পুনর্ভবাপুত্র। চতুর্দশ পর্ব। জলপরিঘাট। লিখছেন আহমেদ খান হীরক
পুনর্ভবা যেদিক থেকে এসেছে, ওদিকটায় যদি একটু উঁকি দেয়া যায় তাহলে বাগান ছাড়া তো আর কিছু দেখা যায় না—আমবাগান। মাইলের পর মাইল। একরের পর একর। সবদিকেই আমাদের বিচরণ। আমাদের খেলার প্রান্তর। শুধু যাই না ওই কাজিগ্রামের দিকে। ওদিকে আসলে কেউই যায় না!
খটখটে দুপুরবেলা, যদি তা হয় গ্রীষ্মের, আমবাগান বড় উপাদেয় জায়গা। এক ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ যে সূর্যও ফালি ফালি হয়ে যায়। তার ওপর মাটিও থাকে শীতল। একটু বাতাস হলে তো কথা নেই—গাও জুড়ায় আবার শাখায় সুর তুলে আমও পড়ে। আমরা আম কুড়াই, বাগানের সোঁদা মাটিতে দাগ টেনে বদ্দন খেলি কিন্তু কখনো কাজিগ্রামের দিকের বাগানে যাই না।
ওই বাগান নিয়ে নানান গুজব!
সবচেয়ে বড় গুজবটা সম্ভবত রবুকে নিয়ে। আমরা রবুকে পেলে তাই মাঝে মাঝেই তাকে ধরি—ও ভাই, কী হইছিল জি ভাই, কিছু কহো না কেন?
রবু হাসে। তার চোখ নড়ে না। চোখ যে কোনো দিন নড়বে না এ নিয়ে তার কোনো বেদনাও নাই। কী হয়েছিল জিজ্ঞেস করলে শুধুই মুচকি মুচকি হাসি। আর এক অপার বিস্ময় মুখের আভায়। যেন কোন সে আনন্দ সে দেখছে!
গরমের দুপুরগুলো যদি বাগানে কাটে তো রাতগুলো কাটে ছাদে। ছাদের ওপর পাটি পেতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা—মিল্কি ওয়ে… আব্বা বলতেন বলদের ডহর! ডহর মানে রাস্তা… কাঁচা রাস্তা। ধুলোয় ধূসরিত। বলদরা চলে গেলে যে গো ধূলি ওড়ে তাই যেন আকাশের নিশানায়। এত সুন্দর নাম… চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। ওদিকে আবার সপ্তর্ষি। নজরুলের কবিতায় পড়েছি ওদের উনি বলছেন—করুণ জিজ্ঞাসা! আসলেই তো তাই… বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকাশজুড়ে। ওদিকে নড়ে চড়ে যাচ্ছে স্যাটেলাইট। রকেট! এরকম বেশ এক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আসত রবুর প্রসঙ্গ! রবুর নজর হারানোর প্রশ্ন… আর অবধারিতভাবে আসত কাজিগ্রামের ওই ঘাটলা… দুইটা পাথর বাঁধা… ওপরে বিস্তীর্ণ বাগান… নিচে পুনর্ভবা। তবে এই পুনর্ভবা রহস্যময়ী।
রহস্যময়ী—কেননা কেউ জানে না এখানে সে কী করে… কেমনভাবে আড়মোড়া দেয়! বরং এখানে রবুরা গেলে নজরহীন হয়ে ফেরত আসে। এসেও তাদের তাদের পরিতাপ থাকে না। থাকে শুধু জীবনভর পাওয়া অমল হাসি। সুখের আভা। চাচা বলেন, শোন রে হীরক, ওইদিকে কিন্তু খবরদার আম কুড়াইতে যাবি না! ওইদিকে পরি নামে! নদীর ঘাটলায় চিৎ হইয়া শুইয়া থাকে!
দুনিয়ার নিয়মনীতি কিছু বুঝি না। কাঠিবরফের চাইতে মজার কোনো খাবার এই দুনিয়ায় তৈরি হয়েছে কিনা কে জানে! কিন্তু সেটা খেতে চাইলেই সবার নিষেধ! আবার এখন শুনছি যে ঘাটে পরি থাকবে সে ঘাটে নাকি যাওয়া যাবে না! গেলে কী হবে?
চাচার ধমক—রবুরে দেখোস নাই! নজর আছে আর তার? তোরও যাইব! সারাটা জীবন অন্ধ হইয়া থাকবি। ট্রেনে উইঠা ভিক্ষা করে খাবি!
আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধ যদি হয়ে যাই তাহলে আর কী থাকে! সত্যিই হয়তো ট্রেনে ট্রেনে ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হবে!
