অক্সিজেন। পর্ব ১৮। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

0

গত পর্বের পর

কাছে দূরে

মীরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছিল আকাশটা খুব কালো করে এসেছে।বৃষ্টি হবে।রাধার খাঁচাটা পেছনের খোলা ছাতে আছে।সরানো দরকার ।একটু আগেই ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ও বলল “লাল্টু,লাল্টু।”

অবাক লাগল তার ।লাল্টু এসেছে যে ও কিকরে জানল?ও তো পেছনের ছাদে ছিল।তারপরেই নজরে এলো ব্যাগটা।লাল্টুর মা পাঠিয়েছে নির্ঘাৎ।একফাঁকে টুক করে এঘরে রেখে নিজের ঠামির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ছেলেটা।ওকে বলতেই ভুলে গিয়েছে। রাধার নজর এড়াতে পারেনি।

সেদিন লাল্টুর মা সুতপা এসেছিল।এমনিতে খুবই শান্ত।কিন্ত একেবারে নিজের মতে চলে।এবাড়ির তুলনায় ওর বোধ বুদ্ধির ধারা উন্নত ।কদিন আগেই লাল্টুর জন্মদিন গিয়েছে।ওর জন্য একটা কাঁসার কাজকরা ডিস  কিনে রেখেছিল মীরা। সেটা ওর হাতেই দিয়েছিল।তাই বোধহয় কিছু খাবার করে পাঠিয়েছে।

ব্যাগের মধ্যে রাখা টিফিন কৌটোটা খোলে ও।একটা খোপে মালপো,বাকি দুটোর একটায় সুজির পায়েস,অন্যটায় আলুরদম।এত তো তারা একা খেতে পারবে না।কুহুকে কিছু দিয়ে আসতে হবে।

লাল্টু একটু আগেই সাইকেল নিয়ে তার কাছ থেকেই বেরিয়েছে।বাড়ি ফিরবে ও। ওরা অনেকদিন এবাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে।মীরা বুঝতে পা্রে বড়জা মানুষটা খারাপ নয়।কিন্তু একটুও আবেগ নেই ওনার।নিজের ছেলে,বউ,এমনকি নাতিকেও কাছে টানতে পারেননা।লাল্টু সুযোগ পেলেই তার কাছে এসে ঘুরে যায়।টুকটাক কিছু খায়।গল্প করে। রঞ্জিতও লাল্টুকে খুব ভালোবাসে।

অবশ্য রঞ্জিতের লাল্টুকে ভালোবাসার ব্যাপারটা পরে।রঞ্জিতের খুব টান লাল্টুর বাবা নিজের ভাইপো মনোজিত মানে মনো্র ওপর। বউদির সঙ্গে ভাইপো বউএর মিটমাট করিয়ে, এবাড়িতেই ওদের রেখে দেবার অনেক চেষ্টাই করেছিল ও।পারেনি। রঞ্জিতের দাদা মারা যাবার পর মিটমাট হবার একটু আশা ছিল।সেটাও হলনা  বউদির জেদে।বউদি কাজের লোকজন রেখে একদম একলা এবাড়িতে পড়ে আছে্ন।তবু ওদের বলেননি বাড়িতে ফিরে আসতে।

শাশুড়ি বউএর প্রথম থেকেই মিলমিশ হয়নি।মনো নিজে পছন্দ করে সুতপাকে ঘরে এনেছিল। আর সেজন্যই হয়ত মনোর মা কোনদিন ওকে পছন্দ করতে পারেননি। এবাড়ির মানুষজন কোনদিনই খুব একটা সুবিধের নয়।এদের মায়া বড় কম। নাহলে তাদের অসুখের সময় বাড়ির বাইরের লোকের সাহায্য এলো।কিন্তু এরা ঘরের লোক হয়ে নিস্পৃহ রয়ে গেল!

একমাত্র সুতপাই দুদিন ফোন করেছিল।খবর নিয়েছিল।খাবার পাঠানোর বায়না জুড়েছিল।মীরা অবশ্য রাজি হয়নি।আজ তাই কোন কথা না বলেই ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।

লাল্টু আজ এসেই বলেছিল “মাম্‌মাম্‌ কিছু আছে? খিদে পেয়েছে।”ওই বলল, “ঠামি বাবাকে বলেছে, ওবাড়িতে লাল্টুকে যেতে বারণ কর।ওদের করোনা হয়েছিল।”

