অক্সিজেন। পর্ব ৮। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রেম আর পার্টি
তালিবান নিয়ে কলেজেও জোর আলোচনা চলছে। ছুটির একটু আগে ক্যান্টিনে ঢুকেছিল ওরা। ও, বাচ্চু,অনু আর পাপু চারজনের একটা গ্রুপ। ওরা সকলেই পলিটিক্যাল সায়েন্সের। অজয় মাঝে মাঝে আসে। ওর সঙ্গে আসে ফার্স্ট ইয়ারের ঝিনা।অজয় কলেজ ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী। ও বেশিরভাগ সময় খুব ব্যস্ত থাকে। ঝিনা মানে ঝিন্ঝিনিকে নিয়ে ওরা অজয়কে খ্যাপায়।
পাপু সবসময় বলে প্রেম আর পার্টি দুটোই ‘প’ দিয়ে হলেও মনে রাখিস, দুটো একসঙ্গে হয় না।হয় প্রেম কর ,নয় …।
অজয় হেসেছিল “প্রথমভাগ ভাল করে পড়েছিলি? সেখানে ‘প’ ছিল। তোর নামেও ‘প’ আছে।আবোলতাবোল বকছিস কেন?কোষ্ঠ সাফ হচ্ছেনা বুঝি ? যত্তসব।আবেগের ঝুড়ি। আমি বলে বাড়ি যাওয়ার সময় পাইনা, আমি…। তোর ইচ্ছে থাকলে বল, ঝিনঝিনিকে বলব?”
“তাহলে ও কেন তোর সঙ্গে সারাক্ষণ সেঁটে থাকে?” বাচ্চুর প্রশ্নটা ছিল আসলে সবার। ওই ঝিন্ঝিনি ভারী অদ্ভুত মেয়ে। রোগা ডিগডিগে চেহারা। তার ওপর বিদঘুটে অদ্ভুত সব পোশাক-আশাক পরে। ও নাকি নিজের পোশাকের নিজেই ডিজাইন করে।ফেসবুকে মাঝেমাঝে ওর ডিজাইন করা পোশাকের ছবি আপলোড করে। ডিজলাইকের অপশান থাকলে ও নির্ঘাৎ তাই দিত।
ঝিনঝিনি একদিন বারোটার সময় কটকটে রোদ্দুরে, কালো একটা কুর্ত্তি আর সাদা ঢোলা পাজামা পরে এসেছিল। কুর্ত্তির বুকের ওপর লাল গোলাপের এমবর্ডারি। সবচেয়ে অদ্ভুত যেটা ও ওদের সঙ্গে থাকলেও কখনওই কারোর সঙ্গে নিজে থেকে বাক্যালাপ করেনা। ঠোঁট বন্ধ করে রাখে। কিসের যে ডাঁট! কিংবা বোঝে হয়ত যে ওরা ওকে অপছন্দ করে। সেদিন ওই অদ্ভুত পোশাকে ওকে কিম্ভুত লাগছিল। যেন খ্যাংড়া কাঠির মাথায় মাটির হাঁড়ি ।
বাচ্চু ওকে ফিস্ফিস্ করে বলেছিল, “দেয়ার ইজ আ ব্ল্যাক ঘোস্ট।” ও হাসি চাপতে না পেরে টয়লেটে চলে গেছিল।
ঝিন্ঝিনির আর একটা রোগ ঝিন্ঝিনি অজয়কে এক মুহূর্ত একা ছাড়েনা। সারাক্ষণ সেলোটেপের মত অজয়ের সঙ্গে লেপটে থাকে। অজয় অবশ্য বলে, “তোদের জন্য ও এরকম করে। তোরা তো কেউ ওর সঙ্গে কথা বলিস না।
কেউ কথা বলেনা এটা ঠিক নয়। অনু বলে। এদিনও অজয় ক্যান্টিনে ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। সঙ্গে যথারীতি ঝিন্ঝিনি। ঝিন্ঝিনি গোলাপী রঙের একটা কামিজ পড়েছে। তার ওপর নীল ওড়না জড়িয়েছে। নিচে আবার একটা নীল লেগিন্স্। ঝিন্ঝিনিকে ভাগানোর জন্য পাপু বলল, “ঝিন্ঝিনি আমাদের কিছু প্রাইভেট কথা আছে অজয়ের সঙ্গে, তুমি বরং একটু ঘুরে এসো।”
অজয় সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে বলল, “ঠিক আছে আমরা আজ আসি। পরে কথা হবে।”
অনু বলল, “অজয় বসে যা। সিঙারা আসছে। সিঙারা খেয়ে যাও ঝিন্ঝিনি।”
ওরা আবার বসে পড়ল সিঙারা খেতে।
সারাটা সময় ঝিন্ঝিনি নির্বিকার রইল। একটাও কথা বলল না। অজয় চলে যেতে পাপু বলল, “অনু , এটা কী হল? আমি ওই ঝঞ্ঝাটকে ভাগাচ্ছিলাম, তুই বসালি কেন?”
