পুনর্ভবাপুত্র। দ্বাদশ পর্ব। গডফাদার। লিখছেন আহমেদ খান হীরক
এইটটা পর্যন্ত ভালো ছাত্রের তকমাটা ছিল। নাইনে উঠতে উঠতে সেটা নিজেই যেন ফেলে দিতে চাইলাম।
বয়সটা তখন কেবল হাওয়া লাগার। সরু গোঁফ উঠে গেছে নাকের নিচে। গোয়েন্দা রাজু আর তিন গোয়েন্দা পেরিয়ে হাতে আসছে মাসুদ রানা। কী মায়াবী জীবন তার! টানে সবাইকে কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। আমি কিন্তু বাঁধনে জড়াতে চাই। বন্ধু–বান্ধবদের সাথে সব সময় থাকতে চাই। জীবনের এক লক্ষ্য—আড্ডা! আর এই আড্ডার বড় বাধা স্কুল!
সেই সকালে ক্লাস শুরু হয়। চলতেই থাকে চলতেই থাকে… ক্লান্তিহীন এই ক্লাস করে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। ফলে আমরা নানা রকম মানে বের করতে শুরু করি তখন।
টুয়েন্টি নাইন সদ্য শিখেছি। হার্টসের তাস স্বপ্নে পর্যন্ত দেখি। এই সদ্য শেখা খেলাটা ক্রমেই নেশাই পরিণত হচ্ছে। দুটো নেশা—এক. সেবা প্রকাশনীর বই দুই. টুয়েন্টি নাইন। দুটোই বড়দের চোখের বিষ। ফলে ফাঁকি!
টিফিন হতো দুপুর একটায়। আমরা দ্রুতগতিতে বাড়ি ফিরে আসি। কেউ সাইকেলে, কেউ হেঁটে। এই ফেরাটার আবার অন্য রকম মজা আছে। মজাটা হলো আমাদের ফেরার রাস্তায় গার্লস হাই স্কুল মেয়েদের সাথে ক্রস হওয়া। ওদের তখন ছুটি হয়ে যায়। ভাঙা ব্রিজে আমরা মুখোমুখি হই। ওরা আমাদের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসে—ওরা হাসলে সুন্দর দেখায়…মিষ্টি দেখায়! আমরা ওদের দেখে চাপা হাসি—আমরা হাসলে আমাদের নোংরা দাঁত বেরিয়ে যায়…চেহারার ভাঙাচোরা ভাব হঠাৎ করে হা হয়ে যায়! আমরা হাসলে তাই ওদের হাসি বন্ধ হয়ে আসে। তবে এই হাসাহাসির পাশাপাশি আবার এ ওকে একটু–আধটু বেশি ভালোবাসাবাসির মধ্যেও যাই। আমরা যেতে পারি না। আমাদের অত সাহস নেই। আমরা মানে আমি, হিমেল, মনোজ, শফিকুল… আমরা শুধু তাকিয়ে থাকা আর নিজেরা নিজেরা অস্থির হয়ে গলে যাওয়া!
সেই মোহসময় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ছুটতে হয় টিফিনের জন্য। বাড়ি। গোগ্রাসে খাওয়া বলতে যা বোঝায় তখন তাই করা হয়। মাছটা আলুটা পটলটা ভাতটা ডালটা…সব এক সাথে মচকিয়ে একেবারে এক অদ্ভুত খিঁচুড়ির মতো কিছু বানিয়ে টপাটপ গিলে পানি খেয়ে দৌড়। কারণ কাজ তো তখন অনেক… বেড়িয়ে মনোজদের ডাকা… তারপর বাগানের ভেতর ঢুকে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া… তারপর না স্কুল!
তখন ‘লিজেন্ড‘ নামের সিগারেট কেবল বাজারে এসেছে। এক প্যাক সম্ভবত পাঁচ টাকা। আমরা চার পাঁচ জনে প্যাকেট উড়িয়ে দিচ্ছি। সাথে হার্টসের জোকার দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছি ক্লাবসের কুইনকে!