“তোর বাবা কী বলল?” মীরা জানতে চায় নাতির কাছে।

বাবা ঠামিকে বলল, “ওরকম করলে আমায় চাকরি ছাড়তে হবে।করোনার ভুক্তভোগীর সংখ্যা তো আমার অফিসে নেহাত কম নয়।তারা সবাই চোদ্দদিনে সুস্থ হয়েছে।ছোটকাকুরা তো একুশ দিন কাটিয়ে ফেলেছে।”

মীরা হাঁ করে ওর কথা শুনছিল। সমস্ত কথা টো টো বলে যাচ্ছে।এমন কী আর বয়স।এই তো সেভেনে উঠল।কিন্তু বড়জায়ের বিষয়ে কিছু কথা শুনলেও ওর সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না ।ছোটদের এসব জটিলতায় টানতে ও পছন্দ করেনা।

মাঝেমাঝে বড় অবাক লাগে তার।বিয়ে হয়ে থেকে যাদের সঙ্গে ছিল, সেই বড়জা তার সঙ্গে কিকরে এমন হৃদয়হীনের মত ব্যবহার করতে পারেন , তার মাথায় ঢোকে না।তার ওপরের ভাসুরের একটু পরেই বিয়ে হয়েছে।সেই মেজদির সঙ্গে তার সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মত ছিল।এখন তাকেও নিজের নামে কথা বলতে শোনে। প্রথম প্রথম খুব অবাক হত।এখন আর হয় না।

সকালে  ভারী ঘাবড়ে গিয়েছিল ও।পাশের বাড়িতে একটু হই চই হচ্ছে দেখে খবর নিতে গিয়েছিল।গিয়ে  দেখল কুহুর বাবার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়েছে। ভয় পেয়ে ওর মা কুহুকে ডাকাডাকি করছিলেন।কদিন ধরেই ভদ্রলোকের ল্যুজ মোশান চলছে।ঠিকমত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।নার্সিং হোমেই পাঠাতে হল।এই কোভিডের সময় আশঙ্কা তো হতেই পারে।কুহু এ্যাম্বুলেন্সে বাবাকে নিয়ে রওয়ানা হলে ও নিজেই বসেছিল ওদের বাড়িতে।

ওর মা বেশ শক্ত মহিলা।ভেঙে পড়েননি।নিজে থেকেই বললেন, “এই ভালো হল।এসব রুগীর, বাড়িতে কি চিকিৎসা হয়?”

কুহু ফিরতে, মীরা বাড়ি ফিরেই ময়নার মুখোমুখি হল ।ওকে জল ছোলা ভেজানো দিলে ও টক্‌টক্‌ করে বলল, “কোথায় ছিলে? খিদে পেয়েছে কখন।”

ওমা একি?ময়না একেবারে মানুষের মতই ঠিকঠাক কথা বলছে তো।

রঞ্জিত বলছিল, “কুহুদের সাবধান করে দিতে হবে ।ওর বাবার যদি করোনা হয়ে থাকে,ওদের ও হবে।”

তাদের বাড়িতেও জোর ঝামেলা হচ্ছিল। মনোজিতের সঙ্গে ওর মায়ের  কোন ব্যাপারেই মিল নেই।ছেলে  এলেই খুঁটিনাটি কথা থেকে ঝামেলা শুরু করে দেন।আজও  হচ্ছিল নাতিকে নিয়ে।লাল্টু কেন ওনার কথা না শুনে মীরাদের বাড়িতে ঢুকেছে।এই করোনা থেকে তারা সবে উঠেছেন। এইসময়ে তাঁদের বাড়িতে না গেলেই নয়?সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবছিল মীরা,যে যার নিজের নিয়ে ভাবছে,অথচ ওইটুকু একটা মেয়ে  কত ঝামেলা কাঁধে বয়ে নিয়ে চলছে। এরপরেও বলছে পাহাড়ে উঠবে।

মনেমনে ভাবছিল মীরা, এবার বিভু আসুক।কুহুর মার সঙ্গে,কুহুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।ওদের মতটা নেওয়া দরকার। কুহুর গ্র্যাজুয়েশানটা অবধি মীরা অপেক্ষা করতে রাজি আছে।ওটা কমপ্লিট হলেই বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে।

এছাড়াও ভাবছিল, কুহুকে বোঝাতে হবে। ওর বাড়ির এই তো অবস্থা।এসময়ে পাহাড়ে যাবার ভাবনাটা নাইবা ভাবল।তবে বলে কিছু হবে বলে মনে হয়না।ও চাইলে যেমন করে হোক যাবেই।সেক্ষেত্রে চাপ দেওয়ার মানে হয়না।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *