কাগজের নৌকো। পর্ব ১৯। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

0

‘তেমন দিন তো আর এল নাই, থালায় অন্ন বেড়ে মা ডাক দিত, আর আমরা দুই ভাই টুপ করি নদীতে ডুব দিয়া আসি খেতে বসতাম! সে-সব এখন স্বপ্ন মনে হয়, বুঝলা!’

লেকটাউনে এক নম্বর পল্লীশ্রী কলোনির শেষপ্রান্তে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটি আসলে টিনের চালার ঝুপড়ি, পুরাতন কাঠের রুগ্ন সদর দরজা, ব্যস্ত জনপদে বহুতল কোনও ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা দিয়ে দেখা এক টুকরো আকাশের মতো উঠান পার হয়ে একখানি ঘর, পাশে অপরিচ্ছন্ন কলঘর, ঘরে আসবাবপত্র তেমন নাই-পায়া ভাঙা চৌকি ইট দিয়ে সোজা করে রাখা হয়েছে, মাটির মেঝের উপর এককোণে রান্নার সরঞ্জাম, টিনের চালের নিচে পলিথিন বিছানো, একখানি লোহার চেয়ার,বেতের জীর্ণ মোড়া-আর কিছুই নাই, কয়েক মুহূর্তে ফুরিয়ে যাওয়া পথের মতো গেরস্থালি। শঙ্করদা একাই থাকেন, স্ত্রী মারা গেছেন বছর দুয়েক, প্রায় সত্তর বছর বয়স, শীর্ণ চেহারা, বাম পায়ে চোট থাকায় একখানি লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁটেন, একমাথা কাশফুলের মতো চুল, গৌরবর্ণ দীর্ঘাঙ্গী, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ, তবে মোটা চশমার পেছনে চোখদুটি ভারি উজ্জ্বল, যেন বর্ষণক্ষান্ত আকাশে ভেসে থাকা রৌদ্রের ঝিলমিল, পাতলা ওষ্ঠ আর তিরতিরে ঋজু নাকের দিকে তাকালে বোঝা যায় মানুষটি যৌবনে রূপবান ছিলেন।

আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘সেই বরিশাল! কী যেন নাম ছিল আপনার গাঁয়ের?’

মলিন বিছানায় একখানি বালিশ কোলের উপর নিয়ে বসে রয়েছেন শঙ্করদা, সামনে একটি বহু পুরাতন বিবর্ণ খাতা, পাশে মাটির ভাড়ে অজস্র বিড়ির টুকরো, আনমনে পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি হাতে তুলে এলোঝেলো গলায় বললেন, ‘নয়না! কীর্তনখোলার পাশেই নয়না, সে-নদী এখনও চোখে ভাসে।’

–গ্রামের নামটি কিন্তু ভারি সুন্দর, নয়না!

 

মুখ তুলে আমার পানে চেয়ে অস্ফুটে হাসলেন শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘গাছপালায় চোখ সবুজ হয়ে যেত, কাঁচামাটির পথ, বাঁদিকে ধু ধু ধানক্ষেত আর ডানহাতে পথের ওপারে তোমার নদী, ইস্কুল থেকে ফেরার সময় একেকদিন জেলেদের নৌকো চেপে মাছ ধরতে যেতাম! ওসব মাছ খেলে জিভের তার খুলে যায়!’

পকেট থেকে ছোট চারমিনার সিগারেট বের একখানি শঙ্করদার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজেও ধরালাম, দুবার ধোঁয়া ছেড়ে শুধোলাম, ‘ইলিশ?’

–ইলিশের কথা আর বলো না, কীর্তনখোলার ইলিশের স্বাদ বলে বোঝান যায় না! ধরো গিয়া দুইখান মাছ পাইচি একদিন, টাকায় দুইখান, একেকটার ওজন এক কিলোর বেশি, তারপর চরে বসেই রান্নাবান্না খাওনদাওন!

–নদী চরেই রান্না? বাড়ি নিয়ে যেতেন না?

জ্বলন্ত চারমিনার তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে ধরে মুখ লাগিয়ে দু-বার জোরে টেনে শঙ্করদা বললেন, ‘আরে বুঝো না, ছেলেপিলাদের শখ, বাসায় তো মাচের ঢিপি, ইস্কুল পলায়ে নদী চরে চড়ুইভাতির মজাই আলাদা! শটিবন পার হয়ে বালুচর, সেখানেই উনান জ্বালিয়ে রান্না, ইলিশ ভাজা আর ভাত! কেউ বেগুন জোগাড় করলে, সঙ্গে গরম বেগুন ভাজা! বাসা থেকে লুকায়ে চাল নিয়ে আসতাম, কাচের বোতলে সর্ষের তেল, পাতায় একখাবলা লবণ আর কারোর খেতের মরিচ, আর কী চাই বলো! ওই তাজা ইলিশের তেল, ডিম গরম ভাতে লবণ আর কাঁচা মরিচ ডলে খেলে তোমার মনে হবে, চারপাশ স্বর্গ হই গেচে!’

