নায়িকার ভূমিকায়। চতুর্থ পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম পর্বে যে কজনের হাত ধরে চলচ্চিত্র মাধ্যম একটি নিজস্ব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল তাঁদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম । নানা রকম গল্প শোনা যায় তাঁর অভিনেত্রী আবিষ্কার নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মূখে দাঁড়িয়েও সেই সময়কার বহু গুণী অভিনেত্রীকে তিনি চলচ্চিত্রে যোগদান করানোতে সমর্থ হন। এঁদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রেমিকা দেবী ছাড়াও ছিলেন সবিতা দেবী, রাধা রানি, ডিলিসিয়া ক্লার্ক, অমিয়া দেবী প্রমুখ। কিভাবে তিনি সবিতা দেবীকে চলচ্চিত্রে যোগদান করিয়েছিলেন তার একটি চমকপ্রদ বর্ণনা কালীশ মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখায় দিয়েছেন।
তৎকালীন ধর্মতলা স্ট্রীটে একদিন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় মটর চালিয়ে যাছিলেন। ভিড়ের মাঝে বই হাতে নেওয়া একটি মেয়েকে তিনি লক্ষ্য করেন । কালীশ মুখোপাধ্যায়র কথায়, “মেয়েটিকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলেই মনে হচ্ছিল । অথচ তার মুখাবয়বে ভারতীয় শ্রীর অভাব ছিল না”। ধীরেন্দ্রনাথ গাড়ির গতি কমিয়ে খানিকটা অনুসরণ করে চিনে নেন মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা। পরদিন পৌছে যান। জানা যায় যে মেয়েটির নাম আইরিশ গ্যাসপার। ওঁর মা শ্রীমতী ইসমে বসতে বলেন ধীরেন্দ্রনাথকে। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব শুনেই ঘাবড়ে যান খুব। না করে দেন তৎক্ষণাৎ । আরেকবার ভেবে দেখার অনুরোধ করে ধীরেন্দ্রনাথ বেরিয়ে যান।
নাছোড় ধীরেন্দ্রনাথ খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন ইসমে দেবী ইংলিশ ম্যান পত্রিকার ফোটোগ্রাফার। মাইনে ৭০-৮০ টাকা। পরদিন আবার হাজির উনি ৭৭ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রীটের বাড়িটিতে। ওঁকে দেখেই কোনো কথা না শুনেই ‘নো নো উই হ্যাড ডিসাইডেড নট টু” বলে ওঠেন শ্রীমতী ইসমে। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে থামিয়ে বলেন, “আমি এসেছি আপনাকে আমাদের কম্পানিতে স্টীল ফোটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ করতে। শুনলাম আপনি খুব নামী ফোটোগ্রাফার”। এতে আর ইসমে আপত্তি করেন নি, ১০০ টাকা মাইনেতে স্টীল ক্যামেরা বিভাগের প্রধান শিল্পী হিসেবে যোগ দ্যান ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মসে। শ্রীমতী ইসমে কাজে যোগ দিয়ে পাঁচ দিন স্টুডিওতে আসার পর ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবার এক দিন সু্যোগ বুঝে আইরিশকে অভিনেত্রী করতে চাওয়ার কথা পাড়েন। এবার আর আপত্তি করেন না উনি। সবিতা দেবী নাম নিয়ে আইরিশ গ্যাসপার পা রাখেন চলচ্চিত্রের দুনিয়ায়। মাসিক মাইনে স্থির হয় ২৫ টাকা।
আইরিশ অভিনীত প্রথম ছবিটি হল ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মসের দীনেশ রঞ্জন দাস অভিনীত পরিচালিত কামনার আগুন (বা ফ্লেমস অফ ফ্লেশ), ১৯৩০এর ২২এ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় পার্ল সিনেমায়। চিতরের রানি পদ্মিনী ও তার বহুকথিত বহুশ্রুত জহর ব্রত অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল ছবিটি। পদ্মিনীর চরিত্রে ছিলেন আরেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রী ডিলিসিয়া ক্লার্ক, আলাউদ্দিন খিলিজির চরিত্র করেন দীনেশ রঞ্জন দাস, আর সবিতা দেবী অভিনয় করেন