কিন্তু নতুন দিনের সূর্য সব সময় আপনাকে সাহসী করে তোলে। কৌতুহল তো তখন এক্কা ঘোড়া… লাগামহীন ছোটাছোটি। ফলে লিংকনের সাথে ফিসফাস। আব্রাহাম না। আমাদেরই প্রতিবেশী। যাবি আম কুড়াতে?
: কোনগুলা? ফজলি?
: না না। কাচামিঠা।
: কাচামিঠা পড়ে না বাতাসে। ঝড় লাগবে।
: যদি পাড়ি?
লিংকনের মুখে টগবগে রক্ত খেলে যায়। নিজে নিজে পাড়ব, মানে চুরি করব… এরচেয়ে আনন্দের আর কী আছে? কিন্তু পরক্ষণেই থমকে গিয়ে বলে, ধুর! আমজাদ ভাইদের বাগানে তিনটা যোগানদার!
: আমজাদ ভাইদের না… কাজিগ্রামের ঘাটে…
লিংকন অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঘাড় নাড়ায়—চ…
ওরও তো নতুন দিনের সূর্য… ওরও তো কৌতুহলের টগবগাডগ ঘোড়া!
দুপুরে নাকে–মুখে ভাত ঠুসে একটু অপেক্ষা। বাড়ির সবাই নিজের মতো বিছানায় গড়াগড়ি যেতেই দরজার খিল খোলা। লিংকন এল তাদের বাড়ির পায়খানার ওপর দিয়ে, সজনে গাছে বাঁদরঝোলা ঝুলে।
এদিকের বাগানে ঢুকতেই একটা প্রাইমারি স্কুল।
ক্লাস কবেই ফুরিয়েছে। পিয়ন বেঁচে যাওয়া টিফিন নিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমাদের ভ্রু কুঁচকে দেখে, আমরা চট করে বাগানের ভেতর ঢুকে যায়। আরো ভেতরে, তারপর আরো ভেতরে!
ছমছমে ভাব এদিকে। লোকজন একদমই নেই। ঘাটের ওপরে যে একটা কাচামিষ্টি আমের গাছ আছে এটা সত্যি। কিন্তু আমার মন সেদিকে না… আমার মন ঘাটে। ফলে গাছটাকে পেরিয়ে যায়। লিংকন বলে, পারবি না?
আমি বলি, পরে। আগে ঘাটে যাই…চ!
লিংকন আৎকে ওঠে—জানিস না তুই! ওই ঘাটে তো…
পরি থাকে। চিৎ হয়ে শুয়ে… চ…
লিংকন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা একটু গোঁফের মতো উঠেছে তার ঠোঁটে। পরির শুয়ে থাকাটা ফলে রমণীয় মনে হয় তার কাছে। গলার কাছে আমারও তো কিছু বেধে যাচ্ছে। আমরা বাগান পেরিয়ে ঢালের দিকে নেমে যেতে থাকি। পৌঁছাই। এইটাই সেই ঘাট।
পুনর্ভবা এখানে নিটোল। কেউ আসে না এ ঘাটে, এখানে আমাদের মতো কোনো বদমাশ সারাদিন সাঁতরায় না… ফলে পুনর্ভবা যেন দম ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু ঘাটে কোনো পরি তো নাই!
কিছু আঁশ পড়ে আছে। মাছের। মাছেরই তো, নাকি?
লিংকন ভালো করে দেখে বলে, নাহ! এইগুলা মাছের না বে!
তাইলে কিসের?
লিংকন আবার এদিক–ওদিক তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপি দেয়। আমি আবার আঁশের দিকে দেখি। নীল নীল আঁশ। পরির কি আঁশ হয়?
লিংকন একটা আঁশ কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেয়। আর তখনই প্রবল শব্দ হয় পুনর্ভবার পানিতে। যেন একটা মহাহাঙ্গামা। আমরা পেছনে তাকানোর সুযোগ পাই না। আওয়াজ শুনেই ঢাল বেয়ে ওপড়ে উঠে যেতে থাকি… হাঁপাই, তবু থামি না। উঠতেই থাকি। একেবারে আমগাছ…কাঁচামিঠা। ওখানে গিয়ে যখন ঘুরে তাকাই তখন দেখি নদীটা একেবারেই শান্ত। একেবারেই। এবং কোনো পরি চিৎ হয়ে শুয়ে নাই ঘাটে!
পরের দিন, আমি আর লিংকন, স্কুলে গল্প শোনাই—আমরা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা জলপরি দেখেছি। দিব্যা ভারতীর মতো দেখতে একেকটা জলপরি… তাদের শরীরে নীল নীল আঁশ!
(ক্রমশ)