মিহিরকণা। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। মিহির সেনগুপ্ত-স্মরণে ‘সিদ্ধিগঞ্জের ভাটিকুমার’।
২০০৫ সালে তাঁর বিষাদবৃক্ষ গ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেলেন মিহির সেনগুপ্ত। নামটির সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয় খবরের কাগজ মারফৎ। গ্রন্থটি নিয়ে দু-চার কথা লেখা হয়েছিল কাগজে। তা থেকে লেখক বা তাঁর লেখা বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা পাইনি, পাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তারই জেরে ২০০৬ সালের বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে এলাম আনন্দ-প্রকাশিত উজানি খালের সোঁতা। এটি সংকলন গ্রন্থ। ‘বিষাদবৃক্ষ’ ও ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ ছাড়াও গ্রন্থিত ছিল ‘ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজি’, ‘ভাটিপুত্রের অপবর্গ দর্শন’ এবং ‘চান্দ্রদ্বীপি শোলোক শাস্তর পল্কি কথা’। বিষাদবৃক্ষ পর্যন্ত পৌঁছতে হলো না, প্রথম তিনটি রচনা পড়েই আমি এক অনাস্বাদিত পঠনসুখে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। কেমন সেই পঠনসুখ? তুলনা দিতে হলে পুরীর সমুদ্রে আমার প্রথম অবগাহন-অভিজ্ঞতার কথা বলতে হয়। কখনো প্রবল ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়ছি, কখনো ঢেউ আমার আমার বুকের কাছে ভেঙ্গে আমাকে তছনছ করে দিচ্ছে। অবিকল সেই শিহরণ তুলছে মিহিরের পরাক্রমি গদ্য আমার অনুভবে। আমার বিগত চল্লিশ বছরের পঠন-অভিজ্ঞতায় সে এক অনাস্বাদিত সংযোজন। মিহির যেন বরিশাল নামক আস্ত একটা দেশকে তার তালুকদারি-অপবর্গীয় স্বভাবচারিত্র্যে, তার শোলক-শাস্তর, গাইল-খামারে তুলে আনলেন তাঁর অনবদ্য চান্দ্রদ্বীপি-তৎসম বাকবন্ধের ঢেউয়ে নাচাতে নাচাতে।
আমি পশ্চিম মেদিনীপুরের পশ্চিমতম প্রান্তের মানভূমীয় রসে লালিতপালিত, বরিশালি উপভাষায় আমার বিন্দুমাত্র বুৎপত্তি নেই। অথচ সে ভাষার শব্দবিশেষের অর্থ না জেনেও তার নির্যাসে ডুব দিতে কোনো অসুবিধে হলো না আমার। আরও আশ্চর্য, চান্দ্রদ্বীপি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মানভূমীয় চারিত্রিক শোভার একাত্মতা উপলব্ধি করলাম নিমেষেই। কেমন সেই বৈশিষ্ট্য বা শোভা? লেখকের ভাষা ধার নিয়েই বলি, – “সারা বছর ‘বীরমার্গী’, শুধু ঘাসের ডগায় ‘অশ্রুগলা’ শিশির দেখলে আর শিউলি ফুটলে যাদের দেহমনে ‘কান্তভাব’ ভর করে তারাই প্রকৃত চান্দ্রদ্বীপি”। এ বাবদে সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের সৈয়দ আলি চাচা লেখকের আত্মজন। কারণ এই সময় চাচার ‘জন্মশত্তুর জুম্মল মোল্লার ছাগলে’ ‘তার আহ্লাদের বাইগুন মরিচের খ্যাত’ ‘মুড়িয়ে দিয়ে গেলে’ তিনি ‘গাইল খামার’ না দিয়ে বলেন, “খাড়অ হুদাহুদা মরিচগুলান খাইস্ না। এক বাডি ফ্যান দিতাছি”।
সোজা কথায় দিলখোলা, জবানখোলা, একবগগা – আমাদের মানভূমীয় অপভাষায় যাকে বলে হোড় বা হেউন্টা। লাঠি তুলতেও যতক্ষণ বুকে টানতেও ততক্ষণ।