অনু যেমন বলে, তেমনই ঠান্ডা গলায় বলল, “আমাকে তাহলে ডাকিস না। আমি এসব অসভ্যতা ঠিক টলারেট করতে পারিনা।”
বাচ্চু বলল, “লে হালুয়া। তোরা মেজাজটাই বিগড়ে দিলি মাইরি। একে অতগুলো পয়সা গেল। আবার রাগারাগি। সিঙারাগুলোই অপয়া!”
কুহু কিছুতেই মন দিতে পারছিল না। ওর মাথায় ভাসছিল দিদির মুখ। উঠে পড়ল ও। মাস ফুরোলেই নতুন টিউশানিটায় যেতে হবে। ওর সাইকেলটা ঠিক মত কাজ করছে না। এটা আবার একটা চিন্তার ব্যাপার হয়েছে। বাবলুর দোকানে সাইকেল সারাতে দিয়ে ও দুদিন ধরেই অটো টোটো চাপছে। সাইকেলে না চাপলে ওর ঠিক ফ্রি লাগেনা, স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে মনে হয়।
দিদির পুরনো সাইকেলটা চাপত ও। দিদি চাপতে চাইত না। সেই সাইকেলটার ব্রেক, চাকা, সিট সব ঝরঝরে হয়ে গেলেও ও চাপা থামায়নি। বন্ধুরা খ্যাপাত, তবু ওই সাইকেলেই ওর বিশ্বভ্রমণ চালু থাকত। হায়ারসেকেন্ডারীতে ভাল রেজাল্ট করলে মা ওকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে এই লাল সাইকেলটা কিনে দেয়। খুব আনন্দ হয়েছিল ওর। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সাইকেলটার একটা নাম দেয় কুহু। নামটা হল ‘জুহু’। এই ব্যাপারটা কেউ জানেনা। একদম গোপনীয়, ব্যক্তিগত খামে ও নামটা লিখে রেখেছে।
কোনদিন খুব দুঃখ বা আনন্দ হলে সেটা জুহুর সঙ্গেই শেয়ার করে ও। জুহু বোবা নয়, মাঝে মাঝে ক্রিং ক্রিং করে সাড়া দিতে পারে। ওভাবেই কথা বলে ও। কিন্তু কালা তো! তবু কিকরে যেন কুহুর সব কথা বুঝতে পারে। কদিন ধরেই খুব একলা লাগছে কুহুর। জুহু এখন বাবলুর ডাক্তারখানায়, ওর অনেক কিছুই বিগড়েছে। সারতে সময় লাগবে। মাঝেমাঝেই কুহু দেখতে যাচ্ছে ওকে।
বাবলু বলছিল, “সারাতে একটু সময় লাগবে। হাতে অনেকগুলো কাজ আছে। লাইন অনুযায়ী হবে। তাড়া থাকলে তোমার সাইকেল অন্য কোথাও দিয়ে দাও বাপু। আমি তাড়াহুড়ো করতে পারব না।”