টুইন্টি নাইনের নেশাটা এমন পর্যায়ে গেল যে এরপর টিফিন পালাতে শুরু করলাম। আমাদের এবি স্কুলের পাশেই বড় বড় সরকারী খাদ্য গুদাম। দুই গুদামের মাঝে সরু গলি। গলির ওপর সুন্দর বসার জায়গা। বাইরে থেকে দেখলে কিচ্ছু বোঝা যায় না…গলিতে কী চলছে! ফলে আমাদের টিফিন পরিয়ড পার করে চলতে শুরু করল তাসের কেরামতি। আমরা চারজন তো আছিই… মাঝে মাঝেই যুক্ত হতে থাকল নতুন নতুন সদস্য!
আমরা যেটা করতাম সেটা হলো স্কুল যেতাম, চারটা ক্লাস করতাম, বাড়ি যেতাম, টিফিন খেতাম…তারপর খাদ্যগুদাম। স্কুলেই আমাদের বইখাতা থেকে যেত। যেহেতু নাইনে উঠে গেছি বই নিয়ে যাওয়াতেও আমাদের কার্পন্য ছিল। একটা লম্বা সাদা খাতা, তার সাথে দয়াপরবশত ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির বই। এই বইগুলো মোটা কিছুটা…ফলে একটা থাকলেও বেশি দেখায়। ধরতেও সুবিধা। এর মধ্যে সাহস বাড়তে বাড়তে এই পর্যায়ে গেল যে খাতার সাথে ক্লাসের কোনো বই নেয়ার আর প্রয়োজনই বোধ করতাম না। একটা সাদা খাতা আর সেবা প্রকাশনীর বই। বিশেষত মাসুদ রানা। বইগুলো ক্লাসেই পড়ে থাকত। টিফিনের পর তিনটা ক্লাস ছিল…সেগুলো শেষ হলে ছুটির ঘণ্টা! আমাদের তাস পেটানো তখন শেষ করতে হতো। সেই সময় চুপি চুপি পেছনের গেট দিয়ে আমরা একেবারে কলপাড়ে। টিউবওয়েলে তখন পানি খাওয়ার হল্লা চলত। অনেক ছেলে…সাদা শার্ট খাকি প্যান্ট! আমরা কয়েকজন সেগুলোর ভেতর মিশে যেতাম।
এমন করেই ১৯৯৬/৯৭ পার হচ্ছিল; কিন্তু কে না জানে, চোরের দশদিন তো সাধুর এক দিন! একদিন আমরা ধরা পড়লাম।
ধরা পড়াটা হয়তো আমাদের নিয়তি ছিল; কিন্তু ধরা আমাদের আসলে খাওয়ালো আমাদেরই ক্লাসের প্রতিপক্ষরা। প্রতিপক্ষে ছিল বেশ কয়েকজন চুপচাপ গোছের ছেলে। এরা শুধুই পড়াশোনা করতে চায় জীবনে। দাঁড়িটা কমাটা পর্যন্ত মুখস্ত রাখে। আমাদের বাউন্ডুলে জীবন এদের ঈর্ষার কারণ! সেই ঈর্ষা থেকেই আরবি ক্লাসে আরাফাত করে দিলো চিচিংফাঁক। আরবি শিক্ষকের নাম নজরুল। তিনি খুবই নিয়মতান্ত্রিক মানুষ। ক্লাসে এসেই হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে দিয়ে সবাইকে সোজা করে বসাতেন। কোনো বেঞ্চ সামনে বা পেছনের বেঞ্চের সাথে অসমান থাকলে সেটা ঠিক করেন সময় নিয়ে। সেই ক্লাসে বোমা ফাটালো আরাফাতরা। নজরুল স্যার জিজ্ঞেস করলেন, সবাই উপস্থিত?
ক্লাসে নিরবতা। সবাই জানে আমরা কয়েকজন উপস্থিত নেই। থাকি না কোনোদিন। কিন্তু অন্যরা মুখ খোলে না। কারণ আমরা বাউন্ডুলে বদমাশ। কী থেকে কী আবার করে দিই, খামোখা ঘাঁটানোর কী দরকার!
কিন্তু আরাফাতরা আর এই তত্ত্বে আস্থা রাখতে পারল না… আরাফাত দাঁড়িয়ে, খুবই ক্রেডিট নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, সবাই উপস্থিত নাই সার।
‘কারা নাই? টিফিন খেয়ে আসেনি এখনো?’
‘অরা তো আসেই না সার টিফিনের পর। ম্যালাদিন থেকে।‘
আরবি স্যারের চোখ ধ্বকধ্বক করে উঠল। বললেন, টিফিন পালায়?
আরাফাতরা মাথা নাড়াল। স্যার বোর্ডে চক দিয়ে লেখা শুরু করলেন—নাম বলো?
বোর্ডে নাম উঠল—হীরক, হিমেল, মনোজ, শফিকুল, রিটু, সোহেল, ডালিম!
আরবি স্যার নাম লিখে বললেন, এদের বইখাতা কোথায়?
আরাফাতরা এত খারাপ… আমাদের বইখাতা সব জমা দিয়ে দিলো আরবি স্যারের কাছে। অন্যদের বইয়ে কী ছিল জানি না… আমার বইপত্র মানে একটা খাতা আর একটা সেবা প্রকাশনীর বই। বইয়ের নাম গডফাদার। লেখক মারিয়ো পুজো। গডফাদার বইটির ওপরের বেশ কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে গেছে। ওপরের পাতাতেই লুসির সেক্সদৃশ্যের বর্ণনা আছে। ও সময় ওটুক বর্ণনাই রগরগে। আরবি স্যার গডফাদার বইটি দেখলেন এবং ক্লাস আর না নিয়ে বইপত্র সব নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পুরো ক্লাসে নেমে এলো নিরবতা। আরাফাতদের মুখে ফুটল মিচকি মিচকি হাসি।
ছুটির ঘণ্টা পড়তে প্রতিদিনের মতো আমরা তাস গুটিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। স্কুলের পেছনের গেটটার কাছে যেতেই আমাদের এক সহপাঠির সাথে দেখা—আমরা বললাম, কী বে জুলমাত, যাচ্ছিস?
জুলমাত ভূত দেখার মতো করে আমাদের দেখল, তারপর কিছু না বলেই চলে গেল। একটু পরেই দেখা হলো নূরতাজের সাথে। বললাম, যাস গা?
নূরতাজ একটা ঢোক গিলে বলে, যা তোরা… তাইলেই বুঝবি!
বেশি দূর যেতে হলো না। যা বোঝার বুঝে গেলার কলপাড়েই। বইপত্র সব জমা পড়েছে হেডস্যারের ঘরে। আমরা যে টিফিন পলাতক সেটা জানাজানি হয়ে গেছে। আরবি স্যার ভীষণ ক্ষেপে আছে। হেডস্যারের কী মতিগতি কেউ জানে না। কারণ তাকে আর তার রুম থেকে বের হতে কেউ দেখেনি!