কিন্তু মিহির সেনগুপ্তের সাহিত্যকৃতির আলোচনা এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রে ঢোকার যোগ্যতা আমার আছে কি না তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িকতায় দীর্ণ এক সময়ের অভিজ্ঞান ধারণ করেও দেশহীন, রাষ্ট্র-কবলিত মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষের পারস্পরিক প্রীতির ফল্গুধারা দিয়ে নিজের লেখাকে জারিত করলেন কোন মন্ত্রে, তার হদিশ করতে পারলে তবেই সেই যোগ্যতা অর্জন করা যাবে। আমি আজ তাই ব্যক্তি-মিহির এবং পরবর্তী কালে আমার সঙ্গে তাঁর সাহচর্যের স্মৃতিচারণ করব বলে কলম ধরেছি।
তাঁকে প্রথম পড়ার পর তিনি আমার কাছে দূরের নক্ষত্র রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। কোনোদিন ভাবিনি তাঁর সঙ্গে আমার একদিন সাক্ষাত পরিচয় হবে, ঘনিষ্ঠতা তো দূরস্থান! ক্রমে ক্রমে সেটাই ঘটে গেল। কেবল দশ দশটা বছর দেরি হয়ে গেল।
আসলে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমার আকৈশোর বসবাস হলেও কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না। কখনো সখনো তাঁদের কারোর সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগ ঘটত আমার অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, উৎপল ঝা মারফত। নিজের কর্মসূত্রেই সে লেখকমহলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। আমার চাকুরিজীবনের শেষের দিকে আমার সহ-আধিকারিকরা একটা নিজস্ব সাহিত্য তথা বিভাগীয় আইনকানুন সম্পর্কিত পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে। সেই পত্রিকার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রতি বছর একজন সাহিত্যিককে সম্বর্ধনা দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। পত্রিকাটি সম্পাদনা করার সূত্রে মূলত আমারই উপর সেই সাহিত্যিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে সম্মত করানোর দায়ভার চাপত। আমার ভরসা উৎপল। সেভাবেই ২০০৯ বা ১০ সালে অভিজিৎ সেনকে সম্বর্ধনা দেওয়া ঠিক হলো।
অভিজিৎ সেনের গল্পের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল অনেক আগেই। মিহিরের লেখা প্রথম পড়ে যেমন উথালপাথাল, তেমনি অভিজিৎ সেনের গল্প প্রথম পড়ে বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম সেই ১৯৮৫ সালে, ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘মাটির বাড়ি’ পড়ে। তফাত এটুকুই যে মিহির সেনগুপ্তের নাম আগে শুনে পরে তাঁর লেখা পড়েছিলাম, আর অভিজিৎ সেনের গল্পটি পড়ার পর তাঁর নামটি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল।
তো অভিজিৎ সেনকে সম্বর্ধনা দিতে গিয়ে তাঁর লেখার সঙ্গে বিস্তৃত পরিচয় হলো এবং অন্যান্য বার যেমন সম্বর্ধনা পর্ব মিটে যাওয়ার পর সম্বর্ধিত সাহিত্যিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ লোপ পেত, সেবার অন্যথা হলো। অভিজিৎ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রইল, তাঁর সঙ্গে খানিক অন্তরঙ্গতাও হলো এবং অবসরের পর যখন উৎপলের সহযোগিতায় আমাদের উভয়ের কয়েকজন সমমনস্ক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ‘জলঘড়ি’ নামে একটি চতুর্মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করলাম, তখন তাঁকে পত্রিকার একজন উপদেশক হিসাবে সঙ্গে পেলাম।
‘জলঘড়ি’র তৃতীয় সংখ্যা থেকে আমরা পত্রিকার সাধারণ বিভাগের সঙ্গে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেবার ঠিক হলো মহাভারত নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র করা হবে। সেটা ২০১৮ সালের গোড়ার দিকের কথা। শুনে অভিজিৎদা মিহির সেনগুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন। তখনই প্রথম জানতে পারলাম, তিনি অভিজিৎ সেনের সহোদর ভাই এবং ভদ্রেশ্বরে থাকেন। আমার বাড়ি চন্দননগরে। অতএব তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আমার পক্ষে সুবিধে হবে। তাছাড়া একদা প্রতিভাত সেই ‘দূরের নক্ষত্র’টিকে সামনাসামনি দেখার কৌতূহল তো ছিলই। মিহিরবাবু যেহেতু উৎপলের দীর্ঘদিনের পরিচিত, তাই ঠিক হল প্রথমবার সে আমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু যাব যাব করে আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল। অবশেষে, খুব সম্ভবত মার্চ মাসে, উৎপল ও আমি একদিন উপস্থিত হলাম তাঁর বাড়িতে। আলাপ পরিচয় হলো। খানিক আড্ডা। আড্ডার কথাই বেশি করে বললেন। কীভাবে একদা দল বেঁধে তাঁর এই বাড়িতে বন্ধুবান্ধবরা আসতেন, তুমুল আড্ডা, সেই সঙ্গে খানাপিনা। অনেকেই আসতেন, সমরেশ বসুও। আমি প্রায় চুপই ছিলাম। নীরবে লক্ষ করছিলাম তাঁকে, তাঁর কথা শুনছিলাম। তাঁর লেখা পড়ে যেরকম মনে হয়েছিল, মিলে যাচ্ছিল যেন। অকপট, সৎ ও সটান। কথাবার্তায় গ্রামীণ সারল্য, মাঝে মাঝে ছলকে উঠছে বৈদগ্ধ্যের আভাও। নাগরিক জীবনের প্রতি তিনি যে ভীষণই বিরূপ, সেটা তাঁর কথায় উঠে এল স্পষ্টতই। বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয়, প্রথম আলাপেই টের পাওয়া গেল উষ্ণ আন্তরিকতার ছোঁয়া। আমার চন্দননগরে বাড়ি জেনে আসতে বললেন মাঝে মাঝে। মহাভারত নিয়ে তাঁর লেখা প্রস্তুতই ছিল। ‘স্বগত নির্বাণে যুধিষ্ঠির’। ফেরার সময় তাঁর লেখাটি নিয়ে এবং আমাদের পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যার একটি কপি দিয়ে এলাম তাঁকে।
পরের দিনই মিহির সেনগুপ্তের ফোন, –আরে আপনার লেখার হাত তো অতি চমৎকার! এমন বিষয়ে এইভাবে লেখার কথা তো ভাবতেই পারি না। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসুন একদিন।
আমাদের পত্রিকার সেই সংখ্যার ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল ‘বন্যপ্রাণ’। সেখানে আমি ‘জনন যে রকম’ নামে বিভিন্ন প্রাণীর মিলন-বৈচিত্র্যের কথা লিখেছিলাম সরস ভঙ্গিতে। সেটা পড়েই তাঁর এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ। আমি তো লজ্জায় তা-না-না তা-না-না করছি, কোনোরকমে বললাম, –আমি কাল বিকেলেই যাচ্ছি মিহিরদা।
–চলে এসো চলে এসো – দুম করে মিহিরদা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে ফোন রাখলেন।
সেই শুরু। তারপরে সপ্তাহে একদিন তো বটেই, কোনো কোনো সপ্তাহে দুদিনও গিয়েছি। মহাভারত নিয়ে বিস্তৃত পড়াশোনা তাঁর। বিদুর, গান্ধারী, ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে অনর্গল বিচার-বিশ্লেষণ করে যেতেন। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনে যেতাম। বিভিন্ন ভাষা, বিশেষত আঞ্চলিক উপভাষা নিয়ে আগ্রহ এবং স্বাভাবিক বুৎপত্তি ছিল তাঁর। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরাজি – তিনটিতেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ইংরাজি তাঁর অধীত বিষয় হলেও তার চর্চা বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সংস্কৃত বোধ হয় তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ছিল। সংস্কৃত কাব্য থেকে অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন। প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা চলত আমাদের আড্ডা। বৌদি অন্তত বার দুয়েক চা দিয়ে যেতেন। কাজের ফাঁকে বসতেনও সামান্য সময়। তাঁর লেখার হাতও মন্দ নয়। নিজের জীবনকে আধারিত করে লেখা একখানি চমৎকার উপন্যাস আছে তাঁর। ‘লিরিক্যাল’ থেকে প্রকাশিত সেই উপন্যাসও পড়ে ফেললাম আমি। তাঁর এবং তাঁদের যৌথজীবন অনেকটাই উন্মোচিত হল আমার কাছে।
দ্বিতীয় দিন থেকেই আমি মিহিরদার ‘গোসাঁই’ হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন অভিজিৎ সেন ফোন করে বললেন, –আরে আপনি তো আমার গোসাঁই ছিলেন। এখন তো দেখি মিহিরের ‘নতুন গোসাঁই’ হয়ে গেছেন।
এইভাবে আমি ধীরে ধীরে পড়ে ফেললাম মিহির সেনগুপ্তের প্রায় সব লেখাই। তাঁরই সৌজন্যে। কিছু ধার নিয়ে, কিছু তাঁর কাছ থেকে উপহার পেয়ে। আনন্দ পাবলিশার্স-এর ‘ভাটিপুত্রের গদ্যসংগ্রহ’ একদিন কিনে নিয়ে এলাম কলেজ স্ট্রিট থেকে। তাঁর সৃষ্টির দিগন্ত, তাঁর মননের রসায়ন, তাঁর ছিন্নমূল বেদনার উৎস, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষমূল উন্মোচিত হলো আমার সামনে।
মিহিরদার শৈশব-কৈশোরের গ্রামজীবনের জন্য কাতরতা, তাঁর প্রকৃতিপরায়ণতা উপলব্ধি করে একদিন তাঁকে বললাম, –চলুন আমার দেশে দু-চার দিন ঘুরিয়ে নিয়ে আসি আপনাকে।
মিহিরদা যেমন দেশ হারিয়ে বরিশালের তাঁর কেওরা গ্রামটিকে ‘দেশ’ বলে আজীবন মেনে এসেছেন, আমিও অনেকটা তাই। চন্দননগরে স্থিত হলেও পশ্চিম মেদিনীপুর-বাঁকুড়ার সীমান্তে অবস্থিত আগরবাঁধ গ্রামটিই আমার বোধে ‘দেশ’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই গ্রামেরই কাছাকাছি মালিবাঁদি বলে একটা জায়গায় আমার এক আবাল্য বন্ধুর একটি চমৎকার বাগান ও বাড়ি আছে। লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলের গায়ে সেই বাড়ি ও বাগান। ২০১৯ সালের নভেম্বরে মিহিরদা, বৌদি এবং তাঁর এক ভ্রাতৃবধু আমার সঙ্গে গিয়ে পৌঁছলেন সেখানে। সেখানে তিন দিন থেকে এক নতুন মিহির সেনগুপ্তকে আবিষ্কার করলাম। ভোরবেলায় উঠে পড়ছেন, বাড়ির সামনেই চমৎকার ফুলের বাগান, তারপরেই ফল-ফলাদি, বসে আড্ডা দেওয়ার জন্যে বাঁশের মাচান, সেখানে পায়চারি করতে করতে উদাত্ত গলায় একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছেন। বাগান ও জঙ্গলের মাঝে একটা ২০-২৫ ফুট উঁচু টাওয়ার। টাওয়ারের মাথায় ছাউনির নীচে তক্তা বিছানো মেঝে। মিহিরদার কোমর ও হাঁটুতে সমস্যা ছিল। বৌদির বারণ করছেন। কিন্তু তাঁকে রোখে কে? মহা উৎসাহে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লেন টাওয়ারের মাথায়। সবুজ অরণ্যে ঘেরা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে গাইতে থাকলেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ।
ওখানেই মিহিরদার গলায় গীতগোবিন্দ আবৃত্তি শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম মোবাইলে রেকর্ড করে রাখব। গড়িমসিতে করা হয়ে ওঠেনি। কী হারিয়েছি আজ উপলব্ধি করতে পারছি।
ওখান থেকে ফিরে আমাকে বারবার বলতেন, –আবার কবে নিয়ে যাবে নতুন গোসাঁই?
আরও একবার গিয়েছিলেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের পরেও। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এবার তাঁর বৃহত্তর পরিবারের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে। বৌদি ছাড়াও ছোটো ভাই, ভ্রাতৃবধু, বোন, ভগ্নিপতি সমভিব্যাহারে। তখন মিহিরদা অনেকটাই অসুস্থ। হাঁটাচলা বিশেষ করতে পারেন না। বেশ কয়েকবার পড়েও গিয়েছিলেন। একবার তো তাঁর ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে আমার চোখের সামনেই। আমাকে একটা বই দেবেন বলে দোতলা থেকে বইটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। শেষ ধাপে এসে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তুললাম। শরীরে তেমন আঘাত লাগেনি, লেগেছিল অন্য কোথাও। চিরকাল ঋজু হয়ে চলেছেন। শরীরের ক্রমবর্ধমান অক্ষমতা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেটা উচ্চারণ ব্যতিরেকেই বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমার।
তো দ্বিতীয়বার মালিবাঁদি গিয়ে তিনি জেদ করে সকলের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের গভীরে ঢুকলেন। প্রথমবার সেই বাড়ির মালিক, আমার বন্ধু অশোক সেখানে উপস্থিত ছিল না। এবার সে উপস্থিত। আমাদের মানদণ্ডে সে আর্থিকভাবে যথেষ্ট সফল। আবার রুচি এবং হৃদয় – দুটি ক্ষেত্রেই সে অসামান্য। মিহিরদা তাকে চোখে দেখার আগেই দূরালাপে প্রীতির বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। স্বয়ং গৃহস্বামীর তদারকিতে তাই এবার আতিথেয়তার এলাহি ব্যবস্থা। জঙ্গলের গভীরে একটা ফাঁকা বৃত্তাকার নিচু জায়গা। সেখানে সাধারণত জ্যোৎস্না রাতে আমাদের আড্ডা হয়। নাম দেওয়া হয়েছে ‘সদর দপ্তর’। সেখানে মাদুর পেতে সবাই মিলে বসা হলো। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। ওখানে তখনও মোলায়েম ঠাণ্ডা। সকালের রোদে পিঠ পেতে বসে টুকটাক খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে গান-কবিতা-গল্পের আড্ডা চলল ঘণ্টা দুয়েক। মিহিরদাকে তাঁর স্বরূপে দেখলাম আরও একবার।
তারপর থেকে আমিও যেন তাঁর বৃহত্তর পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। মিহিরদারা অনেক ভাইবোন। অভিজিৎ, মিহির বাদেও প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর গুণী মানুষ। সবচেয়ে মজার কথা, তাঁদের অনেকেই আমার অকিঞ্চিৎকর লেখালেখির অন্ধ অনুরাগী হয়ে উঠলেন।
আমাদের এই সাড়ে তিন বছরের মেলামেশার মাঝে বহুবার প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর সময়যাপনের বিবরণ আমাকে শুনিয়েছিলেন মিহিরদা। তাঁদের মধ্যে সমরেশ বসুর সঙ্গযাপনই ছিল তাঁর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। সমরেশ বসুর সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কয়েকজন সাহিত্যিকের অসূয়া, দ্বিচারিতার গল্পও শুনিয়েছিলেন। সেসব গল্প শেষ করার পর আমাকে বলতেন, –খবরদার গোসাঁই, আমি কিন্তু এসব কথা লিখিনি কোথাও। তুমিও যেন লিখতে যেও না কখনো।
গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই মিহিরদার অসুস্থতা বেড়ে চলল। বহু ধরনের চিকিৎসা চলছিল, মূলত পারকিনসন্সের। তাঁর কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ভুলে যাচ্ছিলেন অনেক কিছু। কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গের খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। আমাদের আড্ডাও তেমন জমছিল না। একটা নতুন লেখা শুরু করেছিলেন। প্রথম লকডাউনের পর পরই। বারবার আক্ষেপ করতেন, –সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে গোসাঁই, লিখতে পারছি না। এই লেখাটা বোধ হয় শেষ করতে পারব না।
না লিখতে পারার যন্ত্রণাটাও কম ছিল না শারীরিক যন্ত্রণার থেকে। তারপর তো তাঁর মেয়েরা আর তাঁকে ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে রাখতে ভরসা পেল না। বরিশালের গ্রাম কেওরার বিকল্পে ভদ্রেশ্বরের বাড়িটিকে তাঁর বৃহত্তর পরিবারের বা তাঁর বাবার পরিবারের ভদ্রাসন করতে চেয়েছিলেন, যাতে সেই পরিবারের যে-কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারে তার বাড়ি ভদ্রেশ্বরে। সময়ের গতিতে তা সম্ভব হয়নি। তাই নিয়ে বুকের মধ্যে একটা কষ্ট পুষে রেখেছিলেন। নিজের এই দ্বিতীয় ভদ্রাসন ছেড়ে কলকাতায় চলে যাওয়াটাও ছিল তাঁর কাছে নিরুপায় কষ্টের।
কলকাতায় চলে যাওয়ার পরেও বিভিন্ন প্রয়োজনে মাসে একবার করে দু-তিন দিনের জন্যে আসছিলেন। আসার আগে আমাকে ফোন করতেন, –কাল যাচ্ছি গোসাঁই, চলে এসো।
আমি স্কুটি নিয়ে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু আড্ডাটা যেন জমছিল না কিছুতেই। শেষ এসেছিলেন গত পয়লা নভেম্বর। তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ সাক্ষাৎ। ডিসেম্বরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যখন নার্সিং হোমে, তখন বৌদি একদিন সেখান থেকে আমাকে ফোনে ধরে দিলেন মিহিরদাকে। বহুদিন পরে সেই একই রকম তেজি গলা শুনতে পেলাম,–হ্যাঁ গোসাঁই বলো।
আমি তাঁকে বলতে চেয়েছিলাম, তাঁর নতুন বই ‘এপার বড়ো মাঘ মাস ওপার বড়ো কুয়া’ বইটির কাজ চলছে, আমি শ্রেয়ানকে যথাসম্ভব সাহায্য করছি। কিন্তু কথা বলতে বলতেই মিহিরদা একেবারে চুপ করে গেলেন। বৌদি বললেন, –এরকমই হচ্ছে।
তখনও তাঁর রোগ নির্ণীত হয়নি। বোন ম্যারো টেস্ট হয়েছে, তার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। সেই রিপোর্ট যেদিন জানতে পারলাম, সেদিন থেকেই একটা হাড়-হিম ভয় আমার মজ্জার মধ্যে ঢুকে গেল। আর কি শুনব না কোনোদিন ওই প্রিয় কণ্ঠস্বর, – দেহি পদপল্লব মুদারম?
মিহিরদার খবর নিতে সেদিনের পর বৌদিকে আর একবারও ফোন করিনি। জেনে গেছিলাম, একটি সম্পর্কের উষ্ণতা আমাকে এক প্রবল শৈত্যের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। মিহিরকণাহীন বাকি জীবনটুকু কাটাতে হবে অনেকের মধ্যে একা হয়ে।