এমন সুস্বাদু পদে কার না লোভ লাগবে, এতবছর পর কিচিরমিচির কলকাতার সন্ধ্যায় বসে আমারই জিভ সুলসুল করে উঠল, ‘তা বটে! এই খাবার হলে আর কিছুই লাগে না!’

–আর পরিবেশের কথাও ভাবো! যতদূর চোখ যায়, খাঁ খাঁ বালুচর, জলভরা মেঘ কাজলের মতো বুকের উপর নেমে আসচে, শনশন কীর্তনখোলার বাতাসে মাঝিমাল্লাদের গলা শুনতে পাচ্চি, কলা কি পদ্মপাতায় গরম ভাত আর দূরে ভেসে যাওয়া পানসি, তখন কতই বা বয়স, বারো তেরো বচর হবে, তবে অন্ন মুখে নিয়ে মন উতলা হয়ে যেত, বাসায় ফিরে হয়তো দু-লাইন চার লাইন লিখতাম, ওইরকম ছেলেবেলা না হলে হয়তো কোনওদিন কবিতা লিখতাম না! কী জানি!

 

মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, দিগন্তপ্রসারী বালিচরের উপর গর্ভবতী শ্যামলা আকাশের আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকার অপরূপ দৃশ্য, পূর্বগামিনী নদী বাতাসে উথালিপাতালি শটিবন, দূরে কীর্তনখোলার বুকে গাঙভাসি মানুষের নাওয়ের সংসার, ক্ষুদ্র নয়না গ্রামের সীমানায় আঁকা মসীরেখার মতো আম-জাম-কাঁঠাল গাছে ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন পথ, খোড়ো চালের সারি সারি ঘর, শাপলা ফুলে ছাওয়া দীঘি, বাতাসি ধানক্ষেত, সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির উঠানে খেলে বেড়ানো ছাগলছানা কি মুরগীর ডাক আর এদিকে নদীচরে নিঝুম দুপুরে গরম ভাতের সুবাসে ভেসে যাওয়া কতগুলি অপরিণত চঞ্চল কিশোরের চড়ুইভাতি-জীবন তখনও বড়ো মধুর, একটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও বাঙালির আখ্যান টলোমলো হয়নি, আজান ও সন্ধ্যারতির ঘণ্টায় নেমে আসা সন্ধ্যায় নিভে যায় নাই ভদ্রাসনের মঙ্গলদীপ, তখনও কিশোরের খাতা ভরে ওঠে কবিতার আলপনায়…সহসা শঙ্করদার কথায় আমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল, ‘কী ভাবতাছো? দাঁড়াও, জল বসাই, একটু চা খাও!’

কিশোরীর ব্রতকথার মতো অলীক অতীত থেকে এক পলকে কলকাতার সন্ধ্যায় ফিরে এসে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেইসব কবিতা আপনার মনে আছে, শঙ্করদা?’

ছোট একটি পাম্প স্টোভে আগুন জ্বালানোর ফাঁকে শঙ্করদা কৌতুকের সুরে বলল, ‘সে কবেকার কথা, আর কী মনে থাকে, তবে একটা লেখার দু-চার লাইন এখনও মনে পড়ে!’

সাগ্রহে শুধোলাম, ‘কী রকম?’

–ভাঙা এ গৃহ মোর/ ভাসাতে করে নাই জোর/তবু ভেসে যায় তরীখানি, দুপাশে শটিবন/ডাকিবে না কি অবেলায়, তুমি মন?

শঙ্করদার গলা এই বয়সেও বেশ ভরাট, আহামরি না হএলো খুব মন্দ লাগল না, বললাম, ‘বাহ! বেশ হয়েছিল তো?’

আঁধারপ্রায় কেটলি স্টোভে বসিয়ে মুখ ফিরিয়ে হাসলেন, সামনের পাটির একখানি দাঁত পড়ে গেছে, তামাকের কালো ছোপ ঠোঁটে, ‘ওই বয়সে খুব অভিমান হয় জানো তো! খুব ভালো লাগত বলাকা আর পড়তাম কুমুদরঞ্জন!’