এইখানে হেডস্যার সম্পর্কে একটু বলে নেয়া ভালো।
হেডস্যার আমাদের এই এবি হাইস্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। এমন অনেক শিক্ষক আমাদের ছিলো যারা হেডস্যারকে পড়িয়েছিলেন। কানাঘুষা ছিল পলিটিক্যাল পাওয়ার খাটিয়ে হেডস্যার নাকি ওই আসনে বসেছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি তেমন দুর্দান্ত না হলেও প্রশাসক হিসেবে ছিলেন দারুণ। এবি স্কুলকে তিনি অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু নিয়মনিষ্ঠার ব্যাপারে ভীষণ কড়া। পার্সেন্টিজ না থাকার কারণে ভালো কিছু ছাত্রকেও এসএসসি পরীক্ষায় বসতে দেননি। টিফিন পিরিয়ডে একটা কঞ্চি হাতে দেরি করা ছাত্রকে আপদমস্তক পেটানোর অভিপ্রায়ে আমাদের স্কুলের পুরো বারান্দাটা ঘুরতেন। তাকে আমরা যমের মতো ভয় পেতাম। এবং আমাদের ধারণা হেডস্যার আমাদের এই চার–পাঁচজনকে চোখের বালি হিসেবে দেখতেন। সুযোগ পেলে যে আমাদের তুলোধুনো করবেন সে বিষয়ে আমাদের কারোরই সন্দেহ ছিল না। ফলে হেডস্যারের রুমে বই জমা পড়েছে শুনেই আমরা যেটা করলাম সেটা হলো স্কুল পেরিয়ে মাঠ…মাঠ পেরিয়ে রাস্তা… একদম বাড়ির দিকে গমন! কিন্তু যেতে যেতেই প্রশ্ন যেটা এল মাথায় সেটা হলো আমরা যদি চলে যাই, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না… বরং আরো তা বাড়ছে! কারণ হেডস্যারের রুমে বই থেকেই যাচ্ছে… উনি যদি আমাদের অভিভাবক ডাকে?
আমার এই প্রশ্নে বাড়ির দিকে যাওয়ার গতিতে হঠাৎ করেই ট্রাকের হাওয়ার ব্রেক লাগল। সবাই সবার দিকে তাকিয়ে মুখটা আরো শুকিয়ে ফেললাম। বাইরে যাই করি, বাড়িতে আমরা ধোয়া তুলসি পাতা। এবার সেই পাতায় বোধহয় কলঙ্ক লেপন হতে চলেছে। হিমেল আমাদের মধ্যে বুদ্ধিমান বেশি। সে বলল, তাই তো! এইটা হলে তো বাড়িতে পিটায়া মাইরেই ফেলবে!
হিমেলের কথার কোনো জবাব আমরা দিলাম। সত্যি কথার প্রেক্ষিতে কীইবা আর বলার থাকে। শফিকুল বলল, চল, নাচোল পালিয়ে যায়!
নাচোল হলো পরের রেলস্টেশন। ট্রেনে চড়লে ১৫ মিনিট লাগে। সেখানে শফিকুলের আত্মীয়–স্বজন আছে। কিন্তু নাচোল পালালে কি সমস্যার সমাধান হচ্ছে? সেই তো বাড়ি পর্যন্ত যাচ্ছে হেডস্যারের শমন। মনোজ বলল, ক্যান যে টিফিন পালাতে গেছিলাম বাল!
এই এক আফসোস আমাদের সবার মনে। কিন্তু আফসোস করে তো লাভ নাই! ঘটনাটার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে। যেভাবেই হোক হেডস্যারের রুম থেকে বই নিয়ে আসতে হবে… আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাঘের ঘরে ঢুকব!
হেডস্যারের রুমের এক পাশে বেঞ্চি পেতে গাজিস্যার প্রাইভেট পড়ান স্কুল শেষে। আরাফাতরা তখন সেখানে। ওই ব্যাচে আমিও আছি। কিন্তু প্রাইভেট পড়ার কোনো অবস্থা আমার নেই। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা হেডস্যারের রুমের কাছে যেতেই আরাফাতদের চেহারা দেখলাম। মুখে তাদের হাসি। চোখে তাদের ঝিলিক। মনে তাদের একটাই কথা—যা, তোদের সাঁটাবে!