মালেকাজাহানের চরিত্রে। এরপর একে একে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মসের পঞ্চশর (দেবকী কুমার বসু, ১৯৩০), চরিত্রহীন (ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৩১), টাকায় কী না হয় (ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৩১) সবিতা দেবী প্রথম সারির তারকাদের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন । বম্বেতেও বহু ছবিতে উনি অভিনয় করেন । তার মধ্যে বেশ কিছু ছবি সে যুগের নারীকেন্দ্রিক ছবি হিসেবেও স্বীকৃত ও সমাদৃত। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হল লেডিস ওনলি (সর্বোত্তম বাদামি, ১৯৩৯ ) – এই ছবিতে একটি রেলওয়ে স্টেশনে এক গুজরাতি, এক পাঞ্জাবি ও এক বাঙালি মেয়ের দেখা হয়ে যায় , যারা তিনজনেই নতুন এক শহরে থাকার জায়গা খুঁজছে । ভাষা বুঝতে অসুবিধে হওয়া সত্বেও তাঁরা এক সঙ্গে মেস বাড়ি খুঁজতে বেরয় আর গল্পে আসে নানা চরিত্র ।
[ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কম্পানির যমুনা পুলিনে (প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় , ১৯৩৩) ছবির পাবলিসিটি চিত্রে সবিতা দেবী]
শুধু অভিনয় প্রতিভাই নয় , চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে যে গণ মাধ্যমের বিভিন্ন বিভাগ সেখানেও সবিতা দেবীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। ভারতীয় চলচ্চিত্রের উইমেন’স হিষ্ট্রির পাঠে সবিতা দেবীর মত অভিনেত্রীদের অবদান মনে রেখে ইতিহাস লেখা হলে নায়িকাদের লেখালেখির দিকটাও গুরুত্বের দাবি রাখে। নায়িকাদের নিজেদের ও ছায়াছবির জগৎ নিয়ে এই লেখালেখিগুলোতে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান পাব আমরা। সবিতা দেবীর একদম প্রথম দিককার একটি লেখায় স্বদেশি ছবির ধারণা খুঁজে পাই আমরা, আবার পরবর্তী অনেক লেখায় পাওয়া যায় সচেতন এক অভিনেত্রী সেলফ’কে। যখন ওঁর চলচ্চিত্র অভিনেত্রী জীবনের বয়স সবে তিন বছর, সেই সময় ১৯৩১ সালের খেয়ালী পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ‘বিদেশি অনুকরণ’ নামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখছেন উনি আর সওয়াল করছেন ‘আমাদের’ নিজস্ব ছবি তৈরির স্বপক্ষে ও বিদেশি অনুকরণের বিপক্ষে। এও লিখছেন যে, “আমি আজ পর্যন্ত বাঙালি সমাজের বহু বিষয়ে শিক্ষা করেছি এবং যখনই অবসর পাই ওই বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি”। বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগে অভিনেত্রীদের ঘিরে আবর্তিত হওয়া গণ মাধ্যম ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকা এবং লিঙ্গ রাজনীতির যে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট সেখানে এভাবেই আসে ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি শিক্ষার প্রসঙ্গ ।একজন সফল অভিনেত্রী হওয়ার পাশাপাশি চলে এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠাও । আর এক ধরনের নায়িকার নির্মাণ সম্পন্ন হতে থাকে দর্শক ও পাঠক সমাজে ।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ
- কালীশ মুখোপাধ্যায়, “বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস (১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭)”, পত্র ভারতী, ১৯৬৩।
- খেয়ালী পত্রিকা, শারদীয়া সংখ্যা, ১৯৩১।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।
Could we get more content in one part ? But an interesting write up and most probably a fist one in this subject !