চায়ের জল চাপিয়ে চৌকির উপর বসে আমার দিকে তাকালেন শঙ্করদা, ঘরে নিভু নিভু বাল্বের আলো, কলোনির এদিকে লোকজনের কোলাহল তেমন নাই, পথের আলো বিকল হয়েছে অনেকদিন, গলিটিও নিঝুমপুরী-পৌষ মাসের বাদুলে সন্ধ্যায় এলোমেলো স্মৃতি-বাতাস বইছে, আজ ঠাণ্ডাও পড়েছে বেশ, একখানি কালো উলের চাদর বালিশের তলা থেকে বের করে গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে বললেন, ‘কবিতা খারাপ লিখতাম না বুঝলা! এখানকার শুয়োরের বাচ্চারা সব চেপে দিল!’

আমি কিছু না-বলে চুপ করে রইলাম, শঙ্করদার এই এক রোগ, কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই ঝাঁপি খুলে বসেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর কৃত্তিবাসীরা নাকি হিংসায় নীল হয়ে শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে উঠতে দেননি-এসব কথার সত্য মিথ্যা হয় না, জেনে বুঝেও চুপ করে থাকি, মনে হয়, আহা, বুড়ো মানুষ, ক’দিনই বা বাঁচবে, বলুক না, আমাকেই তো বলছে! লেকটাউন জলট্যাঙ্কের মোড়ে নটরাজ ভাতের হোটেলের সামনে ফুটপাতে বিছানো শঙ্করদার পুরনো বইয়ের দোকানে যেদিন প্রথম আলাপ হয়েছিল, সেদিনও বইগুলি সাজাতে সাজাতে বলেছিলেন, একই কথা। কেউ বইপত্র কিনলেই নিজের লেখা একটি তামাদি হলদে হয়ে যাওয়া বই ক্রেতার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘দেখুন, কিনতে হবে না, এমনিই দেখুন!’

বইটির নাম, লাল নিশানের দিন! ওই যে এখন মাথার পাশেই রাখা আছে, প্রায় বিবর্ণ প্রচ্ছদ, জীর্ণ পুস্তানি, তিন-ফর্মার বইটির বাঁধাই খুলে পাতাগুলিও সংসারে বাতিল মানুষের মতো আলগা হয়ে এসেছে, তবুও রয়ে গেছে-যেমন এই প্রাচীন নগরীর আলোয় সাজানো পথঘাটে এখনও একজন দুইজন উন্মাদ চোখে পড়ে, চকচকে হোটলের পাশে কোনও কুসুম উজ্জ্বল রাধাচূড়ার ছায়ায় একফালি ভাতের দোকান বেঁচে থাকে, তেমন ভাবেই কবেকার ‘লাল নিশানের দিন’ও আজও মুছে যায় নাই।

 

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বাণ্ডিল থেকে লাল সুতোর বিড়ি ধরালেন শঙ্করদা, ‘তখন কফি হাউস জমজমাট, দুপুরের দিকে একদিন গেছি, সুনীলদা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে আছে, ওই দোতলায় ঢুকেই বাঁদিকে জানলাটা আছে না, ওর সামনে, তিনখানা টেবিল জড়ো করে নরক গুলজার চলছে। আমাকে দেখেই ডাকল, “অ্যাই শঙ্কর, এদিকে আয়!’, কাছে যেতেই হাসিমুখে বলল, “কৃত্তিবাসের জন্য লেখা দে!”, তা আমিও কম যাই না, বললাম, “কী লাভ, গতবার ডেকে কবিতা নিয়ে ফেলে রেখে দিয়েছ, ওইটাই এবার ছেপে দাও!”‘, কথার মাঝে ধোঁয়া গিলে নিতেই হাঁপানির কাশি উঠল, অল্পক্ষণ পর জলটল খেয়ে একটু ধাতস্থ হতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার কথা শুনে কী বললেন সুনীল?’

হাসলেন শঙ্করদা, ‘কী আর বলবে, তখন একাত্তর সাল, এই শঙ্কর ব্যানার্জীর রেলা ছিল, সন্ধের পর মেসিন ছাড়া পাড়ার বাইরে পা রাখতাম না! এসব পাতিপুকুর, বেলগাছিয়া, লেকটাউন সে-সময় দিনের আলো ফুরোলেই শুনশান, ওই যে এখন সরকারি আবাসন যেখানে, ওইটা ছিল রায়চৌধুরীদের পোড়ো জঙ্গল-কত লাশ যে মাটির তলায় পোঁতা আছে! তা আমাকে কেউ ঘাঁটাতো না, সুনীলদা বলল, “ওইটা কোথায় হারিয়ে গেছে শঙ্কর, তুই একটা নতুন দে! এবার প্রথমেই ছাপব তোর লেখা!”, আমি হেসে বললাম, “ডাবল্‌ ডিমের পোচ খাওয়াও, তাহলে দেব!”। তা সুনীলদা এমনি যাই হোক না কেন, খাওয়াতে বললে দরাজ হাত, খাওয়াল সেদিন পোচ, দিয়েছিলাম লেখা, পরের সংখ্যায় ছেপেছিল, লেখাটার নাম রেখেছিলাম, তোমার মুখ!’