সাঁটানি খাওয়ার প্রস্তুতি আমাদেরও আছে। অনেক পিটানি চলবে তার অন্যথা হওয়ার কোনো উপায় আমাদের জানা নেই। আমাদের লক্ষ্য যেভাবেই হোক বইখাতাগুলো নিয়ে আসা। যেন বাড়ি পর্যন্ত খবরটা না যায়। আমরা হেডস্যারের রুমের পর্দা ঠেলে চৌকাঠে দাঁড়ালাম। প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া কণ্ঠে, একেবারে তলানি থেকে বললাম, স্যার, আসব!
হেডস্যার কী একটা জিনিস দেখছিলেন। মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর যেন চেনেনই এমন একটা চাহনী চোখের তারায় খেলিয়ে আগের কাজে মনোযোগ দিলেন। আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। ঘটনা যতটা ভেবেছিলাম এখন দেখি তারচেয়েও বেশি শক্ত এবং গম্ভীর। হেডস্যারের এমন চোখ সচরাচর দেখা যায় না। আমরা বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সময় যেতে থাকল হেডস্যারের দেয়ালের কালোঘড়িতে—টিকটিক টিকটিক টিকটিক…
এর মধ্যে পিয়ন টুলুমামা দুইবার এসে, কাজ করে, ফিরে গেলেন। তৃতীয়বারের মতো এসে আমাদের একই দূরবস্থা থেকে ভ্রু নাচালেন। আমরা একটা ভঙ্গি করলাম যে আজকে শ্যাষ!
টুলুমামা হেডস্যারকে বললেন, ছেলেপেলেগুলা দাঁড়ায়া আছে স্যার ম্যালাক্ষণ!
হেডস্যার প্রথম যেন আমাদের দেখলেন। বললেন, তোমাদের কী?
আমরা চৌকাঠ পেরোবো কি পেরোবো না এই রকম দ্বিধা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। লজ্জা, সংকোচ, দ্বিধা ইত্যাদিতে যেন মরে যাচ্ছি এমন একটা ভঙ্গি ফোটানোর চেষ্টা করতে থাকলে শরীরিভাষায়। বললাম, স্যার, আরবি স্যার বই রেখে গেছেন আমাদের… আপনার এখানে!
হেডস্যার তার টেবিলে রাখা আমাদের বইগুলো একবার দেখলেন, দেয়ালের এক কোনে রাখা ছয়–সাতটা বেতের দিকে দেখলেন, তারপর আবার বইগুলোর দিকে তাকিয়ে মুখটা আরো গম্ভীর করে ফেললেন। আমি দেখলাম সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়েছে! টেবিলে রাখা সবগুলো বইখাতার ওপরে মারিয়ো পুজোর বইটা—বইটা এখন যতটা মারিয়ো পুজোর…তারচেয়ে বেশি আমার। বইটার ছিঁড়ে যাওয়া পাতায় লুসির যৌনদৃশ্য। ইচ্ছা হলো মাথাটা আমি আমার ইউনিফর্মের ভেতরে ঢুকিয়ে নিই।
হেডস্যার বলল, ও এগুলো… এগুলো নিয়ে তো এখন কথা হবে না। টিচার্স মিটিং ডাকা হবে। টির্চার্স রুমে সব টিচারের উপস্থিতিতে অভিভাবকদের ডাকা হবে…সেখানেই ফয়সালা হবে…
টপ করে একটা আওয়াজ হলো। তাকিয়ে দেখলাম মনোজের ঘামে ফোঁটা পড়েছে মেঝেতে। আমাদেরও অবস্থা তথৈবচ। যা ভেবেছিলাম তাই হতে চলেছে। কালকেই হয়তো মিটিং ডাকা হবে…কালকেই হয়তো আমাদের হাতে টিসি ধরিয়ে দেয়া হবে…কালকের পর থেকে হয়তো যে কোনো সময় তাস খেলতে পারব… কারণ কালকের পর থেকে না আমাদের স্কুল থাকবে, না বাড়িঘর… টিসি পাওয়া ছেলেদের আর যাই হোক আমাদের বাবা–মায়েরা অযথা পুষবে না!
হিমেল মরিয়া হয়ে উঠল—বলল, স্যার, আসলে হয়েছে কি…
হেডস্যার ধমকে উঠলেন—কী হয়েছে কালকেই শুনব…
আমি হড়বড়িয়ে বললাম—আসলে স্যার গাজিস্যারের কাছে প্রাইভেট ছিল তো। তাই বইখাতা একটু লাগত!
হেডস্যার আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, কার কার প্রাইভেট আছে?
সোহেল মিউমিউ করে বলল, আমার আর হীরকের স্যার।
হেডস্যার বললেন, যাদের প্রাইভেট আছে তারা খাতা নিয়ে চলে যাও!
এ আরেক ফ্যাকড়া। শুধু খাতা নিয়ে গেলে বই থেকে যায়। তারচেয়েও বড় কথা আমরা দুজন যদি চলেও যাই বাকিদের কী হবে? আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে আরো কুঁকড়ে গেলাম।
হিমেল তখন নির্জলা মিথ্যা কথাটা বলল, স্যার, আমরা রবিউলের সাথে দেখা করতে গেছিলাম।
‘কোন রবিউল?’
‘গোলকিপার স্যার। ইন্টারস্কুলে ও আমাদের গোলকিপার হবে স্যার!’
ইন্টারস্কুল ফুটবল তখন সামনে সত্য… রবিউল আমাদের স্কুল থেকে অন্য স্কুলে পড়তে চলে গেছে এটাও সত্য… তাকে আমরা আমাদের গোলকিপার হিসাবে খেলাতে চাই এটাও খুব সত্য… আবার তার সাথে আমাদের গেমস্যার যোগাযোগ করতে বলেছিলেন তাও তো মিথ্যা না… কিন্তু এসবের সাথে আমাদের টিফিন পালানোর সম্পর্কটা যে একেবারেই কিছু না… হিমেলের এমন মিথ্যায় আমাদের মনে হলো নতুন এক বিপদের দিকে মোড় নিচ্ছে ব্যাপারটা!
অথচ হিমেল বলেই যাচ্ছে—গেমস্যার বলছিলেন তো স্যার ওর সাথে দেখা করতে। আমরা গেছিলাম। ও খেলবে আমাদের দলে স্যার। এবারের ফুটবল দলটা ভালো হবে স্যার। কাপ আমরাই পাবো।
হেডস্যার কী একটা সাইন করলেন। মুখটা একটু যেন স্বাভাবিক হচ্ছিল, কিন্তু এরই মধ্যে আরবি স্যার চলে আসলেন রুমে। পরিস্থিতি আবার নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করল। আরবি স্যার ঘরে ঢুকেই বলা শুরু করলেন, এমন ধড়িবাজ বেয়াদব ছেলেদের ক্লাসে রাখার কোনো মানে হয় না। এদের রেডটিসি দিয়ে বিদায় করে দেয়া উচিত। আর স্কুলে কী বই এনেছে দেখেছেন? গডফাদার! কী বই এটা!
হেডস্যার একটু থমকে বললেন, মারিয়ো পুজোর বই। খুবই বিখ্যাত।
আরবি স্যার তেড়িয়াভাবে বললেন, যত বিখ্যাতই হোক। এইসব বই স্কুলে কেন? আর যেসব কথা লেখা আছে… ওরা এসব পড়ে এ বয়সে? কার বই এটা? হীরকের?
টপ করে একটা আওয়াজ। এবার অন্যদিকে তাকাতে হলো না। নিজেরই ডান পায়ের কাছে পড়ল মাথার ঘামটা। কোনোমতে মাথা নাড়ালাম। আরবি স্যার বলে উঠলেন, এরা কীভাবে এসএসসি দিবে? একটাও তো পাশ করবে না! টিফিন পালায় এরা… এত সাহস!
