নায়িকার ভূমিকায়। দশম ও শেষ পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
বাংলার সবাক ছবির যুগের গোড়ার দিকে স্টুডিও ইকনমি থেকে ফিল্ম-মেলোড্রামা সব কিছুরই নতুন বিন্যাসের পাশাপাশি প্রযুক্তি আর তার অভিনব ব্যবহারের জন্যে গায়িকা-নায়িকাদের নতুন নতুন ভূমিকা চোখে পড়ছিল। একদিকে অফিসিয়াল ইতিহাস অনুযায়ী ১৯৩৫ সালে তো নীতিন বোসের ছবি ‘ভাগ্যচক্র’ যার হাত ধরে ভারতীয় ছবিতে প্লেব্যাক সঙ্গীতের সূচনা হয়। অন্যদিকে গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ সেই সময় নাগাদই প্লেব্যাক অনুরূপ একটি প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা মনে করাচ্ছেন। সূত্র পরিচালক মধু বসুর আত্মজীবনী। কলকাতায় তখন ‘সেলিমা’ ছবির শ্যুটিং-এ ব্যস্ত মধু বসু। নায়িকার চরিত্র করছেন নবাগতা একটি মেয়ে। নাম মাধবী। যখন গানের দৃশ্যের কাজ হবে, তখন দেখা গেল মাধবী চিত্রনাট্যের চাহিদা মত একেবারেই গেয়ে উঠতে পারছেন না। কী হবে উপায়? অনেক ভেবেচিন্তে মধু বসু একটি মতলব বের করলেন। শ্যুটিং চলাকালীন ‘ক্যামেরা ফিল্ডের বাইরে থেকে’ প্রখ্যাত গায়িকা-নায়িকা কমলা ঝরিয়া গান গাইবেন আর শটের মধ্যে থাকা নায়িকা মাধবী সেই গান শুনে ঠোঁট নাড়াবেন। আরও ভেবে দেখা হল যে কমলার কাছে মাইক থাকবে তাই মাধবী আস্তে গাইলেও সেই আওয়াজ মাইক্রোফোনে ধরা পড়বেনা।
‘সেলিমা’ মুক্তির পর মাধবী চুক্তিবদ্ধ হন নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে। মধু বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন এরপর একদিন নাকি নিউ থিয়েটার্সের ব্যবস্থাপক অমর মল্লিক হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে আসেন। কী ব্যাপার? মল্লিক বাবু এসেই বলেন- মধু তোমার ছবিতে মাধবী এত সুন্দর গান গেয়েছে অথচ আমাদের ছবিতে গান গাইতে গিয়ে একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে! রাই (রাইচাঁদ বড়াল) বলছে, “যে একে দিয়ে গান গাওয়ানো চলবেনা, এ একেবারে বেসুরো।” কী ব্যাপার বলো তো? মধু বসু তখন আসল কারসাজির কথা ভেঙ্গে বলেন। ‘সেলিমা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৫-এ। আর সে বছরই ‘ভাগ্যচক্রে’ “মোরা পুলক যাচি” নৃত্যগীত দৃশ্যে প্লেব্যাক কণ্ঠদান করে ইতিহাস তৈরি করলেন গায়িকা পারুল বিশ্বাস (ঘোষ), সুপ্রভা ঘোষ (সরকার) প্রমুখ ।
স্টুডিও যুগের সবাক ‘বই’ এর বাজারে তারকা হয়ে উঠতে থাকেন নায়িকা-গায়িকারা। স্টুডিওয় আরও ভালো কাজের সুযোগ পেতে সচেতন ভাবে গানের তালিম নিতে থাকেন বহু নায়িকারাই। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ম্যাডান কোম্পানিতে কাজ করতে করতে অভিনেত্রী কানন বালা মন দেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। ১৯৩৫ সালেই মেগাফোন কোম্পানিতে প্রথম রেকর্ড বার হয় কানন বালার। তত্ত্বাবধানে ছিলেন জে. এন. ঘোষ। ১৯৩৬ সালে কানন নিউ থিয়েটার্সে যোগ দেন এবং পরপর মুক্তি পায় ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণ সুদামা’ । কানন ও নিউ থিয়েটার্সের যুগপৎ সাফল্য অব্যাহত থাকে ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮), ‘সাপুড়ে’ (১৯৩৯) ও ‘অভিনেত্রী’ (১৯৪০)র মত আরও অনেক ছবিতে। এই সময় কানন বালার সু্যোগ হয় পঙ্কজ মল্লিকের কাছে গান শেখার। অনেকের মতে গায়িকা কাননের খ্যাতি ছাপিয়ে যায় নায়িকা কাননের তারকা ব্যক্তিত্বকে। আবার অনেকের চোখে গান-অভিনয় ও পর্দার উপস্থিতি সব মিলিয়ে কানন এ যুগের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তারকা। শোনা যায় পঙ্কজ বাবু কাননকে বলতেন – ‘ফার্স্ট সিঙ্গিং স্টার অফ নিউ থিয়েটার্স’।
চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে গণ মাধ্যমের বিভিন্ন যে বিভাগ সেখানে এই গায়িকা-নায়িকাদের অনেক অনেক ছোট বড় গল্প-গসিপ ও তাঁদের নিয়ে সম–সাময়িক জনসংস্কৃতির নানা পর্যবেক্ষণের হদিস পাব আমরা। আর এইসব বিভাগগুলো পড়লে বুঝতে পারব কিভাবে ফিল্ম প্রযোজনার সমান্তরালে এক নায়িকার নির্মাণ সম্পন্ন হতে থাকে পত্র–পত্রিকার পাতায়-পাতায় ও সেখান থেকে দর্শক ও পাঠক সমাজের কল্পনায়। এইসব পত্র-পত্রিকারা বিশেষ আগ্রহী ছিল বাংলার অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনায়। ‘নাচঘর’ পত্রিকায় প্রকাশিত “চাই রূপসী অভিনেত্রী” বা “অভিনেত্রীর অঙ্গসৌষ্ঠব”-এর মত প্রবন্ধ ইঙ্গিত করে কিভাবে এক ‘আদর্শ’ বিষমকামি পুরুষ দর্শকের চোখ (গেজ) আর মূলধারার লিঙ্গ রাজনীতির নিরিখে দেখা হচ্ছিল ছবির পর্দায় অভিনেত্রীর উপস্থিতি বা ব্যক্তিত্ব। তবে এই পত্রিকারাই আবার পরবর্তীতে বাংলার চলচ্চিত্র অভিনেত্রীদের থেকে লেখা নিচ্ছেন, প্রকাশ করছেন তাঁদের চোখ দিয়ে দেখা চলচ্চিত্র জগতের বিবরণ। ৩০-৪০এর দশকে ‘দীপালী’, ‘খেয়ালী’, ‘চিত্রলেখা’, ‘নাচঘর’এর মত পত্রিকাগুলোয় নায়িকাদের নিজেদের ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে এই লেখালেখিগুলোতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অন্য দিকের সন্ধান পাব আমরা। সবিতা দেবী, কানন দেবী, মলিনা দেবী, ছায়া দেবীর এইসব লেখায় পাওয়া যায় সচেতন এক অভিনেত্রী সেলফ’কে আর সেই সেলফের নিবিড় পর্যবেক্ষণে উঠে আসে স্টুডিও সিস্টেমের ভেতরে গেড়ে বসে থাকা লিঙ্গ বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক নির্মান। যখন ‘ভদ্রঘরের মহিলারা’ চলচ্চিত্র জগতে যোগ দেবেন কিনা এই নিয়ে বাংলা সংবাদ পত্র-পত্রিকারা মুখর, সবচেয়ে জরুরি লেখাগুলো লিখতে থাকেন নায়িকারাই। একদিকে লেখিকার ভুমিকাতেও এভাবে ছক ভাঙছেন নায়িকারা। অন্যদিকে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হয়েও ‘সম্ভ্রমের বেষ্টনী’ ছেড়ে সিনেমা পাড়ায় কাজ খুঁজে নিয়ে ঘরে ও বাইরে বিপ্লব নিয়ে আসছেন কিছু নায়িকারা। দু’একজনের কথায় আসা যাক।
সুনন্দা দেবীর জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালে আহিরীটোলায়। ১৯৩৪ সালে বিয়ে ও তারপর সুখেই কাটছিল জীবন। এরপর এই সুস্থির জীবনে হঠাৎ নেমে এল অভাব, অনটন। স্বামীর ব্যাবসা গেল তলিয়ে, ঋণভারে সর্বশান্ত হয়ে সিনেমায় রোলের খোঁজে স্বামীর সাথে পথে নামলেন সুনন্দা দেবী। ঠিক যেন আরও দু’দশক পর পর্দায় অভিনীত সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবির দৃশ্য! অভিনীত হচ্ছে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, স্টুডিওর অফিসে, প্রযোজকদের বৈঠকখানায়। একদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে দেখা ওঁর ছোটকাকার বাল্য সহপাঠী বেতার জগতের স্বনাম ধন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে । তারপর ওঁর বাড়িতে গিয়ে দিনের পর দিন চলল আবৃত্তি চর্চা। এরপর সুযোগ আসে নিউ থিয়েটার্সে যাওয়ার ও অবশেষে চুক্তিপত্র সই করার। শ্যুটিং শুরু হয় সুনন্দা দেবীর প্রথম ছবির। নাম ‘কাশীনাথ’ (নীতিন বসু, ১৯৪৩)।
দ্বিতীয় উদাহরণ নায়িকা বিজয়া দাসের। ছোটবেলা থেকেই বিজয়া দাসের নায়িকা হওয়ার ছিল প্রবল ইচ্ছে । কিন্ত বাদ সেধেছিল অভিভাবক কাকার আপত্তি। ফিল্মের লাইনে ‘নামলে যে ভদ্র ঘরের মেয়েদের খুব বিপদ’ এবং এরকম কথা যে মুখে আনাও পাপ তা বুঝিয়ে দেয়া হয় তাকে। বিজয়া দেখলেন বিদ্রোহ না করে আর উপায় নেই। বোনের সাহায্যে শেষমেশ ইচ্ছে পূরণ হয় আর মজার ব্যাপার হল সেই ছবির নাম ‘শেষরক্ষা’(১৯৪৪)। পত্র-পত্রিকার পাতায় সমাজের অভিভাবকেরা যখন ব্যাস্ত ভদ্রঘরের মেয়েরা অভিনয় করবেন কি করবেননা সেই তর্কে, সুনন্দা দেবী ও বিজয়া দাসের মত নায়িকারা তাঁদের ইচ্ছে বা প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে সিনেমায় ‘নেমে’ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলছেন।
ভদ্রঘরের মেয়েদের অভিনয়ের প্রসঙ্গই উঠল যখন, তখন তথাকথিত ভদ্র পরিমণ্ডলের বাইরে থাকা মেয়েদের নায়িকা হয়ে ওঠার কথাও অল্প বলা দরকার। রতন বাঈ এর মত নায়িকারা বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। ১৯৩৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ ও সিনেমা পত্রিকার পাতা সরগরম সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘করইয়ান-এ-হায়াত (প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্স)নিয়ে। অভিনেত্রী রতন বাঈ অভিযোগ করেন যে, উল্লিখিত ছবিটিতে তার অভিনয়ের অনেক দৃশ্য বাদ পড়েছে। আরও গুরুতর অভিযোগ, তার অভিনীত দৃশ্যে অন্য অভিনেতাকে নেওয়া হয়েছে। অপমানিত রতন বাঈ এই অন্যায়ের ব্যাখ্যা চান এই নামী স্টুডিও প্রতিষ্ঠানের কাছে। তার জবাবে স্টুডিও-কর্তৃপক্ষ রীতিমত আক্রমণ করেন অভিনেত্রীকে, প্রশ্ন তোলা হয় তাঁর অতীত নিয়ে। স্টুডিও-কর্তা বলেন, ২০৬ বউবাজার স্ট্রীটের মিস ইমাম বাদী কে তাঁরাই তারকা রতন বাঈ করে গড়ে তুলেছেন। অভিনেত্রীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সেই কথা ভেবে। এই অপমানেও এতটুকু না দমে রতন বাঈ পাল্টা জবাব দেন, স্টুডিও প্রযোজকের মত সামাজিক প্রতিষ্ঠা তাঁর নাই থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় তিনি শিল্পী হতে পারবেন না। আর তাঁর গায়ে কাদা ছুড়লে, তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়না। উত্তর–প্রত্যুত্তরের চিঠির পালার পুরোটাই প্রকাশিত হয় ফিল্ম পত্রিকা ‘চিত্রপঞ্জি’র পাতায়। আর এই ‘বেয়ারা নায়িকার বেয়াদপি’ দেখে হয়ত ৩০ এর দশকের সিনেমা-থিয়েটার মোদি ভদ্রলোক বাঙালি চোখে-কানে আঙ্গুল দ্যায়। পরবর্তীতে এই ভদ্রলোক বাঙালীরা যখন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস লেখেন রতন বাঈরা যে তাতে উপেক্ষিত থেকে যাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। সময় হয়েছে এখন শুধু এই নায়িকাদের নিয়ে কথা বলারই নয়, এই উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অবহেলারও ইতিহাস লেখার।
(শেষ)
গ্রন্থ
“সোনার দাগ” (শতবর্ষের আলোয় বাংলা চলচ্চিত্র) ১ম পর্ব, গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ, যোগমায়া প্রকাশনী, ১৯৮২।
“অভিনেত্রী কথা”, সংকলন ও সম্পাদনা দেবীপ্রসাদ ঘোষ, প্রতিভাস, ২০১৫ ।
“ভয়েসেস অফ দ্য টকিং স্টারঃ উইমেন অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা অ্যান্ড বিয়ন্ড”, মধুজা মুখার্জী, সেজ পাবলিশিং, ২০১৭ ।
“সবারে আমি নমি”, কানন দেবী, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৮০।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।