 

আজ থেকে পনেরো ষোলো বছর আগে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বালিগঞ্জের বাড়ির বৈঠকখানায় রবিবার সকালে কবি যশোঃপ্রার্থী তরুণ তরুণীদের যাওয়ার চল ছিল, আমার পরিচিত দু-একজন গেছেও সেখানে, তাদের মুখেই শুনেছি, সুনীলবাবু মধ্যমণি হয়ে বসে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের লেখা শোনেন, পছন্দ হলে কারোর লেখা বিখ্যাত কাগজে ছাপার জন্য বলে দেন, বেলা বাড়লে সাধারণ লোকজন চলে আসার পর ঘনিষ্ঠ মানুষদের জন্য থাকে সুখাদ্য ও পানীয়-তবে এসবই শোনা কথা, নিজে তো আর যাই নাই কখনও, তা সেই কথার উপর নির্ভর করেই শঙ্করদা’কে বললাম, ‘এই ক’বছরে তো অনেক লিখলেন, যান না একবার, সুনীল বাবুর বাড়ি, আর কিছু না হোক একটা সরকারি ফান্ড যদি ব্যবস্থা করে দেন তাহলে তো আর এই বুড়ো বয়সে ফুটপাতে বইয়ের দোকান সাজিয়ে বসতে হয় না! আপনার সঙ্গে ভালোই তো আলাপ রয়েছে, নিশ্চয় চিনতে পারবেন।’

চৌকি থেকে নেমে কেটলির ঢাকা খুলে দু-চামচ গুড়ো চা ফেলে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লেখা নিয়ে ভিক্ষা করতে যাব?’

–ভিক্ষা কেন, মানুষ তো এইটুকু সাহায্য আশা করে, ওঁর তো অনেক ক্ষমতা। শুনেছি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক, একটা পেনশন বা সাহিত্য একাডেমির কোনও গ্রান্ট তো সহজেই জোগাড় করে দিতে পারেন।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন বৃদ্ধ, চোখদুটি সন্ধ্যাদীপের মতো ম্রিয়মান, পা টেনে দরজার কাছে গিয়ে সামান্য খুলে বাইরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ঝুমঝুম বৃষ্টি নেমেছে, আজ এখানেই খেয়ে যাও। জলকাদা ঠেঙিয়ে হোটেলে আর খেতে হবে না, চারটি ভাত বসিয়ে দেব, সকালের পুঁটিমাছের চচ্চড়ি রাখা আছে, দুজনের ঠিক হয়ে যাবে।’

সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে কথা বলায় সামান্য অবাক হয়ে শুধোলাম, ‘আপনি তাহলে যাবেন না? একটা ফোন অন্তত করুন, আমি নাম্বার জোগাড় করে দেব।’

রাতের বাগানে আধফোটা কুসুমের মতো হাসলেন শঙ্করদা, ‘তুমি বড়ো ভালো ছেলে, নরম মন! আমার কথা বাদ দাও, চাকরি-বাকরি কিছু দেখছ? বয়স হচ্ছে, কিছু একটা করতে হবে তো এবার!’

