অক্সিজেন। পর্ব ৪। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
বন্ধ দুয়ার
দরজার সামনে ব্যালকনিতে কাগজটার ধপাস্ করে পড়ার আওয়াজ পেল মীরা। আজ চারদিন হল ও বিছানায় লেপটে শুয়ে আছে। এককাপ চা করে খাওয়ার শক্তি নেই। দু’দিকের দেওয়ালের পাশেই বড়জা,মেজজা থাকেন। এককাপ চা কাগজের কাপে ওরা ইচ্ছে করলেই দরজার পাশে রেখে যেতে পারেন। কিন্তু একদিনে ওদের সাড়াশব্দ পাননি উনি।
করোনার ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে রঞ্জিতের দাদার দুই পরিবার। ধারেকাছে আসছে না। এসব দেখলে মনে কষ্ট হয়। কতদিন একসঙ্গে ছিল ,কতকিছুই করেছে ওদের সবার জন্য। আর আজ, সব ভুলে গেল?
নিজেকে জোর করে তুলে দাঁড় করাল মীরা। ওষুধ আছে। তার আগে কিছু খেতে হবে। রান্নার মেয়েটিকে বারণ করায় দুদিন আসেনি। কাছেই একটা সেন্টারে ফোন করে অর্ডার করে দিয়েছে ও। দুপুরে মাছভাতের একটা মিল ওরা রোজ কলিংবেল বাজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সামনের ব্যালকনিতে। কিছুটা খেয়ে বাকিটা রাতের জন্য রেখে দিচ্ছে ও। কিন্তু সকালের চা,জলখাবার, বিকেলের চা?এতকষ্টেও হাসি পেল মীরার। অভ্যাস বড় বালাই।কতলোক একবেলাই খেতে পায়না।
বাথরুম থেকেই আওয়াজ পাচ্ছিল। কলিংবেলের টানা আওয়াজ। দরজা খুলে তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। সামলে নিয়ে এগোল মীরা। ওই আওয়াজের সঙ্গে একটা গলার আওয়াজ ভেসে আসছে না?
“কাকিমা,কাকিমা, আমি কুহু।”
“তুই আবার এলি কেন?” দরজা খুলে দূরেই দাঁড়াল মীরা।
“আসিনি তো। তোমার ব্যালকনির নীচের ফাঁক গলিয়ে…। নিয়ে নাও।আবার কুকুর বেড়ালে মুখ দেবে।”
“কী আছে?”
“দেখে নাও। আমার টিউশানি আছে। দাঁড়াতে পারব না।”
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মীরা। ন’টা বাজে। রোদ উঠছে। ব্যালকনির ওপর মুখবাঁধা কাগজের কাপে এককাপ চা, একটা খাবারের প্যাকেট। হাতে বানানো প্যাকেট খুলে দেখল ও। দুটো রুটি, একটু তরকারি।
কুহুর চলে যাওয়ার, গেট লাগানোর আওয়াজ পেয়েছে ও। টেবিলে রুটি তরকারির প্যাকেট রেখে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে কোনভাবে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিস্কুটের কথা মনে হয়। থাক শুধুই চা খাবে। বিস্কুটের জন্য আর উঠতে ইচ্ছে করছে না।
বিভু কাল রাতে ফোন করেছিল। “মা, কেমন আছ? মলিনাদি আসছে?”
মলিনা এবাড়ির হোলটাইমার। আসছে না। রঞ্জিত নার্সিংহোমে ভর্তি হবার পর ও বারবার বলেছিল আসবে। মীরা আপত্তি করেছে।কিন্তু ছেলেকে সেকথা বললে কালই টিকিট কেটে চলে আসবে। আবার মিথ্যে বলতে জিভে আটকায়। পুরনো সংস্কার।
আসলে বিভুর বাবার এই হাসপাতালে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও। দুটো ভ্যাকসিন্ দেওয়ার পর তারা বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। সেটাই কাল হল।
রঞ্জিতদের পরিবার বেশ বড়। লোকজনও অনেক। কদিন আগেই ওর দিদির ছেলের বিয়েতে যাওয়া হল। বাড়িশুদ্ধু সবাই গিয়েছিল। তখনই সাবধান হলে এমন হত না। সুগার আছে ভালরকম। কদিন ধরেই খাওয়ায় অনিচ্ছা। গন্ধ পাচ্ছিল না খাবা্রে। সব জানা সত্ত্বেও রঞ্জিত নিজে বা মীরা নিজে তেমন গ্রাহ্য করেনি। সেটাই কাল হল। তিন চারদিন পরেই সেই কান্ডটা ঘটল যা ভাবাই যায়নি। বাথরুমে পড়ে গেল রঞ্জিত, টেস্ট করতে হল ডাক্তারের নির্দেশে। করোনা ধরা পড়ল।
ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল ও। ডাকটা খেয়াল করেনি। রাধা ডাকছে। মাস ছয়েক আগে এই পাখিটা পড়েছিল উঠোনে। ময়নার বাচ্চা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দরজার চৌকাঠে জল দেবার সময় দরজা খুলতেই চোখে পড়ে পাখিটাকে। ভয় পেয়ে চেঁচাচ্ছিল। “চিঁ চিঁ” করে ডাকছিল। খুব ক্ষীণ আওয়াজ বেরোচ্ছিল গলা থেকে। বুকের কাছে তুলে ধরতেই হাঁ করে কিছু বলতে চেয়েছিল ও। লাল সেই মুখগহ্বরের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছিল জন্মানোর ঠিক পরেই বিভুর ছোট্ট হাঁ মুখটার কথা। ঘরে নিয়ে এসেছিল পাখিটাকে। তখনও কাঁপছিল থরথর করে, কোন এক অজানা ভয়ে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, তুলো ভিজিয়ে হাঁ মুখে জল দিয়ে কোনমতে শান্ত করে ওকে। তখনও বোঝেনি ওটা কী পাখি। পরে মলিনা বলল “কাকীমা ওটা ময়না।ময়নার বাচ্চা।একটু বড় হলেই কথা বলতে শিখবে। যা তুমি শেখাবে,তাই বলবে।”
তখন অত কিছু ভাবেনি ও। কী করে বাচ্চাটাকে বাঁচাবে সেই চিন্তাই মাথায় ছিল শুধু। কদিন বেশ ধকল গিয়েছিল তার। খাঁচা না আনা অবধি দু’একদিন ওটাকে প্লাস্টিকের ফুটো ফুটো ঝুড়ি চাপা দিয়ে রান্নাঘরের ওপরের তাকে রেখে দিয়েছিল। তাতেই একেবারে ঝিমিয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটা। তারপরে তাকে দুধ খাওয়ানো। তুলো দুধে ভিজিয়ে খাওয়াতে হত। অনেক ঝামেলার পর বাঁচল ওটা। নাম রাখা হল ‘রাধা’।
রঞ্জিত হাসছিল, “রাধা নাম রাখলে। ও ফিমেল কীনা জানো?”
কট্কট্ করে তাকাতে বলেছিল, “না টিঙ্কু বা পিঙ্কু নাম রাখলে সবদিক বজায় থাকত। তাই বলছিলাম আরকি?”
অভির পুরনো ফিডিংবোতল বার করতেও রঞ্জিত মজা করতে ছাড়েনি। “কি ম্যাডাম আবার হবে নাকি? তা যিনি আসছেন তিনি কোন দেবতার দান? আমি তো অনেকদিন মহারাজ পান্ডু হয়ে আছি।”
সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ইয়ার্কি মারা বরাবরের অভ্যাস রঞ্জিতের। এবারেও নার্সিং হোমে যাওয়ার আগে ওই অসুস্থ অবস্থাতেই মুচকি হেসে বলেছিল, “আলমারির লকারে ব্যাঙ্কের বইগুলো আছে। বুঝে নেবে নাকি? কে জানে ফিরব কি ফিরব না।”
রঞ্জিতের জ্বর এসেছিল বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার ঠিক দু’দিনের মাথায়। চাপা সর্দি আর গন্ধ না পাওয়ার উপসর্গ তো ছিলই। তারপর বাথরুমে পড়ে যায়। ডাক্তার আসে। ঠিক তখনই ননদের ছেলে কালুও এসেছিল খবরাখবর নিতে। দু’জনেরই করোনা টেস্টের জন্য স্থানীয় ল্যাবে ফোন করে দেয়। রিপোর্টে দুজনেই পজেটিভ হওয়ায়, রঞ্জিতের জ্বর বাড়ার পর পড়ে যেতে আর রিস্ক নেয়নি ও। কালুকে বলে নার্সিংহোমে পাঠিয়ে দেয় মানুষটাকে। তাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চায়নি রঞ্জিত।
বলেছিল, “আমি যাব না। কিচ্ছু হবে না। তুমি শুধুশুধু ভয় পাচ্ছ।” তবু যেতে হল। রঞ্জিতের নার্সিংহোমে ভর্তি হবার পর তার শরীর আরও খারাপ হচ্ছে। অনেকটা মানসিক। দুটো করে ডোজ দুজনেরই হয়ে গিয়েছে।ওইটুকুই যা ভরসা। কালু ফোন করে খবর নিচ্ছে। ওকেও আসতে বারণ করেছে ও ।
দাদা বৌদি কাছে থাকলেও ফোনেই খোঁজখবর নেয়। বয়স হয়েছে। আসতে পারেনা। পাশের বাড়ির কুহু নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে। ও যা টুকটাক সাহায্য করছে তাই কম কি?
“খেতে দে। দে।”
ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল মীরা। রাধা না? ওকে খেতে দেওয়া হয়নি। বেচারি চেঁচাচ্ছে। ওকে জলও দিতে হবে। অবোধ জীব।কি বোঝে অসুখের?
ভেজানো ছোলা বাটি করে নিয়ে খাঁচা খুলে ওর বাটিতে ঢেলে দিল মীরা জল দিল খাঁচায় রাখা কাপে। রাধা লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আগেই জলের বাটিতে মুখ ডোবালো।
আহারে, খুব তেষ্টা পেয়েছিল। কেমন মুখ গলা ডুবিয়ে চুকচুক করে জল খাচ্ছে। রাধার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল তার করোনা হয়েছে। ওকে খাবার দিলে, জল দিলে, ওর করোনা হয়ে যাবে না তো? তারপরেই হাসি পেল, পাখির করোনা হয়েছে এমন কথা এখনও শোনা যায়নি। তার মাথায় যত উদ্ভট চিন্তা খেলা করে।
(ক্রমশ)