নায়িকার ভূমিকায়। তৃতীয় পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
বাংলার চলচ্চিত্রের আদিযুগের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের পর্দার বাইরের দ্বৈত চরিত্র নিয়ে রয়েছে নানা রকম গল্প কথা ও গুজব। সীতা দেবীকে নিয়ে একটি চর্চিত কাহিনী হল সীতা দেবীর নেপথ্যে নাকি একা রিনি স্মিথ নন, তার বোন পার্সি স্মিথও ছিলেন! দুজনেই নাকি সীতা দেবীর অভিনেত্রী পরিচয়ে ছবিতে কাজ করেছেন! পর্দায়, জীবনে কত রকম দ্বৈত চরিত্র ও কত রকম অভিনেত্রী পরিচয়! যে কথা হচ্ছিল আগের পর্বে, পর্দার চরিত্রের চেয়ে পর্দার বাইরের এই নির্মাণগুলোও কিছু কম আকর্ষণীয় নয়। তবে সীতা দেবীর মতো অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে পর্দায় অভিনীত চরিত্র নিয়ে একেবারেই কোনো কথা না বললেও অন্যায় হয় । লাইট অফ এশিয়া (১৯২৫) ছবিতে গোপার চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি তারকা হয়ে যাওয়ার পর উনি অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন ফ্রান্স অস্টেন পরিচালিত সিরাজ (১৯২৮) ও থ্রো অফ ডাইস (১৯২৯) ছবিতে। শব্দ সংযোজিত হওয়ার আগের পর্বের এই ছবিগুলোয় শুধুমাত্র শরীরী অভিনয় আর মুখ ভঙ্গিমার উপর ভিত্তি করেও যে কী অসামান্য অভিনয়ের নিদর্শন রাখা যায়, যাদের এই ছবিগুলি দেখার দুর্লভ সু্যোগ হয়েছে, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন।
সীতা দেবীর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে যে আর যে ছবি গুলোর কথা বলতেই হয় তা হলো, বাংলায় বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস গুলোর একদম প্রথম দিককার যে চলচ্চিত্রায়ন তার অনেকগুলিতেই নায়িকা বা সহ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সীতা দেবী। ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেড মিথ ও মিথলজিকাল নির্ভর জনপ্রিয় ছবির পাশপাশি প্রযোজনা করতে থাকেন কৃষ্ণকান্তের উইল (১৯২৬), দুর্গেশনন্দিনী (১৯২৭), কপালকুণ্ডলা (১৯২৯) এর মতো বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গুলোর চলচ্চিত্রায়ন । জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তুঙ্গে থাকা এই সময়ে পুরাণ নির্ভর ছবির সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলোর গুরুত্ব বোঝা খুব কঠিন নয়। কিন্তু আবার সেই মজার ব্যাপার, হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক এই ছবিগুলিতে নায়িকার ভূমিকায় বারেবারে পর্দায় আসেন পেসেন্স কুপার বা রিনি স্মিথ। শুধু হিন্দু পৌরাণিক নায়িকাই নয় জাতীয়তাবাদী সাহিত্যিকদের লেখার চলচ্চিত্রায়িত রূপেও নায়িকার ভূমিকায় ফিরে ফিরে আসেন পেসেন্স কুপার বা রিনি স্মিথের মতো প্রকৃতই গুণী অভিনেত্রীরা।
একদিক থেকে দেখলে ৩০ ও ৪০ এর দশকের হিন্দু বাঙালি অভিনেত্রীরা যেমন বিপ্লব নিয়ে আসছেন, অন্তপুরের বাইরেও মহিলাদের এক নতুন পরিচিতি নির্মিত হতে থাকে। অন্যদিকে এটাও মনে রাখা দরকারি তার আগের পর্বের এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের হাত ধরে নায়িকার এক পরিচিতির নির্মাণ হচ্ছে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে। একদিকে পে-রোল, চুক্তিপত্র, শ্রম, প্রযুক্তি মাইনে–এর মতো শব্দদের নিয়ে ও অন্যদিকে সৌন্দর্য , গ্ল্যামার ও সুখ্যাতির দুনিয়া নিয়ে এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীরাই বাংলার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রথম যুগের ওয়ার্কিং উওম্যান।
লিঙ্গরাজনীতি সচেতন ইতিহাসলেখকরা সাম্প্রতিক কালে আগ্রহী হয়েছেন এক বিকল্প ইতিহাসের খোঁজে— উইমেন’স হিস্ট্রি (women’s history)। এই উইমেন’স হিস্ট্রির নিবিড় পর্যবেক্ষণ মানব সভ্যতার সমাজ-রাজনীতি-বিজ্ঞান-শিল্পকলার এক বগগা মেন’স হিস্ট্রির গল্পে নিয়ে আসে নতুন পাঠ। যে সাধারণ ও অসাধারণ মহিলারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেও ইতিহাসের বিভিন্ন ন্যারেটিভে উপেক্ষার শিকার, উইমেন’স হিস্ট্রি ইতিহাস সংগত ভাষ্যে ও তথ্যে তাঁদের পথটিকে আলোকিত করতে থাকে ।
এই কথাগুলো এখানে বলার কারণ সারা বিশ্ব জুড়েই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে খুব দরকারি উইমেন’স হিস্ট্রির পাঠ। আর বিশেষত ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। আমার ব্যাক্তিগত মত, অনেকটাই দেরি হয়ে গেলেও এখনও সময় রয়েছে হয়ত। এই অভিনেত্রীদের অবদান মনে রেখে ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা হলে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অন্য দিকের (women’s film history) হদিশ পাব আমরা। বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগে অভিনেত্রীদের অবদানের দিকে মনোনিবেশ করলে শুধু যে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটা বিস্তার হয় তাই নয়, এই মনোনিবেশ সামনে নিয়ে আসে বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে মহিলাদের ঘিরে আবর্তিত হওয়া কর্মক্ষেত্র ও পেশাদারিত্বের ধারণা, শ্রেণী ও বর্ণের বিন্যাস এবং লিঙ্গ রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট। সেই প্রেক্ষাপটে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীদের ভূমিকা।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।
খুব ভালো লাগছে। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।