সত্যিই তখন আমার নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া দিন, লেকটাউনে একখান মেসে থাকি-খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নাই সেখানে, শুধু কোনওক্রমে মাথা গুঁজে থাকা, দুবেলা হোটেলে খাই, পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন, টইটই ঘুরে বেড়াই এদিক ওদিক, অতিকায় এই নগরী আমাকে কুহকিনীর মতো প্রতিনিয়ত ইশারায় ডাকে, একেকদিন পার্কস্ট্রিট চলে যাই, পথে পথে উদ্দেশ্যহীন হাঁটি, দুপাশে ঝলমলে দোকান বাজার, কর্মচঞ্চল মানুষের ভিড়ের মাঝে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমার কোথাও ফেরার নাই! ফিরলেও হয় অথবা না-ফিরলে কেউ কিছু মনে করবে না। বাপ-মা, সংসার, আত্মীয় পরিজন সবাই ধরে নিয়েছেন, এই ছেলেটির আর কিছু হবে না! একদিকে ভালোই হয়েছে, প্রত্যাশাহীন জীবন বড়ো মধুর! বন্ধু বান্ধবীরা ধীর পায়ে থিতু হচ্ছে, খবর পাই সবই, কেউ বিয়ে করল গত শীতে, কেউ বিদেশ গেছে, তখন তথ্যপ্রযুক্তির খুব রবরবা, কেউ বা ইস্কুলে চাকরি পেয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা হলে মুচকি হেসে বলি, “খাওয়া আজ!”, খিদেও পেত খুব, সারাদিন খাই খাই ভাব, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি, যদি এমন সুখাদ্য মুখে তুলতে পারতাম, তাহলে খুব ভালো হত! দুবেলা খাবার পয়সা জোগাড়ের জন্য কী না করতে হয়, কপর্দকশূন্য অবস্থায় একবার কোনও উপায়ান্তর না দেখে শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এক অবাঙালি পরিবারের মালপত্র ট্যাক্সি খুঁজে তুলে দিয়ে কুড়ি টাকা পেলাম-সেই দিয়ে দুবেলা খাবার জুটল, তখন আট টাকায় কলকাতা শহরের পথে ডিম ভাত পাওয়া যেত! কোনওদিন আবার এয়ারপোর্টের কাছে গুরুদ্বোয়ারায় চলে যেতাম, ওখানে হালুয়া মিলত বিনি পয়সায়, এছাড়া পথেঘাটে শনিবার সন্ধ্যায় বড়ো ঠাকুরের খিচুড়ি-লাবড়া ভোগ হলে তো মহাভোজ! শঙ্করদা খেয়ে যেতে বলায় তাই আর বিন্দুমাত্র আপত্তি করলাম না, তবে অন্ন নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়নি কখনও, কী এক গভীর বিশ্বাস ছিল মনে-যিনি এই জগতে এনেছেন টেনে, তিনিই খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করবেন। ফলে নির্ভার কাপাস তুলোর মতো ভেসে বেড়াতাম, মান-অপমান নাই, ভবিষ্যত অতীত কোনও চিন্তাই মনে দোলা দেয় না, বৃষ্টি, রৌদ্র, মেঘ, আকাশ আর এই বিচিত্র শহরের মানুষজন দেখি দু চোখ ভরে, পিছুটান নাই, সম্পর্ক নাই, খাই দাই ঘুরি, সে এক আশ্চর্য রমতা জীবন।

 

শঙ্করদার কথার উত্তরে সে-কারণেই মৃদু হেসে বললাম, ‘ও কিছু একটা হয়ে যাবে ঠিক, বেঁচে থাকা নিয়ে অত ভাবলে চলে নাকি!’

চিনেমাটির সস্তা কাপে লাল কড়া চা ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ঘরে চিনি শেষ হয়ে গেছে ভাই, বিনা চিনিতেই খাও!’

–আরে দিন! চিনি খেয়ে কে কবে বড়লোক হয়েছে! মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই বিখ্যাত গল্প পড়েননি, চিনি ছাড়ানোর কিস্‌সা!

চায়ে শব্দ তুলে চুমুক দিয়ে হাসলেন শঙ্করদা, ‘তা ঠিকই বলেছ! আসলে কী জানো সুনীলদার কাছে যাওয়া যায় কিন্তু ইচ্ছা করে না। লোকটা আমার সঙ্গে বহুত দু-নাম্বারি করেছে!’

বুঝলাম শঙ্করদা আবার নিজ পথে ফিরে গেছে, এই বিষয়টি যথেষ্ট বিরক্তিকর-স্পষ্ট বুঝতে পারি অধিকাংশই কল্পনা তবুও মুখে কিছু বলতে পারি না, কী জানি কেন, হয়তো নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানুষটির উপর একধরণের আলগা টান জন্মেছিল।

প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য মুখে বললাম, ‘যাকগে ওসব বাদ দিন শঙ্করদা, আপনি বরং সেই নয়না গ্রামের গল্প বলুন।’

–ওসব দিয়ে কী হবে ভাই! কবেকার কথা, হেজে মরে গেছে! শোনো, আমরা তো দলবেঁধে একসময় দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এই পচা-গলা সমাজ ভেঙে নতুন মানুষ গড়ার ডাক দিয়েছিলাম, পা-টা দেখছ, ঠিক করে এখনও স্টুল পাস করে না-রুণুর অফিসাররা করেছিল, আজও তাই, আর কিছু না থাকুক, মানুষের অসততা সহ্য করতে পারি না। তোমাদের সুনীল গাঙ্গুলি খুব ভালো মানুষ নয়!

চায়ের কাপ শেষ করে একটি চারমিনার ধরিয়ে বললাম, ‘দেখুন শঙ্করদা, মানুষ কেমন আমি সত্যিই জানি না, কিন্তু ওঁর “সেই সময়” পড়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি! আর আমার মনে হয় প্রতিভা ও চরিত্র এই দুটির মধ্যে কোনও সম্পর্ক নাই, প্রতিভা ঈশ্বরের একটি অদ্ভুত খেলা, ও কারোর নিয়ম মেনে আসে না!’

জানতাম, পাঁড় কমিউনিস্ট শঙ্করদা ঈশ্বরের কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেন, সেই কারণেই কথাটি বলা, দেখলাম, আমার অনুমান অভ্রান্ত! ঈষৎ রুক্ষ স্বরে বললেন, ‘তোমাদের তো কথায় কথায় ওই নিয়তিবাদ! ঈশ্বরের খেলা! হুঁ! তা সেই ভদ্রলোক নাকি মহিলা, থাকেন কোথায়? ছোটবেলা থেকেই মাথায় যত প্রতিক্রিয়াশীল, বুর্জোয়া চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে!’

কথার উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলাম। তবে বুড়োর রাগ বেশিক্ষণ থাকে না, দু-এক মুহূর্ত পর শঙ্করদা একটি বিড়ি ধরিয়ে বললেন, ‘ভাত বসিয়ে তোমাকে একটা গল্প বলব, নয়না গ্রামের গল্প, গল্পটা একটু অদ্ভুত কিন্তু তোমার ভালো লাগবে!’

বাইরে ঝিমঝিম নূপুর বাজিয়ে বৃষ্টি এসেছে, দিকভ্রষ্ট পৌষ বাতাস ভাঙা কাঠের দরজায় শব্দ তুলে আবার আপন খেয়ালে জগতপথে মিলিয়ে যেতেই পল্লীশ্রী কলোনির অন্ধকার গলির মুখে দু-একটা কুকুর বোধহয় অচেনা কোনও মানুষ দেখে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, যুবতির কাজললতার অভিমানের মতো মেঘাবৃত চরাচরে সহসা সৌদামিনী দেখা দিলেন তখনই, তাঁর সঙ্গীর ডম্বরুধ্বনির শব্দে চমকিত হয়ে উঠল নির্জন নগরী, হতদরিদ্র ঘরের পীতবসনা ম্লান আলোয় আমি সাগ্রহে আখ্যানের আশায় বৃদ্ধ শঙ্কর বন্দ্যোপাধায়্যের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

পৌষ মাসের দ্বিপ্রহর, গতরাত্রির ঝড়বৃষ্টির পর আকাশ এখনও মলিনবসন, মাঝে মাঝে আলতো সোহাগী রৌদ্র অস্ফুট বাক্যের মতো ভুবনডাঙায় ভেসে উঠে মিলিয়ে যেতেই উত্তরপথগামী হিম বাতাসে দূর কুয়াশাবৃতা পাকদণ্ডী পথের কথা মনে পড়ে যায়-আজ শনিবার, এমন পাহাড়ি স্মৃতির দিনে পথঘাটে লোকজনও বেশি নাই, সকালে একটি ফুরোনের কাজে কিছু টাকা-পয়সা হাতে আসায় হাফ প্লেট মুরগির মাংস আর ভাত অর্ডার করে বসে রয়েছি, এই নটরাজ হোটেলে নিম্নমধ্যবিত্ত পথ-চলতি মানুষের ভিড় বেশি, টিনের চালের দোকান, ভেতরে ইস্কুলের মতো কাঠের বেঞ্চি আর টেবিল পাতা, বেশি পদ রান্না হয় না-ওই ভাত, ডাল, একটা পাঁচমিশালি ঘ্যাঁট মতো তরকারি, আলু কি ধুঁধুল ভাজা, ডিম, চালানি মাছ, খামারের মুরগির মাংস, দামও অন্যান্য হোটেলের তুলনায় বেশ কম, প্রতিদিন দু-বেলা খেতে আসায় মালিকের সঙ্গে মুখ চেনা হয়ে গেছে, আজ মাংস অর্ডার করায় ক্যাশ বাক্সের সামনে বসে মুচকি হেসে বললেন, ‘মাংস আজ ভালো হয়েছে, খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে!’

আমি কিছু না-বলে উত্তরে শুধু একটু হাসলাম!

 

জানলার পাশে একটি টেবিলে বসেছি, বাইরে মেঘাচ্ছন্ন জগত, সামনে আমলকি গাছ থেকে রিণিঠিণি শব্দে পাতা খসে পড়ছে, ওপারে একটি দীঘি থেকে ভেসে আসা শিমশিম বাতাসে পড়ন্ত শীতবেলায় আষাঢ় মাসের সুবাস, গরম ভাতে মাংসের ঝোল ঢেলে মেখে একগ্রাস মুখে তুলতেই কী জানি কেন গতরাত্রে শঙ্করদার বলা নয়না গ্রামের আখ্যানটির কথা মনে পড়ল, ঘটনাটি সত্যিই অদ্ভুত, অর্ধশতাব্দী পূর্বে সেই উনিশশো পঞ্চাশের গোড়ার দিকের ঘটনা, তবুও গল্পটি শুনে মনে হয়, এই সেদিনের কথা।

 

পশ্চিমে বালুচর পার হয়ে কীর্তনখোলা খেয়াঘাট, তার পূর্বে জলশূন্য নদীগর্ভ, যতদূর চোখ যায় বিধবার থানের মতো বালি সমুদ্র, খেয়া ধরতে ওই তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে বসন্তঋতু।

 

বিকেল ফুরোনোর আগে মাথার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে চখা-চখীর দল, অনেক দূরে একসারি তালগাছ। কীর্তনখোলার চরে শেষবেলার আলো, বালিহাঁসের দল নেমে এসেছে যেন কোথা থেকে, গাঙ শালিখ ওড়াউড়ি করছে পড়ন্ত বেলায়, পাকা তরমুজের ক্ষেতে কার ফেলে দেওয়া পুরনো জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে একাকী কাকতাড়ুয়া, হাঁড়িপানা মুখ।

শঙ্করদা বলছিল, কীর্তনখোলার ঘাটে নৌকো বায় এক মেঝেনি, সোমত্ত যুবতি, দিয়াসিনি মায়ের মতো একঢাল চুল, কপালে সিন্দুরের টি প, খাঁড়া নাক, তবে নাকটি একটু বাঁকা। ছোট্ট পাথর বসানো নথ ঝলমল করে আলোয়। লোকজন ছাগল মুরগি ঝাঁকা বোঝাই তাজা সবজি রূপশালী ধানের বস্তা নিয়ে নৌকো ওঠে, মেঝেনি তাদের কুসুমপুরে নিয়ে যায়। ষোলো আনা ভাড়া ফেরির।

আমি বিস্মিত কণ্ঠে শুধিয়েছিলাম, ‘ঘাটে মেঝেনি? এমন তো কখনও শুনি নাই!’

স্টোভে ভাতের জল চাপিয়ে হাসলেন শঙ্করদা, তারপর শীত বাতাসের মতো উদাসী সুরে বললেন, ‘তোমাকে তো বললাম, কাহিনীটি বিচিত্র!’

 

মেঝেনি বলে, কীর্তনখোলার চরের মাঝখানে দু এক জায়গায় নাকি চোরাবালি আছে, পা টেনে ধরলে কোন অতলে তলিয়ে যেতে হবে। অনেক বছর আগে এক যুবক মরেছিল, শ্রাবণ মাস, মেঝেনি বহু চেষ্টা করে যখন তুলে আনে আনে তখন যুবকটি মরে কাঠ, ফুলে ঢোল দেহখানি, ভারী ঠোঁট দুটো কালচে নীল হয়ে গেছিল, মেঝেনির চোখ দুটি খুলে দেখার বড় বাসনা হয়েছিল। মরা মানুষের চোখ তো খোলে না সহজে, তাই আগুন খেয়েছিল যুবকের চক্ষুদুটি।

 

কার্তিকমাসে নদের ওপর সারা রাত ধরে কুয়াশা নিজেকে বিছিয়ে দেয়, ভোরবেলা সেই ধোঁয়ার তন্তুজাল কেটে বেরিয়ে আসে মেঝেনির নাও। দুপাশে নিথর গাছপালা, অনেক দূরে সাদা চাদরের মতো জনপদ, বালুচর, বেথুর আর শটিবনের দল। দু একটি গাঙ শালিখ অস্পষ্ট জলরেখার মতো ওড়াওড়ি করে। নৌকোয় হাল ধরে চুপ করে বসে থাকে মেঝেনি, থুতনিটা শুধু একটু নামানো নদীর দিকে। মেঝেনি তাকে মনে মনে বলে, ‘সব ভালবাসা কি একরকমের হয়, বলো, ঠাকুরাইন?’

 

তারপর বেলা হয়, আলো হয়, নৌকো পারাপার করে, মোতিগঞ্জের সওয়ারি নামে কুসুমপুরে আর কুসুমপুরের যাত্রী ফেরে মোতিগঞ্জে। এপারে পীরের মাজার আছে, গরীব ন্যাংটা পীর, ওই দু পয়সা চার পয়সার খদ্দেররা আসে, সস্তা ধূপ জ্বালায়, সিন্নি মানত করে, অবরে সবরে সবুজ চাদর দেয় কেউ। মেঝেনি ক’দিন হল প্রতি রাতে কোন এক অস্পষ্ট জগতের স্বপ্ন দ্যাখে, দুটো দাঁড়কাক উড়ে উড়ে কোথায় যেন যায়, সারাদিন মনমরা হয়ে চেয়ে থাকে, পীরের থানে তিনটাকার সিন্নি মানসিক রেখেছে, স্বপ্নদোষ যেন সেরে যায় তার, নাহলে পার করবে কী করে মানুষকে!