ও কথাটার উত্তর দেয়নি। সাইকেলটা ওখানেই দিয়েছে যখন, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সবকিছু ঠিকঠাক করতে সময় নিলে নিক।তবে কয়েকদিন বাদেই ওটার খুব প্রয়োজন হবে। কিছুদিনের মধ্যেই ও কলেজ ফেরৎ নতুন বাড়িতে পড়াতে যাবে। ছেলেটি ক্লাস এইটে পড়ে। বড়লোকের ছেলে। নাহলে বাংলা, ভূগোল আর ইতিহাসের জন্য কেউ ক্লাস এইটেই টিউশান নেয়? আর ওর মত কলেজের ছাত্রীকে একহাজার টাকা দেয়।
বাচ্চু অবশ্য বলছিল আজকালকার গার্জেনরা নাকি স্ট্র্যাটেজি পাল্টেছে। আগে চল ছিল স্কুল টিচারের কাছে পড়তে দেওয়ার।তাতে পরীক্ষায় সাফল্যের হার বেশি হবে মনে করা হত। এখন কমবয়সী বিষয়ভিত্তিক কলেজ বা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের গুরুত্ব বেড়েছে। মনে করা হচ্ছে তারা অনেক বেশি দায়িত্ববান। পড়ানোতে তাদের উৎসাহও যথেষ্ট থাকে। তাই কলেজ বা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের ট্যুশানির বাজারে এখন হাই রেট চলছে।
বাচ্চুর মাধ্যমে এই টিউশানির যোগাযোগটা হয়েছে। বাচ্চু খুব টিউশানি করে। ও বলেছিল, “আমায় একটা দেখে দে না।”
বাচ্চু বলছিল সেদিন, “আমি তোর জন্য স্যাক্রিফাইস করছি বুঝলি? সামনে পুজো। বড়লোক গার্জেন, হয়ত প্যান্টপিস, শার্টপিস দিত। যাকগে, ছেড়ে দিলাম…।” বলে মস্ত একটা হাই তুলেছিল ছেলেটা। রাগে গা পিত্তি জ্বলে গেছিল ওর।
“তোকে ছাড়তে কে বলেছে? আমায় দয়া করছিস? আমি ওই ট্যুশানি করব না। তুই কর।”
বাচ্চু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল খানিক। তারপর বলল “তোর বড্ড রাগ। রাগলে মুখ একেবারে লাল হয়ে যায়। তোর বর তোকে খুব ভালোবাসবে দেখিস। মাইরি বলছি।”
“আবার ওই মা দিয়ে শব্দ! আর একবার ওটা বললে তোকে পেটাব।”
“তুই ওটাই শুনলি? তার আগের ভালকথাটা দিব্যি হজম করে ফেললি তো।”
জবাবে হাত তুলেছিল ও। কলেজ গেটের ঠিক বাইরে কালোদার ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়েছিল ওরা। মোটামুটি ফাঁকা ছিল চারপাশ। কালোদার এসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। জল গরম করতে করতে একবার আড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দুধচিনি দোব, না শুধু লিকার?”
কুহু বলল “দুটো চা দেবেন, দুটোতেই দুধ, চিনি।”
বাচ্চু চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খুব নিরীহ গলায় বলে, “এখন চা আর সুজিবিস্কুটই কাফি। পরে মাইনে পেলে কিন্তু এত কমে হবেনা …।”
ও আর রাগ করতে পারেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চুর সঙ্গে চা খেয়েছিল। মাঝেমাঝে মনে হয় ওর, এই বাচ্চু, অনুদের জন্যই বেঁচে থাকাটার বেশ মানে আছে এখনও। দিদির জন্য সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা চলে। ওদের সেই হাসিখুশি বাড়িটা একদম পালটে গিয়েছে। বাবার অসুস্থতা নিয়ে মায়ের উদ্বেগের শেষ নেই। তবে ও জানে তার থেকেও বড় কষ্টের কারণ দিদির চলে যাওয়া। মাঝেমাঝে একথাও মনে হয় মা হয়ত দিদির অস্বচ্ছলতার খবর রাখে। তাই খাওয়া পরায় দিনদিন উদাসীন হয়ে যাচ্ছে।
বাবা আগেও কম কথা বলত। এখন নিজের অসুস্থতা নিয়ে আরো সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। মাঝ থেকে ওর আর বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। ওই আবহাওয়ার গুমোট কাটাতে ও বাইরেই বেশি থাকে। এখন অবশ্য পুরনো স্বপ্নটা নতুন করে দেখছে ও। একেবারে পর্বত শৃঙ্গ বিজয়ের স্বপ্ন! বিশাল উঁচু একটা পাহাড়ের চূড়োয় ও উঠবে। একদম একা দাঁড়াবে ভারতের পতাকা হাতে।তারপর…।
ওই তারপরটা নিয়েও মাঝেমাঝে চিন্তা হয়। আশেপাশে তখন আরো কিছু মানুষকে ওই শৃঙ্গে চড়ার অনুমতি দিয়ে দেয় ও। আসলে যাওয়ার সময়ে সঙ্গী না থাকলেও ফেরার পথে একদম একা একা ফেরার ব্যাপারটা ভাবনাতেও ঠিক নেওয়া যাচ্ছেনা।অতক্ষণ মুখবুজে ও থাকবে কী করে?
মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল ও। সারাক্ষণ মাথায় একই চিন্তা ঘুরছে। এটা ঠিক নয়। গম ভাঙানোর দোকানে ফেরার পথে একবার ঘুরে যেতে হবে। যাওয়ার সময় রেশনের গমটা ভাঙাতে দিয়ে গিয়েছিল।
এমাস থেকেই সংসার খরচের টাকা মা ওর হাতে দিয়ে দিয়েছে। এখন ও দেখছে খরচ কীভাবে কমানো যায়। কেননা বাবার ওষুধের খরচা দিনদিন বাড়ছে। আর বাবার জমা টাকার সুদের হার দিনদিন কমছে।
মা হাসছিল, “পাকা বুড়ি একটা। রেশনের গম ভাঙিয়ে কবে খেয়েছি আমরা? বরাবর কিনে আটা খাওয়া হয়। এসব তোর মাথায় আসছে কীকরে?”
উত্তরে ও হেসেছিল শুধু। বাবা অফিসে থাকাকালীন পুজোর সময় বড়সড় বিস্কুটের একটা টিন আসত বাড়িতে। নানারকমের বিস্কুটে ভরা থাকত সেটা! আসার পর ও, দিদি আর মা বাছাই করে নানা কৌটোয় ভরত সেগুলো। ভরতে ভরতে মা কোন কাজে সরে গেলে ভালো ক্রিম দেওয়া দু’একটা বিস্কুট ওদের গালে ঢুকে যেত। বাবা দেখলেও মাকে যে বলবে না, সেটা ওদের জানা ছিল।চেয়ারে বসে কাগজ হাতে বাবা শুধু ওদের বাছাবাছি পর্ব দেখত আর মুখটিপে খুশির একটা হাসি হাসত। ভারী আনন্দের দিন ছিল সেটা। এবারে পুজোর আগে ওরকম একটা বিস্কুটের টিন আনার ইচ্ছে আছে ওর। তার জন্য পয়সা বাঁচাতে হবে।
জুহুকে বলেছে ও, “শোন এবারে পুজোর আগে ওরকম একটা বিস্কুটের টিন আমার চাই, বুঝলি? একটা কৌটোয় সবরকমের বিস্কুট ভরব। তারপর দিদির কাছে নিয়ে বলব, “দ্যাখ, তোর ভাগটা নিয়ে এসেছি। ফেরৎ দিতে পারবি না।”
মাঝেমাঝে ওর সবটা গুলিয়ে যায়। দিদির কি সত্যিই এবাড়ির কোনকিছুতে ভাগ আছে আর? এ কথাটার উত্তর কেউ দেবে না।কিন্তু ওর মন বলে, আছে দিদিরও হক আছে সবকিছুতে।
(ক্রমশ)
দারুণ