অক্সিজেন। অন্তিম পর্ব। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বপ্নের বালুচরে
ছোটবেলায় খেলা করতে করতে বালির পাহাড়ে উঠত কুহুরা। তারপর পা ডুবিয়ে ভুস্ করে নেমে আসত নীচে। ওই বালির পাহাড়ের পাশে ঘরবাড়ি তৈ্রির অনেক মালমশলা পড়ে থাকত মাটিতে। ওইসব জড়ো করত ভবিষ্যত বাড়ির মালিকেরা। তাদের ঘর হবে, দোকান হবে,সংসার হবে ।
ঠিক সেইরকম একটার পর একটা বালির পাহাড় দেখেছিল কুহু। সব সম্ভাবনা বাতিল করে ও এগিয়েছিল ধবলগিরির পথে। আজ আবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওর, পুরনো সেই সব বালির পাহাড়ের কথা।
বিলুকে দেখতে গিয়েছিল বিলুর বাড়িতে। সেই শেষ। তারপরে এখনও অবধি আর যাবার দরকার হয়নি। কিন্তু বিলু আসত। দেখে যেত ওকে ছোটের বাড়িতে। ফাঁকফোকর খুঁজে গল্প করতে বসে যেত ওর সঙ্গে। পিন্টুও থাকত সঙ্গে। ওর দিদিমনিকে চোখের আড়াল করার কথা ভাবতে পারত না ছেলেটা। পিন্টুর মা মাঝেমাঝেই আসতেন। যোগ দিতেন ওদের সঙ্গে।
এসব ছাড়াও বিলুর ম্যাসেজ আসত। ও উত্তর দিত। কিছু যে বোঝেনি তা নয়। কৃতজ্ঞতার একটা মাপ থাকে কোথাও। সেটা ছাপিয়ে অন্য হাওয়ার খেলা চলছিল যা মেয়েরা সহজেই বোঝে। বুঝলেও কুহু সরে আসতে পারেনি। তবে নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতেও চায়নি। সেই কোন ছোটতে একটা বই পড়ে ও পাহাড়ের পথ চিনেছিল। অত সহজে তা ভোলে কী করে?
বাড়ির অবস্থা দিনদিন ঘোরালো হচ্ছে তখন। বাবার স্বাভাবিক হওয়ার আশা ছিলনা অনেকদিনই। অবস্থাটা যে আরো খারাপের দিকেই গড়াচ্ছে, তা দেখে বুঝেও কিছু করার ছিলনা। দিদি পাথরের মত। ঘোরে ফেরে, খায় দায়, কিন্তু কোন অভিব্যক্তি নেই।ওকেও টুকটাক ডাক্তার দেখানো হলেও, সেভাবে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সবকিছুর মূলে একটাই সঙ্কট। সেটা টাকার। তাই মনেমনে পাহাড় জয়ের কথা ভাবলেও তেমন কোন পথ চোখে পড়ছিল না। আগে পরীক্ষা পাস, তারপরে চাকরি। তারপর হয়ত অভীষ্ট সিদ্ধি। কুহু জানত ওপরে ওঠার কোন শর্টকাট হয়না। আর ওর মত মেয়েদের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙেই উঠতে হয়।
দুই আর দুই-এ চার হয়। তিন হয় না। সেকথাটা বোঝা গেল কয়েকদিনের মধ্যে। সামনে পরীক্ষা। চেপে পড়াশুনা করছে ও। হঠাৎ করে শক্তিদা ডেকে পাঠালেন ওকে।
“তোমার পড়াশুনার খবর কী?”
“ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। আর একসপ্তাহের মত সময় হাতে আছে।”
“সব মিলিয়ে আরো একমাস, কী তাইতো।”
“হ্যাঁ তা বলতেই পারেন।”
“তারপরের পরিকল্পনা? রেজাল্ট বেরোন অবধি বেকার তো?”
“বেকার মানে, ট্যুশানিগুলো আছে।”
“বুঝলাম। কত পাও সবমিলিয়ে?”
“হাজার তিনেকের মত।”
“ঠিক আছে। ওগুলো আপাততঃ থাক। আমাদের ক্লাবে বাচ্চাদের ফিটনেস ট্রেনিং প্রোগ্রাম শুরু করছি। প্রতিদিনের ব্যায়াম খেলাধূলো ছাড়াও মাঝে মাঝে ওদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ট্রেকিং, পাহাড়ে চড়ার মত কিছু কোর্স করানো হবে। আমি সোমাকে বলেছি। আপাততঃ তুমি আর সোমা প্রোগ্রামটা শুরু করে দেবে। জগদীশ এর ফিজিওথেরাপীর কোর্স করা আছে। ও থাকবে। ওই বাচ্চাদের এ্যাডমিশান হয়ে গেলেই কত টাকা দিতে পারব ,বলব। কী তুমি রাজি তো?”
চট্ করে ভেবে নিয়েছিল ও। শক্তিদাকে না বলা কোনমতেই সম্ভব নয় । আর ওনার একটাই দুর্বলতা, ক্লাব। বিনা পয়সায় হলেও সার্ভিসটা দিতেই হবে ওকে।
“কী ভাবছ? পরীক্ষাটা দিয়ে নাও। আপাততঃ সোমা আর জগদীশ শুরু করে দিক। তুমি চাকরি পেলে তখন অন্য ব্যবস্থা হবে। ঠিক আছে? এখন এসো। আর একটা কথা এখনই সবাইকে সবটা বলতে হবে না। বোঝই তো, অনেকের অনেক ক্যান্ডিডেট আছে।আমি তোমার নামটা সাজেস্ট করেছিলাম।”
ও হ্যাঁ বলে বেরিয়ে আসার সময় আবার শক্তিদা ডাকলেন ওকে। মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এখুনি এভারেস্ট নয়।ধবলগিরি, অন্নপূর্না, বা লোতসের মত কিছু ভাবতে হবে। ঠিক আছে।”
ও আবার ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়েছিল।
পরীক্ষাটা খারাপ হলনা। আর একটা ঘটনাও ঘটল একই সঙ্গে। মীরা কাকীমা ডেকে পাঠালেন । ওনার বাসনাটাও ব্যক্ত করলেন খুব কুন্ঠার সঙ্গে।
“আমার খুব ইচ্ছে বিভুর সঙ্গে তোর…। তুই কী রাজি আছিস? জানি বয়সের ফারাকটা …।”
কুহু মনে মনে বলেছিল অসম্ভব। মুখে তা বলেনি।
“না না ওসব নয়। তুমি তো জানো পাহাড়ে আমি উঠবই। আর তার জন্যই একটু একটু করে …। আমার দ্বারা যে আর কিছুই হবে না। তুমি আমাকে ভুল বুঝ না।”
আরো কিছুদিন পরে, কুহু যখন রোজকার রুটিনে দৌড়াচ্ছে, একদিন একটা ম্যাসেজ এলো বিলুর। “আর কতদিন অপেক্ষা করব? তুমি কী কিছুই বোঝ না?”
ও একটা কথাই লিখেছিল, “আমার স্বপ্ন আপাততঃ একটাই। আমি ধবলগিরিতে উঠব।”
তারপর বিলু দেখা করেনি যোগাযোগ করেনি বহুদিন। অন্ততঃ ছ’মাস হবে। কুহু নিজেও চুপচাপ ছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে চায়নি ও। ক্লাবের ট্রেনিং নিতে আসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পুরুলিয়া গিয়েছিল। ফিরে আসার পর পিন্টু একদিন বলল “দাদাভাই স্কলারশিপ পেয়েছিল আমেরিকার । ওখানেই পড়তে চলে গেল।”
…………………………………………………………
আরো বেশ কিছুদিন পরে একটা ছোট ম্যাসেজ এসেছিল ওর ফোনে।
“পাহাড় চূড়োয় বরফ থাকে। ওখানে উঠলেও নেমে আসতে হয়। বাস করা যায়না। তুমিও নামবে একদিন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।”
…………………………………………………………
কুহু জানে কিছু কিছু মানুষকে দেখে বোঝা যায়না। তারা আসলে এক একটি পাহাড়। নিজের জায়গা থেকে একটুও নড়েনা। বিলু কি সেরকম একজন?
কুহু তো নিজেকে চিনেছে বহুদিন আগেই। ও যে বরাবর এক লক্ষ্যে স্থির। শুধু পাহাড় জয়ের কথাই ভাবে।
(সমাপ্ত)
অসাধারণ একটি উপন্যাস! মন ভরে গেছে। তবু থেকে গেল কৌতূহল। আশায় রইলাম যদি দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়।
ভালো লাগলো….