। সবই কাঠের জ্বালে রান্না করার উনুন। উনুনের ঠিক পাশেই ফ্যান গালার সুবিধার জন্য দুটো ইঁটের উপর মাটি লেপে একটা ড্রেনের মতো ব্যবস্থা করা থাকত। এই রান্নাঘরখানির চার দেওয়ালে একমানুষ সমান উঁচু করে মাটির প্রলেপ থাকতো, আর বাকি দেওয়াল কঞ্চি দিয়ে আড়াল করা থাকতো যাতে সহজে হাওয়া খেলতে পারে। রান্নাঘরে থাকতো এই এত্তবড় দুইখান লোহার কড়াই, ডাউস একখান মেটে হাঁড়ি। ওইপাশে এই এত্তবড় একখান শিলপাটা। রোজের মশলা একটা খোপকাটা কাঠের রেকাবিতে রোজ বেরোত ভাঁড়ার ঘর থেকে। চাল ডাল ও তাই। সকালবেলায় চানের পর ন’মামি বড়মামি মাটির বারান্দায় আনাজপাতি ধুয়ে নিয়ে কাটতে বসতেন। দিদা ততক্ষণে চালধুয়ে মেটে হাঁড়িতে বসিয়েছেন, লোহার কড়াইতে ডাল ফুটছে বগবগ করে… মাছ মাংস ইত্যাদি সব পুকুর জলে ধুয়ে পরিস্কার করে আনা হত। মাছভাজা কুটনোকোটা ইত্যাদি কাজ মামীরা করলেও দেখতাম তেল ঢেলে ফোড়ন দেওয়া আর মশলা দেওয়ার কাজটি করত দিদা। মাস্টার সেফ যাকে বলে আর কী, দিদা ছিলেন তাই। আবার কোনোদিন দিদা মশলা দেওয়ার ভার মামীদের উপর ছেড়ে দিতেন, বলতেন দাও না, আমি তো দেখছি… বাড়ির রান্নার স্বাদটিকে এইভাবেই তিনি পরের জেনারেশনের হাতে তুলে দিতেন হয়তো। বড়মামি মশলা বাটার পর অদ্ভুত উপায়ে সেটি খুন্তিতে তুলে নিয়ে দিদার হাতে দিতেন দেখতাম। সর্ষে পোস্ত বাটা হলে অবশ্য একটুকরো নারকেল পাতা দিয়ে শিল থেকে চেঁচে তুলতেন। দিদার বহু রান্নাই অসামান্য, তবে আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো এই এত বড় বড় আলুর টুকরো দিয়ে রান্না করা সুগন্ধিত হালকা মিষ্টি মুগ ডাল। কাঁসার থালায় গরম ভাতে ওই মুগডাল আর গন্ধরাজ লেবু…আহা। অমন গন্ধের মুগডাল দিদার সাথেই হারিয়ে গেল।
দিদার রান্না ঘরের মেঝে রান্নাবান্নার পর প্রতিদিন গোবর দিয়ে নিকোনো হত। রান্নাঘরে ছিল কাঁঠাল কাঠের বড় বড় তক্তার পিঁড়ে। ছয়টা তক্তা ছিল ছয়ভাইয়ের জন্য। আর আমাদের ছোটদের জন্য থাকতো খেজুর পাতার ছোট ছোট চাটাই। এই চাটাইগুলি দিদা দুপুরবেলা নিজে হাতে বুনতেন। আমার মা ও শিখেছিলেন এই চাটাই বোনা। আর সবার জন্য ছিল কাঁসার থালা ও গেলাস। মাছের ঝোল দেওয়ার জন্য একটি করে বাটিও ছিল সবার জন্য। তরকারি ঢালা হত বড় ছোট বিভিন্ন সাইজের গামলা জাতীয় পাত্রে। ছুটির দিনে কাঁঠাল কাঠের মস্ত পিঁড়ে পেতে মামারা একসাথে খেতে বসতেন, কাঁসার থালায় চূড়ো করে সাজানো ভাত, তার সাথে একটা কিছু ভাজা, বাটিতে মাছের ঝোল গেলাসে জল, এই পাশে ডাল তরকারীর পাত্র হাতে মামীরা… সে এক পরিপূর্ণ দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার ছিল। দিদাও একপাশে খুব তৃপ্তি নিয়ে বসে থাকতেন।
রাতের বেলায় ওই রান্নাঘরে একটা হলদে রঙের বাল্ব জ্বলত। সেই অদ্ভুত আলোর তলায় খেতে বসে একদিন কারেন্ট চলে গেল। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। রান্নাঘরের বাখারির জানালা ভেদ করে জোছনা এসে পড়ল আমাদের ভাতের থালায়। কী এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সে কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি সেই জোছনা লাগা ভাত মুখে তুললাম, ইচ্ছে করেই, মনে হল যেন এক গরাস জোছনা খেয়ে ফেললাম। তারপর তো সন্ধে থেকে নিবু নিবু করে জ্বেলে রাখা হ্যারিকেন চলে এল, আমরা সেই আলোয় খাওয়া শেষ করলাম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন এই যৌথ রান্নাঘরের হাঁড়ি আলাদা হল, তখনো নববর্ষ রান্নাপুজো বিজয়া এমন সব পর্বদিনে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করেছি। ছোটমামা অবশ্য এই সময়ে অন্যত্র বাড়ি করে চলে যান। ফুলমামা তো বরাবর বাইরে থাকতেন। তবু বচ্ছরকার দিনে বিশেষতঃ ১লা বৈশাখ আমরা সবাই একসাথে হয়েছি। খুব মনে পড়ে নববর্ষের দিন ভোরবেলা পুকুরে জাল পড়ত। এত এত মাছ উঠত। মামীরা সবাই মিলে একসাথে হইহই করে সেই লাফানো মাছ কুটতে বসে যেতেন। মামারা সব দিলখোলা হয়ে বাজার করছেন সেদিন। কেউ আনলেন খাসি তো কেউ চিংড়ি। কেউ মনে করে কুমড়ো ফুল সজনে ফুল কিনলেন ছোটবোনের জন্য তো কেউ আবার বাগান ঘুরে খুঁজে খুঁজে থেকে কেটে আনলেন ঠিকঠাক পুরুষ্টু এঁচোড়। মেজোবোনটা যে এঁচোড় চিংড়ি খেতে বড় ভালোবাসে! বাড়ির একটু বড় দাদারা নিমগাছ থেকে আঁকশি দিয়ে নিমপাতা পেড়ে ফেলছে। রান্নাঘরের পাশের জমিতে লঙ্কাগাছের পাশে কয়েকটি হলুদ গাছ টেনে তুললো টুসি। নিমপাতা আর হলুদ পুকুরজলে কষকষে করে ধুয়ে ঝুড়িতে তুলে রাখলেন সেজো মামী। ওগুলি বেটে সর্ষের তেল সহ গায়ে মাখতে হবে আজ। আমি ঝুনুদিদির সঙ্গে ঘুরেঘুরে টুকটুক করে সংগ্রহ করলাম পাঁচরকমের ফোটা ফুল আর পাঁচটি গাছের পাতা। এর সাথে সোনা রুপো মিলিয়ে শাঁখের ভিতর জলসহ রেখে সেইজল চানের শেষে সবার মাথায় দেওয়া হবে। বাগান ঘুরে কষি আম কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে বাচ্চু, আজ খাওয়ার শেষ পাতে আমের ঝোল ওর চাইই চাই। গোটা বাড়ি জুড়ে নিটোল ভালোবাসার হাওয়া খেলে বেড়াতো সেদিন। মামী আর মাসিরা সবাই মিলে হইহই করে দশহাতে সমস্ত রান্না করে ফেলতেন। আমরা নিম- হলুদ মেখে যথেচ্ছ ভূত হয়ে পুকুরে ঝুঁকে থাকা নারকেল গাছের গোড়া থেকে একটু উঠে ঝপাং করে ঝাঁপ দিতাম। তারপর জল তোলপাড় করে সাঁতার। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বড়মাসি ছদ্ম বকুনি দিতেন, “অনেক হয়েছে এবার উঠে আয় শীগগির!” আমরা আরো একটু লাফাঝাঁপা করে উঠে আসতাম রুনুদিদি ঝুনুদিদির কাছে। ওরা তখন শাঁখের ভিতর থেকে ফুলপাতা আর সোনারুপোর জল মাথায় ঢেলে দিত। পয়লা বৈশাখের নতুন জামা পরে আমরা দল বেঁধে যেতাম বড়দের প্রণাম করতে। মামীরা মা মাসিরা তখন খেতে দেবেন বলে গোছ করছেন, তাঁদের হাত এঁটো। তখন দুইহাতের কব্জির পরের অংশটুকু দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় গালদুটি টিপে আদর করে দিতেন। তারপর আমরা ছোটরা মামাদের সাথে সারি দিয়ে খেতে বসে যেতাম… ভাত, সুক্তো, মুগ ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, এঁচোড়-চিংড়ি, কালবোস কিংবা রুইমাছের কালিয়া, খাসির মাংস, আমের ঝোল, পায়েস…আমরা ছোটরা সব খেয়ে উঠতে পারতাম না। কিন্তু তাতে কিছু যেত আসত না, পরিতৃপ্তিটুকু তখন তো খাবারদাবার থেকে আসতো না…
বিজয়ার সময় নাড়ু বানানোর জন্য একটা ছোট্ট শিলপাটা দিদার ঘরে আলাদা থাকতো। রান্নাঘর থেকে নারকেল চিনি বা গুড় দিয়ে ছাঁই মেরে এনে দিদা সেগুলিকে ধীরে ধীরে শিলপাটায় বেটে নাড়ু, নারকেল সন্দেশ এসব বানাতেন। দিদার নাড়ু হত একটু লালচে, কড়া চিনির পাক। আর, বড়মামি ধপধপে সাদা নারকেল নাড়ু বানাতেন। তাতে পড়ত দুধের সর আর কর্পূর। ওই মাটির রান্নাঘরে বানানো এই দুই স্বাদের নাড়ুর স্বাদ গন্ধে আমার ছোটবেলাটি ভরে আছে।
(ক্রমশ)