হিমেল আবার মিথ্যার ঝুড়ি খুলে বসল, আমরা স্যার টিফিন পালাইনি। আমরা রবিউলের সাথে…ইন্টারস্কুল…গেমস্যার…
হেডস্যার ধরে নিলেন কথা এবার। বললেন, গেমস্যার তোমাদের যেতে বলেছিল?
আরেক ধরা! গেমস্যার তো যেতে বলেছেন সেই কবে। সেই কবে রবিউলকে ঠিক করে এসেছি।
হেডস্যার বললেন, গেমস্যারকে তাহলে ডাকতে হয়…
এবার আর পারলাম না। হিমেলের রাস্তায় ঝাঁপ দিলাম। বললাম, স্যার… স্যার… আসলে আমরা টিফিন পিরিয়ডেই চলে এসেছিলাম। কয়েক মিনিট দেরি হয়েছিল…
হেডস্যার তাকিয়ে আছেন ভ্রু কুঁচকে।
আমি বলে চললাম, গেটের কাছেও চলে এসেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে ক্লাস বসে গেছে… আর আপনি স্যার বারান্দায় ঘুরছেন… আপনার ভয়ে স্যার আমরা আর ঢুকতে পারিনি!
আমি যেটা করলাম… ‘ভয়ে‘ শব্দটার ওপর আলগা জোর দিলাম। দেখলাম হেডস্যারের ভ্রু একটু যেন নেচে উঠল। মুখে একটা আভা খেলে গেল। স্কুলের সবচেয়ে বাটপার ছাত্রগুলো তাকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপারটা বোধহয় তার পাথর গলাতে শুরু করেছে। আমি আবার বললাম, ভয় থেকেই স্যার আর ঢুকিনি ক্লাসে…
হেডস্যার এবার মাথা নাড়িয়ে হাসলেন একটু। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, এরপর ভয় পাবার দরকার নেই। ভয় তারাই পাই যারা অপরাধ করে। পর্যাপ্ত কারণ থাকলে ভয় পাওয়ার কী আছে, তাই না? যাও…
এই যাও বলাটা কেমন হলো বুঝিয়ে বলা মুশকিল। মনে হলো একশ মণ মাথার একেক জনের কাঁধ থেকে নেমে গেল। দ্বিতীয় কোনো ভয়ানক সিদ্ধান্ত যদি চলে আসে তাই দ্রুত বইখাতা বাগিয়ে নিলাম হাতে। তারপর বেরোতে ধরলাম স্যারকে সালাম দিয়ে। আরবি স্যার বলতে থাকলেন, কিন্তু স্যার, গডফাদার বই…ওইটা নিয়ে কিছু…
হেডস্যার বললেন, বিখ্যাত বই নজরুল স্যার। এগুলো পড়ারও দরকার আছে… আছে না?
আরবি স্যার আর কী বললেন আমরা জানি না। আমরা ততক্ষণে হেডস্যারের রুমের চৌকাঠ পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। আরাফাতরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। আমাদের দূরবস্থার প্রতক্ষ্যদর্শী হতে চায়। কিন্তু আমরা পর্দা ঠেলতে ঠেলতেই আমাদের শরীরিভাষা পাল্টে ফেললাম দ্রুত। ঘাড়টা এমনভাবে বাঁকা করে ওদের দিকে তাকালাম যার মানে দাঁড়ায়—হুহ! আমাদের আর কী করতে পারবে! এই যে দেখ… ফিরে এসেছি বহাল তবিয়তে!
ওদিকে আরাফাতদের চোখে ধীরে ধীরে অবিশ্বাস ফুটে উঠতে শুরু করল। আমাদের বুকগুলোও ভরে উঠল আনন্দ আর অহংয়ে। যেন, আমরাই, গডফাদার!
(ক্রমশ)