 

ওদিকে কুসুমপুরের রায়বাড়ির কত্তাবাবা পালা বসাবে আসছে পৌষ মাসে, শহর থেকে থেটারের লোক আসবে, খ্যামটা নাচ হবে, নবান্নের ধান বেচে লোকের হাতে দুটো পয়সা আসে তখন, জোর আমোদ হবে। সারারাত, তিনরাত ধরে গমগম করবে রায়বাড়ির উঠান, হ্যাজাক জ্বলবে, লোহার হাঁড়িতে পাঁচমেশালি চাল ডাল আনাজপাতি নতুন আলোর খিচুড়ি ফুটবে গুবগুব করে।  সে রবরবা আর নাই রায়দের, তবু দালান কোঠার রক্তটুকু তো আছে।

 

কত্তাবাবার চাই ওখানে আমাদের মেঝেনিকে! মল পরে নাচবে কেমন ঝুমুর ঝুমুর, কেষ্ট সাজে সে, মাথায় শোলার মুকুট, নীল রঙ অঙ্গে, আড়বাঁশিটি ধরা হাতে, তাতে ফুঁ দিলে দুলে ওঠে অপ্রতিম জগত! বেথুর ঝোপে কদম ফুল ফোটে থোকা থোকা। কেষ্টর রাধা নাই, একা একাই ঘুরে ফিরে নাচে কাঁদে, নিজেই নিজের সখা। তা কেষ্ট সাজলেই তো হল না, দিন কতক অভ্যেস তো চাই। অঘ্রানের মাঠে, ধান নাই, ফসল নাই, খা খা করছে নদটির চরা, সেখানে রাত হলে নাচ শুরু করে মেঝেনি। দিনমানে তার সময় কই! সূয্যি ডুবলে, নাওখানি ঘাটে বেঁধে, তবে শান্তি, দু দণ্ডের ছুটি।

 

কুয়াশা নামে ধীরে, কেমন হাতে কাপাস তুলোর বস্ত্রের মতো চারপাশ, একেকদিন চাঁদ ওঠে, সেও মরা আলোর পিদিমের মতো-কুয়াশাচ্ছন্ন অলীক আলোর স্রোতে মেঝেনি নাচে, দুলে দুলে নাচে, অঙ্গের কাপড়খানি খুলে যায় কত সময়। কেষ্ট সাজা কি মুখের কথা!  দূর থেকে দেখলে মনে হয়, একতাল আবছা আলো উঠছে আর নামছে, কখনও আবার ঢেউ হয়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটির উপর, টিঁ টিঁ করে ডেকে ওঠে রাতচরা পাখি, ডানা ঝাপটে উড়ে যায় নিশুত রাতে।  চন্দ্রদেব চেয়ে থাকেন অপলক।

ওদিকে তখন কীর্তনখোলার ঘাট পার হয়ে রায়বাড়ির ছোট বউমার পাল্কি নদী চরে আহত অভিমানের মতো পাখা মেলে ছুটে চলেছে, দুপাশে অপরাহ্নের বসতবাটি, সাদা আঁশের মতো শেষ বেলার আলো গড়িয়ে পড়ছে যেন কোথা থেকে, চৈত্রপবন গৃহদাহের সুবাসে আমোদিত।

ফিরে আসার কিছুই নাই আর।

 

কাহিনী শেষ হতেই গরম ভাত স্টোভ থেকে নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন শঙ্কর’দা, ‘ওই মেঝেনি কাঁচা বয়সে আমাকে একটা কথা বলেছিল, জানো তো?’

সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী কথা?’

বৃষ্টির গতি স্তিমিত হয়ে এসেছে তখন, যদিও উন্মনা হিম বাতাস বইছে চরাচরে, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শঙ্করদা নিচু গলায় বললেন, ‘বলেছিল, আমার নাকি একটা বইয়ের দোকান হবে!’

–বইয়ের দোকান?

–হ্যাঁ, আমিও তোমার মতো অবাক হয়েছিলাম খুব, কিন্তু হাজারবার জিজ্ঞাসা করলেও আর কোনও কথা বলেনি! শুধু বলেছিল, একটা দোকান হবে! বইয়ের দোকান! আজও সেই যুবতির কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজে!

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *